আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

নেপোলিয়ন ও জোসেফাইনের প্রেম

ফরাসি বিপ্লবের সময়কার একজন জেনারেল ছিলেন তিনি। ফরাসি প্রজাতন্ত্রের প্রথম কনসল যেমন ছিলেন, ঠিক তেমনি নেপোলিয়ন-১ নামে ১১ নভেম্বর ১৭৯৯ থেকে ৬ এপ্রিল ১৮১৪ পর্যন্ত ফ্রান্সের সম্রাট ছিলেন এবং পুনরায় ১৮১৫ সালের ২০ মার্চ থেকে ২২ জুন পর্যন্ত স্বল্প সময়ের জন্য ফ্রান্সের সম্রাট ছিলেন। তিনি ইতালির রাজাও ছিলেন। সারা বিশ্বে সর্বকালের অন্যতম সেরা সেনাপতি হিসেবে ইতিহাসে স্মরণীয় হয়ে আছেন তিনি। বহুল চর্চিত হয়েছে তার বর্ণাঢ্যময় জীবনগাথা।

আর তার জীবনের এক গুরুত্বপূর্ণ উপাদান ছিল প্রেম। তবে নেপোলিয়নের জীবনে ঠিক কতবার প্রেম এসেছিল, এটা হলফ করে কেউই বলতে পারবে না। তবে স্বীকৃত বিয়ে এবং অস্বীকৃত সম্পর্ক এই সবকিছুতে মোট তিনজন নারীকে তার জীবনে বেশি দেখা যায়। তবে সবাইকে ছাড়িয়ে গেছেন একজন। তিনি জোসেফাইন।

তাকে নেপোলিয়ন বিয়েও করেছিলেন। নেপোলিয়ন আর জোসেফাইনের প্রেম ইতিহাসে আলাদা একটি স্থান দখল করে আছে।

 

নেপোলিয়নের অনেক উক্তিই তাকে ইতিহাসে অমর করে রেখেছে। আবার অনেক উক্তিই তার ব্যক্তিত্ব-প্রজ্ঞা আর মানসিকতাকে করেছে প্রশ্নবিদ্ধ। তবু দিগ্বিজয়ী বীরের কথাগুলোকে ইতিহাস আলাদাভাবে স্মরণ করে সব সময়।

মেয়েদের নিয়ে নেপোলিয়ন একটা কথা বলেছিলেন- Women are nothing but machines for producing children. অর্থাৎ নারীরা কেবলই সন্তান উৎপাদনের যন্ত্র! আশ্চর্য! অথচ, ইতিহাস, ধর্ম, রাজনীতি এবং অন্যান্য বিষয়ে নেপোলিয়নের ধারণা যুগের তুলনায় কত অগ্রসর। অথচ নারী ভাবনায় তিনি এমন কেন? আসলেই কী নারীদের প্রতি বিরাগভাজন ছিলেন তিনি? না, নেপোলিয়নের বর্ণাঢ্য জীবন কিন্তু সে কথা বলে না। তিনি হয়তো সন্তানের জীবনে মায়েদের ভূমিকার কথা স্বীকার করতে গিয়ে অথবা কোনো নির্দিষ্ট ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে বলেছিলেন। এটা মেনে নিতেই হবে। কারণ নেপোলিয়নের জীবন মোটেও নারীসঙ্গের বাইরে ছিল না।

বরং যুদ্ধ-বিগ্রহে ঠাসা এই ফরাসি বীরের জীবনের একটা গুরুত্বপূর্ণ অংশজুড়েই আছেন তার প্রেমিকারা। আর অন্যান্য প্রেমিকা স্ত্রী ও রক্ষিতাদের তালিকা ছাপিয়ে ইতিহাসে একটা নামই এসেছে বারবার। তিনি মেরি জোসেফ রোজ টাচার। আর ইতিহাস তাকে চেনে জোসেফাইন নামে। এই জোসেফাইন আবার নেপোলিয়নের স্ত্রী হওয়ার আগে আরেকজনের স্ত্রী ছিলেন।

স্বামীর মৃত্যুর পর বিধবা রোজের দিন কাটছিল সাদামাটা। আর সে জীবনেই নেপোলিয়নের বর্ণিল ছোঁয়া লাগে অনেকটা নাটকীয়ভাবে।

এই নাটকের সূত্রপাত হয় যখন ডাইরেক্টরি শাসনকর্তারা প্যারির নাগরিকদের বাড়ি তল্লাশি করার ভার দেয় নেপোলিয়নের হাতে। উদ্দেশ্য ছিল বাড়ি তল্লাশি করে সেখান থেকে অস্ত্র বাজেয়াপ্ত করা। নির্দেশ মতো কাজ শুরু হয়ে গেল।

বাড়ি বাড়ি তল্লাশি চালিয়ে নেপোলিয়নের অধীনস্থ সেনারা সব অস্ত্র বাজেয়াপ্ত করছে। এর মধ্যেই ঘটল সেই নাটকীয় ঘটনা। ইউজিন নামের এক কিশোর বালক এসে হাজির নেপোলিয়নের কাছে। ইউজিনের আবেদন তার বাবা আলেকজান্ডারের তরবারিটি ফেরত দিতে হবে। কারণ এটাই তার বাবার স্মৃতিচিহ্ন।

ইউজিনের পিতৃপ্রেম আর সাহস দেখে অবাক হলেন নেপোলিয়ন। জানলেন ইউজিনের বাবা রোবসপিয়রের সন্ত্রাসের যুগে গিলোটিনে প্রাণ দিয়েছেন। ১২ বছরের বালকের দৃঢ়তা দেখে মৃদু হাসলেন নেপোলিয়ন। অধীনস্থদের নির্দেশ দিলেন ইউজিনকে তার বাবার তরবারি ফেরত দিতে। নেপোলিয়নের কাছ থেকে ছেলে ইউজিন যে অনুকম্পা পেয়েছে তা গিয়ে পেঁৗছাল মা রোজের কানে।

রোজ ছুটে এলেন কৃতজ্ঞতা জানাতে। সুন্দরী রোজের সৌজন্যবোধ ও আন্তরিকতায় মুগ্ধ হলেন নেপোলিয়ন বোনাপার্ট। আর এই মুগ্ধতা এতটাই তীব্র ছিল যে এই রোজই শেষ পর্যন্ত পরিণত হন নেপোলিয়নের প্রিয়তমা স্ত্রীতে। পরে অবশ্য তার নাম বদলে হয়ে যায় জোসেফাইন বোনাপার্ট। তবে জোসেফাইনের সঙ্গে নেপোলিয়নের দেখা হওয়ার এ ঘটনাটি নিয়ে মতভেদ রয়েছে।

আরেকটি মত অনুসারে জোসেফাইনের সঙ্গে নেপোলিয়নের দেখা হয়েছিল একটি পার্টিতে। নেপোলিয়ন তখন তুখোড় সেনাপতি। চতুর্দিকে তখন নেপোলিয়নের অনেক নাম-ডাক। পল বারাস নামক একজন রাজনৈতিক নেতার নজরে পড়লেন নেপোলিয়ন। বারাস তার বাসায় নেপোলিয়নের সম্মানে একটি পার্টি আয়োজন করলেন।

শহরের সব গণ্যমান্য ব্যক্তি উপস্থিত পার্টিতে। এর মধ্যেই এক অচেনা রমণীর ওপর চোখ পড়ল বীর সম্রাট নেপোলিনের। অপূর্ব সুন্দরী এই নারীকে দেখেই দারুণ ভালো লেগে যায় নেপোলিয়নের। কিন্তু পরক্ষণেই মনে হলো এ নিশ্চয়ই কারও না কারও ঘরনী। নেপোলিয়ন তখন গ্লাসের পর গ্লাস মদ গিলছেন।

এভাবে কতক্ষণ কেটে গেছে টের পাননি তিনি। হঠাৎ করে তিনি তার কাঁধে পেছন থেকে কারও স্পর্শ অনুভব করলেন। নেপোলিয়ন পেছন ঘুরে দেখেন সেই রমণী।

এ রমণীর ছোটবেলার নাম ছিল মেীি জোসেফ রোজ টাচার। মাত্র ১৬ বছর বয়সেই কিশোরী রোজের বিয়ে হয় হাইডেলবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের ১৯ বছর বয়সী ছাত্র আলেকজান্ডার দ্য বোহারনিজের সঙ্গে।

১৭৮০ সালে এই দম্পতির কোল আলো করে জন্মায় তার প্রথম পুত্র ইউজিন এবং ১৭৮৩ সালে কন্যা হরতেনস। গিলোটিনে স্বামীর প্রাণ গেলেও বেঁচে যান জোসেফাইন।

এই দুই সন্তানের জননী বিধবা রমণীকে দেখে নেপোলিয়নের এমন পাগল হয়ে যাওয়াটা ছিল বিস্ময়কর। কারণ জোসেফাইন ছিলেন নেপোলিয়নের চেয়েও ছয় বছরের বড়। তাহলে কিসের এত মুগ্ধতা?

পেছনের কারণ ঘাঁটতে গেলে দেখা যায়, নেপোলিয়ন খুব অল্প বয়সেই ফরাসি সেনাবাহিনীতে জেনারেল হন।

তার ঘাড়ে তখন বিশাল দায়িত্ব। নেপোলিয়নের অধীনে যারা ছিলেন তারা প্রায় সবাই তার থেকে বয়সে অনেক বড়। অসীম সাহসী আর বীরত্ব দেখিয়ে নিজের স্থান অর্জন করলেও বয়স্ক অধীনস্থদের নিয়ে বিব্রত হতেন তিনি। আর এই বিব্রত অবস্থা কাটাতেই নেপোলিয়ন বিয়ের কথা ভাবছিলেন। আর যদি বিয়ে করতেই হয় তাহলে এমন কাউকে করবেন যে হবে তার চেয়েও বয়সে বড়।

তাও শুধু বড় হলে হবে না, ধনীও হতে হবে। এতে তার অধীনস্থরা আর যাই হোক তাকে আর পুঁচকে ভাবতে পারবে না। আর এ কারণেই দুই সন্তানের জননী জোসেফাইনের প্রেমে হাবুডুবু খেলেন নেপোলিয়ন। মনের কথাটা জোসেফাইনের কান পর্যন্ত পেঁৗছেও দিলেন। কিন্তু প্রথমদিকে বিষয়টিকে একদমই পাত্তা দিলেন না জোসেফাইন।

অন্যদিকে পল বারাসের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল তার। বারাস নিয়মিত জোসেফাইনের বাসায় যাতায়াত করতেন। বিষয়টি নেপোলিয়নেরও অজানা ছিল না। একদলের মতে নেপোলিয়ন নিজেই বারাসের কাছে জোসেফাইনের কথা বলেছিলেন। আবার আরেক দলের মতে বারাসের পাতা ফাঁদে পা দিয়েছিলেন নেপোলিয়ন।

সে মতানুসারে বারাসের ইচ্ছাতেই আসলে নেপোলিয়ন আর জোসেফাইনের বিয়েটা হয়েছিল। তখন ফ্রান্সে বিয়ে তেমন কোনো ব্যাপারই না। দুজনে রাজি হলেই বিয়ে হয়ে যেত। দ্বিধা এড়িয়ে জোসেফাইন যখন হ্যাঁ বললেন তখনই ১৭৯৬ সালের ৯ মার্চ তাদের বিয়ে হয়। মজার ব্যাপার হলো নেপোলিয়নের বয়স তখন ২৬ আর জোসেফাইনের ৩২।

নেপোলিয়নের সঙ্গে জোসেফাইনের ডিভোর্স হয় ১৮০৯ সালের ১৫ ডিসেম্বর। এ নিয়েও দ্বিধা রয়েছে। একপক্ষের মতানুসারে জোসেফাইন আসলে বারাসের রক্ষিতা ছিলেন। বারাসের চাপেই নেপোলিয়নকে বিয়ে করেন তিনি। এই পক্ষের মতানুসারে জোসেফাইন বহুগামিতায় আসক্ত ছিলেন।

ফলে নেপোলিয়ন যখন যুদ্ধবিগ্রহ নিয়ে ইতালিতে ব্যস্ত ছিলেন, জোসেফাইন তখন ফিরে যান পুরনো অভ্যাসে। তবে এর মধ্যে জোসেফাইন আর নেপোলিয়নের মধ্যে চিঠির আদান-প্রদান হতো ঠিকই। এরপরও নেপোলিয়ন শেষ পর্যন্ত সব সত্য জেনে যান এবং ডিভোর্সে বাধ্য হন। আবার আরেকটি মতানুসারে কেবলই সিংহাসন রক্ষা ও উত্তরাধিকারের জন্য তিনি জোসেফাইনকে ডিভোর্স দিয়েছিলেন। কারণ নেপোলিয়ন জানতে পেরেছিলেন জোসেফাইন কখনো মা হতে পারবেন না।

তবে তাদের মধ্যে ছাড়াছাড়ি হয়ে গেলেও আমৃত্যু দুজনকে দুজন প্রচণ্ড ভালোবেসে গেছেন।

এর বাইরেও নেপোলিয়নের জীবনে নারী ছিল। তবুও ইতিহাসের পুরোটাজুড়ে আছেন কেবলই জোসেফাইন।

 

 

সোর্স: http://www.bd-pratidin.com/     দেখা হয়েছে ১০ বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।