আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

ভালোবাসার রসায়ন



সহস্র বছরের ইতিহাসকে এক সেকেন্ডে ভাবার চেষ্টা করুন। দুটো শব্দ উঁকি দেবে। মানুষ ও মানবিকতা। এবার মানবিকতাকে একটি বৃত্ত হিসেবে কল্পনা করুন। বৃত্তের ঠিক মাঝ বরাবর ম্যাগনিফাইং গ্লাস রেখে চোখ রাখুন।

কেন্দ্রে একটিমাত্র শব্দের অস্তিত্ব। তা হলো, ভালোবাসা। প্রাণী মাত্রই ভালবাসবে। আর তার সমার্থক হিসেবে কারো মনে যদি ‘প্রেম’ শব্দটা হানা দেয়, তবে তিনি মানুষ না হয়ে পারেন না। কেননা মানুষ ছাড়া অন্য কোনো প্রাণীর নিউরাল নেটওয়ার্ক অতোটা বিস্তৃত নয় যে একটি মাত্র শব্দের সঙ্গে সুতো জড়িয়ে তা থেকে সে রোমাঞ্চকর, জটিল, উদ্দীপক ও অসংজ্ঞায়িত আরেকটি ধোঁয়াটে বিষয়কে টেনে আনতে সম।

আর ভালোবাসার সংজ্ঞা? না, একে নিছক অনুভূতি বলতে প্রায় সকলেই কুণ্ঠাবোধ করবেন। আজ থেকে প্রায় ৪ হাজার বছর আগে ভারতীয় চারবাক দার্শনিকরা প্রাণকে ব্যাখ্যা করেছিলেন মদশক্তিগুণসম্পন্ন বিশেষ এক যৌগের সঙ্গে। অনুভূতি হলো যে যৌগের মাদকতা। উত্তর আধুনিক যুগের বিজ্ঞানীরাও প্রাণের সঙ্গে সেই মদশক্তির যোগসূত্র খুঁজে পেয়েছেন (তবে বোতলটা ঢের পাল্টে গেছে)। অধুনাদের জন্য প্রাণের আরেক অর্থ হলো দেহকোষের ডিএনএর ভেতর চলতে থাকা জটিল এক রাসায়নিক খেলা।

ভালোবাসাও যার উর্ধ্বে নয়। সোজাসাপ্টাভাবে বলতে গেলে, ভালোবাসা বিশেষ অনুভূতি ঠিকই, তবে বায়বীয় নয়। কাচের জারে রাখা রাসায়নিক যৌগের মতোই তরল (কিছুটা ঝাঁঝাঁলোও বটে)। আর এই তত্ত্বের ভিত্তিতে বেশ কবছর ধরে প্রকাশিত হয়ে আসছে ভালোবাসার সহজ সরল রাসায়নিক উপাখ্যান। একে একে আবিষ্কৃত হয়েছে হরমোনরূপী বেশকটি ভালোবাসার কারিগর, প্রেমের কন্ট্রোল ইউনিট এবং আবেগের জেট ইঞ্জিন।

অন্ধপ্রেমের মুখবন্ধ: বিশেষ কোনো কারণ ছাড়াই মানব-মানবীযুগল একে অপরের প্রতি আকর্ষণবোধ করতে পারে। নিঃসন্দেহে বলা যায়, আকর্ষণবোধের কয়েক সেকেন্ড আগে তাদের উভয়ের যকৃতের পাশে থাকা এড্রিনালিন গ্রন্থিতে ছোটখাট বিস্ফোরণ ঘটেছিল। সাময়িকভাবে চোখে সর্ষে ফুল দেখার শুরুটাও হয় তখন থেকে। এড্রিনালিন থেকে নির্গত হওয়া ফিনাইলইথাইলএমিন হরমোনটি øায়ুকোষে তথ্য আদান-প্রদানের গতি বাড়িয়ে দেয় কয়েকগুন। এড্রিনালিন হরমোনের কারণে হৃদয়ের ভেতর শুরু হয় আবেগের ইঁদুর দৌড়।

আর ভাললাগার অনুভূতির জন্য ডোপামিন তো রয়েছেই। পুরো প্রক্রিয়াটির জ্বালানি হিসেবে কাজ করবে নরএপিনএফ্রিন হরমোন। এড্রিনালিন গ্রন্থিতে ক্রমাগত হরমোনের নিঃসরণ ঘটানোই যার কাজ। হরমোনগুলোর মিলিত রাসায়নিক প্রভাবে তৈরি হয় বাড়তি উদ্দীপনা। গোলাপি ডানায় ভর করে ভেসে বেড়ানো আর রাত জেগে ফোনালাপের ক্যালরির যোগান দেয়ার দায়িত্বটাও তাদের ঘাড়ে বর্তায়।

প্রথম দর্শনে প্রেম তথা অন্ধপ্রেমের সূচনা ঘটে এভাবেই। তবে বিপরীত লিঙ্গের বিশেষ কাউকে ভাললাগার পেছনেও রয়েছে জটিল আরেক রসায়ন। শৈশবের স্মৃতি, মা-বাবার আচরণ এবং জিনের ভেতর লুকিয়ে থাকা ভালোবাসার মানচিত্রই (লাভ ম্যাপ) বলে দেবে কাকে দেখার পর আপনি চোখ বুজে ঝাঁপ দিতে পারেন। যে কারণে একজনই সেরা: স্তন্যপায়ী প্রাণীকুলে মাত্র ৩ শতাংশ একগামী। অর্থাৎ একজনেই তুষ্ট।

দুর্ভাগ্য অথবা সৌভাগ্য যাই বলুন না কেন, প্রাকৃতিকভাবে মানুষ এর মধ্যে নেই। অর্থাৎ ভালোবাসার বিশ্বায়ন ঘটাতে মনুষ্যহৃদয় সদা প্রস্তুত। কিন্তু সামান্য পরিমাণ ভেসোপ্রেসিন আপনার হৃদয়ের কাঠামোয় এনে দিতে পারে আমূল পরিবর্তন। কেবল একজনকে ভেতরে রেখে আবেগের খোলা জানালাগুলো সটাসট বন্ধ করে দিতে ভেসোপ্রেসিনের জুড়ি নেই। এ জন্যই রাসায়নিক এ বস্তুটির আরেক নাম মনোগামাস (একগামী) কেমিক্যাল।

যার শরীরে প্রাকৃতিকভাবে রাসায়নিক বস্তুটি অঢেল থাকে তাকে নানা জনের কাছে আবেগের ধরনা দিয়ে ঘুরতে হয় না। একবার যাকে ভাল লাগে তাকে নিয়েই তিনি পার্থিব, অপার্থিব সকল জগতের স্বপ্ন সাজাতে থাকেন। স্পর্শের সমীকরণ: প্রণয়জুটির স্পর্শ আর সাধারণ স্পর্শের মাঝে রয়েছে আকাশ-পাতাল ফারাক। বিশেষ স্পর্শে আপনার নিউরো ট্রান্সমিটারের মাথা খারাপ হয়ে যাওয়াটা মোটেও অস্বাভাবিক নয়। অথবা প্রিয়জনের বিশেষ চাহনী বা কণ্ঠও আপনার কাছে মাঝে মাঝে স্বর্গীয় বলে মনে হতে পারে।

কারণ একটাই, তা হলো অক্সিটসিন হরমোনের আধিক্য। আবেগঘন সময় কাটাতে এ অক্সিটসিনই একমাত্র সহায়। তা না হলে যতোই বাঁকা চোখ আর হাত ধরাধরি করে বসে থাকুন না কেন, চোখ কুঁচকে আপনি ভাবতে থাকবেন, ইজ দিস লাভ? বিরহ ঠেকাবে এন্ড্রোফিন: ধরা যাক, উš§ত্ত দিনগুলো আপনি বেশ দৃঢ়চিত্তে পেরিয়ে এসেছেন। মহাড়ম্বরে বিয়েও করেছেন। কিন্তু কাছাকাছি না থাকার বিরহ যন্ত্রণাটুকু কিছুতেই তাড়াতে পারছেন না।

আবার অনেককে দেখছেন সঙ্গী/সঙ্গিনী থেকে শতমাইল দূরে থাকা সত্ত্বেও হাসিমুখে দিনের পর দিন কাটাচ্ছে। ব্যাপারটা মোটেই গোলমেলে নয়। এন্ড্রোফিন হরমোনের স্বল্পতাই আপনাকে ক্রমশ কাতর করে দিচ্ছে। বিপরীতক্রমে যে হরমোনটির সরব উপস্থিতিতে প্রিয়জনের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়েও অনেকে নিরবচ্ছিন্নভাবে ঘনিষ্ঠতা, নির্ভরশীলতা ও উষ্ণতার অনুভূতি পাচ্ছে। ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের মার্ক গাউলস্টোনের ভাষায়, ‘আমরা ভালোবাসা ভালবাসি, তাই এন্ড্রোফিনকে নিয়ে আমরা ভালবাসতে চাই।

’ অতঃপর চকোলেট!: ভালোবাসার রসায়নে চকোলেটের ভূমিকা নেহাৎ কম নয়। কেননা একেকটি চকোলেট ফিনাইলইথাইলএমিনের বিশাল ভাণ্ডার। যা কি-না এম্ফিটামিন হরমোনের সহোদর। যারা চকোলেট ভালবাসেন তাদের দেহে সেই ডোপামিন আর নরএপিনএফ্রিন তৈরি হয় যথেষ্ট পরিমাণে। øায়ুকোষ ও নিউরো ট্রান্সমিটারে তথ্য সরবরাহের গতিও বাড়ে জ্যামিতিক হারে।

সুতরাং ভেবে দেখুন ভ্যালেন্টাইন ডে’র উপহার হিসেবে এক বাক্সো চকোলেট কতোটুকু উপকারী হতে পারে!

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.