আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

বইপাগল ঃ গানস, জার্মস অ্যান্ড স্টীল

সুন্দরী বালিকাদের যত্ন করে কামড়াই

আমার 2006 সালে পড়া বইগুলোর মধ্যে সেরা এটা। জ্যারেড ডায়মন্ডের 97 সালে লেখা বই। বইটার অনুশিরোনাম হচ্ছে, আ শর্ট হিস্ট্রি অব এভরিবডি ফর দ্য লাস্ট 13,000 ইয়ারস। ডায়মন্ডের বিশদ পরিচয় আপনারা ইন্টারনেট হাঁটকে বার করে নিতে পারবেন, সে ভরসা আছে বলেই আমি বেশি কিছু বলবো না। বন্দুক, বীজাণু আর ইস্পাতের এক অদ্ভূত গল্প ডায়মন্ড খুব সহজ ভাষায় গড়গড়িয়ে বলে গেছেন।

গোটা বইটা একটি যুগল প্রশ্নের উত্তর, কেন ইয়োরোপীয়রা মোটামুটি সমস্ত পৃথিবীর ওপর কতর্ৃত্ব জাহির করতে পেরেছে, কেন গোটা পৃথিবী গিয়ে ইয়োরোপে কর্তৃত্ব ফলায়নি? যে চার্টটা পোস্টের সাথে তুলে দিলাম, এটা খুব সংক্ষেপে ডায়মন্ডের গোটা বইয়ের বক্তব্য। বর্ণবাদী উত্তর দিয়ে অনেকেই প্রশ্নদুটিকে পেরিয়ে বা এড়িয়ে যেতে পেরেছে, কিন্তু সেটাকে নাকচ করে ডায়মন্ড হাত দিয়েছেন অন্য কিছু ফ্যাক্টরের ওপর। না, ইয়োরোপীয়রা বিবর্তনের ধারায় অন্য মহাদেশের মানুষের তুলনায় শারীরতাত্তি্বক দিক দিয়ে মহত্তর হয়ে ওঠেনি, তাদের আজকের এই ফাঁটের পেছনে বরং কাজ করেছে এই কারণগুলো, যা অন্য মহাদেশের সমসাময়িক মানুষদের ক্ষেত্রে খাটেনি। ইউরেশিয়া পূর্ব থেকে পশ্চিমে বিস্তৃত একটি মহাদেশ, যেখানে আমেরিকা (উত্তর-দক্ষিণ) আর আফ্রিকা উত্তর থেকে দক্ষিণে। ফলে একই অক্ষাংশে অবস্থিত প্রাণী ও ফসলের প্রজাতি সহজে বিস্তৃত হতে পেরেছে (একই অক্ষাংশে ঋতুপরিক্রমা একই রকম), যা আমেরিকা বা আফ্রিকার ক্ষেত্রে ঘটেনি।

তাছাড়া ইউরেশিয়াতে ভৌগলিক ব্যারিয়ার তুলনামূলকভাবে কম, তাই উর্বর কাস্তে (মেসোপটেমিয়া ও সংলগ্ন এলাকা) আর চীনে উদ্ভূত ফসল ও পশু ছড়িয়ে পড়েছে গোটা মহাদেশে, গার্হস্থ্যায়নের মাধ্যমে। গার্হস্থ্যায়ন কথাটা খটোমটো, আমারই কয়েন করা। বুনো পশু পোষ মানানো নয়, গার্হস্থ্যায়ন মানে হচ্ছে কোন পশুকে বন্দীদশায় নিজের সুবিধার মতো করে বিবর্তিত করে নেয়া, যেমন নেকড়ে থেকে আজকের কুকুর এসেছে গার্হস্থ্যায়নের মধ্য দিয়ে। ডায়মন্ড এরপর পাত্তা নিয়েছেন বিভিন্ন মহাদেশের প্রাচীন শস্য ও প্রাণীদের খোঁজ। করুণ এক চিত্র ফুটে উঠেছে ইউরেশিয়ার বিপরীতে আমেরিকা, আফ্রিকা আর অস্ট্রেলিয়ায়, যেখানে লাগসই শস্য বা প্রাণী তেমন ছিলো না।

ইউরেশিয়ায় যেমন আজকের আধুনিক শস্যের পূর্বপুরুষ গম, যব, ধান ইত্যাদি ঘাসের বিভিন্ন নামজাদা আত্মীয়স্বজনেরা ছিলো, অন্য মহাদেশে তেমন ছিলো না। ছিলো না গার্হস্থ্যায়নের উপযোগী বড় প্রাণীও। যেমন আমেরিকার একমাত্র গার্হস্থ্যায়িত বড় প্রাণী ছিলো ইয়ামা-আলপাকা, আফ্রিকা বা অস্ট্রেলিয়াতে কোন বড় প্রাণী গার্হস্থ্যায়িত হয়নি, ওদিকে গরু, ভেড়া, ছাগল, মোষ, উট আর সবচে গুরুত্বপূর্ণ জিনিস, ঘোড়া, সবই ইউরেশিয়াতে গার্হস্থ্যায়িত হয়েছে। গার্হস্থ্যায়নের উপযোগী অন্যান্য বড় প্রাণী বরফযুগের ফিলটার পেরোতে পারে নি বাকি মহাদেশগুলোয়। ডায়মন্ড এরপর দেখিয়েছেন, কিভাবে গার্হস্থ্যায়িত শস্য আর প্রাণীর আধিক্য মানুষকে আদি কৃষিজীবী সমাজবদ্ধতার দিকে ঠেলে দিয়েছে।

এই কৃষিজীবী সমাজ প্রতিযোগিতা করেছে আদিম শিকারী-সংগ্রাহক সমাজের সাথে, যাদের কোন স্থাবর ঠিকানা ছিলো না, অস্থাবর কিছু সম্পত্তি নিয়ে তারা আজ এখানে কাল ওখানে করে ছোট ছোট গোষ্ঠী বেঁধে টিকে থাকতো। কৃষির উদ্ভবের পর কৃষিজীবী সমাজ শুরু করেছে ঘন, বড়, থিতু আর স্তরীকৃত সমাজ পত্তনের। এই পর্যায়ে এসে তারা দু'টি বড় অস্ত্র লাভ করেছে। একটি হচ্ছে, পশুর নৈকট্যের কারণে উদ্ভূত জীবাণু, আরেকটি হচ্ছে প্রযুক্তি। শিকারী-সংগ্রাহক মানুষের বুনো জীবনযাত্রায় প্রযুক্তির সুযোগ খুব কম, কারণ তারা ঘন ঘন স্থান পরিবর্তন করে, এবং এই দৌড়ের ওপর থাকা জীবনে তারা টেকসই প্রযুক্তির পেছনে সময় বা মনোযোগ দিতে পারে না।

এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় যাওয়ার সময় তারা সাথে নেয় অস্ত্র, শিশু আর সামান্য টুকিটাকি। কিন্তু থিতু কৃষিজীবী সমাজের মানুষের ঘনঘন জায়গা পাল্টানোর হ্যাপা নেই, তারা স্থায়ী ও ভারি প্রযুক্তির দিকে এগিয়ে যায়। আর অনেক দিন পশুর সংস্পর্শে থাকার ফলে তাদের শরীরও সেই পাশবিক জীবাণুর বিরুদ্ধে প্রতিরক্ষাব্যবস্থা গড়ে তুলতে পারে, যা পারে না কৃষিমূর্খ সমাজের মানুষেরা। উদাহরণ, কলম্বাস, কর্তেজ আর পিজারোর পদার্পণের পর আমেরিকার সিংহভাগ আদিবাসী বসন্ত, ইনফ্লুয়েঞ্জা ও অন্যান্য মহামারীতে গুষ্টিসুদ্ধু লোপ পায়। ঐ রোগের বিরুদ্ধে তাদের শরীরে কোন প্রতিরোধ ব্যবস্থা ছিলো না, কারণ তাদের জীবনে পশুর ভূমিকা প্রায় ছিলো না বললেই চলে।

আন্দেজ এলাকার ইনকারা ভারবাহী পশু হিসেবে ইয়ামা-আলপাকা ব্যবহার করতো, কিন্তু ইয়ামা কখনোই ঘরের ভেতরে থাকে না, তার দুধ খাওয়া যায় না, যে কারণে তার শরীরের জীবাণুগুলিও মানুষের দেহে সংক্রামিত ও রূপান্তরিত হতে পারেনি। তাছাড়া একটি জীবাণুর হঠাৎ আগমনের পর তার বিরুদ্ধে প্রতিরোধব্যবস্থা গড়ে তুলতে সময়ের প্রয়োজন হয়, ছোট ছোট গোষ্ঠীতে বাস করা অনেক জাতি সে সুযোগ পায়নি, একেবারে ঝাড়ে বংশে লোপ পেয়েছে তারা। ওদিকে দিন আনি দিন খাই গোছের শিকারী-সংগ্রাহক জীবন পেছনে ফেলে আদি কৃষিজীবী মানুষ যখন খাবারের আধিক্য আর তার সংরক্ষণের ব্যবস্থা করতে পারলো, তখন সে সেই উদ্্বৃত্ত ব্যয় করলো বিশেষ শ্রেণী ও পেশার মানুষের পেছনে,ন্তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্যরা হচ্ছে যোদ্ধা, রাজনীতিবিদ ও প্রযুক্তিবিদ। শিকারী-সংগ্রাহকদের সবাইকেই গো ডাচ নীতি মেনে চলতে হয়, বাড়তি খাবারওলা সমাজে সেই মাথাব্যথা নেই। ফলে কৃষিজীবী সমাজে দাঁত আর নখও গজিয়ে ওঠে।

সামাজিক গড়নে যখন আরেকটু জটিলতা জন্ম নেয়, তখন বিভিন্ন সমাজের মধ্যে মিথষ্ক্রিয়ার তীব্রতা বাড়তে থাকে। যুদ্ধ, বিনিময়, আন্ত:সমাজ বিবাহ, বাণিজ্য, সব। ফলে বেগ পায় প্রযুক্তির বিকাশ। রাজনৈতিক কাঠামো আর লিখন পদ্ধতি সুযোগ করে দেয় বড় বড় অভিযান পরিচালনার। প্রায় সব বড় ইউরেশিয় শক্তির নিজস্ব লিখন ব্যবস্থা ছিলো, যে লিখন ব্যবস্থা পরবর্তী প্রজন্মকেও শক্তিশালী করে তথ্য দিয়ে।

আমেরিকায় উদ্ভূত লিখন ব্যবস্থা ছিলো দুর্বল, আফ্রিকায় (উত্তর আফ্রিকা বাদ দিয়ে) উদ্ভূত লিখন ব্যবস্থার তেমন চিহ্ন পাওয়া যায় না, পাওয়া যায় না অস্ট্রেলিয়াতেও। এর পর আসে অন্যতম কারণগুলো, যা বেশি চোখে পড়ে। ঘোড়া। সাম্রাজ্য জয়ের অন্যতম বাহন। 168 জনের বাহিনী নিয়ে ফ্রান্সিসকো পিজারো ইনকা সম্রাট আতাহুয়ালপার লক্ষাধিক সেনাকে পরাজিত করেছিলেন, আতাহুয়ালপাকে বন্দী করে পৃথিবীর ইতিহাসে সবচেয়ে বড় র্যানসম আদায় করেছিলেন, তারপর তাকে খুন করেছিলেন।

এর একটা বড় মনস্তাত্তি্বক কারণ হচ্ছে, ঘোড়া, যা আমেরিকায় আগে ছিলো না। অশ্বারোহী হিসপানিক সেনারা কচুকাটা করেছিলো পদাতিক ইনকাদের। কচুকাটা করেছিলো ইস্পাতের তলোয়ার দিয়ে, ব্রোঞ্জের ঠুনকো অস্ত্র দিয়ে ইনকারা কিছুই করতে পারেনি। একই কথা খাটে কর্তেজের ক্ষেত্রেও। তবে কয়েক শতক পরে উত্তর আমেরিকার আদিবাসীরা যখন ঘোড়া আর বন্দুকের ব্যবহার রপ্ত করে ফেলে, তাদের সামলাতে গিয়ে হিমসিম খেয়ে যেতে হয় শ্বেতাঙ্গ জবরদস্তদের।

ওয়েস্টার্ন গল্পগুলি তো তা-ই বলে, নাকি? ওদিকে মহাসাগর পাড়ি দেয়া জাহাজের ব্যবহারের ক্ষেত্রেও গল্প মোটামুটি একই। আতাহুয়ালপা বড় জাহাজে চড়িয়ে কোন ইনকা সেনাবাহিনী পাঠাননি স্পেন দখল করতে, উল্টোটাই ঘটেছে। কারণগুলো ওপরে বলা। বইটার শেষে প্রতিটি মহাদেশের জন্য বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর গল্প বলেছেন ডায়মন্ড, দেখিয়েছেন কিভাবে এই কারণগুলো মহাদেশগুলির বিভিন্ন জাতির মধ্যে একটি বা দুটিকে প্রাধান্য বিস্তারের পেছনে দাঁড়িয়ে। আরো অসংখ্য ছোট ছোট অনুসিদ্ধান্ত এসেছে বইটার মোড়ে মোড়ে।

প্রাঞ্জল, সুন্দর, অল্প কথায় অনেক কিছু। জ্যারেড ডায়মন্ড 34 বছর নিউগিনির বিভিন্ন অঞ্চলে কাটিয়েছেন, সেখানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা বিচিত্র জাতিগোষ্ঠীর সংস্পর্শে এসেছেন, আধুনিক যুগেও প্রাচীন সময়কে ধরে রাখা মানুষদের বিভিন্ন দিক নিয়ে শিখেছেন অনেক কিছু। গানস, জার্মস অ্যান্ড স্টীল আসলেও এক হীরকখনি। সামাজিক বিবর্তন নিয়ে পড়তে যাঁরা আগ্রহী, বইটা হাতে নিয়ে কয়েকদিন বিছানায় যান। হতাশ হবেন না, জিনিস হালকা হলেও খারাপ না।



এর পর.....

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।