আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

স্বামী বিবেকানন্দ : সার্ধ শতাব্দীর চালচিত্র

স্বামী বিবেকানন্দের সার্ধশতজন্মবার্ষিকীতে সবাইকে জানাই আন্তরিক শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন । বহুরূপে সম্মুখে তোমার, ছাড়ি কোথা খুজিছ ঈশ্বর ? জীবে প্রেম করে যেই জন, সেই জন সেবিছে ঈশ্বর । । স্বামী বিবেকানন্দের সার্ধশতবর্ষের পরিপ্রেক্ষিতে, আমরা বিশ্লেষণে প্রয়াসী হব, তাঁর আধ্যাত্মিক চিন্তার মূল অভিমুখ, আমাদের জাতীয় সত্তার প্রসঙ্গ, সমাজের জাতিভেদ প্রথার কুসংস্কার এবং জাতীয় জীবনে নারীদের স্বতন্ত্র গুরুত্বের প্রশ্নে, তাঁর নির্দিষ্ট অবস্থান। পরিশেষে, আমরা মূল্যায়ন করব দেশের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক মুক্তির প্রসঙ্গে স্বামী বিবেকানন্দের গভীর অবদানের কথা।

ভারতীয় সংস্কৃতির ঐতিহ্যের অন্যতম স্তম্ভ নির্মিত হয়েছিল ধর্মীয় সমন্বয়বাদের প্রেক্ষাপটে। উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে তার অন্যতম বিশিষ্ট ধারক ছিলেন রামকৃষ্ণ পরমহংসদেব। স্বামী বিবেকানন্দ ছিলেন রামকৃষ্ণ পরমহংসদেবের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য শিষ্য। স্বামী বিবেকানন্দের অভিধায় ভূষিত হওয়ার আগে, যুবক নরেন্দ্রনাথ দত্তের প্রথম সন্ন্যাস-নাম ছিল বিবিদিষানন্দ। নরেন্দ্রনাথ যখন প্রথম রামকৃষ্ণ পরমহংসদেবের সান্নিধ্যে এসেছিলেন, তখন পরমহংসদেব তাঁকে গ্রহণ করেছিলেন পরম উষ্ণতায়।

বিবেকানন্দের প্রথম উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ সুচিত হয়েছিল, তিনি যখন পরমহংস রামকৃষ্ণদেবের ঐতিহ্যকে ভারতে ও বিদেশে প্রচারের সূত্রে, রামকৃষ্ণ মিশন প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে, দেশের ধর্মীয় সমন্বয়বাদের ঐতিহ্যকে সন্নিহিত করেছিলেন। বিবেকানন্দের অসাধারণ ব্যক্তিত্বের প্রতি আকৃষ্ট হয়েছিলেন বহু বিদ্বজ্জন। তাঁদের সাহায্যে তিনি আমেরিকাতে, ১১ই সেপ্টেম্বর, ১৮৯৩ সালে, শিকাগো শহরে তাঁর ঐতিহাসিক ভাষণ প্রদান করেছিলেন আন্তর্জাতিক ধর্মীয় সম্মেলনে। সেই ভাষণের সূত্রে, ভারতীয় সাধনার সমন্বয়বাদের ঐতিহ্য দেশে ও বিদেশে প্রসারিত হতে শুরু করেছিল। ভারতবর্ষে প্রত্যাবর্তনের পরে স্বামী বিবেকানন্দের রাজনৈতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক চিন্তার প্রসঙ্গগুলি বহু ধারায় প্রসারিত হয়েছিল।

স্বামী বিবেকানন্দের রচনাবলী পাঠ করার পরে, সুভাষচন্দ্র অনুধাবন করেছিলেন যে, বিবেকানন্দের শিক্ষার মূল লক্ষ্যবস্তু ছিল আধ্যাত্মিক ও চারিত্রিক উন্নতি, দেশাত্মবোধ, নারীদের প্রতি সম্মানবোধ এবং মানবসেবা। সুভাষচন্দ্র লিখেছিলেন, ‘আমার জীবনে যখন বিবেকানন্দের আবির্ভাব ঘটে, তখন সবে পনেরয় পড়েছি। তারপর আমার মধ্যে শুরু হলো এক বিপ্লব। ... তাঁর শিক্ষা থেকে বিবেকানন্দকে এক পূর্ণ বিকশিত ব্যক্তিত্ব বলেই আমার বোধ হয়েছিল। ... এখন বিবেকানন্দের প্রদর্শিত পথের কথাই ভাবতে লাগলাম’।

বিবেকানন্দের প্রধান শিষ্যা ভগিনী নিবেদিতা বলেছিলেন যে, স্বামীজির আরাধ্যা দেবী ছিলেন তাঁর মাতৃভূমি। সুভাষচন্দ্র একাধিকবার বলে ছিলেন ‘বিবেকানন্দের ‘ideal হচ্ছে আমার ideal’। হুগলী জেলার ছাত্র সম্মেলনে (২১শে জুলাই, ১৯২৯) সভাপতির ভাষণে সুভাষচন্দ্র বলেছিলেন, ‘ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষ দিকে এবং বিংশ শতাব্দীর প্রারম্ভে স্বাধীনতার অখণ্ডরূপের আভাস রামকৃষ্ণ-বিবেকানন্দের মধ্যে পাওয়া যায়। “Freedom, freedom is the song of the soul”, এই বাণী যখন স্বামীজীর অন্তরের দুয়ার ভেদ করিয়া নির্গত হয়, তখন তাহা সমগ্র দেশবাসীকে মুগ্ধ... করিয়া তোলে। স্বামী বিবেকানন্দ মানুষকে যাবতীয় বন্ধন হইতে মুক্ত হইয়া খাঁটি মানুষ হইতে বলেন এবং অপরদিকে সর্বধর্ম সমন্বয় প্রচারের ভিত্তি স্থাপন করেন’।

স্বামী বিবেকানন্দের অখণ্ডতার আদর্শই ছিল সুভাষচন্দ্রের আদর্শ, যে আদর্শ শুধু রাজনৈতিক বন্ধনমুক্তির কথা বলেনি, অর্থনৈতিক ও সামাজিক বন্ধনমুক্তির কথাও বলেছিল। বিবেকানন্দের শিক্ষার একটি মূল কথা হলো চরিত্রগঠন ও খাঁটি মানুষ তৈরি করা। তাঁর নিজের কথায়, ‘সামাজিক ও রাজনীতিক সর্ববিধ বিষয়ের সফলতার মূল ভিত্তি — মানুষের সাধুতা। রংপুরে বঙ্গীয় প্রাদেশিক সম্মেলনে (৩০শে মার্চ, ১৯২৯), সুভাষচন্দ্র সভাপতির ভাষণে বলেছিলেন, ‘নিজের দেশের নবীন জাতি সৃষ্টির কাজও বিবেকানন্দ আরম্ভ করিয়াছিলেন। ... তাই তিনি বলিলেন “Man making in my mission।

...বিবেকানন্দের এই চিন্তা যে কত সঠিক তা বোঝাতে গিয়ে সুভাষচন্দ্র, রংপুরে প্রদত্ত ভাষণেই তিনি লেনিনের চিন্তার কথা উল্লেখ করেছিলেন, বিশেষত, স্বদেশকর্মীর প্রয়োজনে। তিনি লেনিনকে উদ্ধৃত করেছিলেন : It is better to get hold of ten able men than hundred dullards’। তারপরে সুভাষচন্দ্র উল্লেখ করেছিলেন : ‘স্বামী বিবেকানন্দও বলেছেন ‘‘দশটা মানুষ পেলে আমি ভারতবর্ষ উলটে দিতে পারি। কিন্তু মানুষ চাই, পশু নয়। স্বামী বিবেকানন্দ উদাত্ত আহ্বান জানিয়েছিলেন আমাদের এখনও জগতের সভ্যতার ভাণ্ডারে কিছু দেবার আছে।

তাই আমরা বেঁচে আছি’’। হুগলীর ছাত্র সম্মেলনে সুভাষচন্দ্র বিবেকানন্দের অবদানের পুনরায় উল্লেখ করে বলেছিলেন : ‘‘কর্মহীন সন্ন্যাসে বা পুরুষ্কারহীন অদৃষ্টবাদে তিনি বিশ্বাস করতেন না। ’’ বিবেকানন্দ সুস্বাস্থ্যের উপর গুরুত্ব আরোপ করে বলেছিলেন : ‘‘আমাদের যুবগণকে প্রথমত সবল হইতে হইবে, ধর্ম পরে আসিবে। গীতাপাঠ অপেক্ষা ফুটবল খেলিলে তোমরা স্বর্গের আরও নিকটবর্তী হইবে। ... তোমাদের বলি, তোমাদের শরীর একটু শক্ত হইলে তোমরা গীতা আরও ভাল বুঝিবে।

’’ বিবেকানন্দের হৃদয়ের সহজ-বিশ্বাসের তীব্র আকুলতা তার গদ্যকে ছন্দায়িত কবিতার কম্পন-মুখরতা দান করেছিল। তার বহু প্রবন্ধই প্রথমে বক্তৃতার আকারে কথিত হয়েছিল। তাঁর গদ্য-রচনার মধ্যে ‘বর্তমান ভারত’, ‘প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য’, ‘পরিব্রাজক’ ইত্যাদি অবিস্মরণীয়। বিবেকানন্দ মনে করতেন আমাদের দুর্দশার একটি বড় কারণ নারীজাতির প্রতি অবজ্ঞা। তিনি বলতেন মেয়েদের এমন শিক্ষা দিতে হবে ‘‘যাতে character form (চরিত্র তৈরি) হয়, মনের শক্তি বাড়ে, বুদ্ধির বিকাশ হয়, নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারে ... ঐ রকম শিক্ষা পেলে মেয়েদের problems (সমস্যাগুলো) মেয়েরা নিজেরাই solve (মীমাংসা) করবে।

এ সময় তাদের (আত্মরক্ষা) শেখা দরকার হয়ে পড়েছে। স্বাধীনতা আন্দোলনের নীতি ও পদ্ধতির প্রসঙ্গে, বিবেকানন্দ ও সুভাষচন্দ্রের দৃষ্টিভঙ্গির মিল ছিল। সুভাষচন্দ্র একবার তাঁর বন্ধু দিলীপকুমার রায়কে বলেছিলেন, ‘আমি যদি তাঁর (বিবেকানন্দের) কাছ থেকে কিছু শিখে থাকি ভাই, সে তাঁর এই দেশপ্রেম। ’ স্বামী বিবেকানন্দের সার্ধশতবর্ষে, আমাদের দেশ গড়বার পথিকৃতদের প্রতি আমার অনুরোধ দেশ প্রেমিক হন সবাই । দেশকে প্রান দিয়ে ভালবাসুন ।

আর তেমন কিছু আবশ্যক নেই আছে শুধু প্রেম ,সরলতা ও সহিষ্ণুতা । ।

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে ১১ বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।