আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

আলীমের বিরুদ্ধে গণহত্যাসহ আটটি অভিযোগ প্রমাণিত

বিএনপির নেতা ও সাবেক মন্ত্রী আবদুল আলীমের বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় প্রথম ১২টির মধ্যে হামলা, গণহত্যাসহ আটটি অভিযোগ প্রমাণিত হয়েছে। তৃতীয়, চতুর্থ, পঞ্চম ও ১১তম অভিযোগ প্রমাণ করতে ব্যর্থ হয়েছে রাষ্ট্রপক্ষ। এর মধ্যে চতুর্থ ও পঞ্চম অভিযোগে রাষ্ট্রপক্ষ কোনো সাক্ষী হাজির করতে পারেনি।
বিচারপতি ওবায়দুল হাসানের নেতৃত্বে তিন সদস্যের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২-এ বিচারকাজ চলছে। সকাল ১০টা ৫০ মিনিটে বিচারপতিরা ট্রাইব্যুনালে আসেন।


রায়ের পড়া শুরুর আগে ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান বিচারপতি ওবায়দুল হাসান বলেন, ‘আজ আলীমের বিরুদ্ধে মামলার রায় ঘোষণা করা হচ্ছে। রায়টি ১৯১ পৃষ্ঠার। তবে এটি সংক্ষিপ্ত আকারে পড়া হবে। ’
ট্রাইব্যুনালে উপস্থিত অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলমের মাধ্যমে অন্যান্য আইনজীবীকে উদ্দেশ করে বিচারপতি ওবায়দুল হাসান বলেন, ‘সম্পূর্ণ রায় না পড়ে মনগড়া মন্তব্য করবেন না। এটা আইনের শাসনের জন্য ক্ষতিকর।


এরপর রায়ের প্রথম অংশ পড়েন বিচারপতি মো. শাহিনুর ইসলাম। বর্তমানে রায়ের দ্বিতীয় অংশ পড়ছেন বিচারপতি মো. মজিবুর রহমান মিয়া। চূড়ান্ত অংশ পড়বেন ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান বিচারপতি ওবায়দুল হাসান। এটি হবে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলার অষ্টম এবং আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২-এর পঞ্চম রায়।
সকাল ১০টা ৩৫ মিনিটে আবদুল আলীমকে ট্রাইব্যুনালের হাজতখানা থেকে আসামির কাঠগড়ায় আনা হয়।

ট্রাইব্যুনালে আবদুল আলীমের পরিবারের পক্ষ থেকে তাঁর দুই ছেলে সাজ্জাদ বিন আলীম ও খালিদ বিন আলীম উপস্থিত আছেন।

এর আগে সকাল পৌনে ১০টার দিকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রিজন সেল থেকে আবদুল আলীমকে অ্যাম্বুলেন্সে করে ট্রাইব্যুনালে আনা হয়।

আজ রায় ঘোষণাকে কেন্দ্র করে ট্রাইব্যুনাল এলাকায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অতিরিক্ত সদস্য মোতায়েন করা হয়েছে। এ ছাড়া সতর্ক অবস্থানে রয়েছে সাঁজোয়া যান। সংশ্লিষ্টদের পরিচয় নিশ্চিত ও তল্লাশি করে ট্রাইব্যুনালে প্রবেশ করতে দেওয়া হচ্ছে।

বিচারপতি ওবায়দুল হাসানের নেতৃত্বাধীন তিন সদস্যের ট্রাইব্যুনাল-২ গতকাল মঙ্গলবার আবদুল আলীমের রায়ের দিন ধার্য করে আদেশ দেন।

 গত ২২ সেপ্টেম্বর এই মামলার কার্যক্রম শেষে রায় অপেক্ষাধীন রাখা হয়। ওই দিন বিচারপতি ওবায়দুল হাসান, বিচারপতি মো. মজিবুর রহমান মিয়া ও বিচারপতি মো. শাহিনুর ইসলামের সমন্বয়ে গঠিত তিন সদস্যের ট্রাইব্যুনাল-২-এ আলীমের বিরুদ্ধে মামলায় রাষ্ট্র ও আসামিপক্ষের যুক্তি উপস্থাপন শেষ হয়। যুক্তি উপস্থাপন শেষে ট্রাইব্যুনাল বলেন, যেকোনো দিন এ মামলার রায় ঘোষণা করা হবে। ট্রাইব্যুনাল আলীমের জামিন বহাল রাখার আবেদন বাতিল করে তাঁকে কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দেন।

আলীমকে ২০১১ সালের ২৭ মার্চ মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় জয়পুরহাটের বাড়ি থেকে গ্রেপ্তার করা হয়। ওই বছরের ৩১ মার্চ শারীরিক অবস্থার কারণে তাঁকে জামিন দেন ট্রাইব্যুনাল-১। গত বছরের ২৭ মার্চ আলীমের বিরুদ্ধে মামলাটি ট্রাইব্যুনাল-১ আমলে নেন। রাষ্ট্রপক্ষের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে গত বছরের ১৬ এপ্রিল মামলাটি ট্রাইব্যুনাল-২-এ স্থানান্তর করা হয়। ওই বছরের ১১ জুন ট্রাইব্যুনাল-২ আলীমের বিরুদ্ধে ১৭টি অভিযোগ গঠন করেন।

এর মধ্যে গণহত্যার তিনটি অভিযোগ রয়েছে। এগুলো হলো জয়পুরহাটের কড়ইকাঁদিপুর গ্রামে ৩৭০ জন হিন্দুকে হত্যা, উত্তর হাটশহরে নয়জনকে এবং জয়পুরহাট চিনিকলে বিচার বসিয়ে ২৫ জনকে হত্যা। অন্যান্য অভিযোগের মধ্যে হত্যার ১০টি এবং দেশান্তরকরণের একটি অভিযোগ আনা হয়েছে।

এই মামলায় গত বছরের ৬ আগস্ট রাষ্ট্রপক্ষের সাক্ষ্য গ্রহণ শুরু হয় এবং রাষ্ট্রপক্ষের ৩৫ জন সাক্ষীর সাক্ষ্য গ্রহণ শেষ হয় চলতি বছরের ২২ আগস্ট। আসামিপক্ষের তিন সাক্ষীর সাক্ষ্য গ্রহণ করা হয় ২৭ আগস্ট থেকে ৩ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত।

রাষ্ট্রপক্ষ ৪ সেপ্টেম্বর থেকে চার কার্যদিবস এবং আসামিপক্ষ ১৫ সেপ্টেম্বর থেকে পাঁচ কার্যদিবস যুক্তি দেয়। ২২ সেপ্টেম্বর রাষ্ট্রপক্ষের আইনগত যুক্তি উপস্থাপন শেষে রায় অপেক্ষাধীন (সিএভি) রাখেন ট্রাইব্যুনাল।

ট্রাইব্যুনাল-২ ইতিপূর্বে চারটি মামলার রায় দিয়েছেন। এর মধ্যে চলতি বছরের ২১ জানুয়ারি জামায়াতের সাবেক সদস্য (রুকন) পলাতক আবুল কালাম আযাদকে মৃত্যুদণ্ডাদেশ, ৫ ফেব্রুয়ারি জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল আবদুল কাদের মোল্লাকে যাবজ্জীবন, ৯ মে দলটির আরেক সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মুহাম্মাদ কামারুজ্জামান ও ১৭ জুলাই সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মোহাম্মাদ মুজাহিদকে মৃত্যুদণ্ডাদেশ দেন। এর মধ্যে কাদের মোল্লার রায়ের বিরুদ্ধে আপিলের নিষ্পত্তিও হয়ে গেছে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে।

আপিল বিভাগ ১৭ সেপ্টেম্বর রায়ে কাদের মোল্লাকে মৃত্যুদণ্ডাদেশ দেন।

আলীমের বিরুদ্ধে অভিযোগ
প্রথম অভিযোগ অনুসারে, একাত্তরের ২০ এপ্রিল আলীম পাকিস্তানি সেনাদের নিয়ে জয়পুরহাটের পাঁচবিবি থানার দমদমা গ্রামের মেহের উদ্দিন চৌধুরীর (মৃত) বাড়িতে হামলা চালান। যার ফলে তিনি দেশান্তর হতে বাধ্য হন।
দ্বিতীয় অভিযোগে বলা হয়, মুক্তিযুদ্ধকালে ২৬ এপ্রিল আলীম মেজর আফজাল ও অন্যদের নিয়ে কড়ইকাঁদিপুর এলাকার হিন্দু-অধ্যুষিত গ্রামের বাড়িঘরে লুণ্ঠন, অগ্নিসংযোগের পর ৩৭০ জন নিরস্ত্র হিন্দুকে হত্যা করেন।
তৃতীয় অভিযোগ অনুসারে, আলীমের দেওয়া তালিকা অনুসারে একাত্তরের ১৮ জুন রিয়াজ মৃধা পাকিস্তানি সেনাদের একটি তালিকা দেন।

সেই অনুসারে ২৮ জনকে চিহ্নিত করা হয়। তাঁদের মধ্যে ২২ জন নিহত হন, বাকিরা পালিয়ে যান।
আলীমের বিরুদ্ধে চতুর্থ অভিযোগে বলা হয়, মে মাসে আলীমের নির্দেশে কোকতারা, ঘোড়াপা, বাগজানা, কোটাহারা গ্রামের ১৯ জন মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের লোককে হত্যা করেন।
পঞ্চম অভিযোগ অনুসারে, মে মাসে আলীমের নির্দেশ ও উসকানিতে ৬৭ জন নিরস্ত্র হিন্দুসম্প্রদায়ের লোককে কবর দেওয়া হয়।
ষষ্ঠ অভিযোগ অনুসারে, আলীমের নির্দেশে একাত্তরের মে মাসের প্রথম দিকে আক্কেলপুরের ১০ জন নিরস্ত্র ব্যক্তিকে ভারত যাওয়ার পথে আটক করা হয়।

পরে কোকতারা গ্রামের বকুলতলা এলাকায় নয়জনকে হত্যা করা হয়। মোফাজ্জল নামের এক ব্যক্তি পালিয়ে যান।

সপ্তম অভিযোগে বলা হয়, ২৬ মে আলীমের পরামর্শ ও নির্দেশ অনুসারে রাজাকার ও পাকিস্তানি সেনারা জয়পুরহাটের পাঁচবিবি থানার নওদা গ্রামের চারজন নিরস্ত্র মানুষকে কালী পুকুরের পাশে নিয়ে হত্যা করা হয়।

অষ্টম অভিযোগ অনুসারে, একাত্তরের মে মাসের প্রথম দিকে আলীম পাকিস্তানি মেজর আফজালকে সঙ্গে নিয়ে ক্ষেতলাল থানার উত্তরহাট শহর নামের একটি স্থানে পাঁচ-সাত শ জনের একটি সমাবেশে যান। সেখানে তিনি বলেন, ‘হিন্দুদের ক্ষমা করা যাবে না।

এদের যা পাও লুট করে নাও’। এই উসকানিমূলক বক্তব্যের পরে মে মাসের শেষদিকে হিন্দুপল্লি, উত্তরহাট শহর, হারুনজাহাট এলাকায় হিন্দু জনগণের ওপর হামলা ও লুটপাট চালানো হয়। ওই এলাকা থেকে হিন্দুসম্প্রদায়ের ১০ জন লোককে ধরে শাওনলাল বাজলার গদিঘরে স্থাপিত শান্তি কমিটির কার্যালয়ে নিয়ে যাওয়া হলে আলীম তাঁদের হত্যার নির্দেশ দেন। পরে ওই ১০ জনকে খঞ্জনপুর কুঠিবাড়ি ঘাট এলাকায় নিয়ে হত্যা করা হয়।

নবম অভিযোগে বলা হয়, একাত্তরের ১৪ জুন আলীম মেজর আফজালের সঙ্গে পরামর্শ করে ১৫ যুবককে পশ্চিম আমাত্রা গ্রামে নিয়ে নির্যাতন করে হত্যা করেন।

পরে তাঁদের গণকবর দেওয়া হয়।

দশম অভিযোগে বলা হয়, জুনের শেষ দিকে আলীমের সিদ্ধান্ত অনুসারে রাজাকার ও শান্তি কমিটির সদস্যরা ২৬ জন ব্যক্তিকে মুক্তিযোদ্ধা সন্দেহে ধরে এবং একটি ট্রাকে করে জয়পুরহাট রেলস্টেশনে নিয়ে যায়। এ সময় আলোখেলা স্টুডিওর মালিক মোতাসিম বিল্লাহ নামের এক ব্যক্তিকে আলীম নিয়ে আসেন এবং তিনি ওই ২৬ জন আটক ব্যক্তির সঙ্গে আলীমের ছবি তোলেন। পরে তাঁদের জয়পুরহাট কলেজে নিয়ে হত্যা করা হয়।

একাদশ অভিযোগ অনুসারে, একাত্তরের জুনে আলীমের নির্দেশে গাড়োয়ালসহ ১৯ ব্যক্তিকে খঞ্জনপুর কুঠিবাড়ি সেতুর কাছে গিয়ে হত্যা করে মৃতদেহ নদীতে ফেলে দেওয়া হয়।

দ্বাদশ অভিযোগে বলা হয়, ২৪ জুলাই আলীমের নির্দেশ অনুসারে স্থানীয় রাজাকাররা দেবীপুর কাজীপাড়া থানা থেকে ডা. আবুল কাশেমকে ধরে আনে। ২৬ জুলাই তাঁকে হত্যা করা হয়।

১৩তম অভিযোগ অনুসারে, আলীমের নির্দেশে ও পরামর্শে ১১ জনকে পাকিস্তানি সেনারা গুলি করে হত্যা করে।

১৪তম অভিযোগ অনুসারে, আলীমের নির্দেশে পাহাড়পুরে আহত মুক্তিযোদ্ধা ফজলুল করিমসহ আরও দুজনকে হত্যা করা হয়।

১৫ ও ১৬তম অভিযোগে বলা হয়, মুক্তিযুদ্ধকালে জয়পুরহাট চিনিকলে স্থাপিত সেনাক্যাম্পে ২৫ জন ব্যক্তিকে ২৫ অক্টোবর থেকে আটকে রাখা হয়েছিল।

আলীম ও পাকিস্তানি কর্নেলের সিদ্ধান্ত অনুসারে অষ্টম রাতে তাঁদের হত্যা করা হয়।

সর্বশেষ ১৭তম অভিযোগ অনুসারে আলীম ইস্ট পাকিস্তান রেজিমেন্টের ১৭ উইংয়ের সুবেদার মেজর জব্বল হোসেনকে হত্যা করেন।

সোর্স: http://www.prothom-alo.com

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.