আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

ক্ষমতার সমীকরণ ও দলীয় লুটেরা শ্রেণী

ক্ষমতার সমীকরণ ও দলীয় লুটেরা শ্রেণী ফকির ইলিয়াস ============================== এক সময়ের স্বৈরশাসক হু মু এরশাদ মাঝে মাঝে বেশ চমকপ্রদ কথা বলেন। তিনি বলেছেন আগামী নির্বাচনে আওয়ামী লীগ একশ আসন পেতে পারে। এর জবাবে আওয়ামী লীগেরই এক নেতা (যদিও দল তাকে নিষ্ক্রিয় করে রেখেছে) মাহমুদুর রহমান মান্না বলেছেন, তাহলে কী বাকি দুশ আসন এরশাদ পাবেন? অবশ্য মান্নাও বলেছেন, দেশের মানুষ আওয়ামী লীগকে হলুদ কার্ড দেখাবে। বাংলাদেশে এখন ক্ষমতার সমীকরণ চলছে। আগামী সংসদ নির্বাচনে কে কতো আসন পাবেনÑ তার হিসাব কষছেন অনেকেই।

বিএনপি ক্ষমতায় যেতে চায়। কারণ তাদের করণীয় ফর্দের তালিকা অনেক লম্বা। তারেক-কোকোকে ফিরিয়ে আনা, একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদের বের করে আনাÑ এর মাঝে অন্যতম। অন্যদিকে এরশাদ চাইছেন নিজে রাজনীতির ‘মধ্যনিয়ামক’ শক্তি হতে। তিনি চাইছেন, মহাজোট করে যা পারেননি, তার প্রতিকার করতে।

কারণ আওয়ামী লীগ দুইশর বেশি আসন পাবার পর আর যে কারো ধার ধারবে না তা এরশাদ জেনেছিলেন আগেই। তারপরও শেষ পর্যন্ত তিনি মহাজোটের সঙ্গে থাকবেন এটাও প্রত্যাশিত। বাংলাদেশের রাজনীতির অন্যতম নিয়ামক শক্তি হলো কালো টাকা। সম্প্রতি নিউইয়র্কে এসেছিলেন ক্ষমতাসীন দলের এক নীতিনির্ধারক। এক ঘরোয়া আড্ডায় বললেনÑ ‘আরে ভাই ইলেকশন তো করতে হবে।

টাকা ছাড়া কী ইলেকশন হয়। আমেরিকায়ও তো ফান্ড রেইজিংয়ের নামে চাঁদাবাজি হয়!’ আমি দ্বিমত পোষণ করলাম। না, হয় না। ফান্ড তুললে এর হিসাব দিতে হয়। না দিলে, চাঁপাবাজি করলে জেল জরিমানা হয় রাজনীতিকদের, এই আমেরিকায়।

একটা জিনিস বুঝলাম তার কথায়, টাকা তোলার জন্য সব কটি দলই ব্যস্ত। তা যেভাবেই হোক। মনে পড়লো শেয়ারবাজার কেলেঙ্কারির কথা। আমরা দেখেছিলাম, কিছু কিছু সংবাদ মাধ্যমে এসব লুটপাটকারী হিসেবে কিছু নাম ছাপা হয়েছিল। এর মধ্যে এসইসির কিছু শীর্ষ কর্মকর্তার নামও ছিল।

তা নিয়েও চলেছে নানারকম বাগ্বিত-া। সিকিউরিটিজ এন্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের যাদের নাম ছিল, তারা সরকারি গোয়েন্দা সংস্থাগুলো গভীর তদারকি ফাঁকি দিয়ে কিভাবে এমন যোগসাজশ তৈরি করলো তা ভেবে দেখার বিষয় ছিল। কিছুই দেখা হয়নি। অন্যদিকে ব্যবসায়ী হিসেবে যাদের নাম ছাপা হয়েছিল, তারা প্রধান দুটি রাজনৈতিক দলের সঙ্গে শীর্ষ পর্যায়ে সম্পৃক্ত। আর এই সুবাদে তারা আগেই হাজার হাজার কোটি টাকার মালিক ছিল এবং আছে।

লক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে এরা আওয়ামী লীগ কিংবা বিএনপির রাজনীতির ম“পুষ্ট হলেও লুটপাটের মাঠে তারা একে অন্যের সতীর্থ। দলীয় আদর্শ তখন তাদের কাছে মোটেই মুখ্য নয়। বাংলাদেশে ‘মিলেমিশে’ লুটপাট করার প্রথা নতুন নয়। এর আগেও হয়েছে। বিশেষ করে এবার শেয়ারবাজার কেলেঙ্কারিতে এসব দলীয় লেবাসধারীদের একই সমান্তরালে অবস্থান তাদের মুখোশ নগ্নভাবে খুলে দিয়েছে।

কতো অরক্ষিত একটি দেশে বসবাস করছে বাংলাদেশের মানুষ! এটা খুবই নিশ্চিত করে বলা যায়, শেয়ারবাজার কেলেঙ্কারিতে যদি শুধু বিএনপিপন্থী শীর্ষ ব্যবসায়ীদের সম্পৃক্ততা থাকতো তবে, মহাজোট সরকার গলা হাঁকিয়ে তাদের নাম বলে বেড়াতো। যেহেতু এই কেলেঙ্কারিতে আওয়ামী লীগপন্থী শীর্ষ ব্যবসায়ীরাও জড়িত ছিল কিংবা আছে, সে কারণেই ‘ভাসুরের নাম মুখে নিতে’ লজ্জা পাচ্ছিলেন সংশ্লিষ্টরা। আমাদের মনে আছে, স্বাধীনতা-পরবর্তীকাল থেকেই এই ‘প্রভাবশালী’ মহলটি নানা সময়ের সরকারি আশ্রয়-প্রশ্রয় পেয়ে জনগণের সম্পদ লুণ্ঠন করেছে। এরা কখনো সামরিক জান্তাদের মিত্র সেজে, কখনো গণতান্ত্রিক সরকারের প্রিয়ভাজন সেজে রাষ্ট্রের সুনাম এবং সম্পদ দুটোই হাতিয়ে নিয়েছে। মনে রাখা দরকার ’৯৬ সালে জিতে আওয়ামী লীগ ক্ষমতাসীন হওয়ার পরও শেয়ারবাজারে এমনি একটি পরিকল্পিত ধস নেমেছিল।

এসব ঘটনা আসলেই রাষ্ট্রের জন্য ভয়াবহ শঙ্কার খবর। তারপরও আমরা দেখছি, এসব লুটেরা শ্রেণীর প্রতিনিধিদের রাষ্ট্রক্ষমতায় বসানোর জন্য একটি শ্রেণী মরিয়া হয়ে কাজ করছে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী চার বছরে তার সরকারের সাফল্যের যে বিবরণ গেলো ১১ জানুয়ারি তার ভাষণে দিয়েছেন, তা আরো পরিপক্ব হতে পারতো যদি বাংলাদেশে দুর্নীতি প্রাতিষ্ঠানিকভাবে প্রশ্রয় না পেতো। জাতি দেখতে চায়, হলমার্ক কিংবা ডেসটিনি কেলেঙ্কারির নেপথ্যে কারা? বাংলাদেশে পেশিশক্তি ও কালোটাকার এই যে মহড়া দেখানোর প্রতিযোগিতা, তা ধ্বংস করে দিচ্ছে দেশের মননশীল মানুষের মেরুদ-। প্রজন্ম সাহস পাচ্ছে না দুর্নীতির বিরুদ্ধে সোচ্চার হতে।

বরং তাদেরই কেউ কেউ টেন্ডার, চাঁদাবাজি, ভাগ-বাটোয়ারায় অংশ খেতে কক্ষচ্যুত হয়ে দলীয় সন্ত্রাসী বনে যাচ্ছে। অথচ আমরা জানি, এই বাঙালি জাতির তরুণ প্রজন্মই বাহান্নর ভাষা আন্দোলন, ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান, সত্তরের নির্বাচন একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্ব দিয়েছিল। তাহলে আজ এই প্রজন্মের এতো সামাজিক অবক্ষয় কেন? এর কিছু কারণ আছে। তার অন্যতম হলো রাষ্ট্র মেধাবী প্রজন্মকে যথাযথ মূল্যায়ন করতে বারবার কার্পণ্য দেখিয়েছে। ফলে পচনশীল সমাজ ব্যবস্থার ছত্রছায়ায় অর্ধশিক্ষিত, অশিক্ষিত নেতৃত্বের দাপট গণমানুষের স্বপ্নের বাংলাদেশের দখল নেয়ার অপচেষ্টা করেছে।

দেশে ধনী-দরিদ্রের বৈষম্য প্রকট আকার ধারণ করেছে। এ অবস্থার পরিবর্তন করতে মানুষ যে চেষ্টা করছে না, তা কিন্তু নয়। তারপরও নিষ্পেষণের করাঘাতে মানুষ বারবার পরাজিত হয়েছে লুটেরা শ্রেণীর কাছে। একটি রাষ্ট্রে গণতন্ত্র সুসংহত করার জন্য দেশপ্রেম কতোটা অপরিহার্য, তা বিশ্বের যে কোনো সভ্য গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের দিকে তাকালেই আমরা দেখতে পারি। ভারতের রাজনীতিকরা মুখে একে অপরের যতোই সমালোচনা করুন না কেন, লোকসভায় তারা দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি ইত্যাদির বিরুদ্ধে কিভাবে ঐক্যবদ্ধ তা আমরা বরাবরই দেখছি।

অথচ বাংলাদেশে লুটপাটের বিরুদ্ধে কথা বললেই তাকে রাজনৈতিক প্রতিহিংসা বলে চালিয়ে দেয়ার চেষ্টা করা হয়। নিজেদের গা বাঁচানোর জন্য হরতাল ডেকে জনমানুষের দুর্ভোগ আরো বাড়িয়ে দেয়া হয়। বাংলাদেশের মানুষ চারদলীয় জোটের শাসন দেখেছে ২০০১-২০০৫ সালে। একযোগে বোমা হামলা কিংবা ২১ আগস্টের শক্তিশালী গ্রেনেড হামলার স্মৃতি এ দেশের মানুষের মানে আছে। পরিতাপের কথা হচ্ছে, বাংলাদেশে প্রগতিশীল গণতান্ত্রিক কিংবা সমাজতান্ত্রিক মানসিকতার রাজনীতিকরা এখন অনেকটাই জনসমর্থনহীন।

এদের জনবল নেই। অথচ এরা কিন্তু দেশকে লুটেরা শ্রেণীর হাত থেকে বাঁচাবার জন্য ডাক দিয়েই যাচ্ছেন। কিন্তু তাদের ডাক কেউ শুনছে না। গেলো কিছুদিন আগে সিপিবি ও বাসদ একটি যৌথ ঘোষণা দিয়েছিল। ১৫ দফা ঐ দাবিগুলো ছিল এরকমÑ ১. মহান মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে অর্জিত সংবিধানের সকল বিকৃতি ও অসম্পূর্ণতা দূর করে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও গণআকাক্সক্ষার আলোকে সংবিধানকে আরো গণতান্ত্রিক ও গণমুখী করা।

২. ’৭১-এর যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ও শাস্তি দ্রুত নিশ্চিত করা ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনা-গণআকাক্সক্ষার পুনর্জাগরণ ঘটানো। ৩. রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস বন্ধ এবং রাষ্ট্রের সকল অগণতান্ত্রিক কালো আইন বাতিল করা। গণতান্ত্রিক আন্দোলনে পুলিশি হস্তক্ষেপ বন্ধ ও শাস্তিযোগ্য অপরাধ আইন প্রণয়ন। ৪. সকল প্রকার অবৈধ স্থাবর-অস্থাবর সম্পদ ও কালো টাকার পুঁজি রাষ্ট্রীয় মালিকানায় নিয়ে আসা। ৫. ঘুষ-দুর্নীতি, দলীয়করণ, দুঃশাসন-অনিয়ম এবং লুটপাট ও দখলদারিত্ব রোধ করা ও আইনের আওতায় আনা।

আদর্শবাদী রাজনীতির পুনর্জাগরণ ঘটানো। ৬. খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। খাদ্য পণ্যের সিন্ডিকেট ভাঙা ও মধ্যস্বত্বভোগীদের আধিপত্য বিলোপ করা। সর্বস্তরে রেশনিং ব্যবস্থা চালু। টিসিবিকে সক্রিয় করে ন্যায্যমূল্যের বিক্রয়কেন্দ্র খোলা।

দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি রোধ ও সমবায় চালু করা। ৭. ৮০০০ টাকা ন্যূনতম জাতীয় মজুরি নির্ধারণ করা এবং মহার্ঘ্য ভাতা চালু করা। ট্রেড ইউনিয়ন অধিকার নিশ্চিত করে শ্রমজীবী মানুষের অনুকূলে শ্রমনীতি ও শ্রম আইন প্রণয়ন করা। ৮. আমূল ভূমি সংস্কার করা। গ্রাম-শহর সর্বত্র জমির সিলিং করা।

সার-বীজসহ কৃষি উৎপাদন সহায়তা ও কৃষি পণ্যের লাভজনক মূল্য নিশ্চিত করতে কৃষি ভর্তুকি, হাট-বাজারে সরকারি ক্রয়কেন্দ্র খোলা। ক্ষেতমজুরদের রেজিস্ট্রেশন করাসহ কর্মসংস্থানের নিশ্চয়তা বিধান। এনজিও ও অন্যান্য খাত থেকে ক্ষুদ্রঋণ গ্রহীতার স্বার্থ সংরক্ষণের ব্যবস্থা ও আইন প্রণয়ন করা। ৯. গ্যাস-বিদ্যুৎ ও বিশুদ্ধ পানি সরবরাহ বৃদ্ধি নিশ্চিত করা, বাড়িভাড়া ও গাড়িভাড়া যুক্তিসঙ্গত পর্যায়ে আনা ও পরিবেশ দূষণসহ যাতায়াত সংকট দূর করা। রেল- নৌপথ সম্প্রসারণসহ গণপরিবহন ব্যবস্থা চালু করা।

১০. রাষ্ট্রীয় খরচে সকলের জন্য বৈষম্যহীন শিক্ষা এবং সকল নাগরিকের স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করা। ১১. মালিকানা জনগণেরÑ এই নীতির ভিত্তিতে জাতীয় সকল সম্পদ অনুসন্ধান, সংরক্ষণ ও ব্যবহার নিশ্চিত করা। ১২. বাংলাদেশকে সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধ চক্রান্ত ও আধিপত্যবাদী নিয়ন্ত্রণমুক্ত রাখা। জোট নিরপেক্ষ পররাষ্ট্রনীতি অনুসরণ করা। ১৩. রাষ্ট্র, সমাজ ও পরিবারের সর্বক্ষেত্রে নারী ও পুরুষের সম-অধিকার নিশ্চিতকরণ ১৪. আদিবাসী ও ক্ষুদ্র জাতিসত্তার সাংবিধানিক স্বীকৃতি প্রদান ও তাদের ন্যায্য অধিকার এবং ভাষা-সংস্কৃতির বিকাশ ঘটানো।

১৫. প্রকৃতি ও পরিবেশের বিপর্যয় রোধ, জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ এবং জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলা করা। এসব দাবির সঙ্গে কারো কারো কোনো অংশে দ্বিমত থাকতেই পারে। কিন্তু দাবিগুলো বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রটির মূলধারার চেতনার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ তা মানতেই হবে। প্রতিটি রাজৈতিক দলের ভেতরেই ঘাপটি মেরে বসে আছে কিছু লুটেরা শ্রেণী। তারা মনে করে নিজেদের সরকার ক্ষমতায় থাকতেই আখের গুছিয়ে নিতে হবে।

এজন্য এরা দেশ-জাতি-মানুষের স্বার্থকে মোটেই পাত্তা দেয় না। আসছে জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে এদের ব্যাপারে সতর্ক থাকা দরকার। ছাত্রলীগ কিংবা ছাত্রদলের কারা ভয়ঙ্কর চাঁদাবাজ- তা দলের সিনিয়রদের অজানা নয়। আর রগকাটা আল-বদর চক্রের দোসররা যখন কিছুই মানছে না- ওদের শায়েস্তা করতে হবে রাজনৈতিকভাবেই। সংসদীয় আসনের আগাম ভাগ-বাটোয়ারা করা ভালো।

তবে মনে রাখতে হবে, এ দেশের মানুষ পাঁচ বছর পর পর যে মৌলিক ভোটাধিকার পান, তা কাজে লাগাতে মোটেই অবিবেচক হন না। ---------------------------------------------------------------- দৈনিক ভোরের কাগজ / ঢাকা / শনিবার, ১৯ জানুয়ারি ২০১৩ ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.