আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

বাংলার বাঘ পর্ব-1



বাংলার বাঘ পর্ব-1 রয়াল বেঙ্গল টাইগার -হাসনাত হাওড়ী ্ব সুন্দরবনের রয়াল বেঙ্গল টাইগার বাংলাদেশের জাতীয় পশু, গর্বও বটে। এমন অনিন্দ্যসুন্দর প্রাণীটি আজ অযত্ন-অবহেলায় বিলুপ্তির পথে। একে রৰায় আমাদের দায়িত্ব অনেক। প্রয়োজন সচেতনতা। সবার প্রিয় এ পশুটি সম্পর্কে এখনো আমাদের জানাশোনা সীমিত।

কিন্তু বাঘকে বাচাতে এ সম্পর্কিত জ্ঞানই সবচেয়ে জরম্নরি। এজন্যই আজকের বিষয় রয়াল বেঙ্গল টাইগার। বাংলার বাঘ সুন্দরতম সত্দন্যপায়ী প্রাণীদের অন্যতম। রয়াল বেঙ্গল টাইগার বা বাংলার বাঘ আমাদের জাতীয় পশু। বাঙালি জাতির সঙ্গে বাঘের রয়েছে অবিচ্ছেদ্য ঐতিহাসিক, সাংস্কৃতিক, সামাজিক ও প্রাকৃতিক সম্পর্ক।

বাংলাদেশে খুব কম মানুষই আছেন যারা শৈশবে গুরম্নজনের কাছে বাঘ মামার গল্প শোনেননি। আর বাঘ বাঙালি জাতির একটি অন্যতম গর্বের বিষয়। কিন্তু দুঃখের বিষয় হলেও সত্য, বাঘ প্রজাতি যেভাবে নিঃশেষ হচ্ছে তাতে হয়তো অদূর ভবিষ্যতে রয়াল বেঙ্গল টাইগার শুধু গল্পেই থাকবে, বাসত্দবে নয়। ডোরাকাটা বাঘ বাঘের কথা মনে হলেই আমাদের চোখের সামনে ডোরাকাটা দাগ ভেসে ওঠে। জীববিজ্ঞানের ভাষায় বিড়াল গোত্রের মধ্যে বাঘ সবচেয়ে সুন্দর প্রজাতি।

শরীরে লালচে কমলা লোমসজ্জা, তাতে মোটা কালো ডোরা, মুখম-লে একই লোমসজ্জার মাঝে সাদা-কালো ছোপ; গলদেশ সাদাটে। ঘাড় থেকে শুরম্ন হয়ে লেজের গোড়া পর্যনত্দ গাঢ় কালো ডোরা, লেজ ঘিরে ডোরা বলয়ের আকারে বিন্যসত্দ। লেজের ডগা সাদা। নিতম্বকেশ, ঊরম্ন ও জানুতে সর্বাধিক সংখ্যক ডোরা রয়েছে। পেছনের পায়ের ভেতর দিকে কেবল দু'একটি ডোরা দেখা যায়।

সাদাটে পেটে কয়েকটি মোটা ডোরা। কানের পেছনটা কালো। এর মধ্যে একটি বড় সাদা ফোটা। লোমরাজি ঘনবিন্যসত্দ, খাটো। পুরম্নষ বাঘের ঘাড়ে কেশরের মতো সামান্য দীর্ঘ লোমসজ্জা বর্তমান।

পেছন পায়ের তুলনায় সম্মুখ পা খাটো, কিন্তু সম্মুখ থাবা পেছনটির চেয়ে বড়। সম্মুখ পা ও কাধের ওপরের পেশি খুবই শক্তিশালী। ফলে স্পৃংয়ের মতো লাফিয়ে সহজেই শিকার ধরতে পারে। নখর শক্ত, বাকানো, প্রয়োজনে নখ গুটিয়ে লুকিয়ে ফেলে, আবার বের করে। সম্মুখ পায়ের নখ তুলনামূলক বেশ লম্বা।

সাধারণত শিকার ধরা এবং ছিড়ে খাওয়ার সময় লুকানো নখর থাবার বাইরে বেরিয়ে আসে। একটি বাঘের গড় দৈর্ঘ্য (নাকের ডগা থেকে লেজের মাথা) সাড়ে নয় ফুট (290 সেন্টিমিটার), সর্বোচ্চ দৈর্ঘ্য 310 সেন্টিমিটার পর্যনত্দ হতে পারে। কাধ পর্যনত্দ উচ্চতা 90 সেন্টিমিটার, ওজন 150 কেজি পর্যনত্দ হয়। বাঘিনীর সত্দনে চারটি বোটা। বাঘিনীর তুলনায় বাঘ আকারে বড়।

সাইবেরিয়ার বাঘ সবচেয়ে বড় এবং ইন্দোনেশিয়ার জাভা দ্বীপের বাঘ সবার ছোট। সাইবেরিয়ার বাঘ লম্বায় 330 সেন্টিমিটার, ওজনে 306 কেজি পর্যনত্দ হয়। বাঘিনীর দৈর্ঘ্য 275 সেন্টিমিটার, ওজন 167 কেজি। এদের গায়ের রঙ হালকা, বাংলার বাঘের মতো গাঢ়, চকচকে নয়। বাঘের বিবর্তন ও বিসত্দৃতি প্রায় 60 মিলিয়ন বছর আগে ডাইনোসরদের যুগে মাইয়াসিড - গন্ধগোকুলের মতো এক প্রাণী নামের প্রাণী থেকে বাঘ এবং অন্যান্য মাংসাশী প্রাণীর উৎপত্তি হয়েছে বলে ধারণা করা হয়।

বিবর্তনের ধারাবাহিকতায় এই ৰুদ্র প্রাণীগুলো (যাদের লম্বা দেহ ও ছোট ছোট পা রয়েছে) থেকে সহস্রাধিক প্রাণী যেমন বিড়াল, ভালুক, কুকুর ইত্যাদি গোত্রের প্রাণীর উৎপত্তি হয়েছে। বর্তমানে প্রায় 37 প্রজাতির বিড়াল গোত্রীয় প্রাণী পৃথিবীতে বিদ্যমান, যাদের মধ্যে বাঘ অন্যতম। পূর্ব এশিয়া থেকে বাঘের উৎপত্তি হয়েছে। পস্নাইওসিন যুগের শেষে অথবা পস্নাইস্টোসিন যুগের শুরম্নতে জীবাশ্ম বা ফসিল বাঘ সম্পর্কে জানা যায়। পস্নাইস্টোসিন যুগের শুরম্নর দিকে উত্তর চায়নায় একটি ছোট জাতের আদি বাঘ বসবাস করতো বলে জানা যায়।

বিবর্তনের কেন্দ্রস্থান থেকে দুই মিলিয়ন বছর আগে বাঘ দু'দিকে ছড়িয়ে পড়ে। প্রথম ধারার বাঘের সেন্ট্রাল এশিয়ার উডল্যান্ড বা বন এলাকা থেকে পশ্চিম এবং দৰিণ-পশ্চিম অংশে কাস্পিয়ান বাঘ নামে ছড়িয়ে পড়ে। দ্বিতীয় অংশ চায়না থেকে শুরম্ন করে সেন্ট্রাল এশিয়ার পর্বতমালার পূর্ব থেকে দৰিণ-পূর্ব এশিয়া এবং ইন্দোনেশিয়ার দ্বীপগুলোয় এবং পরবতর্ী সময়ে ইনডিয়ার পশ্চিমাংশে ছড়িয়ে পড়ে। বাঘ বহু বিচিত্র ভৌগোলিক জলবায়ু, আবহাওয়া ও প্রতিবেশ ব্যবস্থার সঙ্গে মানিয়ে জীবনযাপনে অভ্যসত্দ। রাশিয়ার তুষারাচ্ছন্ন তুন্দ্রা বনভূমি, মরম্নপ্রবণ এলাকার কাটাবন, শালবন, বাদাবন ও সমুদ্র উপকূলের বনভূমি সব পরিবেশেই বাঘের বিসত্দৃতি লৰ্য করা গেছে।

নেপালের তরাই থেকে শুরম্ন করে ইনডিয়ার হিমালয়ের পাদদেশ হয়ে বাংলাদেশ, ভুটান ও মিয়ানমার এবং মধ্য ও দৰিণ ইনডিয়ার সব অরণ্যে বাঘ বাস করে। অবশ্য অরণ্য, মরম্ন বা শুষ্ক এলাকা_ যেমন রাজস্থান, পাঞ্জাব, কচ্ছের রান ও সিন্ধুতে বাঘ নেই। মজার ব্যাপার হলো, ভারতবর্ষের সর্বদৰিণ বিন্দু কন্যাকুমারী পর্যনত্দ পৌছলেও বাঘ শ্রী লংকায় নেই। বিংশ শতাব্দীর শুরম্নতে এ দেশের প্রায় সব জেলার বনভূমিতেই বাঘের অসত্দিত্ব বজায় ছিল। ক্রমেই বন উজাড় হওয়ার প্রক্রিয়ায় বাঘের সংখ্যা হ্রাস পেয়ে বর্তমানে কেবল সাতৰীরা, খুলনা ও বাগেরহাট জেলার সুন্দরবনে কয়েকশ' বাঘ রয়েছে।

বাঘ : বৈজ্ঞানিক শ্রেণী বিন্যাস রাজ্য : (অ্যানিমালিয়া) পর্ব : (কর্ডাটা, মেরম্নদ-ী) শ্রেণী : (ম্যামালিয়া, সত্দন্যপায়ী) বর্গ : (কারনিভরা, মাংসাশী) পরিবার : (ফেলিডি, বিড়াল পরিবারভুক্ত) উপপরিবার : (প্যানথারিনি, বড় বিড়াল উপগোত্র) গণ : (প্যানথেরা) প্রজাতি : (প্যানথেরা টাইগৃস) এ পর্যনত্দ পৃথিবীতে বাঘের আটটি উপপ্রজাতি বিজ্ঞানীরা নিরূপণ করেছেন। গত শতাব্দীতে পরিবেশ বিরূপ কর্মকা-ের ফলে বাঘের তিনটি উপপ্রজাতি পৃথিবী থেকে চিরতরে বিলুপ্ত হয়ে গেছে। বর্তমানে জীবিত ও বিলুপ্ত বাঘ উপপ্রজাতির একটি সংৰিপ্ত তথ্য তুলে ধরা হলো। বাংলার বাঘের আদি উৎস রয়াল বেঙ্গল টাইগার নাম হলেও বাঘ কিন্তু আদি ও অকৃত্রিম বাঙালি প্রাণী নয়। এই প্রাণী মধ্য এশিয়া থেকে হিমালয় ডিঙিয়ে আসামের উত্তরাঞ্চল হয়ে প্রথমে ইনডিয়াতে প্রবেশ করে।

ইনডিয়া উপমহাদেশের সমতল ভূমিতে এসে এরা তৃণভোজী শিকার উপযোগী প্রাণী অধু্যষিত বিভিন্ন বনাঞ্চলের মতো বাংলাদেশের বিভিন্ন অংশে আসত্দানা গেড়ে নেয়। আজ থেকে প্রায় পাচ হাজার বছর আগের মহেঞ্জোদারোর ঐতিহাসিক প্রমাণপঞ্জিতে এ বাঘের উলেস্নখ দেখা যায়। আবার সিংহল বাঘের সমপূর্ণ অনুপস্থিতি থেকে এ কথাও স্পষ্ট প্রতীয়মান হয় যে, ওই দ্বীপটি ভারতীয় উপমহাদেশ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়ার পরই বাঘ ভারতবর্ষে পাড়ি জমিয়েছে। আজ থেকে 60-70 বছর আগেও ভারতীয় উপমহাদেশে বাঘের সংখ্যা ছিল প্রায় 50 হাজার। বর্তমান পরিসংখ্যান প্রমাণ করে, এ সংখ্যা আশঙ্কাজনক হারে কমে এসেছে।

বর্তমানে দুই হাজারের কাছাকাছি বাঘ রয়েছে বলে বিশেষজ্ঞদের ধারণা। বেঙ্গল টাইগারের আদর্শ ও নিরাপদ আবাসস্থল সুন্দরবনেও বাঘ আজ বিপন্ন ও বিলুপ্ত হওয়ার পথে। বাঘের জীবনযাপন ও প্রজনন বাঘ পশু হলেও এর রয়েছে নির্দিষ্ট এলাকা এবং জীবনযাপনের স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য। বাঘ একাকী জীবনযাপনে অভ্যসত্দ। প্রাকৃতিক নিয়মে কেবল প্রজনন ঋতুতে বাঘ-বাঘিনী জুটি বাধে ও মিলিত হয়।

জন্মের পর শাবক প্রায় দুই বছর পর্যনত্দ মায়ের সঙ্গে থাকে। তবে বাঘ তার বসবাস ও বিচরণের এলাকা সম্পর্কে বিশেষ সচেতন। একটি বাঘের এলাকা 10-20 বর্গ কিলোমিটার পর্যনত্দ হতে পারে। উন্নতমানের অপেৰাকৃত বৃহত্তর বনাঞ্চলে বাঘের এলাকা বা টেরিটরি বেশ বড় হতে পারে। সুন্দরবনে আনুমানিক প্রতি 10 বর্গ কিলোমিটার এলাকায় একটি বাঘ বাস করে (শুধু স্থলের ৰেত্রে)।

একটি বাঘের এলাকায় একাধিক বাঘিনী থাকতে পারে; আবার একই বাঘিনী পাশাপাশি বাসরত দুই বাঘের এলাকা জুড়েও বিচরণ করতে পারে। স্ব স্ব এলাকা প্রতিরৰণে বাঘ নানা পদ্ধতি প্রয়োগ করে থাকে। এর মধ্যে অন্যতম হলো, নিজের চৌহদ্দির মধ্যে অবস্থিত কিছু সুনির্দিষ্ট বস্তু। যেমন মরা গাছের গুড়ি, উচু ঢিবি, পাথর বা গাছের মোটাসোটা কা-, ঘন ঝোপঝাড় ইত্যাদির গায়ে নিজের 'ফেরোমেন' মাখিয়ে চিহ্নিত করে রাখে, অর্থাৎ লিঙ্গ পেছনে বাকিয়ে পিচকিরির মতো করে প্রস্রাব ওইসব মনোনীত বস্তুর গায়ে বসিয়ে দেয়। এ প্রস্রাব বের হওয়ার সময় ওই প্রস্রাবের সঙ্গে যুক্ত হয় পায়ুগ্রন্থি নিঃসৃত এক রকম রাসায়নিক পদার্থ।

বাঘের প্রস্রাব ও পায়ুগ্রন্থির ওই নিঃসরণ একই সঙ্গে প্রজাতির বিশেষ বাঘটির পরিচায়ক; কারণ এতেই রয়েছে বিশেষ 'ফেরোমেন'। এছাড়া বাঘ ও বাঘিনী নিজ নিজ অসত্দিত্ব জাহির করতে গাছের গুড়ি, বাকল বা মাটিতে নখের আচড় কেটে রাখে। আবার চলার পথে এমন সব জায়গায় পায়খানা করে রাখে, যেন সেটা সহজেই অন্য বাঘের চোখে পড়ে। কোনো বাঘ যদি প্রস্রাবের চিহ্ন দেখে বুঝতে পারে যে ওটা কোনো অনধিকারীর বর্জ্য, তাহলে সে ওই প্রস্রাবের ওপর আবার প্রস্রাব করে নিজের অধিকার প্রতিষ্ঠা করে। আর ওই প্রস্রাব যদি কোনো বাঘিনীর হয়, বাঘ সেটা দেখে তখন ওই বাঘিনীর সঙ্গমেচ্ছা কতোখানি তীব্র হয়েছে সেটা আচ করতে পারে।

প্রজনন মৌসুমে বাঘিনীও ওইসব চিহ্নের ওপর বেগে প্রস্রাব করে নিজের কামভাবের বিষয়ে জানান দেয়। বাঘ নিশাচর প্রাণী। তাই দিনে নির্জন ঝোপঝাড়ের আড়ালে বিশ্রাম করে বা ঘুমায়। কারণ বাঘের দেখা পেলেই বনের পশুপাখি সন্ত্রসত্দ হয়ে অতিস্বরে ডাকাডাকি করে, যা বাঘের জন্য অস্বসত্দিকর। বাঘ রোদ পোহাতে পছন্দ করে আবার সামান্য গরম বোধ করলেও পানিতে নেমে যায়।

বাঘের গর্জন প্রায় দুই কিলোমিটার দূর থেকে শোনা যায়। এলাকায় নিজের অসত্দিত্ব জাহির করা, প্রতিপৰকে শাসানো, সঙ্গমেচ্ছা প্রকাশ এবং শিকারে ভাগ বসানোর জন্য সঙ্গিনীকে আহ্বান করতে বাঘ গর্জন করে থাকে। ক্রোধ প্রকাশ বা ভয় দেখাতে বাঘ 'গরগর' শব্দ করতে পারে; আবার ঠোট কাপিয়ে 'ফুর-রর' বা 'ঘ-র-র-র' আওয়াজের মাধ্যমে বাঘিনী, শাবক বা বাচ্চাদের প্রতি বাঘের প্রশ্রয় বা স্নেহের বহিঃপ্রকাশ ঘটে। এছাড়া বাচ্চাদের খোজ করতে বা কাছে ডাকতে বাঘিনী প্রায় কান্নার সুরে ডাকে। এই ডাক 10-12 মিটার দূর থেকে শোনা যায়।

প্রতিটি বাঘের একটি সুনির্দিষ্ট চলাচল চৌহদ্দি থাকে। এই চলাচল বা বসবাস সীমারেখা খুবই নিখুত ও সুস্পষ্টভাবে চিহ্নিত। যখন কোনো বাঘের বার্ধক্যজনিত মৃতু্য ঘটে বা অধিকতর শক্তিধর কোনো বাঘ ওই এলাকা বলপূর্বক দখল করে নেয়, কেবল তখনই একটি বাঘের আপন সীমানা লঙ্ঘিত হয়। সাধারণভাবে বাঘিনী তার আপন চৌহদ্দির মধ্যে সুদীর্ঘ সময় কাটায়। কিন্তু বাঘের সীমানা পরিবর্তনশীল।

তাই বাঘের পদচিহ্ন ছাপ জরিপ পদ্ধতিতে সহজে বাঘ পরিবারের সদস্যভিত্তিক সংখ্যা নির্ণয় করা যায়। ফলে গণনাবিচু্যতি কম হয়। প্রজনন ঋতুতে বাঘের গর্জন শুনে ধারেকাছের কোনো বাঘিনীও বিশেষ সঙ্কেতে গর্জে ওঠে। এরপর বাঘ-বাঘিনী প্রস্রাবের নিশানা ও গন্ধ শুকে একে অন্যের কাছাকাছি হয়। এ সময় তারা দু'তিনদিন একসঙ্গে থাকে এবং 100 থেকে 150 বার মিলিত হয়।

প্রতিবারে সঙ্গম মাত্র দু'এক মিনিট স্থায়ী হয়। এরপর বাঘিনী বনের মধ্যে লুকিয়ে থাকে যেন অন্য কোনো বাঘের নজরে না পড়ে। গর্ভধারণকালে সাড়ে তিন মাস সময় নেয় তবে 103 দিনের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে। একবারে 2 থেকে 5টি (সর্বোচ্চ 6টি) বাচ্চা প্রসব করে। জন্মের সময় বাচ্চা বাঘের ওজন হয় গড়ে এক কেজির মতো অথবা মায়ের ওজনের সোয়াশ' ভাগের এক ভাগেরও কম।

জন্মের সময় বাচ্চা বাঘ অন্ধ থাকে। তবে চোখ মেলে 10-12 দিন পর এবং পুরোপুরি দেখতে পায় তারও 10 দিন পর। আশ্চর্যের বিষয় হলো, জন্ম থেকে বাচ্চাগুলো হুবহু মা-বাবার মতো দেখায়। তবে বাঘ বাচ্চাদের প্রস্রাব বা পায়খানা বাচ্চাদের মা করার সঙ্গে সঙ্গে চেটেপুটে খেয়ে নেয়। জন্মের দুই মাস পর্যনত্দ বাঘ বাচ্চারা মায়ের ওপর নির্ভরশীল থাকে।

40 দিন বয়স হলেই বাচ্চারা মাংস খেতে পারে। তবে চার মাস পর্যনত্দ সাধারণত বাঘ বাচ্চারা মাতৃদুগ্ধ পান করে। 18 থেকে 28 মাস বয়সে নিজেরা খাবার শিকার করার যোগ্যতা অর্জন করে এবং মায়ের সঙ্গ ত্যাগ করে। তিন বছর বয়সে স্ত্রী বাঘ ও চার বছরের মাথায় পুরম্নষ বাঘ বয়ঃপ্রাপ্ত হয় এবং সংসার পাতে। বন্দিদশায় বাঘের সর্বোচ্চ আয়ু 25-26 বছর।

প্রকৃতিতে বাঘ কম সময় বাচে, যা 15 বছরের কাছাকাছি। তবে বাঘিনী দীর্ঘদিন বেচে থাকে, কেননা বাঘকে অন্য বাঘের সঙ্গে লড়াই করে বেচে থাকতে হয় আর বাঘিনীদের মারামারি হয় না বললেই চলে। বাঘের খাদ্য বাঘের প্রধান খাবার হলো অন্যান্য সত্দন্যপায়ী প্রাণীর মাংস। তবে সুন্দরবনের বাঘ মাছও খেয়ে থাকে। বাঘ সাধারণত সপ্তাহে একবার শিকার করেই সন্তুষ্ট থাকে।

তবে শিকারের ওজন 30-40 কেজির কম হলে ঘন ঘন শিকার করতে হয়। বাঘ সাধারণত ময়ূর, অজগর সাপ, চিত্রাহরিণ, সাম্বার, শূকর, মায়াহরিণ, বনগরম্ন, বান্টেং গয়াল, নীলগাই, হাতি বা গ-ারের বাচ্চা, এমনকি কুমির পর্যনত্দ শিকার করে খায়। যদিও বাঘ রাতের যে কোনো সময় শিকার করতে পারে তবু বাঘ মূলত গোধূলি বা ঊষালগ্নে শিকার করে থাকে। শিকারের জন্য বাঘ ঝোপঝাড় বা ঘাসবনে ঘাপটি মেরে বসে থাকে। শিকার 15-20 মিটারের মধ্যে এলেই সে প্রচ- বেগে কয়েকটি লাফে শিকার পর্যনত্দ পৌছে প্রাণীর নিতম্ব বা গলদেশ কামড়ে ধরে অথবা থাবার আঘাতে তাকে ধরাশায়ী করে তার গলা এমনভাবে কামড়ে ধরে যে, শিকার কয়েক মিনিটের মধ্যেই শাসরম্নদ্ধ হয়ে মারা যায়।

সুন্দরবনের বাঘের প্রধান খাদ্য হলো চিত্রাহরিণ ও বন্য শূকর। তবে বানর, গুইসাপ, গিরগিটি, উদবিড়াল, সরীসৃপ জাতীয় প্রাণী, ব্যাঙ, মাছ, কাকড়া, অন্যান্য মাংসাশী প্রাণী এবং মাঝে মধ্যে মানুষও খাবার হিসেবে শিকার করে। বাঘ খাদ্যের জন্য চিত্রাহরিণ ও বন্য শূকর শিকার করে। এদের সংখ্যা সীমিত রেখে, খাদ্যচক্র এবং বনের বনায়ন পুনরাবৃত্ত করার ৰেত্রে গুরম্নত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। সুন্দরবনের শিকার প্রাণীর আনুমানিক সংখ্যা শিকার প্রাণীর নাম সংখ্যা চিত্রা হরিণ 90,537 মায়া হরিণ 29,184 বানর 40,000 শূকর 45,269 উদবিড়াল 20,000 তথ্যসূত্র : বাংলাদেশ বন বিভাগ 2000 খাবার হিসেবে বেঙ্গল টাইগারের গড়ে প্রায় 7 কেজি মাংসের প্রয়োজন।

বছরে 2555 কেজি (7 কেজি ক্ম 365 দিন) মাংসের প্রয়োজন মেটানোর জন্য একটি বাঘকে 3650 কেজি ওজনের প্রাণী হত্যা করতে হয়। এই ওজন 73টি চিত্রাহরিণ অথবা বন্য শূকরের ওজনের সমান। মানুষখেকো বাঘ কোনো কারণ ছাড়াই বাঘ মানুষকে আক্রমণ করে না। নথিপত্র অনুযায়ী 1670 সালে সুন্দরবনে বাঘ মানুষকে আক্রমণ করেছে এ রকম তথ্য মেলে। 1933 সালের ডড়ৎশরহম চষধহ ড়ভ ঃযব ঝঁহফবৎনধহং থেকে জানা যায়, 1912 থেকে 1921 সালের মধ্যে 427 জন বাঘের শিকার হয়েছিল।

1975 থেকে 1997 পর্যনত্দ বাঘ 534 জন মানুষ মেরেছে। অর্থাৎ 1912 থেকে 1997 সাল পর্যনত্দ মোট 961 জন মানুষ মেরেছে। সাধারণত যেসব কারণে বাঘ মানুষ হত্যা করে_ 1. খাবার সংগ্রহ বা গ্রহণকালে বিরক্ত করলে 2. শাবককে রৰা করার প্রয়াসে 3. শিকার করে খাদ্য যোগাড়ে অসমর্থ হলে 4. যখন অন্য প্রাণীর তুলনায় মানুষ শিকার করা সহজ হয়। বন বিভাগ বিভিন্ন সময়ে মানুষখেকো বাঘ হত্যার অনুমতি দিয়েছে এবং 1981-1992 সময়ে এ রকম চারটি বাঘ মারা হয়েছে। বন বিভাগের তথ্য মতে, 1996-2000 সাল পর্যনত্দ 24টি বাঘের মৃতু্য হয়।

এর মধ্যে 11টি মেরেছে চোরা শিকারিরা, 11টি বনের গ্রামবাসীরা, একটি বাঘের স্বাভাবিক মৃতু্য এবং শিকারি একটি বাঘ হত্যা করে। এ সময় বাঘ সুন্দরবন সংলগ্ন গ্রামে ঢুকে মোট 4টি গরম্ন, 6টি শূকর, 16টি ছাগল, 3টি কুকুর ও 2টি হাস মেরে খায় এবং 12 গ্রামবাসীকে আহত করে। বাংলার বাঘ বিলুপ্তির পথে এক সময় বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলায় বাঘের বিসত্দৃতি ছিল; বর্তমানে বাঘ দেশের প্রায় সব এলাকা থেকে বিলুপ্ত হয়ে কেবল সুন্দরবনেই থিতু হয়েছে। বাঘের নিরাপদ আবাসভূমির উচ্ছেদ, খাবারের অভাব, চামড়া ও অন্যান্য প্রত্যঙ্গের জন্য বাঘ শিকার, বিপজ্জনক বাঘ হত্যা ইত্যাদি কারণে বাঘের সাম্রাজ্য অসত্দিত্বের প্রশ্ন এসেছে। দুই দশক আগেও সুন্দরবনে বাঘ শিকার করলে বন বিভাগের পৰ থেকে শিকারিকে পুরস্কৃত করা হতো।

সিলেটে মাঘ-ফাল্গুন মাসে এক সময় দু'একটি বাঘ লোকালয়ে ঢুকতো। এ সময় বাঘকে 'মেলা' করে শিকার করা হতো। সেই বাঘের গড় দেখতে দূর-দূরানত্দ থেকে ছুটে আসতো মানুষ। ফাদে আটকে গণ্যমান্য মানুষের সামনে তামাশা দেখানো হতো। যার ফলে বর্তমান বাঘ প্রজাতি ধ্বংসের মুখে।

বাঘের বিলুপ্তি এবং সংখ্যা হ্রাসের মূল কারণগুলো হলো_ * 1950-60 দশক পর্যনত্দ দেশের প্রায় সর্বত্র বাঘ বাস করতো এবং তখন তথাকথিত সামাজিক সম্মান বৃদ্ধির লৰ্যে দেদার শিকার হতো। * চামড়া ব্যবহারের জন্য শিকার; যা আজো চলছে। * মানুষের যৌনৰমতা বৃদ্ধির জন্য দেশজ ওষুধে বাঘের দেহের বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ ব্যবহার : চায়না ও তার আশপাশের দেশে আজো তা চলছে এবং * মানুষের বিভিন্ন চাহিদা মেটানোর প্রয়োজনে সর্বত্র প্রাকৃতিক বন ধ্বংস _ বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় উদাহরণ। প্রাণী বিজ্ঞানীরা বাঘের বিপন্নতার পেছনে দুটি মূল কারণ উলেস্নখ করেছেন। সেগুলো হলো _ 1. আবাস সংকোচন বা ধ্বংস 2. খাদ্য সঙ্কট।

অবৈধ শিকার ও চামড়া পাচার সুন্দরবনের বাঘ ধ্বংসের সবচেয়ে বড় কারণ হচ্ছে অবৈধ শিকার। বাঘ শিকারের ৰেত্রে প্রধানত ছোট বন্দুক বা রাইফেল ব্যবহৃত হয়; বিষ প্রয়োগেও বাঘ শিকার করা হয়। মাঝে-মধ্যে বাঘ গ্রামে ঢুকলেও তা হত্যা করা হয়। 1981-1999 সালের মধ্যে অবৈধভাবে 33টি বাঘ মারা যায়। অবৈধ শিকারিরা বাঘের চামড়া, হাড়, দাত, চোয়াল ও মাংস সংগ্রহ করে।

আনত্দর্জাতিক বাজারে সুন্দরবনের বাঘের চামড়ার চড়া মূল্য থাকায় চোরা শিকারিরা এ প্রাণীটিকে তাদের শিকারের টার্গেট বানায়। গত এক যুগে চোরা শিকারিদের হাতে শতাধিক বাঘ নিধন হয়েছে। বাঘের চামড়া পাচারের সময় উদ্ধার হয়েছে অর্ধ শতাধিক রয়াল বেঙ্গল টাইগারের মূল্যবান চামড়া। বিশ্ব বাজারে রয়াল বেঙ্গল টাইগারের চামড়া খুবই মূল্যবান। প্রতিটি বাঘের চামড়া কম করে হলেও বাংলাদেশি টাকা 20 থেকে 25 লাখ টাকায় বিক্রি হয়।

বিশেষ করে মিডল ইস্টে ধনাঢ্য শেখ ও আমীররা তাদের ড্রইং রম্নমে রয়াল বেঙ্গল টাইগারের চামড়া ঝুলিয়ে নিজেদের আভিজাত্য প্রদর্শন করে থাকেন। সুন্দরবনের 4টি রেঞ্জের বনসংলগ্ন গ্রামগুলোতে একাধিক সংঘবদ্ধ বাঘ শিকারি দল রয়েছে। এদের অবস্থান হচ্ছে বাগেরহাট জেলার শরণখোলা, মংলা, মোড়েলগঞ্জ, সাতৰীরার আশাশুনি, কালিগঞ্জ, শ্যামনগর, বরগুনা জেলার পাথরঘাটা উপজেলার চরদোয়ানী, খুলনা জেলার পাইকগাছা, দাকোপ ও কয়রায়। চোরা শিকারিরা জেলে সেজে বন বিভাগের মাছ ধরার পাস নিয়ে গভীর বনে ঢুকে পড়ে। শিকারের পর স্থানীয় পদ্ধতিতে চামড়া ছাড়িয়ে সংরৰণ করে।

পরে ওই চামড়া বিশেষ পদ্ধতিতে সংরৰণ করে লাখ লাখ টাকার বিনিময়ে পাচারকারি চক্রের হাতে তুলে দেয়। 2003 সালের 5 অক্টোবর খুলনার একটি হোটেলে 'গেস্নাবাল টাইগার ফোরাম' (জেটিএফ) এর সভা শেষে বিশ্বের কয়েকটি দেশের প্রতিনিধিদের উপস্থিতিতে এক প্রেস বৃফিংয়ে বলা হয়, বিশ্বের 40টি দেশের কালোবাজারে বাঘের চামড়া বেচাকেনা হয়ে থাকে। স্থানীয় চোরদের হাত থেকে পাচারকারিরা অতি গোপনে চামড়া নিয়ে আসে ঢাকায়। সেখান থেকে আনত্দর্জাতিক চোরাচালানিদের মাধ্যমে বিদেশে পাঠানো হয়। 2002 সালের 9 সেপ্টেম্বর সুন্দরবনের চাদপায় রেঞ্জের জোংড়া এলাকায় বনরৰী ও শিকারি দলের মধ্যে বন্দুক যুদ্ধের পর একটি বাঘের মৃতদেহ উদ্ধার করা হয়।

এ বছরেই 27 জুলাই শ্যামনগর উপজেলার গাসরামারি খেয়াঘাট থেকে পুলিশ একটি এবং সাতৰীরার কালিগঞ্জের সাতপুর সেতুর কাছ থেকে বিডিআর সদস্যরা 12টি বাঘের চামড়া উদ্ধার করেছে। মাঝে-মঝেই এ রকম চালান ধরা পড়ে, যার পরিমাণ মূল পাচার সংখ্যার দিক থেকে খুবই নগণ্য। ঢাকা ছাড়াও মংলা বন্দরের বিদেশি জাহাজ এবং ইনডিয়ার চোরাচালানিদের মাধ্যমেও বিশ্বখ্যাত রয়াল বেঙ্গল টাইগারের চামড়া পাচার করা হয়। তবে এসবের সঙ্গে অনেক সময় বনরৰী ও কর্মকর্তারা জড়িত থাকে বলে জানা যায়।


সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে ১২ বার

এর পর.....

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.