আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

নিঃসঙ্গ ঈদ



আজ পবিত্র ঈদ-উল-আযাহা। আমাদের জীবনে অন্যতম খুশি ও আনন্দের দিন। আর যারা পড়ালেখা, চাকরি ইত্যাদি কারণে পরিবার থেকে দূরে থাকে, তাদের জন্য পরিবারের সাথে মিলনের এক সুবর্ণ সুযোগ। সবাই কত আনন্দই না করবে এ দিনে! আবার এমনও কিছু মানুষ আছে, যারা শুধু অন্যের আনন্দ দেখে দেখে আর আপন মনের ব্যাথা গুলো গোপন রেখে কাটিয়ে দিবে ঈদের দিনগুলো। আমার তেইশ বছরের জীবনের প্রতিটি ঈদই বাড়িতে, সবার সাথে কাটিয়েছি।

কিন্তু এবারই প্রথম পরিবারের বাইরে ঈদ করছি; নিঃসঙ্গতার বেড়াজালে নিজের সত্তাকে আড়াল করে। বঙ্গবন্ধু হলে আমরা মোট ২৫ জনের মত ছাত্র আছি, যারা পরীক্ষা বা অন্য কোন না কোন কারণে বাড়ি যেতে পারিনি। হলের প্রায় সব রুমই বন্ধ। যে কয়েক জন রয়ে গেছি, তারা ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছি পুরো হল জুড়ে। তাই কোন সাড়া-শব্দ নেই, পুরো হলে সুনসান নীরবতা।

এক ধরণের একাকীত্বের ঘোর যেন ভর করেছে পুরো হলের উপর। সদা কোলাহলময় আমাদের এ বঙ্গবন্ধু হল যেন নীরবতার কালো চাঁদরে মুড়ে আছে। রিডিং রুম, টিভি রুম, পেপার রুম, গেমস রুম ও মাসজিদ— সবখানেই শুধু খাঁ খাঁ শূন্যতা। গতকাল কিছুক্ষণের জন্য পেপার রুমে গিয়েছিলাম, পাশেই টিভি রুম। আমার সম ব্যাচের ইংরেজির রোকন, রাষ্ট্র বিজ্ঞানের নাজিম আর একটি ছোট ভাই-র সাথে দেখা।

টিভি রুমের সবখানেই শূন্যতা বিরাজ করছে। মনে পড়ে গেল—এই সেই টিভি রুম, যেখানে টিভির রিমোট কন্ট্রোল নিয়ে ‘রাজনীতির সেবক’ দু দল ছাত্রের মধ্যে কী সংঘর্ষই না হয়েছিল! ঢাবির অন্যান্য হলের রিডিং রুমের মত বঙ্গবন্ধু হলের রিডিং রুমটাও বেশ বড়। তারপরেও ছাত্ররা মাগরিবের নামাজের পরপরই যার যার পড়ার জায়গা ধরে রাখত। কিন্তু ঈদের ছুটিতে আজ রিডিং রুম পুরোটাই ফাঁকা। আমি একটু ভিতরে গেলাম, মনে হল, কে যেন আমারে বলছে—একী তুমি একা কেন? হাবীব কই? তুমিত একা রিডিং রুমে পড়তে আসতে না।

আমি রিডিং রুম থেকে বের হয়ে আমার রুমে চলে আসলাম। বঙ্গবন্ধু হলে দুটি ব্লক। উত্তর ও দক্ষিণ ব্লক। আমি দক্ষিন ব্লকের ৪২০ নং রুমে থাকি। আমার রুমমেট সকলেই বাড়ি চলে গেছে।

পুরো রুমটাতে আমি একা। পাশের রুমে একটা ছোট ভাইও একা; পরীক্ষার জন্য বাড়ি যায়নি। দুদিন আগেই হল প্রশাসন কোরবানির জন্য গরু কিনেছে দুটি। একটি বড় প্রমাণ সাইজ—লাল রং। আরেকটি একটু ছোট— সাদা রং।

হলের প্রধান করিডোর দিয়ে রুমে আসার সময় কিছুক্ষণ দাড়িয়ে গরু দুটিকে দেখছিলাম। গভীর কালো চোখ; যেন আমাকে বলছে—তুমি বাড়ি যাও নি কেন? বাড়ির জন্য মন কাঁদে না? জান, ইট-পাথরের এই আবেগহীন শহরে আমরা একদমই আসতে চাই নি। আমরা চেয়েছিলাম আমাদের যেন গাঁয়ের কোন হাটে বিক্রি করা হয়। কিন্তু আমাদের মালিক বেশি টাকার লোভে এ খটখটা ঢাকা শহেরে নিয়ে এল। বাব্বা, কি অসহ্য যানজট, ভিড় ও চাপাচাপি।

আমাদের একেবারে নাভিশ্বাস উঠে গেছে। এখন অবশ্য এত খারাপ লাগছে না। তোমাদের ক্যাম্পাসটি আমাদের বেশ পছন্দ হয়েছে। অনেকটা আমাদের নিজের গ্রামের মত, যেখানে আমরা বেড়ে উঠেছি। কত কত গাছ-পালা, ঘাস-লতা,মাটি আর সবুজে ভরপুর।

আর তোমাদের হলের কর্মচারীরা ত আমাদের বুঝতেই দিল না যে, আমরা আমাদের চিরচেনা ‘আতাল’ ছেড়ে ঢাকায় চলে এসেছি। কি যে যত্ন করল! গতকাল বিকেলে তোমাদের স্যারদের দুটি ছোট্ট বাচ্চা আমাদের দেখতে এসেছিল। ভয়ে ভয়ে আমাদের একটু ছুঁতে চেয়েছিল। আমরাই ওদের সুযোগ করে দিয়েছি। আমাদের গায়ে ও মাথায় হাত বুলিয়ে ওরা যে কী খুশি! আমাদেরও খুব ভাল লেগেছে।

রফিক ভাই, বাড়ি যান নি? এক ছোট ভাইয়ের ডাকে আমার ঘোর কেটে গেল। এরপর রুমে ফিরে আসলাম। মনে পড়ল সিপন ভাইয়ের সে-ই স্নেহমাখা দুষ্টামি, আরিফ, টিটুর ভালবাসা মেশানো ‘ভাই’ ডাক। আরও মনে হল এইত খালিদ ভাই টেবিলে বসে গভীর মনোযোগ দিয়ে তার গবেষণার কাজগুলো দেখছেন। আর আমার বেডমেট চির সজ্জন ইকবাল ভাই যেন আমাকে বলছেন, ‘কাল রাতে কই ছিলা?’ কিন্তু এরা সবাই ছুটিতে বাড়িতে গেছে।

পুরো রুমটাতে শুধু আমি একা। ঈদের দুদিন আগে ঢাকা শহরে ঈদের ছুটির প্রভাব দেখতে বেরিয়েছিলাম। তখনও মানুষ আর যানজটের এ শহরের চিরচেনা রূপ সম্পূর্ণ বিলীন হয়ে যায় নি। তবে ক্রমেই মানুষ শহর ছাড়ছে। আসলে ঈদের দিন যতই ঘনিয়ে আসছে ঢাকায় মানুষের সংখ্যা ক্রমবর্ধমান হারে হ্রাস পাচ্ছে।

ফলে একদিকে ঢাকার বাসাবাড়িগুলো ফাঁকা হচ্ছে, অন্যদিকে রাস্তায় ঘরমুখো মানুষের ব্যস্ততা বাড়ছে। সায়েদাবাদ রেল ক্রসিং-এ দাড়িয়ে আমি দেখছিলাম—মানুষ নিজের শিকড়ের টানে কত কষ্ট করে গাঁয়ের বাড়ি যাচ্ছে। কিন্তু অনেকেই গাড়ি পাচ্ছে না; তাদের সাথের শিশুগুলোর মুখের দিকে তাকানো যাচ্ছিল না। দাদু-নানু বাড়ি যাওয়ার আনন্দ যেন এ বিশ্রী মুহূর্ত গুলো কেড়ে নিচ্ছিল। তবে যখনি কেউ কষ্ট করে কোন মতে কোন গাড়িতে উঠতে পারছে; তাদের মুখে সে এক নিশ্চিন্তা-নির্ভরতার হাসি।

আর বাচ্চাগুলোর মনের অন্তঃপুরে জমানো সুখগুলোও যেন ডানা মেলতে শুরু করেছে। নিষ্পাপ মুখগুলো দেখে আমার কলেজের প্রথম দিককার কথা মনে পড়ে গেল। যখন যাত্রাবাড়ী থেকে গাড়িতে বাড়ির উদ্দশ্যে রওয়ানা হতাম, কত স্বপ্নই না বুনতাম পথে যেতে যেতে। আমার ছোট গাঁয়ের কত স্মৃতিই না সজীব হয়ে উঠত মস্তিষ্কের প্রতিটি নিউরনে। আমাকে সবচেয়ে বেশি টানত আমার গ্রামের পাশ দিয়ে বয়ে চলা আড়িয়াল খাঁ নদ।

সায়েদাবাদ থেকে টিকাটুলি। এখান থেকে সিদ্ধান্ত নিলাম এই ভিড়-ভাট্টার মধ্যে গাড়িতে না গিয়ে পায়ে হেটে ক্যাম্পাসে ফিরব। গ্রামের স্কুলে যখন পড়তাম, সায়েদাবাদ-শাহবাগ দূরত্বের দিগুণ দূরত্বেরও বেশি দূরের পথ পায়ে হেটে স্কুলে গিয়েছি। সেই সাথে একটি নদীও পার হতে হত। তাই হাটতে শুরু করলাম।

ইত্তেফাক মোড় দিয়ে বঙ্গভবন ডানে রেখে বঙ্গবন্ধু মনুমেন্ট পেরিয়ে ওসমানী উদ্যানে প্রবেশ করলাম। দু দিন আগে কোন একটা জাতীয় পত্রিকায় এ উদ্যানের লেকের পানিতে কচুরিপানা ফুল বিষয়ে একটা ফিচার পড়েছিলাম। সাথে কচুরিপানা ফুলের একটা রঙিন ছবিও ছিল। আজ বাস্তবে দেখব বলে লেকের পাড়ে এসে বসলাম। তাছাড়া এতক্ষণ প্রথম অগ্রহায়ণের ভর দুপুরের সূর্যের তেজস্বিতা ও খু্ৎ-পিপাসায় দেহ মন অবসন্ন হয়ে আসছিল।

সারা লেক ভরে আছে নীলাভ-শাদা বর্ণের ফুলে। বাস্তবিকই এক অনিন্দ্য সুন্দরের সমারোহ। ইট-পাথরের ঢাকা শহরের নাগরিক জীবনে এ এক অন্য রকম ভাল লাগার অনুভূতি। গ্রীষ্মের ভ্যাঁপসা দুপুরে এক পশলা বৃষ্টি হয়ে যাওয়ার পর প্রবাহিত মৃদুমন্দ বাতাসে যেমন তনু মন জুড়িয়ে যায়, তেমনি কচুরিপানা ফুলের অনুপম দৃশ্য আমার ক্লান্ত শরীরে প্রশান্তি ছড়িয়ে দিল। মনে হচ্ছে যেন আমার গ্রামের কোন জলাশয়ের পাশে বসি আছি; পত্রিকার সে ফটোগ্রাফার কে ধন্যবাদ।

বেশ কিছুক্ষণ কাটিয়ে দুচোখ ভরে সৌন্দয উপভোগ করে আবার শুরু হল আমার পদযাত্রা— ক্যাম্পাস অভিমুখে। সচিবালয় হয়ে কার্জন হল, সেখান থেকে রিকশা নেয়ার চেষ্টা করলাম। কিন্তু কোন চালকই যাবে না। না যাওয়ার কারণ আমিও বুঝতে পারলাম। পুরো হলই এখন ছাত্র শূন্য বলা যায়।

ফিরতি পথে যাত্রী পাওয়ার সম্ভাবনা শূন্যের কোঠায়। কায়িক পরিশ্রমী এ মানুষগুলোর বিবেচনা বোধ দেখে আমি বরং খুশিই হলাম। এতটুকু হিসাব না থাকলে তাদের চলবে কেন, কেননা তাদের আয়ের ত আর কোন অলৌকিক উৎস্য নেই। এই ত্রিচক্রযান ঠেলেই তাদের খাওয়া পরা। অবশেষে আবার পায়ে হাটা শুরু।

ক্যাম্পাসে ঢুকে বুকের ভিতরটা হু হু করে উঠল। বাতাসের মৃদুমন্দ বয়ে যাওয়া আর পাখ- পাখালির কিচির-মিচির ছাড়া কোন সাড়া-শব্দ নেই। কে বলবে দু দিন আগেও এ ক্যাম্পাসটা ছিল হাজারো তরুণ প্রাণের উচ্ছ্বলতায় মুখর। অবশ্য ঈদসহ বিভিন্ন ছুটিতে বেশ কিছু দিন পূর্ব থেকেই ৃসবার চোখেমুখে এক ধরণের বাড়ির ছায়া পরিলক্ষিত হয়। আর হওয়াটাই স্বাভাবিক, বর্তমান সেমিস্টার পদ্ধতিতে (২০০৬-২০০৭ ইং সাল থেকে) আমরা যারা অনার্স পড়ছি, তাদের অবসর নেই বলেলেও অত্যুক্তি হবেনা।

এ্যাসাইনমেন্ট, ক্লাস টেস্ট, মিডটার্ম দেখতে দেখতে সেমিস্টার ফাইনাল। সব কিছু কেমন যেন শুরু হতে না হতে শেষ হওয়ার মতো। টি এস সি, সড়ক দ্বীপ, হাকিম চত্বর, সেন্ট্রাল লাইব্রেরী, ডাকসুর সামনের রাস্তা থেকে অপরাজেয় বাংলা, সিনেটর কেনেডি বটতলা, ব্যাকবেঞ্চার চত্বর থেকে শ্যাডোর ফটোকপির দোকান, ভিসি চত্বর থেকে পুরো মল চত্বর— কোথাও কোন প্রাণের স্পন্দন নেই, নেই কোন কোলাহল, সব খানেই শূন্যতা ও হাহাকারের আর্তনাদ; এ যেন শীত ঋতুর আগমনে প্রকৃতির নিজেকে খোলসাবৃত করে নেওয়া। মল চত্বেরর ঠিক মাঝের যে রাস্তাটি সোজা জিয়া এবং বঙ্গবন্ধু হল অভিমুখে চলে গেছে সে রাস্তা দিয়ে হাঁটছি এবং ভাবছি, আসলে এইত জীবন; একদিন আমাদের সবাইকে চলে যেতে হবে এ জগত ছেড়ে অনেক দূরে— লোক চক্ষ্মুর অন্তরালে। অবশেষে হলে আসলাম।

আসার পথে জাসীম উদ্দীন হল থেকে খেচুরি খেয়ে নিলাম। হলে এসে গোসল-নামাজ সেরে ঘুম। সন্ধ্যায় টিউব লাইটটা বন্ধ করে দিয়ে টেবিল লাইটটা জ্বালালাম। একটা উপন্যাসের শেষ কয়েকটা অধ্যায় পড়া বাকি ছিল, উপন্যাসটা পড়া শেষ করলাম। চমৎকার এক উপন্যাস--- হেঁয়ালি ও বাস্তব জীবনের চমৎকার এক সম্মীলন ঘটিয়েছেন ঔপোন্নাসিক।

রুম থেকে বের হয়ে ফ্রেশ রুমে গেলাম। বেসিনের সামনে দাড়িয়ে আমি। আর একজন মাত্র এখানে— সে আয়নার ভিতরে আমার প্রতিবিম্ব; আর সবটাই শুধু শূন্যতা। ১৭ ,১১, ২০১১ ইং বঙ্গ বন্ধু হল, ঢাবি

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।