আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

আত্মজা--

কত আজানারে জানাইলে তুমি, কত ঘরে দিলে ঠাঁই দূরকে করিলে নিকট,বন্ধু, পরকে করিলে ভাই।
মেয়েটার পায়ে কদিন থেকে খুব ব্যাথা। প্রথমে খুব একটা গা করেননি মা। স্কুলে বাসায় সারাদিন খেলাধুলা করে সিঁড়ি দিয়ে ধাপধুপ লাফালাফি করে চলাফেরা করে কোথাও বোধ হয় ব্যাথা পেয়েছে। একদিন এসে বলল - মা তুমি দেখোনা কেন? আমার ডান পায়ের চেয়ে বাম পাটা বেশি মোটা।

আমার এই পায়ে ব্যাথা। মা পাত্তা দিলেন না। কোথাও ব্যাথা পেয়েছিস। খেলিসতো বাস্কেটবল আর ভলিবল। হয়ত কোথাও লেগেছে।

মা বেশ একটু রাগত স্বরেই বললেন -তোমার পড়তে বসলেই পা ব্যাথা করে, তাই না। মেয়েটা বেশ অভিমানই করলো। মার মনটাও খঁচখঁচ করছে। মেয়েটা প্রায়ই বলে ব্যাথার কথা ডাক্তার দেখালেই হয়। একদিন সময় করে নিয়ে গেলেন ডাক্তারের কাছে।

ডাক্তার হাতে ধরিয়ে দিলেন একগাদা টেস্ট। মা যখন বললেন- কি হয়েছে মনে হয়। অ্যাসোসিয়েট প্রফেসর ডাক্তার বেশ গম্ভীর ভাবে বললেন -এই টেস্টগুলি যত দ্রুত সম্ভব করে নিয়ে আসেন। তারপর বোঝা যাবে আসলেই কি হয়েছে। শুরু হল টেস্ট।

এক্স-রে , ব্লাড, ইউরিন, সব টেস্ট করে দুইদিন পর আবার ডাক্তার। ডাক্তার সব রিপোর্ট দেখলেন, মেয়ের পা টিপে টুপে দেখলেন এবং উদ্বিগ্ন মায়ের কোন প্রশ্নের কোন জবাব না দিয়ে শুধু বার বার রিপোর্টগুলি দেখলেন। এবারে মেয়েকে চেম্বার থেকে বের করে দিয়ে ডাক্তার বললেন -আপনার মেয়ের পায়ের একটি হাড় মোটা । এটি মোটা হচ্ছে। কেন হচ্ছে তা এখনও সেই ভাবে পরিস্কার না।

আপনি মেয়েকে নিয়ে ঢাকা চলে যান। যদি সম্ভব হয় তবে বিদেশে নিয়ে যান। মা জিজ্ঞাসা করলেন - কি হয়েছে বলে আপনার ধারনা। ? তিনি বললেন - টিবি, টিউমার বা ক্যান্সার। টিবি টিউমার নিয়ে আমি চিন্তিত না।

এর ভাল চিকিৎসা আছে কিন্তু ক্যন্সার যদি হয়, এখনও আর্লি এস্টেজ, চিকিৎসা করলে ভাল হয়ে যেতে পারে----- ডাক্তার বলে চলেছে একের পর এক কথা আর মার কানে বাজছে ক্যান্সার ক্যান্সার ক্যান্সার--- মার চারিদিকে আসীম শূন্যতা। মা যেন কিছু খুঁজছে আকড়ে ধরবার। কিন্তু কোথাও কিছু নেই। মা ধীরে ধীরে চলে গেলন তার মেয়ের জন্ম মুহুর্তে। মেয়েটা যখন জন্ম নেয় তখন নাকি ওর গলায় নাড়ী পেঁচানো ছিল।

আয়ারা বার বার বলছিল তিন প্যাঁচ দেয়া ছিল নাড়ী। এই বাচ্চা হবার সময় নাড়ীরই ফাঁস লাগে মারা যায় বাচ্চারা । সেই মেয়ে বেঁচে গিয়েছে। আপাগো বড় ভাগ্যবতী মেয়ে তোমার। অনেক বড় হবে।

গভীর আনন্দে মা চোখ বুঝে ছিল। তার পর কোথা দিয়ে সময় কেটে গেছে মা বুঝতেই পারেনি। মার মনে হচ্ছিল খুব দূর থেকে একটা কন্ঠ যেন বলছে শমার্থী মা-মনি আমার, আর কত ঘুমাবে । মা চোখ খুলে দেখলেন শমার্থী তার বাবার কোলে। আর তার বাবা এই সদ্য জন্ম গ্রহন করা শমার্থীর সাথে কথা বলে চলেছে।

শমার্থী নামটা মনে হতেই মা যেন সজাগ হলেন। তাকিয়ে দেখলেন তিনি ডাক্তারের চেম্বারে আর ডাক্তার তাকে কি কি যেন সব বলে যাচ্ছে। মা চেম্বার থেকে বের হয়ে এলেন। মেয়েকে শক্ত করে ধরে বললেন-চল। মেয়েটা মাকে জিজ্ঞাসা করল -মা ডাক্তার তোমাকে কি বলল? মা মেয়ের দিকে ফিরে বললেন --কিছুনা।

বলল তোমাকে ঢাকায় দেখাতে। আর আমরাতো ঈদ করতে ঢাকায় যাচ্ছিই। মেয়েকে নিয়ে মা গাড়িতে চড়লেন। গাড়ি চলছে হাইওয়ে দিয়ে। গাড়িতে মেয়ে গান ছেড়েছে ।

গান বাজছে দ্রুত লয়ে, যে স্পীডে গাড়ি চলছে সেই স্পীডে গান বাজছে আর মার মন তার চেয়ে দ্রুত গতীতে কাজ করে যাচ্ছে। কোথায় নেব মেয়েটাকে? আমি কি ঢাকায় নেব না কি প্রথমেই দেশের বাইরে? শমার্থী শব্দের অর্থ শান্তির দূত, বিশ্ব শান্তি, বিশ্ব মৈত্রি। শমার্থী নামটা মা নিজেই রেখেছে। যেদিন মা অনুভব করলেন তার নিজের ভিতরে অন্য কারো অস্তিত্ব, সেদিন কেমন যেন একটা অনুভূতি হয়ে ছিল। আনন্দ বেদনার সংমিশ্রনে এক অন্য ধরনের অনুভূতি।

ধীরে ধীরে বেড়ে উঠল একটা শিশু মায়ের জঠরে। মা আস্তে করে তার ডান হাতটা রাখলেন তার পাটে। যেন মেয়েটা তার পেটেই আছে এখোনো। প্রথন যেদিন মেয়েটা পেটের ভিতরে নড়েছে সে দিনটার কথাও মার মনে আছে খুব স্পস্ট ভাবে। প্রথমে তো বুঝতেই পারেননি কি হল।

ভয় পেয়ে গিয়েছিলেন। গাড়ি বাড়িতে এল। মা যন্ত্রের মত গাড়ি থেকে নেমে তার শোবার ঘরের বিছানায় এসে বসলেন। তার পিছু পিছু মেয়েটাও এল। মার ঘাড়ে হাত রেখে মাকে জিজ্ঞাসা করল-- মা তোমার কি হয়েছে? শরীর খারাপ লাগছে? মা যেন সম্বিত ফিরে পেলেন।

মুহূর্তেই নিজস্ব চপলতায় ফিরে বললেন-- না না কিছু না। তুমি কাপড় চেঞ্জ না করে ঘুরছো কেন? যাও কাপড় চেঞ্জ কর। মা নিজেকে আড়াল করবার জন্য তাড়াতাড়ি কেবিনেট খুলে তার কাপড় বের করতে শুরু করলেন। মেয়ে পাশে এসে দাঁড়িয়ে বলল- আমাকে লুকাচ্ছো কেন মা ? কি হয়েছে তোমার? মন খারাপ হল কেন? বাবার সাথে কথা হয়েছে?  না কেন?  এমনি তোমার মনে হচ্ছে যেন কিছু হয়েছে?  কিচ্ছু হয়নি। তুমি কাপড় চেঞ্জ করে টেবিলে যাও।

কি ইফতারি খাবে ?  শরমা খাব? মা হেসে ফেললেন। জানতেন মেয়ে এটাই চাইবে। কয়েকদিন থেকেই বলছে। বানানোর ঝামেলার জন্য মা বানাননি। মেয়ে বলল-- থাক মা, তুমি টায়ার্ড আজ না কাল বাবা আসবে তখন বানিয়ো।

মা মেয়েকে তার রুমে যেতে বলে বাথরুমে ঢুকে গেলেন। দেয়ালে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে ভাবতে চেস্টা করলেন তার মেয়েটা কবে এত্ত বড় হল। মায়ের মুখ দেখেই বুঝতে শিখেছে মার কিছু হয়েছে। মার মনে এতটুকু কষ্ট থাক মেয়েটা কিছুতেই তা সহ্য করতে পারে না। এইতো সে দিন মেয়েটা হাঁটতে শিখলো।

কথা বলা শিখলো। বুড়ো মানুষদের মত বড় বড় কথা বলে। মা শত চেষ্টা করেও ওর ছোটবেলার একটা কথাও মনে করতে পারলো না। মা চোখ বন্ধ করে সেই সময়ে যেতে চাইলেন পারলেন না । কিছুতেই না।

মেয়ের চিৎকারেই মায়ের আবার ধ্যান ভঙ্গ হল। মা চোখে মুখে বেশি করে পানি দিয়ে বের হলেন। ঘর থেকে দেখলেন মেয়েটা তার শোবার ঘরের বারান্দার সাথে লাগোয়া ছাদে উঠবার ল্যাডারটার উপর দাঁড়িয়ে ওর ছোট ভাই বোন দুটির সাথে খুনটূসি করছে। মা তীক্ষ্ণ চোখে মেয়ের দিকে তাকালেন। খুব খঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে শুরু করলেন তার মেয়েটা কোথায় অসুস্থ্য।

কি সুন্দর প্রানবন্ত একটি মেয়ে। যেমন লম্বা তেমনি স্বাস্থ্য। একেবারে খেলোয়ারের মত । সারা শরীর প্রান চাঞ্চল্যে ভরপুর। কোথায় অসুখ বাসা বেঁধেছে।

মেয়েটার শেষ জ্বর হয়েছে প্রায় চার বছর আগে। কি বলল ডাক্তার? আমার আত্মজার অসুখ। এমন এক অসুখ যার কোন ফিরবার পথ নেই। না এ হতে পারে না। আমি বেঁচে আছি আর আমার মাঝে সৃষ্টি এই আমার আত্মজা আজ ধুঁকে ধুঁকে মৃত্যুর দিকে ধাবিত হবে ? আমি অসহায় কতটা আসহায়।

কোথায় খোদা তুমি? কেন তবে দিয়েছিলে তাকে এই পৃথিবীতে? এত মায়া মমতায় ও কেন বেঁধেছে আমাকে? কেন সে এল আমার কোলে? না মায়ের চোখে কোন পানি নেই। ফোনটা বাজছে। রিংটোন বলে দিচ্ছে ফোন করেছে মেয়ের বাবা। মা ফোনটা ধরলেন। খুব সাবলীল ভাবে বলে গেলেন ডাক্তার কি বলেছে? অপর প্রান্ত থেকে বার বার বলছে-- কি বলছো বুঝতে পারছি না ঠিক করে বল।

মা খুব শান্ত ভাবে বললো- তুমি কি বাংলা কথা বুঝতে পারছো না আমি কি ইংরেজীতে বলবো। আমি বাঙ্গলা বা ইংরেজী ছাড়া অন্য কোন ভাষা যে জানি না। বলেই মা হু হু করে কেঁদে উঠলেন। ওড়নাটা মুখে জোরে চেপে ধরে কান্না রোধ করতে চাইছেন পারছে্ন না। কান্নার শব্দে বাচ্চারা চলে এলে সমস্যা হবে।

মা আর পারছে না। ফোণটা বেজেই চলছে। মা আর ফোনটাও ধরতে পারছে না। মেয়েটা এসে ফোন ধরলো। বাবা বোধ হয় জিজ্ঞাসা করলো -মা তোমার জন্য কি আনবো? পেটুক মেয়েটা আমার রোজা আছে তাই সব ভালো ভালো খাবার ওর চোখে ভাসছে।

বাবাকে বললো- বাবা আমার জন্য একটা চকলেট কেক আনবে। আবার দেখি বলছে- কাকু আমি ভাল আছি। মা বোধ হয় বাবার সাথে ঝগড়া করেছে কথা বলবে না এখন, একটু পরে ফোন কোরো। কাকুর সাথে কি সব নিয়ে হাসা হাসি করলো। মেয়েটা বারবার বলছে- না কাকু আমি পনেরো তারিখের আগে ঢাকা যেতেই পারবোনা।

আমার এই পরীক্ষায় নাইনটি আপ পেতেই হবে তা না হলে আমি সাইন্স পাব না। আমি পনেরো তারিখ রাতেই ঢাকা যাব। মার তো আর দিন কাটে না। নামাজে বসে কি ভাবে আর কি বলে মা তা নিজেই বুঝেনা। রাতের পর রাত কেটে যায়।

মায়ের দুই চোখ এক হয় না। মা বারান্দার রকিং চেয়ারে বসে দোল খায়। মেয়েটার বাবা এসে কখন যে মায়ের পিছনে দাঁড়ায়। বলে - ঘরে চল ঘুমাবে। মা জিজ্ঞাস করে- তুমি ঘুমাওনি।

-ঘুম আসছে না। -কিছু বল না যে? - কি বলবো কোন কথাই তো খুঁজে পাই না। -শোন ডাক্তার যদি বলে মেয়েটার পা টা কেটে ফেললে ও সুস্থ্য হয়ে যাবে তবে কি করবে তুমি? - এখনও তো আমরা জানি না মেয়ের কি হয়েছে? - মনে কর এটাই হয়েছে? কি করবে বলনা? - যা ভালো হবে তাই করবো। - না একটা কথা মনে রেখো আমি মরে গেলেও আমার মেয়ের পা কাটতে দেব না। - কক্ষোনো তা হবে না।

বাবা মায়ের পিঠে হাত রেখে বিড় বিড় করে বলছেন - তুমি না চাইলে কিছুই হবে না । মেয়ে জন্ম দিয়েছো তুমি ওর সব ব্যাপারে সিদ্ধান্ত তুমিই দিবে। বাবা পাগলের মত কা৬দতে লাগলেন। সেহেরীর সময় হয়। ফজরের আজান পরে।

বাবা জায়নামাজেই বসে থাকে। থাকতে থাকতে ডুকরে কেঁদে উঠে। মাঝে মাঝে জোরে জোরে দো’য়া পড়ে চিৎকার করে কাঁদে। মা জানত চায়- কেন এমন করছো ?, বাবা তখন বলেন- খোদা যেন শুনতে পায়------বাবা মা নিঃশব্দে চোখের জলে ভাসে। আকাশের দিকে তাকায়।

কোথায় মুক্তি মেলে তাই খোঁজে। এর পরের ইতিহাস খুব দীর্ঘ নয়। সারা ঢাকা শহর ছেঁচে মা জেনেছেন মেয়েটার পায়ে ব্যাথা খেলার কারনেই। ডাক্তার শুধু একটা ব্যায়াম করতে বলেছেন ও গরম স্যাঁক দিতে বলেছেন। কোন ম্যাডিসিন না শুধু ব্যায়াম।

যে ঔষধ খাওয়ানো হচ্ছিল তা তাৎক্ষনিক ভাবে বন্ধ করে দিলেন। ব্যাংককের ডাক্তারও বলেছেন--এটাকে বলা হয় গ্রোইং পেইন। বাচ্চার গ্রোথ ভালো এবং খেলাধুলা করে তাই বোন টেনসন অনেক সময় সহ্য করতে না পারলে এই ধরনের পেইন হয়। কোন ম্যাডিসিন না শুধু ব্যায়াম।
 


অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।