আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

নবাবের মৃত্যুও ঋণের বোঝা কমাতে পারেনি পরিবারের

'... আমাদের আশার কোনো পরকাল নাই'

রাজশাহীর বিড়ালদহ মাজার থেকে পুঠিয়া যাবার পথে মূল রাস-ার উত্তরে নেমে গেলে সারি সারি মাটির বাড়ি। সেখানেই এক বছরের শিশুসন-ান নাদিমকে নিয়ে দাদীর ঘরে আশ্রয় নিয়েছেন নাদিরা। সোমবার দুপুরে অনেক খুঁজে পেতে নাদিরার দাদীর ঘরের আঙিনায় গিয়ে তার খোঁজ করতেই বারান্দায় বসে থাকা নাদিরা হঠাৎ করে দৌড়ে পালিয়ে যেতে চাইলেন। অবশেষে কোনো এনজিওর লোক নই, সাংবাদিক- এই পরিচয় পেয়ে কিছুটা আশ্বস- হলেও প্রায় আধাঘন্টা কথোপকথনের সময় এক মুহূর্তের জন্যও আতঙ্ক তার পিছু ছাড়েনি। গত বছরের ১৭ আগস্ট নাদিরার স্বামী নবাব মারা যান।

এরপর শ্বশুরবাড়িতে তার আর জায়গা হয়নি। তখন থেকেই তিনি থাকেন এখানে। স্বামী নাদিরার নামে গ্রামীণ ব্যাংক ও ব্র্যাক থেকে ঋণ তুলেছিলেন। সেই ঋণের টাকার তাগাদা শেষ পর্যন- মৃত্যু ডেকে এনেছিলো নবাবের। প্রতিবেশীরা বলেন, নবাব আত্মহত্যা করেছিলেন।

কিন' নবাবের পরিবারের লোকজন এ ব্যাপারে মুখ খোলেন না। নবাব মারা যাবার পর নাদিরার নিজের ও তার শিশুপুত্রের দু'বেলা দু'মুঠো অন্ন জোটা দায়। কিন' তারপরেও তার নামে তার স্বামীর তোলা ঋণের বোঝা পিছু ছাড়েনি তাদের। সে কারণে কেউ খোঁজ করতে গেলেই নাদিরা মনে করেন, এই বুঝি ঋণের তাগাদা দিতে লোক এসেছে! নবাব শুধু নিজের স্ত্রীর নামেই নয়, ব্র্যাক থেকে প্রায় ১৫ হাজার টাকা ঋণ তুলেছিলেন তার বোন ফিরোজার নামে। নবাবের মৃত্যুর পর তার রেখে যাওয়া সেই ঋণের কিসি- এখন ফিরোজার গলায় ফাঁস হয়ে আটকে আছে।

বাধ্য হয়ে সেই কিসি- শুধছেন নবাবের বাবা সাজাহান। তিনি পুঠিয়ার গণ্ডগোহালি গ্রামের নিমতলা বাজারে সাইকেল মিস্ত্রীর কাজ করেন। সাজাহান জানান, তিনি তার ছেলের ঋণ শোধ দিতে বাধ্য হয়ে এখন নিজেই বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান থেকে ঋণ নিয়েছেন। সমপ্রতি তিনি গ্রামীণ ব্যাংক থেকে ৭ হাজার ও দু’মাস আগে ব্র্যাক থেকে ১০ হাজার টাকা ঋণ নিয়েছেন। নবাবের রেখে যাওয়া ঋণ এবং পরবর্তীতে সেগুলো শুধতে সাজাহানের নেয়া ঋণ মিলিয়ে এখন তার মোট ঋণের পরিমাণ ৫২ হাজার টাকা।

প্রতি সপ্তাহে সাইকেল মেকার সাজাহানকে ঋণগুলোর সাপ্তাহিক কিসি- দিতে হয় মোট ১২শ টাকা করে। সাজাহানের দিনে গড়ে ১শ টাকা করে সর্বোচ্চ আয় হয় তার দোকান থেকে। সেই হিসেবে সপ্তাহে তার সর্বোচ্চ আয় ৭শ টাকা। মাসে দোকান ভাড়া দিতে হয় ৩শ টাকা আর পরিবার চালাতে খরচ করেন প্রতি মাসে ২ হাজার টাকা। এই হিসেবে প্রতি সপ্তাহে তার দোকান ভাড়া আর পরিবার চালাতেই ৫শ টাকার ওপরে ব্যয় হয়।

তাহলে সাপ্তাহিক ঋণের কিসি- শোধ করেন কীভাবে? কিছুক্ষণ নিরুত্তর থাকার পর সাজাহান জানালেন, বিভিন্ন জায়গা থেকে খুচরা ঋণ করেন। এক প্রতিষ্ঠানের কিসি- শুধতে অন্য প্রতিষ্ঠান থেকে ঋণ নেন। এভাবে কতোদিন চলবে? সাজাহান বললেন, ‘যে জালে ফাঁসছি, এছাড়া আর উপায় কী?’ নবাব পুঠিয়ার জিউপাড়া গ্রামীণ ব্যাংকের ৩১ নম্বর কেন্দ্র থেকে তার স্ত্রী নাদিরার নামে ৫ হাজার টাকা ঋণ নিয়েছিলেন। ব্র্যাক, পুঠিয়া শাখা থেকে নিয়েছিলেন নাদিরার নামেই আরো ১০ হাজার টাকা। নাদিরা জানান, ঋণ তার নামে তোলা হলেও একটি টাকাও তিনি তোলার পর এমনকি হাত দিয়ে ছুঁয়েও দেখেননি।

তার স্বামী সেই টাকা দিয়ে কী করেছেন, তাও তিনি জানতেন না। স্বামীর মৃত্যুর পর নাদিরা তার দাদী বেগমের কাছে আশ্রয় নিয়েছেন। বেগম জানান, ১৭ আগস্ট নবাবের মৃত্যুর প্রায় ৪ মাস আগে ঋণের কিসি- পরিশোধের তাগাদা চরমে উঠলে নবাব লাপাত্তা হয়ে যায়। কিছুদিন পর ফিরে এলেও কিসি-র উপর্যুপুরি তাগাদায় তিনি অসুস' হয়ে পড়েন। মারা যাবার আগের দুইদিন গ্রামীণ ব্যাংক ও ব্র্যাক থেকে মাঠ কর্মীরা এসে নবাবকে ঋণ ফেরত দেয়ার জন্য চাপ দেন।

তিনি অভিযোগ করেন, এ সময় মাঠকর্মীরা নবাবের শার্টের কলার ধরে তাকে পুঠিয়া নিয়ে যেতে চান। এ ঘটনার পরেই তিনি মারা যান। স্ত্রী নাদিরা জানান, মৃত্যুর সময় তার মুখ দিয়ে সাদা ফেনা বের হচ্ছিলো। তাদের ধারণা, বিষ খেয়ে নবাব আত্মহত্যা করেন। কিন' নবাবের পরিবারের সদস্যরা পুলিশী ঝামেলা আর সামাজিক পরিসি'তির কথা চিন-া করে অসুস'তার কারণে তার মৃত্যু হয়েছে বলে প্রচার করেন।

সোমবার নবাবের বাবা গ্রামীণ ব্যাংক ও ব্র্যাকের মাঠকর্মীর তাগাদা ও কলার ধরে নবাবকে তুলে নিয়ে যেতে চাওয়ার ঘটনা স্বীকার করলেও নবাব আত্মহত্যা করেছে কি না এ প্রশ্নের কোনো জবাব দেননি। নাদিরা ও তার এক বছরের শিশুপুত্র নাদিম এখন অসহায় অবস'ায়। নাদিরা জানান, তার নামে ঋণ দিলেও সেই ঋণে তিনি কিছুই করতে পারেননি। অথচ ঋণের কারণেই এখন তার জীবন দুর্বিষহ। তিনি দাদীর কাছে আছেন ঠিকই কিন' তিনি তাকে কতোদিন রাখতে পারবেন তিনি জানেন না।

নবাবের বাবা সাজাহান জানান, তিনি নাতিকে কাছে এনে রাখবেন। কিন' নবাবের স্ত্রীর ভরনপোষণের দায়িত্ব নিতে তিনি রাজী নন। এদিকে মৃত্যুর পর ঋণের মোট টাকা থেকে কেটে রাখা ৫শ টাকা বীমার কারণে নাদিরার নামে তোলা গ্রামীণ ব্যাংকের ৫ হাজার টাকা ঋণ তার স্বামী নবাবের মৃত্যুর পর মওকুফ হয়ে যাবার কথা। প্রতি সপ্তাহে ২০ টাকা করে সঞ্চয় করার কারণে প্রায় ২ হাজার টাকা গ্রামীণ ব্যাংক থেকে পাবার কথা তার। কিন' ঋণ মওকুফের কথা মৌখিকভাবে কর্মকর্তারা জানালেও এ ব্যাপারে এখনো লিখিত কোনো কিছু তাদের দেয়া হয়নি।

এমনকি সঞ্চয়ের টাকাও ফেরত পাননি নাদিরা। এ ব্যাপারে গ্রামীণ ব্যাংক জিউপাড়া পুঠিয়া শাখার ব্যবস'াপক মাহাবুবুর রশীদ বলেন, তাদের অফিসিয়াল প্রক্রিয়া সম্পন্ন হবার পর সমপ্রতি ঋণের টাকা মওকুফ করা হয়েছে। সঞ্চয়ের টাকা নাদিরাকে ফেরত দেয়ার বিষয়ে তিনি বলেন, তারা একটি পল্লী ফোন তুলেছিলেন। সেই ফোনের প্রায় সাড়ে ৭শ টাকার বিল বকেয়া থাকায় সঞ্চয়ের টাকা এখনো ফেরত দেয়া হয়নি। অবশ্য মৃত্যুর আগে টাকা তুলতে নবাবকে চাপ দেয়ার কথা অস্বীকার করে ব্যবস'াপক বলেন, তিনি শুনেছেন ব্র্যাকের মাঠকর্মী তাগাদা দিয়েছিলেন।

অন্যদিকে নবাবের মৃত্যুর পরেও ব্র্যাক থেকে নেয়া ঋণের কিসি- শুধতে হচ্ছে নিয়মিত। পুঠিয়া ব্র্যাকের ব্যবস'াপক নাসির উদ্দিন এ ব্যাপারে কোনো মন-ব্য না করে বলেন, নথিপত্র না ঘেঁটে তিনি কিছু বলতে পারবেন না। তাদের মাঠকর্মী নবাবকে ঋণের তাগাদা দিতে গিয়েছিলো কি না সে ব্যাপারে তিনি সরাসরি কোনো মন-ব্য না করে বলেন, ঋণ তুলতে হলে তো একটু আধটু তাগাদা দিতেই হয়। # ১৯ ফেব্রুয়ারি ২০০৭

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।