আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

আত্মজা


কত ঘন্টা, কত মিনিট, কত সেকেন্ড পার হয়েছে জানিনা। নির্বাক বসে আছি আমি। নিস্পলক, নিশ্চুপ। মুখের ভাষা হারিয়েছে অবাক চেয়ে আছি আমি, ওর দিকে! বুকের ভেতর ব্যাথার ভাংচুর, ওলোট পালট। নিশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে।

চোখের মনিগুলিও যেন ঠেলে বাইরে বেরিয়ে আসতে চাইছে। গলার কাছে শত সহস্র বছরের না বলা কথাগুলি দলা পাঁকিয়ে উঠছে। পিন্জরাবদ্ধ পাখির মত ডানা ঝাপটে মরছে তারা। বেরিয়ে আসতে চাইছে কত কথা, কত অনুভুতিগুলি হুড়মড় করে। তবুও নির্বাক বসে আছি আমি।

নিস্পলক, অনঢ়, অটল! ওর মুখের দিকে চেয়ে কত ঘন্টা,কতক্ষন,পলক ফেলিনি আমি, জানিনা তার হিসাব। ঐ তো আমার সামনে আমারই মত নিশ্চুপ বসে আছে সেও। নিস্তব্ধ নিশ্চল। আমার মেয়ে। আমার আত্মজা! একটি দীর্ঘশ্বাস, গভীর গোপন ব্যাথা, সুতীব্র লজ্জার এক অকথিত ইতিহাসের নাম।

দশ মাস, দশ দিন তিল তিল করে নিজের রক্ত মাংস,স্নেহ ভালোবাসা দিয়ে একে গড়েছিলাম আমি। লোকলজ্জা, ঘৃনা, অপমান, অবজ্ঞা সকল কিছু উপেক্ষা করে চুপি চুপি হাত বুলিয়েছি কত নিশুতি রাত্রীতে তার বেড়ে ওঠার একমাত্র স্থান আমার ক্রমবর্ধমান কলংকিত স্ফীত উদরে। কত গভীর রাত জাগা প্রহরে গড়িয়েছে জল চোখের কোনায়। তার অনাগত ভবিষ্যতের চরমতম অশনি সংকেতে কেঁপে উঠেছি বার বার । চুপি চুপি পালিয়ে যেতে চেয়েছি তাকে নিয়ে কোনো অজানা গন্তব্যে।

চির পরিচিত গন্ডি ছেড়ে নিরুদ্দেশে। কোনোটাই হয়নি! পারিনি তাকে রক্ষা করতে। এই কুটিল পৃথিবীর নিয়ম নীতির বেড়াজালে সে ছিলো বড়ই অপাংতেয়, অচ্ছুৎ। আমি হতভাগিনী, দুঃখীনি চির পাপী এক মা, যে পারেনি তার সন্তানকে বুকে আগলে রাখতে, যে পারেনি একটা দিনের জন্যেও তার সন্তানের কোমল ছোট্ট মুখখানি বুকে চেপে ধরতে। ছোট্ট আত্মজের গা্য়ের মিষ্টি অজানা গন্ধটা আজীবন অজানাই রয়ে গেলো ।

তবুও স্বপ্ন বিভ্রমে কত কত রজনীর বসন্তের মৃদুমন্দ বাতাসে ভেসে এসেছে তার গায়ের গন্ধ । অনাঘ্রাতা যুইফুলের অজানা তবু চিরচেনা সেই গন্ধ ভেসে এসেছে বদ্ধ কপাট গলে। বর্ষাস্নাত সন্ধ্যার জানালার গ্রীলে কপাল চেপে দাঁড়িয়ে থাকা হঠাৎ কোনো আচমকা ক্ষনে বিদ্যুৎ চমকে চম্‌কে গেছে ছোট্ট কিন্তু খুব সুতীক্ষ্ণ ব্যাথা বুকের পাঁজর ভেদ করে। সে আমার হারিয়ে ফেলা আত্মজার জন্য খুব গভীর গোপন লুকিয়ে রাখার ব্যাথা। আমার সোনামনি, আমার বুকের পিন্জিরায় লুকিয়ে রাখা করুন দীপাবলি।

মনে পড়ে তোকে দেখার সেই প্রথম মুহুর্তটুকুর কথা। প্রতিটা শিশু জন্মের পর পায় তার পরম আপন আত্মীয় স্বজন, পরিবার পরিজনের নিরাপদ স্নেহময় কোল। আর তুই ! তুই কি পেলি? তুই পেয়েছিলি জন্মের পর পরই এক অজ পাড়াগায়ের ভেজা স্যাতস্যেতে মাটির ঘরের কঠোর কঠিন মেঝের ছোঁয়া। ছুঁড়ে ফেলা হলো তোকে চরম অবজ্ঞায়। তোকে স্পর্শেও যেন পাপ, তোর ছায়াও ছিলো অসূচী, এই দুনিয়ার পুত পবিত্র মনুষ্যজাঁতের কাছে তুই ছিলি শুধুই অনাহুত।

তুই যেন এক অচ্ছুত জন্তু! তোকে ছুলেই জাত যাবে সবার। কোনো কোমল কোল তো দূরের কথা কারো এক অঙ্গুলীর ক্ষনিক ছোঁয়াও তোর জন্য নিষিদ্ধ। তাই তোকে পড়ে থাকতে হলো স্যাতস্যাতে ভেজা মাটির এক কোনে। ষোলো ঘন্টা প্রসব বেদনার পর নেমে এসেছিলি তুই ধরিত্রীর কোলে। কিন্তু একফোটা মমতা জোটেনি তোর কপালে।

জোটেনি কোনো স্নেহময়ী মুখের স্বাগত সম্ভাষন। আর তাই বুঝি পৃথিবীকে জানান দিতেই তুই তারস্বরে কাঁদছিলি। চিৎকার করে জানাতে চাইছিলি তোর আগমনী বার্তা। ছোট্ট ছোট্ট পুতুলের মত লাল লাল হাতগুলি নেড়ে কাঁদছিলি তুই। তোর আগমন এ জগতে নিষিদ্ধ ছিলো আর তাই গ্রামের প্রসিদ্ধ দাই আবুর মা চেপে ধরলো তোর মুখ।

এক ফোঁটা আওয়াজও যেন না শোনা যায় বাইরে কোথাও। তারপরও কি দূর্দান্ত রোষে ফুসে উঠছিলি তুই। আবুর মায়ের শক্ত অঙ্গুলির ফাঁক ফোকর দিয়ে এক ফোটা শব্দও বের হতে পারছিলো না। কি ভীষন নির্মম। কি ভীষন নিষ্ঠুর।

চেয়ে চেয়ে দেখা ছাড়া কিছুই করার ছিলো না আমার। সমাজ সংসারে তুই অচ্ছুত অপাংতেয়। কোনো মায়ের মনের কোনে লুকিয়ে থাকা একফোটা ভালোবাসা, স্নেহ, মমতার দাম নেই সেখানে। তাই চেয়ে চেয়ে দেখতে হলো তোর নরম কোমল গালে ষাড়াশীর মত চেপে বসা কঠিন আঙ্গুলগুলি। চোখ বুজে ফেলেছিলাম নিস্ফল যাতনায়।

তোর এই হতভাগীনী মা পারেনি জোর করে কেড়ে নিতে তোকে ঐ কঠোর নিদারুন মনুষ্য জগতের এক কঠিন হৃদয় পাষানীর হাত থেকে। হঠাৎ তুই ঘুরে তাকালি আমার দিকে। কান্নাও বুঝি থমকে গেলো তোর। কি অবাক বিস্ময়ে তুই তাকিয়ে ছিলি আমার দিকে! হয়তো তুইও অনেক অবাক হয়েছিলি তাইনা রে? ভেবেছিলি এ কেমন মা তোর! অক্ষম, নিষ্ঠুর, পাষানি, কি ভেবেছিলি রে? তোর ছোট্ট কপালে আমি দেখেছিলাম অবাক প্রশ্নবোধক চিহ্ন। তুই ভাষাহীন চোখে আমার কাছে কি বলতে চেয়েছিলি মা? বাঁচতে চেয়েছিলি? আশ্রয় চেয়েছিলি আমার কাছে? নাকি জানতে চেয়েছিলি কি তোর অপরাধ যে মায়ের স্নেহ কপালে জুটবেনা তোর! কার অন্যায় অপরাধের বোঝা বহন করতে হবে তোকে! তুই কি অস্ফুট ভাষায় আমাকে ডাকতে চেয়েছিলি? জগতের সবচাইতে নিরাপদ স্থান, মমতার জায়গা মায়ের কোল, সেই কোলে একটাবার জায়গা হলোনা তোর।

আমি এক হতভাগিনী মা পারিনি তোকে রক্ষা করতে। এমন অভাবনীয় অপরিসীম দুঃখ বা কষ্টের মুহুর্ত বুঝি কোনো মানুষের জীবনে আসেনা। অন্যদের মত আমিও ভেবেছিলাম তোকে অনেক ঘৃণা করবো । কিন্তু পারিনি রে, তিল তিল করে এতগুলো দিন ধরে নিজের শরীরে গড়ে তোলা কোনো রক্তমাংসের ছোট্ট একটা পুতুলকে কেউ কি পারে ঘৃণা করতে? কেউ কি পারে তাকে অন্যের হাতে তুলে দিতে? আমিও পারিনি। তবুও আমাকে নিশ্চুপ থাকতে হয়েছিলোরে।

তোর জন্মের পর পরই যখন ওরা তোকে নিয়ে গেলো মুখ ফুঁটে একটা টু শব্দও করতে পারিনি আমি। তোর চলে যাবার পথের দিকে তাকিয়ে আমার ভেতরটায় কি রকম ডুকরে কেঁদে উঠেছিলো তা কখনও জানা হবেনা কারও, শুধুই চোখের কোনে গড়িয়ে পড়া দুফোটা জল সযতনে মুছিয়ে দিয়েছিলেন একজন। সে আরেক মা, আরেক জননী। আমার জন্মদাত্রী। এক মায়ের ব্যাথা বুঝি আরেক মাই শুধু বুঝতে পারে।

তবুও লোকলজ্জা, কলংকিত অধ্যায় বা শত্রুদলের নির্মম পাশবিকতার কাছে পরাজিত হয়েছিলো সকল মায়ের স্নেহ, মমতা ও ভালোবাসা। আমার কিছু করার ছিলোনা মা। আমি জানতাম তোকে রক্ষা করতে পারবোনা আমি। কেউ তোকে বাচতে দেবেনা। মামনি তুই কি জানিস, আমাদের দেশের পরম শত্রু, স্বাধীনতার বিপক্ষ কুকুরগুলো যখন দিনের পর দিন ধর্ষন করেছিলো আমাকে, সেই কষ্টও হার মেনেছিলো তোকে হারিয়ে ফেলার সেই মুহুর্তটুকুর কাছে।

মামনি ওরা বলে পাকী শত্রুর নষ্ট বীর্যে ধর্ষিতা রমনীর সন্তানদের বেঁচে থাকার কোনো অধিকার নেই আমাদের এই প্রিয় স্বাধীন দেশটাতে। ওরা কি বলতে পারবে আমার কি দোষ ছিলো? আচ্ছা তোরই বা কি দোষ? এই মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে আমার অবদান কি কম ছিলো বা তোরই কি কম বলতো? ওহ না তারা আমাকে সন্মাননা দিয়েছে আমি বীরাঙ্গনা। এই স্বাধীনতায়, অন্যায় অত্যাচার থেকে দেশকে মুক্ত ও রক্ষা করতে আমাকে দিতে হয়েছে সতীত্ব বিসর্জন। আমি বীরঙ্গনা। এই মুক্তিযুদ্ধের আমিও একজন বিজয়ী সৈনিক।

কিন্তু মা হিসাবে আমি এক পরাজি্ত মা, দূর্ভাগা জননী। একটা প্রশ্ন বারেবারেই উঁকি দিয়েছে আমার মনে, ঐ কুকুরগুলোর অপরাধে যদি তোর সারাজীবনের মাতৃস্নেহ বিসর্জন দিতে হয়,যদি তোকে হতে হয় নির্বাসিত তাহলে আমার অবদানের মূল্যটুকুর জন্যও কি একফোটা ভালোবাসা তোর প্রাপ্য নয়? কে দেবে আমার এই প্রশ্নের উত্তর? কে দেবে জবাব? এই দুষিত সমাজের নিয়মে একজন জন্মদাত্রীর চাওয়া পাওয়া ভালোবাসার কোনো মূল্য নেই...... জানিস, এই একচল্লিশ বছরে একটা দিনও ঘুমাতে পারিনি আমি। আমি মনে প্রাণে চেষ্টা করেছি তোকে ভুলে যেতে। কিন্তু পারিনি। কত কথা, কত দুঃখ স্মৃতি, কত একলা থাকার দীর্ঘশ্বাসের ইতিহাসে জড়িয়ে থাকা গল্পগুলো, খুব বলতে ইচ্ছে করছে তোকে ।

বলতে ইচ্ছে করছে এতগুলো বছরের একটা দিনও ভুলিনি তোকে মা। কিন্তু কোন মুখে বলবো সে কথা আমি আজ তাকে? আমি এক অক্ষম, ভীতু ও দূর্ভাগ্যের কাছে পরাজিত এক দুঃখিনী মা। যে পারেনি তার সন্তানকে আগলে রাখতে। একটাবার তার ননী গন্ধ মুখে একটা চুমু খেতে, একটা বার তাকে মামনি বলে ডাকতে। নির্বাক, নিশ্চল বসে আছে মেয়েটা।

আজও ওর কপালে জন্মের সময় ক্ষনিকের দেখা সেই প্রশ্নবোধক চিহ্ন। নীরবতা ভাঙ্গে মেয়েটি- - মা আমি কোনো উত্তর দিতে পারছিনা কেনো? যে ডাক শোনার জন্য বছরের পর বছর অপেক্ষা করেছি আমি। কতদিন কতরাতে হেলুসিনেশন শুনেছি এই একটি মাত্র ডাক, মা। আজ তুই আমার সামনে বসে । কোনোরকম হেলুসিনেশন ছাড়াই তুই আজ আমাকে ডাকছিস,আমার পরম আরাধ্য সেই ডাক।

কিন্তু উত্তর দিতে পারিনা কেনো আমি আজ? - মা এই বৃদ্ধাশ্রম থেকে আমি তোমাকে নিয়ে যেতে এসেছি মা। আমার পালক মায়ের কাছ থেকে তোমার ঠিকানা পেয়েছি। এই বৃ্দ্ধাশ্রমের ঠিকানা। তোমাকে আমি নরওয়েতে নিয়ে যাবো, আমার বাড়িতে। আমি জানি ঠিক আমার মতনই অসহনীয় কষ্ট তুমিও পাচ্ছো।

তোমাকে কিচ্ছু বলতে হবেনা মা। কখনও ভেবোনা তুমি আমার জন্য কিছু করতে পারোনি। নিজেকে কখনও দোষী ভেবোনা। তুমি আমার জন্য এই সমাজ সংসার আর পৃথিবীর কাছে যে দুঃখটুকু পেয়েছো বাকী জীবনটাতে আমি তোমার সে দুঃখ ভুলিয়ে দিতে চাই। আমি নিশ্চুপ বসে থাকি।

মেয়েটি আবার প্রশ্ন করে, -পারবোনা মা বলো? আমি মেয়েটির মুখের দিকে তাকিয়ে আছি। মেয়েটি ঝুঁকে হাত বাড়ায় আমার দিকে। ওর দুহাত আমার দুহাতের উপরে। কতদিন কত যুগ পর আমার হাতের উপর আমার আত্মজার প্রথম স্পর্শ। ওর হাতের উপর ঝরে পড়ে আমার চোখের জল।


 

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।