আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

রাষ্ট্রায়ত্ব ব্যাংক বেসরকারিকরণ : একটু ভেবে দেখা দরকার



রাষ্ট্রায়ত্ব ব্যাংক বেসরকারিকরণ_ একটু ভেবে দেখা দরকার* আহমেদ স্বপন মাহমুদ** বিগত জোট সরকারের সময়ে রাষ্ট্রায়ত্ব ব্যাংকগুলোকে বেসরকারি খাতে ছেড়ে দেয়ার সিদ্ধান্ত হয়। আন্তর্জাতিক অর্থলগি্নকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর শর্ত ও পরামর্শ মানতে গিয়ে রূপালী ব্যাংককে ইতোমধ্যেই বেসরকারি খাতে ছেড়ে দেয়া হয়েছে। আইএমএফ'র শর্ত ছিলো রূপালী ব্যাংক বেসরকারি খাতে ছেড়ে না দিলে পিআরজিএফ'র আওতায় পঞ্চম কিস্তির অর্থ তারা ছাড় দিবে না। অন্যান্য রাষ্ট্রায়ত্ব ব্যাংক যেমন সোনালী, জনতা, অগ্রণী ব্যাংককেও বেসরকারিকরণের জন্য প্রকল্প গৃহীত হয় জোট সরকারের আমলে। জোট সরকার প্রবল প্রতিবাদের মুখে শেষ পর্যন্ত ব্যাংক বেসরকারিকরণ প্রক্রিয়া স্থগিত রাখে।

বেসরকারিকরণের প েঅনেক যুক্তি দেয়া হয় বিভিন্ন সরকারী- বেসরকারী প্রতিষ্ঠানের প থেকে। এটা শিা, স্বাস্থ্য, রেলওয়ে, কলকারখানা, ব্যাংক, বিমান, বন্দর ইত্যাদি সকল েেত্রই একই যুক্তি_ মানে এসব প্রতিষ্ঠান বা খাত অদ, দুনীতিগ্রস্ত, লোকসানী প্রতিষ্ঠান ইত্যাদি। ফলে বেসরকারিকরণ হচ্ছে যেন একমাত্র দাওয়াই। একথা সত্যি যে, রাষ্ট্রায়ত্ব ব্যাংকগুলোতে অদ জনবল, সীমাহীন দুনর্ীতি, গাফিলতি ইত্যাদি বিষয় রয়েছে যা দিন দিন সেবার মানকে নষ্ট করেছে, যা জনগণের সাথে প্রতারণার সামিল। কিন্তু এই যুক্তির ওপর ভর দিয়ে ঢালাওভাবে ব্যাংকগুলোকে কর্পোরেট সেক্টরে ছেড়ে দিতে হবে, বেসরকারি খাতে ছেড়ে দিতে হবে এমন নয়।

বেসরকারি খাতের ব্যাংকগুলো সম্পর্কেও দুনীতি ও অদতার নজির রয়েছে। সরকারের প থেকে যদি ব্যাংকগুলোতে দ জনবল নিয়োগ, উপযুক্ত পারিশ্রমিক, দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণের উদ্যোগ নেয়া, প্রশিণ, নজরদারি ও মূল্যায়নের ব্যবস্থা নেয়া হয় এমন উদ্যোগ নেয়া হয় তাহলে বেসরকরি খাতে এগুলো ছেড়ে দিতে হয় না। এছাড়া, এটা সরকারের ব্যার্থতাকেই প্রমাণ করে না যে সরকার এসবের বিরুদ্ধে বিধিব্যবস্থা নিতে পারে না। কারণ ব্যাংকগুলোর অদতা মানে সরকারের অদতা। সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগ এেেত্র উদ্যাগ নিতে পারে কিভাবে দতা বাড়ানোর মাধ্যমে সেবার মান বাড়ানো যায়, দুনীতি দূর করা যায়।

বেসরকারি খাতে যদি সম্ভব মনে করা হয়, সেেেত্র সরকারিভাবে তো আরো বেশী করা সম্ভব। এ বিষয়গুলো ভেবে দেখা অতি জরুরি। কারণ একে একে শিা, স্বাস্থ্য, পানি ও অন্যান্য জনসেবাখাতগুলো যেভাবে দাতাদের শর্ত পূরণ করতে গিয়ে বেসরকারি খাতে ছেড়ে দেয়া হচ্ছে, গরিব জনগণের প েসেসব সুযোগসুবিধা গ্রহণ বা নাগরিক হিসেবে যেসব সেবা রাষ্ট্রের প থেকে জনগণের পাওয়ার কথা সেইসব সেবা পাওয়া কোনোদিনই সম্ভব হবে না। কেবল ধনী ও বিত্তবানরা ভোগদখল করবে এটা হতে পারে না। আর এ দেশের অধিকাংশ মানুষ যারা গরিব, দিনমজুর, চাষাভুষা, শ্রমিক, কৃষক_ দিন আনে দিন খায় তাদের সামর্থ্য থাকবে না কোনো, তারা ক্রমাগত বঞ্চিত হবে শিা থেকে স্বাস্থ্যসুবিধা থেকে, হয়তো তাদেরও একবোতল পানি খেতে হবে ভাতের পরিবর্তে।

আর না হয়, খালবিল পুকুরের দুর্গন্ধ পানি খেয়ে বাঁচামরার লড়াই করতে হবে। কিন্তু এসব মানুষের প্রতি রাষ্ট্রের দায়দায়িত্ব আছে, রাষ্ট্রের উদাসীনতা দেশ ও জনগণকে বিপর্যয়ের মুখে ঠেলে দেয়, এই অভিজ্ঞতা তো আছেই আমাদের। সরকার ব্যাংকিং খাত সংস্কারের কাজে হাত দিয়েছে বিশ্ব্যব্যাংক-আইএমএফ'র চাপে। অর্থনৈতিক সংস্কারের ও উন্নয়নের নামে নেয়া হচ্ছে বিভিন্ন প্রকল্প। ব্যাংকিং খাতে সংস্কার প্রকল্পটির নাম হচ্ছে "শিল্প উন্নয়ন ও ব্যাংক আধুনিকীকরণ প্রকল্প"।

তাছাড়া সরকারের হাতে আরেকটি প্রকল্প রয়েছে "কেন্দ্রীয় ব্যাংক শক্তিশালীকরণ প্রকল্প" নামে। প্রথম প্রকল্পে ঋণের পরিমাণ 38 কোটি 83 লাখ 90 হাজার ডলার এবং পরেরটির জন্য রয়েছে 4 কোটি 61 লাখ 30 হাজার ডলার। এেেত্র দাতাদের শর্ত হলো ব্যাংকগুলোকে বেসরকারি খাতে ছেড়ে দিতে হবে। সংস্কারের জন্য বরাদ্দকৃত অর্থের অধিকাংশই চলে যাচ্ছে পরামর্শকদের পকেটে নানাভাবে। যেমন : রূপালী ব্যাংক বেসরকারীকরণের জন্য ইংল্যান্ডের পরামর্শক প্রতিষ্ঠান জিবিআরডবি্লউ পারিশ্রমিক হিসেবে নিচ্ছে 18 লাখ 97 হাজার ডলার, অগ্রণী ব্যাংক'র জন্য পরামর্শবাবদ 65 লাখ 76 হাজার 269 ডলার নিচ্ছে হংকং-এর প্রতিষ্ঠান প্রাইস ওয়াটার হাউসকুপারস, যুক্তরাষ্ট্রের আইবিটিসি ইনকরপোরেট সোনালী ব্যাংকের পরামর্শ-পারিশ্রমিক হিসেবে নিচ্ছে 48 লাখ 59 হাজার 996 ডলার এবং আয়ারল্যান্ডের ইন্টারন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট-আয়ারল্যান্ড নামে একটি প্রতিষ্ঠান জনতা ব্যাংক বেসরকারিকরণের েেত্র পরামর্শ বাবদ নিচ্ছে 50 লাখ 70 হাজার ডলার।

অর্থাৎ এই চারটি রাষ্ট্রায়ত্ব ব্যাংক বেসরকারি খাতে ছেড়ে দেয়া বাবদ পারিশ্রমিক হিসেবে মোট 1 কোটি 84 লাখ 03 হাজার 265 ডলার যাচ্ছে পরামর্শকদের পকেটে। এই বিপুল পরিমাণ অর্থ খরচ করে অর্থনৈতিক সংস্কার ও উন্নয়নের জন্য যেসব প্রকল্প মেনে নিচ্ছে আমরা তার সুফল কতটুকু হবে তা ভেবে দেখা খুবই জরুরি। বিশ্বব্যাংক-আইএমএফ'র সাথে দ ও যৌক্তিক সমঝোতা এসবের নিরসন করতে পারে খানিক। কারণ দেখা গেছে বিশ্বব্যাংক-আইএমএফ'র অধিকাংশ প্রকল্প বাস্তবায়ন করার ফলে আদৌ কোনো উন্নতি হয়েছে এমন নজির কম। বরং কাঠামোগত সমন্বয় কর্মসূচির ফলে অনেক দেশ আরো গরিব হয়েছে।

এখন পিআরএসপি'র আওতায় যেসব প্রকল্প নেয়া হচ্ছে তার ফলাফল যে শুভ হচ্ছে না তারও ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে আগেভাগে। এসব দিক বিবেচনা করে ঢালাওভাবে রাষ্ট্রায়ত্ব প্রতিষ্ঠানগুলো কর্পোরেট সেক্টর তথা বেসরকারীকরণের আগে একটু সময় নিয়ে ভেবে দেখা দরকার, সংশ্লিষ্ট দতাসম্পন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান তথা জনগণের বিভিন্ন পর্যায়ে আলোচনা করা প্রয়োজন এবং সব গুরুত্বপুর্ণ সিদ্ধান্তের সাথে জনগণের আশাআকাঙ্ার প্রতিফলন কতটুকু হবে তা বিবেচনা করা দরকার। একদিকে জনগণের জীবনজীবিকার সংগ্রাম তীব্রতর হচ্ছে আর অন্যদিকে দুনিয়াজুড়ে ব্যবসাবাণিজ্য স্ফীত হচ্ছে কর্পোরেশনগুলোর। তাহলে আমরা কী নিজেদের বাণিজ্যের শেকলে আবদ্ধ হয়ে পড়ে থাকব? একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের জনগণের যে স্বাধীনচেতা আকাঙ্া তার বাস্তবায়নে কী পদপে নেয়া যায় না? ঋণসাহায্যের কারণে বিশ্বব্যাংক-আইএমএফ-এডিবি তথা কথিত দাতাগোষ্ঠির চাপিয়ে দেয়া শর্ত যা আমাদের জনগণের বিপ েযায়, সেগুলো প্রতিটি সরকার বারবার মাথা পেতে মেনে নিয়েছে। দুর্বল, মতালিপ্সু, দুর্নীতিপরায়ন রাজনৈতিক নেতৃত্ব জনবিরোধী প্রকল্প বা ঋণ-সাহায্য গ্রহণ না করে স্বাধীন জাতীয় উন্নতির নীতি তৈরি করার কাজ করতে পারতো যা দেশগঠনে কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে, দেশের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব অুন্ন রেখে প্রগতিশীল গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র নির্মাণ করে জনগণের আশাআকাঙ্া বাস্তবাযন করতে পারত।

আমাদের দুর্ভাগ্য! ফলে দুর্বল ও গরিব রাষ্ট্রের কাঁধে ভর দিয়ে অর্থলগি্নকারী প্রতিষ্ঠানগুলো মর্জিমাফিক বিভিন্ন শর্ত চাপিয়ে দিচ্ছে দেশের ওপর। রাষ্ট্রায়ত্ব ব্যাংক বেসরকারি খাতে ছেড়ে দেয়ার বিষয়টি সেই ঋণশর্তের অধীন। বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ ও বহুজাতিক কোম্পানিদের পরামর্শে রাষ্ট্রায়ত্ব ব্যাংকগুলো বেসরকারিকরণের ফলে সারাদেশে এসব ব্যাংকের বিভিন্ন শাখার মাধ্যমে সাধারণ মানুষ ও কৃষকসমাজ এখন পর্যন্ত যতটুকু ব্যাংকিং সেবা পাচ্ছে তা থেকেও বঞ্চিত হবে। বেসরকারি খাতে ব্যাবসাবাণিজ্যের প্রসার হয়তো হবে, কিন্তু রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণ তথা জনগণের প্রতি রাষ্ট্রের যে দায়িত্ব তা ভেঙে পড়বে ক্রমাগত। প্রশ্ন হচ্ছে, একটি অরাজনৈতিক সরকার জননির্বাচিত সরকারের নেয়া সিদ্ধান্ত কী ইচ্ছে করলেই অগ্রাহ্য করতে পারে, বিশেষ করে সেই সকল সিদ্ধান্ত যেগুলো জনস্বার্থসংশ্লিষ্ট? বর্তমান সরকার যেমনটি দাবী করে যে, এটি জনগণের আকাঙ্া বাস্তবায়নকারী সরকার, তাহলে জনপ্রতিরোধের মুখে যে সিদ্ধান্ত বিগত জোট সরকার স্থগিত রাখতে বাধ্য হয়, সেইসব নীতিগতসিদ্ধান্ত একটি অনির্বাচিত সরকার কোনোভাবেই গ্রহণ করতে পারে কি? * 11 ফেব্রুয়ারি 2007 দৈনিক সমকালে প্রকাশিত।

ইষৎ সম্পাদিত। ** আহমেদ স্বপন মাহমুদ, কবি, প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.