আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

সুজাতা সুখে আছে

বিকালের রোদ আড় হয়ে পড়েছিল আমাদের পরিচিত গলির চায়ের আসরে। ভেবেছিলাম আজ সন্ধ্যাটা একটু অন্যরকমভাবে কাটাব। ওই একঘেয়ে চায়ের আসরে যাব না। কিন্তু ওই সময় অনীশের জন্য আমি এমন কাঙাল হয়ে উঠেছিলাম যে ওই আসরে মানিক আজ থাকবে জেনে আমি তড়িঘড়ি টিউশনি শেষ করে বাস ধরে চলে এসেছিলাম এই আড্ডায়। তাও প্রায় একরকম ছুটতে ছুটতে।

মানিক কাপের সবটা চা এক চুমুকে শেষ করে বাঁহাতের উল্টো দিক দিয়ে ঠোঁট মুছল। মানিক দেখতে অনেকটা তারেক মাসুদের মতো। চওড়া কপাল। টানটান, চকচকে ত্বক। টেবিলের ওপর পা তুলে চেয়ারে উঁচু হয়ে বসে বলল সে ব্লাউন্ড ১০০ টাকা হিট, রাজি? পার্থ মুচকি হেসে বলল রাজি।

হুমায়ূন একটা সিগারেট নিয়ে তার ভেতর থেকে তামাক বের করছিল। মানিক খানিকটা নিচু স্বরে বলল, চলবে নাকি একটা? বললাম, ছেড়ে দিয়েছি। কেউ জানে না কার জন্য আমার এই সন্ন্যাসবৃত্তি। আমি তখন অনীশকে বেপরোয়া বুনো ষাড়ের মতো ভালোবাসতে শুরু করেছিলাম। কিন্তু অনীশের রহস্যময় উদ্ভ্রান্ত চালচলনে তার কাছ থেকে পাত্তা না পেয়ে মনের মধ্যে আত্দবিশ্বাসের খুঁটিটা কেমন যেন নড়বড়ে হয়ে যাচ্ছিল।

তখন মানিকের ভবিষ্যদ্বাণীর ক্ষমতার ওপর মনেপ্রাণে নির্ভর করতে চাইছিলাম। আমি অল্প একটু হেসে বললাম, মানিক আপনার সঙ্গে আমার জরুরি কিছু কথা আছে।

একদম ঠিক ঠিক জবাব দিতে হবে কিন্তু। মানিক হাসতে হাসতে বলল, আরে বাপরে! কী এমন সাংঘাতিক কথা যে, একদম ঠিকঠাক জবাব চাই।

আমি খানিকক্ষণ মাথা নিচু করে বললাম, বলেন তো আমার কপালে ভালোবাসার শোক আছে কিনা।

মানিক মুচকি হেসে বলল, এসব বিষয়ে কি এত নিশ্চিত করে কিছু বলা যায়?

আমি জোর দিয়ে বললাম, কেন যাবে না, আপনি এত বড় অ্যাস্টলজার, কত বড় বড় ডিগ্রি, ডক্টরেট করেছেন, কত বছর ধরে কত বিষয়ে ভবিষ্যদ্বাণী করে আসছেন...। বলেন ভালো করে, আমার রেখাটেখা বিশ্লেষণ করে তারপর বলেন...।

মানিক আমার হাত অনেকক্ষণ মনোযোগের সঙ্গে পর্যবেক্ষণ করল। তারপর হুমায়ূনের কাছ থেকে একটা সিগারেট চেয়ে নিয়ে উদ্বিগ্ন ভঙ্গিতে টান দিল। পার্থের দিকে চোখ সরু করে বলল, তুই একটা টান দিবি না?

পার্থ বলল না, তুই-ই খা।

আমার ইচ্ছা নেই আজ। আমি ধরা গলায় বললাম, কই মানিক বললেন না তো।

মানিকের মুখটা আবারও বিষণ্ন হয়ে গেল, তবু খুবই সুখী স্বরে বলল, তোমার মকর রাশি। মকর রাশিতে এ সময় আছে রাহু ও শুক্র। আর পাশাপাশি দ্বাদশ ঘরে ধনুতে অবস্থান করছে মঙ্গল।

রাহু মানে ধ্বংস আর শুক্রের জন্য আসে আগুন। দ্বাদশে মঙ্গল মানেও ধ্বংস। কিন্তু বৃহস্পতি এ সময় বৃশ্চিকে একাদশ ঘরে আছে বলেই ভরসার কথা। এদিকের রেখাটাতে বুধের প্রাধান্য আবার রবির প্রাধান্যও প্রকট। তোমার প্রেমে মঙ্গলই খুব প্রবল, খুব সুখী হবে তুমি।

পার্থ প্রবল অবিশ্বাসের হাসি হাসছিল। তারপর বলল, বন্ধুকে না ঠকিয়ে বটতলায় গিয়ে বসলেও তো পারিস। ধারের টাকায় এসব ছাইপাশ গিলতে হয় না। যত্ত সব চোট্টানি। তোরও সুজাতা ন্যাকামির কমতি নেই।

কোথাকার কোন এক গাঁজাখোর মানিক...।

আমি হেসে বললাম, গাঁজাখুরি বলছেন কেন, হতেও তো পারে। হুমায়ূন হাত বাড়িয়ে শেষ হয়ে আসা সিগারেটটা নিল। তারপর দুটো লম্বা টান দিয়ে খক খক কাশল।

তাসের টেবিল থেকে তুমুল একটা হৈচৈ শোনা গেল।

হুমায়ূন উঁচু গলায় বলল, মানিক একটা জোচ্চর, দ্যাখ হাত দেখার নামে কীভাবে সুজাতার সঙ্গে জোচ্চুরিটা করছে। তাও আবার ইশ্বরের নামে জোচ্চুরি, যেন ঈশ্বর যা জানে, ঈশ্বর যা লিখে রেখেছে সুজাতার জন্য... সব সে জানে। আমি সর্বস্ব বাজি ধরে বলছি, মানিক যা বলছে তা যদি সুজাতার জীবনে ক খ নও সত্যি হয়, তো আমি... আর্থিক দুদর্শার সেই চরম দুঃসময়ে যখন ভালো বাসাবাসিকে বন্ধুমহল নিতান্তই বুর্জোয়া বিলাস হিসেবে শক্ত গালি দিত আমি সেসব প্রতিজ্ঞা বিস্মৃত হয়ে ভালোবেসে ফেললাম তাকে। সেই তাকে যে আবার অমিত রায়ের মতো বিশ্বাস করত আফিমওয়ালী বাঁধে ও বটে, ভোলায়ও কাজেই তাকে ভোলানো সহজ ছিল না, আর ভোলানোর প্রশ্নই বা আসছে কোথা থেকে, কেননা আমি তো তার জন্যই আমার সবকিছু নিয়ে বসেছিলাম সর্বনাশের আশায়। অথচ তার দিকে সম্পূর্ণ মনোযোগ দিলে সে এমন তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করে বিপরীতে কোনো নারীর প্রতি এত আগ্রহী হয়ে উঠত যে, মনে মনে কতবার যে সে সব নারীকে আমি খুন করেছি! ভালোবাসা অবহেলিত হলে সবারই এক সময় পুতুল নাচের ইতিকথার কুসুমের দশা হয়।

কোনো কিছুই করে উঠতে না পেরে অপেক্ষা করতে থাকলাম কবে আমার সেই কুসুম দশা হয়। অথচ সব ফর্মুলাকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে তার প্রতি আমার ভালোবাসা তাকে কাছে পাওয়ার সাধ এবং স্বাদ উত্তরোত্তর বেড়েই চলছিল। একটা বোবা ব্যথা আমার পাঁজরের হাড়গুলোকে এমনভাবে চেপে ধরত যে, আমি মরিয়া হয়ে বাঁচার কিংবা মরার উপায় খুঁজে ফিরছিলাম। মৃত্যুর মুখেও নিঃসঙ্গতার ঘোর একাকিত্বে দাঁড়িয়ে থাকা একলা আমার চিৎকার করে বলতে ইচ্ছা করত, 'আমি আমার ভালোবাসার স্বীকৃতি চাই। ' অথচ জানতাম, ভালোবাসা না চিৎকার না স্বীকৃতির অপেক্ষা।

তবে আমার মতো দুর্দশায় যারা পড়েছেন কেবল তারাই বুঝবেন এটা ঠিক শিমুল কাঠের আগুনের মতো পোড়া নয়, তুষের আগুনের মতো পোড়া। সত্যিই তাকে শেষের কবিতার অমিত রায় বললে বোধহয় মিথ্যা বলা হবে না। কারণ সে মিলন নয়, সাধনা করত মুক্তির, তার কথাই ছিল স্ফুলিঙ্গ, যুক্তির তোড়ে নিমিষেই অন্তঃসারশূন্য প্রমাণ করে দিত বিখ্যাত সব মানুষদের। অমিত রায়ের মতো তারও ছিল নিরাসবারের সাধনা। কী বিচিত্র অনুভূতি মানুষের! কী বিভীষিকাময় দুঃসহ আবেগে যে আমি পুড়ছিলাম অথচ ঠিক ওই সময়টাতেই জীবনকে আমি নিবিড়ভাবে ভালোও বাসতে শিখেছিলাম।

আদ্যোপান্ত কাটখোট্টা আমি নিমিষেই রূপান্তরিত হলাম এই গ্রহের সবচেয়ে রোমান্টিক নারীতে। যত্ন করে চোখে কাজল দিয়ে মায়াবতী হওয়ার চেষ্টা, নিজেকে ঘষে-মেজে একটু ফর্সা করার চেষ্টা, চার ইঞ্চি হিল পরে একটু দীর্ঘাঙ্গী হওয়ার চেষ্টা... আবৃত্তির ঢঙয়ে কথা বলার চেষ্টা, কণ্ঠে ভাঁজ আনার চেষ্টা... হায়! কত হাস্যকর চেষ্টাই না করেছিলাম একটুখানি তার মনোযোগ কাড়ার জন্য। কারও নিষ্ঠুর বড়শিতে আপনার হৃদয় বিদ্ধ হলে নিশ্চয়ই আমার সেদিনের অবস্থা আপনি অাঁচ করতে পারবেন। দুর্দশা করুণ হতে হতে অবস্থা এমন দাঁড়াল যে, কৃষ্ণপক্ষের বিলম্বিত ক্ষয়িত চাঁদ আর শুক্লা চতুদর্শীর চাঁদের পার্থক্য নির্ধারণ করাও আমার পক্ষে সম্ভব ছিল না।

মাধবীলতা দিয়ে সাজানো গেট।

মানুষসমান উঁচু প্রাচীরঘেরা বাড়ি। সাদা পাথর বিছানো পথ চলে গেছে বহুদূর, তারপর মূল ভবন। বাইরে থেকে দেখলে মনে হবে আলোর সাগরে ডুবে আছি আমি। কিন্তু ভেতরে ঘোরতর অন্ধকার। গারবেজ ক্যানে পেপার প্লেটগুলো ফেলে বোন চায়নার দুর্লভ সেটটা ঢোকানো হলো ডিশওয়াশারে।

পার্টি নামক মজমা শেষ; এখন পড়ে আছে কেবল তার কিছু নষ্ট চিহ্ন। কোনার দিকে মাস্টার বেড ভরে আছে টেবিল ল্যাম্পের লেবু পাতার মতো নরম আলোয়। নিজেকে মনে হচ্ছে একটা ধ্বংসস্তূপ। তবু সেই ধ্বংসস্তূপটাকেই এখন টেনে টেনে নিয়ে যেতে হবে ওয়াশরুমে। শাওয়ারের নিচে দাঁড়িয়ে সাফ করতে হবে শরীরের কলঙ্ক।

চোখ ঘুমে ঢুলুঢুলু। তবু সে অবস্থাতেই দীর্ঘক্ষণ করতে হবে স্নান। আজকের অতিথি বিশেষ কেউ। খুবই বিশিষ্ট কেউ। স্নান সেরে চুলে তোয়ালে জড়িয়ে হাউস কোটের বোতাম লাগাতে লাগাতে মনে হলো মাথা ছিঁড়ে পড়ছে, পুরো শরীরে ব্যথা।

জ্বর আসছে জমিয়ে। তবু উপায় নেই এ অবস্থাতেই তাকে আত্দসমর্পণ করতে হবে ওই বিশেষ মানুষটির কাছে। উত্তেজনায় আকণ্ঠ ডোবাতে হবে তাকে যা রোজ রাতেই হয়। ওডিকোলনের এক বুনো ঘ্রাণ মাতাল হয়ে ঢুকছিল মাথায়। কত রাত হবে এখন? একটা? দুটো? রঞ্জিত সেন হুইস্কি জড়ানো গলায় বলে যাচ্ছে, তুমি তো ভাবো আমি একটু এঙ্ট্রোভার্ট ধরনের।

বল, ভাবো না? আমার পার্টির কেউ কেউ বোধহয় তাই-ই ভাবে। কিন্তু সুজাতা, আমি শুধু তোমার কাছেই আসি। দেয়ার ইজ নো সেকেন্ড লাভ ইন মাই লাইফ। অস্বীকার করব না, তোমার শরীরই টানে আমাকে, ইনফ্যাক্ট আমার বউয়ের শরীরের প্রতিও আই অ্যাম নট ইন্টারস্টেড। শি হার্ডলি টাচেস মি দিস ডেইজ বাট নাথিং হ্যাপেনস; কিন্তু তোমার কাছে এলেই আমার কী যে হয়...।

তুমি, তুমি... তুমি সুজাতা ভাবো আমি খুব চতুর, খুব কৌশলী ধরনের মানুষ। কিন্তু সিরিয়াসলি সেইং নিজের জীবনকে আমি কখনো এঙ্প্লয়েট করিনি। বহুবারই সে ধরনের সিচুয়েশন হয়েছিল, টেমটেশনও ছিল। কিন্তু আলটিমেটলি নিজেকে আমি কো-আপ করেছি। ভদ্রলোকেরা বুঝি এঙ্ট্রা ম্যারিটাল অ্যাফেয়ার করতে পারে না? যে সব লেফটিস্টদের তুমি দেবতা ভেবে প্রতিদিন তাদের মূর্তিতে ধুপধুনো দিয়ে যাচ্ছ, তাদেরকে আমি চিনি... সব একেকটা মিচকে শয়তান... আমি বললাম, চার পেগের বেশি হয়ে গেছে, এবার বিশ্রাম নিলে হয় না? সে ভাবল আমি প্রসঙ্গ পাল্টাতে চাইছি।

কাজেই স্বর আরও চড়ল। সেই চড়া স্বর... রাতের নির্জনতা ভাঙছে। শোন শোন... বলছে সে, বিপ্লবের স্মৃতি রোমন্থন আর শুকনো তত্ত্বের সঙ্গে রাতদিন কাটানো আমার পক্ষে সম্ভব নয়। সম্ভব নয় বলেই তো পার্টি ছেড়েছেন, বললাম।

হ্যাঁ ছাড়বই তো।

গরম গরম বক্তৃতা দিয়ে মানুষের রক্তে আগুন ধরিয়ে দেওয়া যায়; কিন্তু যাদের জন্য বিপ্লব দরকার তাদের জন্য কিছুই করা যায় না। এবং সেটা আমি বুঝেছি বলেই আই অ্যাম রাইনিং আর তোমার ওই বিপ্লবী হি ইজ নাথিং বাট অ্যা বিচ, হি ইজ এ পানজেন্ট স্মেল। বাট আই অ্যাম আইফেল টাওয়ার। কী সব ফিল্মি ডায়লগ... নিরক্ষর মানুষকে অক্ষর দিতে হবে... গরিব চাষিদের ইউনিয়ন করে দিতে হবে... জোতদার মহাজনদের শোষণ বঞ্চনার ইতিহাস শোনাতে হবে... আরে একবার ইলেকশনে নেমে দ্যাখ... তোর ভোটের বাঙ্ হবে গড়ের মাঠ... যদি না হয় তো আমি রঞ্জিত সেন রাজনীতি ছেড়েই দেব...।

হতে পারে অনীশদের বিপ্লবটা সফল হয়নি; কিন্তু তাতে তো তাদের স্বপ্নটা মিথ্যা হয়ে যায়নি।

সুজাতার স্বরে হয়ত কিছু একটা ছিল, রঞ্জিত সেনের রক্তে দাবানল ছুটছে-ডোন্ট ট্রাই টু গিভ মি লেকচার আই হেট লেকচারস। আই অ্যাম সিক অব লেকচারস, ডিসগাস্টেড অব লেকচারস। যে সুযোগ পায় সে-ই আমাকে লেকচার শোনাতে চায়। ঘরের বউ, প্রতিপক্ষ, নিজপক্ষ হাইকমান্ড এমনকি তুমিও। চল তোমাকে আমি জার্মানির ট্রিয়ের শহরে নিয়ে যাব, সেখানে কার্ল মার্কসের বাড়ি কোথায় জিজ্ঞাসা করলে সব হাঁ করে মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে।

সেখানে একজন মানুষকেও তুমি খুঁজে পাবে না, যে মার্কসের বাড়ি চেনে। খোদ জার্মানিতেই যার এ ধরনের দুর্দশা তাকে নিয়ে তোমাদের এই আদিখ্যেতার মানেটা কী?

তোমার ওই অনীশও কিন্তু ওয়াইন খায়; কিন্তু পৃথিবীর সেরা ওয়াইনটা কোথায় পাওয়া যায় গাধাটা সেটা জানে না। ও হলো একটা কাসেদ আলী মার্কা বাম।

মানে? সুজাতার কণ্ঠে কৌতূহল।

কাসেদ আলী মার্কা বাম মানে হলো- অন্ধ এবং আবেগপ্রাণ মার্কসবাদী।

যে নিজেই মোহ আর বিভ্রান্তির শিকার।

সুজাতার আজকের অতিথি সাফারি স্যুট। রঞ্জিত সেনের মতো তারও প্রবল বিদ্বেষ বামদের ওপর। কেন? অনীশ ওই ধারাতে আছে এ জন্য? নাকি তারা নিজেদের জীবনে সম্ভোগের কাছে পরাজিত হয়েছে? আমাদের কাছে মার্কসবাদ হলো সাত অন্ধের হাতি দেখার মতো। মার্কসের এই হাতুড়ে দশা হয়েছে তোমার অনীশের মতো বামদের হাতে এসে।

বলেই সে সুজাতার বেতসলতার মতো ভাজহীন কোমরে চুমু খেয়ে চনমনে গলায় বলল দ্য বেস্ট ইজ জাস্ট গুড এনাফ ফর মি। তার কণ্ঠস্বর আরও ঘন হয়ে এলো, আমার বিজনেসের একটা ব্রাঞ্চ খোলা হয়েছে ওয়েস্ট কোস্টে। সেখানে তুমি আমার সঙ্গে কাজ করবে। অনীশকে নিয়ে সুজাতার মনের মধ্যে চলছে টাগ অব ওয়্যার। অথচ তখনো তার ঠোঁট প্রবেশ করে আছে সাফারি স্যুটের ঠোঁটে।

সাফারি স্যুট অবিরল তার ঠোঁট থেকে শুষে নিচ্ছে আগুন। বহুক্ষণ ধরে এভাবেই চলবে, নয়ত সাফারি স্যুটের রক্তের প্রলয়ঙ্করি নাচন বন্ধ হবে না। তারপর এক সময় সাফারি স্যুটের ঝড়ো তাণ্ডব উঠে আসবে রক্তে। আর রক্তের মধ্যকার সেই ভয়ঙ্কর তাণ্ডব তাড়িয়ে তাড়িয়ে সম্ভোগ করবে সাফারি। সাফারি শুনতে চাইবে সুজাতার শরীরের প্রমত্ত পাড় ভাঙার শব্দ।

ভুল হিসেবে ডুবে যেতে যেতে সুজাতারও এক সময় মনে হবে আনন্দ ও এমন বিস্ময়কর! এমনই সীমাহীন! ব্যাকুল স্বতঃস্ফূর্ততায় শরীর সাড়া দেবে শরীরের সব আহ্বানে। এক সময় গভীর ক্লান্তির অতলতায় নিমগ্ন হবে সুজাতা। নিজেকে মনে হবে ধ্বংসস্তূপ। তবু তার নিয়তি এই যে, এই ধ্বংস্তূপে বিলীন হওয়ার জন্যই তার এই পেশা। এই পেশায় কি নেশার মাহাত্দ্যও নেই? এই যে প্রতিদিন নিত্যনতুন তৃষ্ণাকাতর জিভ তার সর্বাঙ্গ লেহন করে ভণ্ডামি করে কেন বলবে সে, এ শুধু কষ্টের কাহন? নিজের শরীরের ওপর ঘেন্না ধরে গেছে তার।

না না তা সে বলবে না। এত ক্লিশে কথা সে বলে না, এত ক্লিশে ভাবনাও সে ভাবে না। ওই নিষ্ঠুর হৃদয়হীন মানুষটার অবহেলার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে নিজেকে এই নেশায় বিলীন করা ছাড়া তার ভিন্ন উপায় ছিল না।

উচ্চকিত হয় সাফারির কণ্ঠ, অনীশকে উদ্দেশ করে সে প্রায় চিৎকার করে, আরে তোর ওই মিডল ক্লাস আইডেনটিটি যদি মুছতেই চাস, তাহলে আমার কাছ থেকে ট্রেনিং নে। অ্যান্ড ইউ উইল গেট দ্য সাকসেস।

সুজাতার তিরিক্ষি মেজাজটা আরও তিতকুটে হয়ে যায়। তবু সাফারি স্যুট চেঁচাতেই থাকে, তোর সুহিতা সুলতানাকে কি আমি কেড়ে নিয়েছি নাকি, সে তো বিক্রি হওয়ার জন্য রেডি হয়েই ছিল।

আর তোদের রিলেশনটাইবা ছিল কেমন যে একটা চাকরির আশায় তোর বউ চলে আসে আমার কাছে...। আর রিলেশন আবার কি? একটা ফ্রেন্ডশিপ ছিল। কিছুদিন একসঙ্গে ঘুরেছি।

ও আমাকে দুটো চুমু খেয়েছে... আমি ওকে দুটো চুমু ফেরত দিয়েছি। ব্যস। দি রিলেশন ইজ ওভার...। তোমার অনীশ দা তো সেই থেকে বুকের মধ্যে তুষের আগুন নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে।

সুজাতা ভাবে গাধাটা জানেও না অনীশকে সে দাদা কিংবা ভাই কিচ্ছু বলে না।

যাকে সে দাদা কিংবা ভাইয়ের মতো দেখে না, তাকে সেটা বলতে যাবেইবা কেন?

মনের মধ্যে চোরা কষ্টরা উঁকি দিল। আরও একটা ব্যর্থ দিন পার হতে যাচ্ছে। এ রকম শত শত দিনের ব্যর্থতা জমে জমে একদিন সে শন বুড়ি হয়ে যাবে। শরীরের মধ্যে এখন অ্যালকোহল। শিরায় শিরায় তার উত্তাপ... স্কচের বোতলটা মুঠো করে ধরে অনেকখানিক গলায় ঢেলে দিল তার।

যে মানুষটা তাকে মানুষই ভাবছে না তার জন্য নিজেকে কষ্ট দেওয়ার কী মানে থাকতে পারে তাও জানে না সে।

আশা রাক্ষসী আশা তবু মায়ার মতো মিশে থাকে মনে। সেই আশা... যে আশা মানিক তাকে দেখিয়েছিল হাত দেখে। বলেছিল খুব সুখী হবে সে...। রবীন্দ্রনাথের কুড়ানির মতো ওই মিথ্যা প্রতিশ্রুতিটুকুকে সম্বল করে প্রতিদিন কতবার যে মৃত্যু হয় তার...।

তবু আশা...। তারপরও মৃত্যু।

 

 

সোর্স: http://www.bd-pratidin.com/

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.