আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

সেদিন ট্রেনে

আজও নিজের মাঝে অসাধারণতার ছাপ খুঁজে বেড়াই কিন্তু প্রতিবারই নিজেকে খুব সাধারণরূপে আবিষ্কার করি। মন্দ কি...ভালই তো আছি।
ভোর ৫ টা। বাইরে প্রচন্ড কুত্তা বিলাই বৃষ্টি হচ্ছে আই মিন 'ইট রেইন্স কেটস এন্ড ডগস' এরকম বহুল কাঙ্ক্ষিত সকালে ঘুমের সাথে তৃপ্তির সহবাসের আগমনি ডাকে সাড়া না দিয়ে যদি পেরার শহর ঢাকার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হওয়ার জন্য ঢুলুঢুলু চোখে দাঁত ব্রাশ করতে হয় তখন নিশ্চই 'কি আছে জীবনে' টাইপ আক্ষেপের চাইতে বেশি কিছুই করার থাকে না। খুব কসরত করে একটা ইজি বাইক ডেকে বাসার সামনে দাঁড় করালাম।

আর দেরি না করে আমার জ্বালায় অতিষ্ট আমার স্নেহময়ী মা জননীকে মন খারাপের বিদায় জানিয়ে বেরসিক 'এগারসিন্দুর এক্সপেস' ধরার মনোবাসনা নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম। অবাধ্য বৃষ্টির কয়েকটি ফোঁটা যেন যেচে এসে আমাকে ভিজিয়ে দিয়ে যাচ্ছে! আগে থেকে টিকিট করা ছিল না বিধায় জীবনে প্রথমবারের মত উপলব্ধি করলাম শ্বশুর হিসেবে একজন স্টেশনমাস্টার জুটলে নেহায়াত মন্দ হত না। শোভন চেয়ার কোচ শেষ হয়ে যাওয়ায় উস্তাদকে অনেক পামপট্টী মেরে 'ঠ' নাম্বার কামরার বাথরুমের পাশের সিটখানা নিয়েই সন্তুষ্ট থাকতে হল জানালার পাশে হওয়ায় তবুও কিছুটা রক্ষা। ডাবল প্যাসেঞ্জারেরে সিটটা তখনো ফাঁকা। বেশ আয়েশ করেই গিয়ে বসে পড়লাম।

ততক্ষণে গগনবিদারী হুইসেল শুনিয়ে কচ্ছপ গতিতে ট্রেন চলতে শুরু করেছে। কিছু সময় পরেই একজন এসে জিজ্ঞাস করল 'ভাই বসতে পারি?' মনে বুঝলাম বেচারার টিকিট নাই। একটু পোদ্দারি ভাব নিয়েই বললাম 'ওহ শিউর বসুন না প্লিজ। ' ভাইজান রাজ্য বিজয়ের এক হাসি দিয়ে পান চিবুতে চিবুতে পাশে বসে পড়লেন। শুরু হল উনার সাথে টুকটাক কথাবার্তা।

নাহ উনি লোক কিন্তু মন্দ নয়। বরং আমাদের মত মানুষদের চেয়ে ঢের বেশি আন্তরিক। নিজে পড়ালেখা শেখেন নি বিধায় চেহারায় একটা আক্ষেপের ছাপ ফুটিয়ে আমাকে অতিরিক্ত উচ্চতায় বসানোর চেষ্টায় তার অতিরঞ্জিত শব্দগুলো আমার নামের সামনে পিছনে জুড়ে দিতে লাগলেন যাতে আমি যার পর নাই বিব্রতবোধ করতে থাকি। উনার সম্পর্কে যতটুকু জানা হল তাতে উনি একজন চালের ব্যবসায়ী। ভৈরব বাজারে উনার চালের আড়ত।

তাই প্রতিদিনই ভোর সকালে বাজিতপুর থেকে এই ট্রেনে চেপে ভৈরবের দিকে যাত্রা করেন। বাড়িতে অসুস্থ মা। তাই নানা ঝুঁটঝামেলা সত্ত্বেও পরিবার পরিজন নিয়ে বাড়িতেই থাকা হয়। একমাত্র ছোট ভাইটিকে ঢাকার তিতুমীর কলেজে পড়াচ্ছেন। ক্লাস এইটে পড়ার সময় মর্মান্তিক এক সড়ক দুর্ঘটনায় বাবা মারা যাওয়ায় হাতের বই ফেলে তখনই সংসারের ভার কাঁধে তুলে নিয়েছেন।

আমি কেবল মনকে বলি বাস্তবতা কত কঠিন। তবে তার কঠোরতা পরিমাপ করতে গিয়ে প্রতিবারই তালঘোল পাকিয়ে ফেলি...চরমভাবে ব্যর্থ হই। কথা বলতে বলতেই ট্রেন গচিহাটা স্টেশনে এসে থামল। গা শিউরে উঠা এক ঝাঁকুনিতে নড়েচড়ে বসলাম। কিছুক্ষণ বাদেই দেখলাম এক ভদ্রলোক উঠল সাথে এক লোক উনার ব্রিফকেইস হাতে দাঁড়িয়ে।

আমার পাশে এসে দাঁড়িয়েই ব্রিফকেইস হাতে দাঁড়িয়ে থাকা লোকটিকে উদ্দেশ্য করে বললেন 'ইচ্ছে করলে অবশ্য বসাই যায়' তারপর আমাকে জিজ্ঞাস করলেন 'এখানে কেউ আছে আপনার' প্রথম কথাটি শোনেই মেজাজ খারাপ হয়ে গেল। উত্তরে হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়লাম। বেশি হবে না। তার দশ মিনিট পরেই আবার আমাকে উদ্দেশ্য করে, - কি আপনার লোক কোথায়? - আমার লোক যেখানেই থাক আপনি দেখতে পাচ্ছেন না এখানে দুইজন বসে আছি! - আপনি এভাবে সিট দখল করে রাখতে পারেন না। - আরে আজব তো? আপনার কি মনে হয় আমি টিকিট ছাড়াই বসে আছি? তাছাড়া এটা যে দুইজনের সিট আপনি দেখতে পাচ্ছেন না? তারপরও কিভাবে বলেন 'ইচ্ছে করলেই অবশ্য বসা যায়!!' - আপনি তো আইনের কথা বলছেন।

মানবিকতাবোধ বলতে কিছু জানেন? - এক্সকিউজ মি আংকেল! আমি এই মুহূর্তে আপনার কাছ থেকে মানবিকতা শিখতে বাধ্য নই। - আচ্ছা ভাই আসেন চাপাচাপি করে বসে পড়ুন (পাশের লোকটি বলে উঠলেন) - না থাক আপনাদের মত লোকদের সাথে না বসলেও চলবে। বয়স পঞ্চাশ (যদিও একদম মনে হয়নি) হলেও গায়ে যথেষ্ট শক্তি আছে। তারপরই ভদ্রলোক (এরপরে ভদ্রলোক সম্বোধন করা কতটুকু সমীচীন তা নিয়ে যথেষ্ট সন্ধিহান) কমপার্টমেন্ট ভরতি মানুষজনের সামনে বেফাঁস উল্টাপাল্টা বকতে শুরু করলেন। "এই প্রজন্মের পোলাপানকে কি বলবেন? এইগুলি চরম মাত্রায় বেআদব।

সারাদিন নেশাগাঁজা খেয়ে পরে থাকে। এরা মানবিকতাবোধের বুঝবে টা কি! এখন কি দেখছেন সামনে তো আরও ভয়ংকর দিন আসতেছে" ইত্যাদি ইত্যাদি। আমি আর ভ্রুক্ষেপ না করে পকেট থেকে ফোন বের করে কানে হেডফোন গুজে দিয়ে গান শোনা শুরু করে দিলাম। পাগলা দেখি আরও তেলেবেগুনে জ্বলে উঠছে সামনের ষ্টেশনে ট্রেন থামল। ততক্ষণে বেশ খিদা লেগে গেছে।

নিচে নেমে পাউরুটি, কলা আর এক বোতল ঠান্ডা পানি নিয়ে আসলাম। খাচ্ছি হটাতই খেয়াল করলাম সামনের মেঝেতে কোলে বসে থাকা বাচ্চাটি বারবার এদিকে আঙ্গুল দিয়ে ইশারা করে মাকে খুব বিরক্ত করছে। আমি এক মুহূর্তে ভেবে দুইটি কলা আর দুই পিস পাউরুটি সামনে এগিয়ে দিলাম। মহিলাটি খুব লজ্জিত হাসি ফুটিয়ে হাত বাড়িয়ে দিলেন। পাশেই টিফিন বক্স বের করে শাহী খাবার চিবুতে থাকা মানবিকতার বাচ্চার মুখে বিশেষ পরিবর্তন লক্ষ করলাম।

এরপর কি আর আমার সামনে দাঁড়িয়ে থাকার সাহস করে! হনহন করে অন্য কামরায় ছুটে গেল। আমি পাশে বসা ভাইটির দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসলাম। উনিও ততক্ষণে কেইস বুঝে গেছেন। আমার কাঁধে হাত রেখে হাস্যজ্জল ভঙ্গিতে বললেন 'ভাই কিছু মনে কইরেন না। এইরকম পাগল কিছিমের মানুষ সব জায়গায় কয়েকটা থাকেই।

' মোড়াল অফ দ্যা স্টোরিঃ শিক্ষিত মানুষ মাত্রই স্বশিক্ষিত নয়। মন্তব্যঃ তোদের মত মাথামোটা পেটলা সুশিলদের কাছ থেকে এর থেকে বেশি কিছুই আশা করা যায় না। পরিবর্তনটা 'নিন্দুকেরে বাসি আমি সবার থেকে ভাল' মন্ত্রে দীক্ষিত এই নষ্ট, নেশাখোর প্রজন্মের হাত ধরেই আসবে।
 

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.