আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

কাণ্ডজ্ঞানহীন পর্যটন পরিকল্পনা পশ্চিমবঙ্গে

পর্যটনশিল্পের উন্নয়ন এবং উপার্জনের ব্যাপক সম্ভাবনা রয়েছে পশ্চিমবঙ্গে। কিন্তু পরিবেশ সুরক্ষা বা অন্যান্য শর্তগুলো লঙ্ঘন করার লাইসেন্স তাতে মেলে না। কিছুদিন আগে ঘোষণা হয়েছে, আকাশপথে কলকাতা শহর দর্শনের গগনচুম্বি এক পরিকল্পনার কথা। রাজ্য পর্যটন উন্নয়ন নিগমের উদ্যোগে নাকি হেলিকপ্টার উড়বে কলকাতার আকাশে। আগে এ শহরের ধনী ব্যক্তিরা ঘোড়ায় টানা ফিটন গাড়িতে চড়ে গড়ের মাঠে হাওয়া খেতে যেতেন।

আর একালের বাবু-বিবিরা কয়েক হাজার টাকা খরচ করলেই হেলিকপ্টারে চড়ে শহরের মাথায় উড়ে উড়ে হাওয়া খেতে পারবেন।

এবার সেই হেলিকপ্টার পর্যটনের হাওয়া লাগল সুন্দরবনের গায়ে। সম্প্রতি রাজ্যের পর্যটনমন্ত্রী কৃষ্ণেন্দু নারায়ণ চৌধুরি ঘোষণা করেছেন, সুন্দরবনের ঝড়খালিতে তৈরি হবে বিলাসবহুল রিসোর্ট। অন্তত তিন তারকা খচিত সেই পর্যটন কেন্দ্রে আরো নানা আমোদের পাশাপাশি থাকবে হেলিকপ্টারে চড়ে আকাশপথে সুন্দরবন দেখার ব্যবস্থা। পরিবেশ যদি বিঘ্নিত হয় ওই এলাকায় হেলিকপ্টার উড়লে, বা বন্যপ্রাণীরা যদি বিরক্ত হয় – এমনতর সব সম্ভাবনা হেলায় উড়িয়ে দিয়েছেন মন্ত্রীমশাই৷ তিনি আত্মবিশ্বাসী, যে পরিবেশ দপ্তর তাদের সব আকাশকুসুম পরিকল্পনায় একবাক্যে সায় জানাবে।

ঠিক কী হতে পারে সত্যিই ঝড়খালিতে হেলিকপ্টার উড়লে? তার আগে চট করে একবার দেখে নেয়া যাক, এই ঝড়খালি জায়গাটি ঠিক কেমন। সুন্দরবনের যেকটি প্রত্যন্ত অরণ্য অঞ্চল যাতায়াতের আয়ত্বে আছে, ঝড়খালি তাদের মধ্যে একটি হলেও এখানে প্রকৃতিকে মানব সভ্যতার উৎপাত এখনো সেভাবে সহ্য করতে হয়নি। তার একটা কারণ অবশ্যই ঝড়খালির দুর্গমতা। মাতলা, বিদ্যেধরী এবং হেড়োভাঙ্গা – এই তিন নদী তিন দিক থেকে ঝড়খালিকে আগলে আছে৷ এর আগে ঝড়খালিতে বাণিজ্যিক তৎপরতা বলতে একমাত্র হয়েছে মাছ চাষ, যা সবদিক দিয়েই সুন্দরবনের প্রাকৃতিক পরিবেশের সঙ্গে মানানসই।

প্রায় ১৫ বিঘা জলাজমি আছে ঝড়খালিতে, যা মাছচাষের, বিশেষ করে চিংড়ি মাছ চাষের উপযুক্ত প্রাকৃতিক ক্ষেত্র গড়ে দিয়েছে।

কিন্তু মানুষের লোভ আরও বেশি। ওই ১৫ বিঘা জলাজমি বুজিয়ে তার ওপর তারকা-খচিত রিজর্ট গড়ে তোলার কথা ভেবেছে সরকার, কোনও বেসরকারি লগ্নিকারের সঙ্গে যৌথ উদ্যোগে। পশ্চিমবঙ্গের মূল ভূখণ্ড থেকে সেই রিজর্টে যাবেন পর্যটকরা, তার জন্যে ওই পাবলিক-প্রাইভেট পার্টনারশিপ, অর্থাৎ তথাকথিত 'পিপিপি' মডেলেই ঝড়খালি যাতায়াত করবে বিলাসবহুল ক্রুজ লাইনার। আন্দাজ করাই যায় যে, চলতি স্টিমার বা লঞ্চে যাতায়াত করাটা বিত্তবান পর্যটকদের পোষাবে না।

পর্যটনমন্ত্রী অবশ্য বিতর্ক এড়াতে আগাম বলে দিয়েছেন, সাধারণ মধ্যবিত্ত পর্যটকদের জন্য বাজেট-বন্ধু বন্দোবস্তও থাকবে ওই তারা মার্কা রিজর্টে৷ এবং থাকবে হেলিকপ্টার! কিন্তু শুনেই প্রমাদ গুণেছেন বন্যপ্রাণ বিশেষজ্ঞরা।

কারণ বেচারা হরিণ, বানর, বুনো শুয়োর, এমনকি রয়েল বেঙ্গল টাইগারও এত পর্যটনের উন্নয়ন বা পশ্চিমবঙ্গের আর্থিক সমৃদ্ধির মারপ্যাঁচ বোঝে না। তারা স্রেফ জঙ্গলে, নিজেদের জায়গায় শান্তিতে থাকতে চায়। কিন্তু হেলিকপ্টারের উৎকট আওয়াজে তাদের সেই শান্তি নষ্ট হবে এবং কিছুদিনের মধ্যেই তারা পশ্চিমবঙ্গের সুন্দরবনের দিক থেকে চলে যাবে বাংলাদেশের সুন্দরবনের দিকে, আর হয়ত ফিরবে না।

তবে সুন্দরবনের আরো বেশি বাঘ এবং অন্যান্য বন্যপ্রাণী বাংলাদেশের দিকে চলে যাবে, এতে যতটা খুশি হওয়ার কথা, তা কিন্তু বাংলাদেশ হবে না। কারণ ওই সুন্দরবন অঞ্চলে ভারত এবং বাংলাদেশ এক আন্তর্জাতিক জল ও আকাশসীমার নিয়মনীতি মেনে চলে, কোনো খুশিয়াল পর্যটকের ফূর্তির খাতিরেই যেটা লঙ্ঘন করা যায় না।

পররাষ্ট্র সম্পর্ক বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এটাই সবথেকে বড় সমস্যার জায়গা হবে। কারণ, হেলিকপ্টারে চড়ে কেউ হাওয়া খাবে বলে আকাশসীমা পেরিয়ে বার বার অনুপ্রবেশ হবে, এটা কোনও দেশ মেনে নেবে না। সেক্ষেত্রে প্রতিবার উড়ানের আগে বাংলাদেশের এয়ার ট্রাফিক কন্ট্রোলের অনুমতি লাগবে, যেটা আদৌ বাস্তবসম্মত নয়।

ফলে সুন্দরবনের আকাশে শেষ পর্যন্ত হয়ত হেলিকপ্টার উড়বে না। যুক্তিসঙ্গত কারণেই উড়বে না, আর সেজন্য দুই পা তুলে আশীর্বাদ করবে সুন্দরবনের যাবতীয় বন্যপ্রাণী।

সোর্স: http://www.bd-pratidin.com/

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।