আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

গল্পঃ সম্রাট শাহজাহান-১

সময়ের সমুদ্রের পার--- কালকের ভোর আর আজকের এই অন্ধকার

১ কাক ডাকা ভোরে আমাকে জাগানো হল। আমার কাছে কাক ডাকা ভোর সকাল দশটা। আমি চোখ মেলে তাকালাম। লম্বা একটা কাক আমাকে জাগিয়েছে। কাকের সাইজ এতো বিশাল হতে পারে আমার ধারনা ছিল না।

চোখ কচলে ভালো করে কাক-দর্শন করলাম। খাটের পাশে কাক-পক্ষী নয়, আমার স্ত্রী মীরা দাঁড়িয়ে আছে। কাকের মত কুঁচকুচে কালো রঙের একটা শাড়ী পরেছে। শুভ্র দেবী মীরার পরনের কালো শাড়ীটা দারুন লাগছে। আমি ভ্রু কুঁচকে লক্ষ্য করলাম, মীরার ফর্সা লাল গালে একটা টিকটিকি বসে আছে ।

কাক ডাকা ভোরে গালে করে টিকটিকি বয়ে বেড়ানোর মানে কি? এই মেয়ে কি এখন টিকটিকি পুষছে? পুষতেও পারে। যে জাতি পুরুষ জাতিটাকে সারাক্ষন বগলদাবা করে রাখতে পারে, সেখানে একটা টিকটিকি ঘাটের মড়া। আশ্চর্য! টিকিটিকিটা কোমর দোলাচ্ছে। ডানে বামে দোলাচ্ছে। দ্বিতীয়বারের মত চোঁখ কঁচলালাম।

ভালো করে লক্ষ্য করে বুঝলাম, গালে টিকটিকি নয়। সূর্যের আঁলো জানালা গলে সরাসরি মীরার গালে পড়েছে। জানালার গ্রীলের লতানো ফুল গাছটার একটা পাতার ছায়া পড়েছে গালে। অবিকল টিকটিকির মতো। বাতাসে পাতা নড়ছে।

পাতার সাথে তার ছায়াও নড়ছে। কাক ডাকা ভোরে ঘুম ভাঙ্গিয়ে মারাত্মক অপরাধ করেছে আমার স্ত্রী। আলাদীনের দৈত্য যদি একটা ইচ্ছা পুরন করে, আমি একটা সুন্দর প্রাসাদ চাইব। প্রাসাদের একপাশে থাকবে বিশাল জঙ্গল, আরেকপাশে থাকবে পদ্মপুকুর। লাল লাল পদ্মে পুকুর ছেয়ে যাবে।

গ্রীষ্মের তাপে মনে হবে পুকুরের পানিতে আগুন ধরে গেছে। মাঝ পুকুরে থাকবে বাঁশের চাটাই দিয়ে বোঁনা টং। আমি টং এ শুয়ে শুয়ে সারাদিন ঘুমাব। পাশে একজন কাজের লোক বসে থাকবে । তার কাজ হবে ছোট ছোট পাথরের টুকরা দিয়ে পুকুরের পানিতে ঢিল ছোড়া।

ঢিল ছোড়ার তালে তালে পানিতে টুপটুপ শব্দ হবে। টুপটুপ শব্দ সাথে নিয়ে ঘুমাব। ঘুমের মাঝেও স্বপ্ন দেখব টুপটুপ করা কোন পরিবেশের। আহারে! কি মায়াময় পরিবেশ! আলাদীন মার্কা ঘুমটা ভাঙ্গিয়ে মীরা এখন অপরাধী অপরাধী ভঙ্গীতে দাঁড়িয়ে আছে। নিচের ঠোঁটটাতে দাঁত দিয়ে কামড়ে ধরে আছে।

যেকোন মুহুর্তে ঠোট কেটে দাঁতগুলো ঢুকে যেতে পারে। অসম্ভব কিছু না। এই মেয়ে অতীতেও এইরকম মারাত্মক ঘটনা ঘটিয়েছে। একবার মীরা আমাকে রাত তিনটায় জাগাল। প্রচন্ড বিরক্তি নিয়ে বললাম, ‘এতো রাতে বিরক্ত করছ কেন?’ মীরা অপরাধী অপরাধী ভঙ্গীতে বলল, ‘আমার কেমন যেন করছে।

’ আমি নিস্পৃহ ভঙ্গীতে বললাম, ‘কোথায়?’ ‘কোথাও না। ঘুমাও। ’ এক হাড়ী বিরক্তি নিয়ে বললাম, ‘মাঝরাতে ঘুম থেকে টেনে তুলে বলছ ঘুমাও? এটা কেমন ব্যবহার? আদব-কায়দা কিছু শেখ নি? ছোট বেলায় সিপারা-কোরান পড়নি?’ ‘পড়েছি। ‘না পড়নি। পড়লে আদব-কায়দা কিছু শিখতে।

’ ‘খারাপ লাগছে বলেই তো ডেকে ওঠালাম। ’ ‘খারাপ লাগলেই মাঝরাতে ডেকে ওঠানোর কিছু নেই। ’ মীরা প্রচন্ড মন খারাপ করে বলল, ‘আচ্ছা ঘুমাও। আর কখনো ডাকব না। ’ ‘তা কি করে হয়? এমনিতে নিশ্চয় ডাকো নি।

কাজের জন্যই ডেকেছ। তাই সিদ্ধান্ত নিয়েছি এখন আর ঘুমাব না। কিচেনে যদি লেবু থাকে, এক গ্লাস ঠান্ডা লেবু শরবত করে আনো। খাব। ঘুম ভাঙিয়েছ এটা তার শাস্তি।

গ্লাসে এক মুঠো গুড় ছেড়ে দিবে। আমার বাবার চিনি কেনার সামর্থ ছিল না। তাই আমার মা আমাকে গুড়ের শরবত খাওয়াত। তুমি খাওয়াবে লেবু সহ গুড়ের শরবত। পারফরমেন্সে মার চাইতে অন্তত কিছুটা এগিয়ে থাকবে।

’ মীরার মন ভালো হয়ে গেল। চোখে হাজার ওয়াটের লাইট ঝিলিক মারল। প্রবল উৎসাহে নিয়ে এক গ্লাস ঠান্ডা লেবু-গুড় শরবত বানিয়ে আনল। এসে দেখে আমি ঘুমিয়ে গেছি। লজ্জায় মীরা ঘুমাতে পারল না।

ভোরবেলা পর্যন্ত সে গ্লাস হাতে বসে থাকল। আমি জেগে উঠে বিরক্ত হয়ে বললাম, ‘সারারাত জেগে ছিলে?’ ‘হুম। ’ ‘জেগে থাকার কিছু নাই। বায়োজিদ বোস্তামীর খোলস গায়ে দিয়ে সং সাজা আমি একদম পছন্দ করি না। ’ মীরা অপরাধী অপরাধী ভঙ্গীতে ঠোটে ঠোঁট চেপে বসেই রইল।

আমি আবার ঘুমিয়ে পড়লাম। ঘুম ভাঙ্গল দুপর একটায়। উঠে দেখি মীরার ঠোঁট কেটে রক্তারক্তি অবস্থা। জিজ্ঞাসা করি কিভাবে কাটল, কিছু বলে না। মারাত্মক আত্ম-কেন্দ্রিক মেয়ে।

পেটের মধ্যে বোমা ফাটালেও মনের কষ্ট প্রকাশ করবে না। মনের কষ্ট মনেই মরে, মুখে শুধু মধু ঝরে টাইপ। আজকে তাকে মাফ করে দিলাম। ঠোঁট কেটে রক্তা-রক্তি দৃশ্য সহ্য করার ক্ষমতা কোন পুরুষ মানুষকে দেওয়া হয় নি। আমিও তার বাইরে নই।

আমি তাকে হাত ধরে বিছানায় বসালাম। ফিসফিস করে বললাম, ‘চেঙ্গিস খানকে চেন?’ মীরা ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে রইল। আমি সব কিছুতেই জ্ঞানী জ্ঞানী ভাব দেখাই। মীরা সেটা সহ্য করতে পারে না। আমি তার ভ্রু কুঁচকানোকে উপেক্ষা করলাম।

আইনস্টাইন টাইপের একটা ভাব নিয়ে বললাম, ‘ইনি নিষ্ঠুরটার জন্য ইতিহাসের সেরা যোদ্ধা। প্রতিপক্ষ্যের রাজ্যে হামলা করে পুরুষ ও নারীদের মাথা কেটে ফেলত। কাঁটা মাথাগুলো দিয়ে শহরের প্রবেশদ্বারে একটা করে পিরামিড বানিয়ে রাখত। কাঁটা মস্তক দিয়ে তৈরি পিরামিড গুলোর উচ্চতা ছিল নিষ্ঠুরতার সীমা। যাও একগ্লাস ঠান্ডা লেবু-গুড় শরবত আনো।

’ মীরা রান্নাঘরে যাচ্ছে। আমি পেছন থেকে বললাম, ‘ভোর বেলা আমার ঘুম ভাঙ্গানো আর চেঙ্গিস খানকে দিয়ে পা টিপে নেওয়া সমান অপরাধ। ’ আমার স্ত্রী একটা হাঁসি দিল। বিশেষ বিশেষ দিবসে সে এই হাসিটা দেয়। বিশেষ হাসিটা দিয়ে বলল, ‘বসার ঘরে একজন সাক্ষাতপ্রার্থী।

যাও চেঙ্গিস খানের ইতিহাসটা তাকে বল। আমার চাইতে তার শোনা বেশী দরকার। ’ ৩ প্রচন্ড বিরক্তি নিয়ে বসে আছি। আমার সামনের সোফাতে একজন অপরিচিত লোক। হাত-পা ছড়িয়ে বসে আছে।

হাত-পা ছড়ানোর ভঙ্গিমা বলে দিচ্ছে এই মানুষটাকে আমার চেনা উচিৎ। না চেনা মারাত্মক অপরাধ বলে বিবেচিত হবে। কি আশ্চর্য! আমি চিনতে পারছি না। মস্তিষ্কের অলি-গলিতে কিছুক্ষন ঘোরাঘুরি করলাম। লাভ হলো না।

এই লোককে নিয়ে আমার মস্তিষ্কে কোন জমানো স্মৃতি নেই। ইনি সম্পুর্ন অপরিচিত মানুষ। লোকটির পরনে সাদা পাঞ্জাবী। পাঞ্জাবীর গলার কাছে এমব্রয়ডারি করে একটা সাপের নকশা করা। দূর থেকে দেখলে মনে হচ্ছে একটা সাপ গলায় ঝুলিয়ে বসে আছেন।

অনাড়ী দর্জি সাপের চেহারা পুরোপুরি বানাতে পারে নি। সাপের পেটের কাছটা বিদঘুটেভাবে মোটা হয়েছে। গোখরা সাপ বানাতে গিয়ে গুঁই সাপ বানিয়ে ফেলেছে। আশ্চর্যভাবে, গুঁইসাপটাও লোকটাকে মানিয়েছে। গোখরা হয়ে গেলে মনে হয় মানাত না।

খাপছাড়া খাপছাড়া লাগত। লোকটার হাতে একটা সোনার তৈরী পানের কৌটা। কৌটায় উচ্চ রুচি সম্পন্ন কারুকার্য করা। মোঘলাই টাইপ কারুকাজ। মোঘল সম্রাটরা মনে হয় এরকম কৌটায় পান রাখত।

লোকটির চেহারার মধ্যেও একটা মোঘলাই মোঘলাই ভাব আছে। সম্রাট শাহজাহান টাইপ ভাব। গলায় গুঁইসাপ ঝুলিয়ে হাতে সোনার কৌটায় পান নিয়ে সম্রাট শাহজাহান বসে আছেন। সম্রাট বধু মমতাজ এই দৃশ্য দেখলে নির্ঘাত হার্ট ফেল করতেন। মোঘল সম্রাট শাহজাহানের পানের পিক চিবুক গড়িয়ে পরনের পাঞ্জাবীতে পড়ছে।

সাদা পাঞ্জাবী লাল হয়ে যাচ্ছে, তাতে ভদ্রলোকের ভ্রুক্ষেপ নেই। মোঘল সম্রাটরা পান খাবেন। পানের পিক কোথায় পড়বে সেই খোঁজ রাখবেন না। সম্রাটের পান খাওয়ার ধরনেও একটা বিশেষত্ব আছে। মানুষ কাঁচা পানপাতা কচকচ করে চিবিয়ে খায়।

কিন্তু সম্রাট শাহজাহান চিবিয়ে খাচ্ছেন না। গপগপ করে গিলে খাচ্ছেন। গপগপ করে মানুষ ভাতের নলা মুখে পোরে। ইনি পুরছেন পানের খিলি। সম্রাট শাহজাহানকে আমার বিদঘুটে চিড়িয়া মনে হচ্ছে।

আমি চাই না আমার ব্যক্তিগত জগতে সে ঢুকে যাক। বাসার প্রত্যেকটা আসবাবপত্র আমার কাছে ব্যক্তিগত জগত। ছোট্ট একটা ফ্লাটে একজন দেবীর মতো স্ত্রীকে নিয়ে থাকি। আমার সমগ্র ধ্যান-জ্ঞান স্ত্রী মীরা। মীরার ধ্যান-জ্ঞান রিশান।

সম্পুর্ন অপরিচিত ছেলেটা আমার স্ত্রীর ভালোবাসাকে বিভক্ত করেছে। মাঝে মাঝে মনে হয় মীরা রিশানকে আমার চাইতেও বেশী ভালোবাসে। একদিন আমিও অবাক বিস্ময়ে লক্ষ্য করি, রিশান ছেলে হিসাবে মন্দ না। আমিও তাকে পছন্দ করে ফেলেছি। এতটুকুই আমার জগত।

ছোট্ট একটা সুখী সুখী ত্রিভুজ প্রেমে মত্ত আমরা। আমি ত্রিভুজের আশেপাশে কাউকে ভীড়তে দেই না। আজিব চিড়িয়াও এর বাইরে নয়। সম্রাট শাহজাহানকে শুরুতেই বিদায় করতে হবে। না গেলে প্রয়োজনে ঝাড়ু পেটা করতে হবে।

একজন সম্রাট ঝাড়ুপেটা কিভাবে নিবে বোঝা যাচ্ছে না। সম্রাট শাহজাহানকে প্রথম কথা, ‘এখন ব্যস্ত আছি। চলে যান। ’ লোকটি হাসিমুখে জবাব দিল, ‘স্যার, কিঞ্চিত সময় থাকতে অনুমতি চাই। ’ ‘দুঃখিত অনুমতি দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না।

পারিবারিকভাবে সমস্যার মধ্য দিয়ে যাচ্ছি। আরেকদিন আসুন। চলে যান। ’ ‘আপাতত যাচ্ছি না স্যার। ’ সম্রাট শাহজাহানের ‘না’ কথার মাঝে বিচিত্র কারনে একটা শক্তি লক্ষ্য করলাম।

ভেতরে ভেতরে চমকে গেলাম। চঁমকানোর ভাব প্রকাশ করা যাবে না। এখন সোফায় চেপে আছে। দুর্বলতা টের পেলে আমার ঘাড়ে চাপবে। চাপাচাপির প্রথম অংশ থেকেই বিদায় করতে হবে।

ঘাড়ে চাপার সুযোগ দেওয়া যাবে না। আমি কুঁচকানো ভ্রু আরো কুঁচকিয়ে ফেললাম। জানতে চাইলাম, ‘কেন এসেছেন?’ ‘একখান গল্প বলতে এসেছি। মারাত্মক একখান গল্প। ’ আমি বিরক্তির সাথে বললাম, ‘আমি গল্প-টল্প একদম পছন্দ করি না।

আপাতত হার্ট এটাকের রিস্ক জোনে আছি। একখান গল্প মারাত্মক হলে আরো বিপদ। গোদের উপর ক্যান্সার। ’ লোকটি পিচিক করে মেঝেতে পিচকিরি ফেলল। আমার চমকে ওঠার কথা।

বিচিত্র কারনে আমি চমকালাম না। মীরা এই দৃশ্য দেখলে চেঁচামেচি করে বাড়ী মাথায় তুলবে। কেয়ামত ঘটাবে। দূর দৃষ্টিতে একটা মিনি কেয়ামতের রিহার্সেল দেখতে পাচ্ছি। মিনি কেয়ামত ধেঁয়ে আসছে।

আলোর গতিতে। সম্রাট শাহজাহান কিছুই হয় নি ভঙ্গিতে আবার পা দোঁলানো শুরু করল। মারাত্মক সম্রাট। এই না হলে জাহাঙ্গীরের বেটা, আওরঙ্গজেবের বাপ। একটা ঘরোয়া কেয়ামতের আলামত সৃষ্টি করেও নিস্পৃহ আছে।

বিশাল ক্ষমতা। আমাকেও নিস্পৃহতা শিখতে হবে। আমি সম্রাট শাহজাহানকে পছন্দ করে ফেললাম। ‘গোস্তাগী মাফ করবেন’ টাইপ শ্রদ্ধার সাথে বললাম, ‘কি বলতে এসেছে বলুন। বিষয়বস্তু আঁটসাঁট করবেন।

আরব্য রজনীর রুপকথা আমি পছন্দ করি না। মারাত্মক গল্পখান বলেই ভাগবেন। ’ সম্রাট শাহজাহান অদ্ভুত একটা হাঁসি দিল। এর অর্থ হতে পারে ‘যাবা কও মিয়া ভাই, আজ কইল রেহাই নাই’।


সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।