আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

দুর্নীতি অনিয়মে স্থবির মিল্কভিটা দেড়শ কোটি টাকা আত্মসাৎ

সরকারি সমবায় প্রতিষ্ঠান মিল্কভিটা নজিরবিহীন অনিয়ম, দুর্নীতি ও স্বেচ্ছাচারিতায় স্থবির হয়ে আছে। যে প্রতিষ্ঠানটি জাতীয় গৌরব ও অহঙ্কারের অংশীদার হতে পারত অনিয়মে বিপর্যস্ত সেই প্রতিষ্ঠান কেবল পেছনের দিকে হাঁটছে। ভারতের বিশ্বখ্যাত 'আমূল'-এর দৃষ্টান্ত ধরে ১৯৭৩ সালে গড়ে তোলা মিল্ক ভিটা চার দশক শেষে এসে হতাশার ডালপালা বিস্তৃত করছে। অন্যদিকে গত কয়েক বছরে বেসরকারি খাতের ডেইরি প্রতিষ্ঠানগুলো শত গুণে বিকশিত হয়েছে। মিল্ক ভিটার ব্যবস্থাপনা কমিটির অব্যবস্থাপনায় দুই দশক ধরে একই অবস্থানে আটকে আছে প্রতিষ্ঠানটি।

মিল্ক ভিটার তরল দুধ ক্রয়, প্রক্রিয়াজাতকরণ, বিপণন, প্লান্ট স্থাপন, নিয়োগ, পদোন্নতি সব ক্ষেত্রে সীমাহীন দুর্নীতি প্রতিষ্ঠানটির ভবিষ্যৎ বিপন্ন করে তুলেছে। প্রায় ১ লাখ সমবায়ী সদস্যের এ প্রতিষ্ঠানে দুগ্ধ খামারিরা পদে পদে বঞ্চনা ও হয়রানির শিকার হচ্ছে। ভোক্তা পর্যায়ে যে তরল দুধ ৫৮ টাকা লিটার বিক্রি হয় সেই দুধ উৎপাদককে বিক্রি করতে হয় মানভেদে ৩২ থেকে ৩৬ টাকা দামে। দুধ সংগ্রহ, পরিমাপ এবং ফ্যাট নির্ধারণ থেকে শুরু করে সংস্থার ক্রয়-বিক্রয় প্রতিটি ক্ষেত্রে অনিয়ম, লুটপাট অমিত সম্ভাবনাময় এ প্রতিষ্ঠানটিকে নিঃশেষ করে দিচ্ছে।

জনবল নিয়োগে দুর্নীতি : মিল্ক ভিটায় টাকা ছাড়া কোনো নিয়োগ হয় না।

এমনকি প্রার্থী সমবায়ী সদস্য হলেও টাকা দিতে হয়। মন্ত্রী-এমপিদের সুপারিশের পরও মোটা অঙ্কের টাকা গুনতে হয় চাকরি পেতে। জনবল নিয়োগের ক্ষেত্রে অনিয়ম ও দুর্নীতির দীর্ঘ ধারাবাহিকতা অনেক দিন ধরে চলে আসছে। মন্ত্রণালয়ের সুপারিশ ও ব্যবস্থাপনা কমিটির সন্তুষ্টি ছাড়া প্রতিষ্ঠানটিতে চাকরি হওয়ার সুযোগ নেই বললেই চলে। অস্থায়ী ভিত্তিতে নিয়োজিত পদগুলোর বিপরীতে বার বার এমন ঘটনা ঘটে।

সম্প্রতি মিল্ক ভিটায় প্রায় ৫০০ লোক নিয়োগে কোটি কোটি টাকার দুর্নীতি নিয়ে তোলপাড় চলছে। এরই মধ্যে মিল্ক ভিটায় তৃণমূল পর্যায়ে গবাদিপশু প্রজনন সহকারী পদে নিয়োগের নামে এবং মিল্ক ভিটায় বিভিন্ন কারখানায় অস্থায়ী শ্রমিক নিয়োগের নামে ভাইস চেয়ারম্যানের নেতৃত্বাধীন সিন্ডিকেট কয়েক কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। এ প্রক্রিয়ায় প্রায় ৫০০ জনকে নিয়োগ দেওয়ার চেষ্টা চলছে। চাকরি দেওয়ার পূর্বশর্ত হিসেবে প্রতিটি পদের বিপরীতে দুই থেকে সাড়ে তিন লাখ টাকা করে নেওয়া হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে।

বাজার হারাচ্ছে মিল্ক ভিটা, বেসরকারি ফার্মের বিস্তার : বহুমুখী অনিয়মে বছরের পর বছর মিল্ক ভিটার বাজার ক্রমেই কমছে।

অন্যদিকে বেসরকারি দুগ্ধ উৎপাদনকারীদের বাজার বিকশিত হচ্ছে। ২০০৫-০৬ অর্থবছরে একটি বেসরকারি ডেইরি প্রতিষ্ঠানের দৈনিক বিক্রি ছিল ৫ হাজার লিটার। ২০১১-১২ অর্থবছরে এসে সেই প্রতিষ্ঠানের দৈনিক বিক্রি বেড়ে দাঁড়িয়েছে প্রায় দেড় লাখ লিটার। অন্যদিকে ২০০৫-০৬ অর্থবছরে মিল্ক ভিটার বিক্রি ছিল ৭ কোটি ৭৬ লাখ লিটার। ৬ বছর পর ২০১১-১২ অর্থবছরে মিল্ক ভিটার উৎপাদন ও বিক্রি বাড়েনি।

বরং কমে গিয়ে তা দাঁড়িয়েছে ৭ কোটি ২৩ লাখ লিটারে।

দেড় শ কোটি টাকা আত্দসাৎ : মিল্ক ভিটায় যে যেভাবে পারছে লুটপাটে অংশ নিচ্ছে। এরই মধ্যে মিল্ক ভিটার প্রভিডেন্ড ফান্ডের প্রায় দেড় শ কোটি টাকা আত্দসাতের ঘটনা ধরা পড়ে। সম্প্রতি এ ঘটনার সঙ্গে জড়িত মিল্ক ভিটার সাবেক সহকারী ব্যবস্থাপক (অর্থ ও হিসাব) শহিদুজ্জামান খানের বিরুদ্ধে পৃথক ১০টি চার্জশিট দাখিলের অনুমোদন দেয় দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। শহিদুজ্জামান নিজ নামে তথ্য গোপন রেখে ভবিষ্য তহবিল থেকে ঋণ উত্তোলনের মাধ্যমে এবং মানি রিসিটের মাধ্যমে গ্রহণকৃত টাকা ব্যাংকে জমা না দিয়ে, এফডিআরের জন্য প্রস্তুতকৃত চেক পে-অর্ডার করে নিজ ও স্ত্রীর যৌথ নামে জিপিওতে জমা দেন।

তিনি ১৯৯৫ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত তিনটি ক্যাটাগরিতে অপরাধজনিত বিশ্বাসভঙ্গের মাধ্যমে মোট ১ কোটি ৪০ লাখ ৮৮ হাজার ৯৩৬ টাকা আত্দসাৎ করেন। তদন্ত কর্মকর্তার সুপারিশের ভিত্তিতে তার বিরুদ্ধে চার্জশিট দাখিলের অনুমোদন দেওয়া হয়েছে।

যেখানে দুধ নেই সেখানে প্লান্ট : অতীত সরকারগুলোর আমলে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রীরা প্রভাব বিস্তার করে নিজেদের এলাকায় মিল্ক ভিটার দুগ্ধ শীতলীকরণ প্লান্ট স্থাপন করে গেছেন। বিগত বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলে এলজিইডি মন্ত্রী প্রয়াত আবদুল মান্নান ভঁূইয়ার নির্বাচনী এলাকা শিবপুরে একটি প্লান্ট স্থাপন করা হয়। প্রতিমন্ত্রী জিয়াউল হক জিয়ার এলাকা লক্ষ্মীপুরের রায়পুরেও মিল্ক ভিটার একটি প্লান্ট স্থাপন করা হয়।

অথচ লক্ষ্মীপুরের রায়পুর উপজেলার ৬২টি দুগ্ধ খামারের মধ্যে ৪০টি এরই মধ্যে বন্ধ হয়ে গেছে। গোখাদ্য সংকট, খাদ্যের দাম বৃদ্ধি, পরিবহন সমস্যা ও দুধের মূল্য কমসহ বিভিন্ন সংকটের কারণে গত দুই বছরে এ খামারগুলো বন্ধ হয়ে যায়। বাকি ২২টি খামার লোকসানের মুখে থাকায় সেগুলোও বন্ধ হওয়ার পর্যায়ে রয়েছে। ফলে সংকটে পড়েছে স্থানীয় মিল্ক ভিটা। রায়পুরে ২০০২ সালে মিল্ক ভিটার দুগ্ধ শীলতলীকরণ কারখানার কার্যক্রম শুরু হয়।

এদিকে গত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলেও নোয়াখালীর সুবর্ণচরে দুটি প্লান্ট করা হয়েছে। কিন্তু সেখানে দুধ পাওয়া যাচ্ছে না। ময়মনসিংহ, গাজীপুর, চট্টগ্রামের পটিয়ায় স্থাপিত প্লান্টগুলোরও একই অবস্থা। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে স্থাপিত বরিশাল প্লান্ট এলাকায়ও পর্যাপ্ত দুধ না পাওয়ায় প্লান্টটি বন্ধ হয়ে গেছে।

হঠাৎ বন্ধ দুধ কেনা, বিপাকে খামারিরা : মাঝেমধ্যেই খবর বেরোয় রাস্তায় দুধ ঢেলে প্রতিবাদ করেন দুগ্ধ খামারিরা।

এর অন্যতম কারণ মিল্ক ভিটার দুধ কেনা বন্ধ থাকা। গত অর্থবছরে মিল্ক ভিটা খামারিদের কাছ থেকে ৪৬ দিন দুধ নেয়নি। ফলে তাদের অনেক কম দামে স্থানীয় বাজারে দুধ বিক্রি করতে হয়েছে। অনেকে দুধ বিক্রি করতে না পেরে রাস্তায় দুধ ঢেলে বাড়ি ফিরে গেছেন। মিল্ক ভিটার দুগ্ধ শীতলীকরণ মেশিনে ত্রুটি দেখা দেওয়ার অজুহাত দেখিয়ে তারা বিভিন্ন এলাকায় দিনের পর দিন দুধ কেনা বন্ধ রাখেন।

এতে ঋণের কিস্তি পরিশোধ এবং গরুর খাদ্য কিনতেও হিমশিম খান হতদরিদ্র খামারিরা।

অর্ধেক দামে কিনে দ্বিগুণ দামে বিক্রি : মিল্ক ভিটা দুগ্ধ খামারিদের কাছ থেকে প্রতি লিটার তরল দুধ মানভেদে ৩২-৩৫ টাকায় কেনে। কিন্তু বাজারে সে দুধ বিক্রি করা হয় ৫৮ টাকা লিটারে। আধা লিটারের দুই প্যাকেটে ৩২ টাকা করে প্রতি লিটারের দাম পড়ে ৬৪ টাকা। এমনকি ২৫০ গ্রামের চার প্যাকেটে ১৭ টাকা করে ১ লিটার দুধের দাম পড়ে ৬৮ টাকা।

এর পরও মিল্ক ভিটার দুধ নিরবচ্ছিন্নভাবে সরবরাহ পাওয়া যায় না। ঈদে কিংবা অন্য কোনো উৎসবে সে দুধই লিটারপ্রতি ১০-১৫ টাকা দাম বেড়ে যায়। মিল্ক ভিটার একশ্রেণীর কর্মচারী খুচরা বিক্রেতাদের কাছ থেকে বাড়তি টাকা নিয়ে দুধ সরবরাহ করে বলে অভিযোগ পাওয়া যায়। তবে গত ঈদে সে অভিযোগ কম শোনা গেছে। সূত্র জানায়, বাজার ব্যবস্থাপনায় মিল্ক ভিটার ব্যবস্থাপনা কমিটির লোকজন বিভিন্নভাবে প্রভাব বিস্তার করে।

মার্কেটিং কর্মীদের মোটরসাইকেল দেওয়া হয় ব্যবস্থাপনা কমিটির নেতাদের আত্দীয়স্বজন ও কাছের মানুষদের, যারা কখনই মার্কেটে যান না।

নির্বাচন নিয়ে সংশয় : মিল্ক ভিটার তিন বছর মেয়াদি ব্যবস্থাপনা কমিটি নির্বাচিত হয় দুগ্ধ উৎপাদনকারীদের প্রত্যক্ষ ভোটে। ১২ সদস্যের কমিটির আটজন নির্বাচিত, বাকিরা সরকার মনোনীত। সর্বশেষ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় ২০১১ সালের ৮ জানুয়ারি। সে হিসেবে আগামী ৭ জানুয়ারি এ কমিটির মেয়াদ শেষ হয়ে যাচ্ছে।

কিন্তু নির্বাচনের কোনো প্রক্রিয়ার মধ্যে নেই বর্তমান কমিটি। চলতি বছরের বার্ষিক সাধারণ সভাও (এজিএম) করা হয়নি। সমবায়ীদের দাবি, নির্ধারিত সময়ের মধ্যে নির্বাচন দিয়ে নতুন নেতৃত্বের মাধ্যমে মিল্ক ভিটা পরিচালক করা হোক। এসব বিষয়ে জানতে মিল্ক ভিটার চেয়ারম্যান হাসিব খানের ফোন নম্বরে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করেও তাকে পাওয়া যায়নি। মিল্ক ভিটার একজন সাবেক চেয়ারম্যান বলেন, দেশের মানুষের চাহিদা বিবেচনায় রেখে যে জাতীয় প্রতিষ্ঠানের সৃষ্টি হয়েছিল তা এখন লক্ষ্যচ্যুত হয়ে পড়েছে।

এটি এখন রাজনীতি প্রভাবিত অনিয়মের প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে।

 

 

সোর্স: http://www.bd-pratidin.com/

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.