আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

ফলোআপ : হেফাজত মানে হাবিলের হাসি, ফকিরের উচ্ছাস কিংবা আতীব্র তৃষ্ণার পানি..

ভালো আছি

ভালোবাসা যে কোথায় আছে, আজও রাষ্ট্রের জানা হয় নি। রাষ্ট্র কী বলে ? রাষ্ট্র বলে অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা ও চিকিৎসা মানুষের মৌলিক অধিকার। এই অধিকার রাষ্ট্রের কাছে মানুষের। দ্বন্দ্বটা এখান থেকেই শুরু। যেখানে রাষ্ট্র আর মানুষকে আলাদা করে দেখা হয়েছে।

অথচ মানুষের অর্গানাইজেশনের নাম হওয়া উচিত রাষ্ট্র। মাটি ও মানুষ মিলে হবে দেশ। হয় না। হবেও না। যতদিন ওই পাঁচটি প্যাঁচানো আর দুর্বোধ্য বিষয়ের ঘেরাটোপে বন্দী করে রাখা হবে মানুষের ভাবনা।

মানুষকে যত বেশি বন্দী রাখা যাবে, রাষ্ট্রের জন্য ততটাই অমঙ্গল; অথচ সরকারের জন্য ভালো। সরকার বলতে বোঝানো হয় ক্ষমতাধর, দেশের নিয়ন্ত্রক। তাহলে রাষ্ট্র, সরকার ও মানুষের মাঝে তফাতটা কোথায় ? কেন মানুষকে তাদের নিত্যদিনের ‘প্রকৃত’ মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত রাখা হচ্ছে ? এই রকম জটিল মারপ্যাঁচগুলো খুলতে না পারলে সব অন্দোলন ব্যর্থ হয়ে যায়। এই জটিলতার গুণেই সারা পলিনদের কাছে হারে পৃথিবীর সকল ওবামা। মানুষ হারে প্রাণীর মোকবেলায়।

কনস্টিটিউশন মার খেতে থাকে প্রস্টিটিউশনের দুয়ারে দুয়ারে। কাউকে একটি ছোট্ট ঘর উপহার দেয়া হবে চিরদিনের জন্য, তার মৌলিক অধিকারের সবক’টি পূরণ করে−পর্যাপ্ত খাবার, প্রচুর বই, আর চিকিৎসার আধুনিক ওষুধপত্র দিয়ে। তবু কোনো মানুষ এর একটিও গ্রহণ করবে না, যদি তাকে সেখানে বন্দী রাখার শর্তারোপ করা হয়। ‘প্রকৃত মৌলিক অধিকার’ ফিরিয়ে দেয়া না হয়। হ্যাঁ, স্বাধীনতা।

এটাই মানুষের মৌলিক অধিকার পূরণের পূর্বশর্ত। যা আল্লাহ প্রতিটি মানুষের চেতনায় গেঁথে দিয়েছেন আজন্মের মতো। এটাই এক অনি:শেষ নেয়ামত। এখানেই মানুষের শ্রেষ্ঠত্ব ও ফজিলত। শুধু তাই নয়, এভাবেই হয়ে ওঠে এবাদত।

নয়তো পরাধীন হলে প্রভুর সান্নিধ্যে বিঘœ ঘটে। পরাধীন অঞ্চলে বহু বন্দেগি সিদ্ধ নয়। জুমার নামাজ হবে নিষিদ্ধ। মানুষকে স্বাধীনতার জন্য, মুক্তির জন্য লড়াইয়ে নাবতে হয়। আগ্রাসী শত্রুর চোখে চোখ রেখে কথা বলেতে হয়।

এটাই আল-জিহাদ; এমন প্রতিকূল সময়ের সবচে’ মহিমান্বিত এবাদত। আশ্চর্য ! স্বাধীনতা নামক এবাদতের লড়াইটাও কিন্তু আরেকটি এবাদত বৈ নয়। এভাবে, ঠিক এইভাবে এবাদতের অধিকার আদায় করতে হয় স্বাধীনতার তরবারি দিয়ে। কিন্তু, চিরস্বাধীন মানুষ কেন পরাধীন হবে ? কার বিরুদ্ধে লড়াই করবে মানুষ ? রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ? তাহলে তো মানুষেরই অমঙ্গল। তিলে তিলে নিজেদের গড়া অর্গানাইজেশন, স্বাধীনতার পরে যেখানে তার অন্যসব মৌলিক অধিকার পূরণের প্রতিশ্রুতি রয়েছে, রয়েছে একটু মাথাগোঁজার ঠাঁই, একমুঠো খাদ্য, জ্ঞানতৃষ্ণা ও লজ্জা নিবারণের ভূষণ, আছে রোগশুশ্রƒষার আয়োজন− তার মোকাবেলায় কোন উছিলায় দাঁড়াবে সে ? রাষ্ট্র তো কাউকে স্বাধীনতা এনে দেবে না।

স্বাধীনতার ফলেই তো তৈরি হয় রাষ্ট্র। তাহলে বাকি থাকে সরকার। সরকার কি দেশের সত্যিই নিয়ন্ত্রক ? সেবক নয় ? সরকার যদি সেবক না হয়ে নিয়ন্ত্রকই হয়, আর সে নিয়ন্ত্রণ যদি হয় দেশের মানুষের বিরুদ্ধে, মানুষ তখন তার স্বজাতি থেকে সরকারকে বের করে ফেলবে। কেন বের করবে না ? এই নিয়ন্ত্রণ কি মানুষের স্বাধীনতা খর্ব করে না ? তাহলে মানুষ কেন সরকারের বিরদ্ধে দাঁড়াবে না ? তাকে তো স্বাধীনতা অর্জন করতেই হবে। এবাদত অধিকার অর্জন ছাড়া মানুষের স্বস্তি আসবে না।

স্থিরতাও আসবে না। সরকার যদি মানুষ হয়, সে সেবক হবেই হবে। কেননা, মানুষের সেবা করার জন্যই মানুষ তার স্বজাতি থেকে কিছু লোককে বিবেচক মনে করে তাদের সরকার হিসেবে নির্বাচিত করে। সেবাই সরকারের ক্ষমতা। সেবার নামে সর্বময় ক্ষমতা কুক্ষিগত করে যদি মানুষের স্বাধীন বন্দেগি অর্জনের অন্তরায় হয় সরকার, তাহলে বান্দা মানুষ লড়াই করবেই।

হ্যাঁ, একান্ত যদি সে মানুষই সরকারের মতো মনুষ্যত্ব খুইয়ে বসে, তাহলে ভিন্ন কথা। এ কারণেই আমরা দেখি, আদমের সন্তান হাবিল থেকে নিয়ে রেশমী রুমাল আন্দোলনের ফকিরদেরকে পর্যন্ত কোনোদিন এই অন্ন-বস্ত্রের জালে বন্দী করা সম্ভব হয় নি। সম্ভব হয় নি কেবল মানুষ হওয়ার ফলেই। এবাদতের স্বাধীনতার জন্য স্বাধীনতার এবাদত অর্জনের লড়াইয়ে তাদের অবদানের কথা ইতিহাস অকৃপণ হাতে লিখে গেছে। মানুষ ও মনুষ্যত্বের প্রতি তাদের অকৃত্রিম প্রেম-ভালোবাসার গান গেয়েছে মানুষ প্রবাদতুল্য ভাষায়− আলমাহইয়া মাহইয়াকুম, ওয়াল মামাতু মামাতুকুম− জীবন তো তোমাদেরই জীবন, মরণ তো তোমাদেরই মরণ।

হেফাজত কেবলই সেই অনুপ্রেরণার অনুরণন মাত্র। এক. অদূর ভবিষ্যতে নয়, এখনই অনেক বোদ্ধারা বলছেন, হেফাজতকে জাগাতে শাহবাগের ‘অবদান’ আছে। এখানে অবদান মানে ইন্ধন নয়− উস্কানী। বিশ্বে ফ্রিম্যাসনের মতো একটা গোষ্ঠী সবসময়ই ছিলো, যারা মুসলিম ইমোশন নিয়ে খেলতে ভালোবাসে। কিছু চেতনাকে জাগিয়ে, কিছু অনুভূতি নাড়িয়ে জাতির পাল্স পরীক্ষা করে এরা।

এবারও তেমন কিছু হয়েছে কি না ইতিহাস বলে দেবে। যদি হয়েও থাকে তবে তারা দাবানলকে ফুলকি ভেবে ভুল করেছে। শুধু ভুল নয়, পরীক্ষক স্বয়ং হল ছেড়ে পালিয়েছে। তবু যে হেফাজত শাহবাগের বিরুদ্ধে দাঁড়ায় নি এবং শুধু ধর্মদ্রোহিতা রুখতে দফা কায়েম করে নি, এর কারণ হলো, হেফাজত এসেছে সবার হয়ে। সব মত ও পথের অভিধান ও অভিব্যক্তি নিয়ে।

আমরা দেখেছি হেফাজতের সঙ্গে ভিড়ে গেছে চিন্তাশীল বামপন্থীদের একটি দল। যারা সেক্যুরাজিমকে এদেশে বেমানান বলতে কুণ্ঠিত হয় নি। অনেকেই এটাকে সুবিধাবাদ বললেও এই কৃতিত্ব কিন্তু ফেলে দেয়ার মতো নয়। হেফাজতের ভাবনা ছাড়ে নি তসলিমাকেও। একসময়ের মোল্লাদের কারণে দেশছাড়া হলেও যদি বলি নতুন করে ‘ইসলামীপন্থীদের পছন্দ’ করা, কিংবা ‘তাওবা করে মুসলমান’ হওয়ার কথা বলেছে সে কেবলই হেফাজতের প্রেক্ষাপটে এসে, হেফাজতের ক্ষমার আশা নিয়ে− তবে কি অবান্তর হয়ে যাবে ? অথচ ক’দিন আগেও সে শাহবাগের বিরোধিতা করেছে বেশ খোলামেলাভাবেই।

যে যাই বলুক, সংশয়বাদীদের মনে জ্বালা ধরলেও ইসলাম তাকে ছায়া দিতে নিমরাজি থাকবে না কিছুতেই। এছাড়া, হেফাজতের অনুষঙ্গ নাড়িয়ে দিয়েছে মার্কিন পররাষ্ট্র দফতর থেকে জাতিসংঘের অধিবেশনকে। কাঁপিয়ে দিয়েছে ন্যাটো জোট থেকে জিএইটের রাষ্ট্রনায়কদের। ভাবনা পড়েছে র’ থেকে মোসাদ, এনএসআই থেকে সিআইএ। আরো দেখেছি, হেফাজত নিয়ে কথা বলতে স্বাচ্ছন্দ বোধ করেছে বিশ্বের তাবৎ মিডিয়া।

ভয়েস অব আমেরিকা যখন বলে, ‘এদের সম্পর্কে সাধারণ মানুষের ধারণা, যদি এরা তাদের অবস্থান ধরে রাখতে পারে, তবে দুর্নীতিমুক্ত একটি বাংলাদেশ গড়া সম্ভব হবে’− তখন আর সন্দেহের অবকাশ থাকে না যে, অজাতশত্রুদের মুখে ছাই দিতে সক্ষম হয়েছে হেফোজত। হামবুর্গ থেকে অস্ট্রেলিয়া, মস্কো থেকে চীন− পৃথিবীর বহুদদেশের বহু নাগরিক তৃতীয় বিশ্বের এই দেশটিকে জানে এক একটি কৃতিত্বের স্বাক্ষর দেখে। হেফাজতের সার্বজনীন কৃতিত্ব, অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশের সকল ধর্ম, বর্ণ ও মতবাদের মানুষকে অধার্মিকতা, অমানবিকতা, পরাধীনতা ও বিদ্বেষের মোকাবেলায় একপ্লাটফর্মে দাঁড় করানোর অবদান−যেখানে একাকার হয়ে গেছে গয়েশ্বর চন্দ্র কিংবা সুনীল শুভ রায়েরা, উপজাতীয় ওয়াংডুরা, কমিউনিষ্ট কিংবা কট্টর মৌলবাদীরা, ফরহাদ মজহার কিংবা সঞ্জীব চৌধুরীরা−এই কৃতিত্ব ও অবদান অচেনা বিশ্বকে আরেকবার আলোড়িত করেছে, চেনা মানুষকে নতুন করে ভাবিয়েছে। সুতরাং অপরূপ বঙ্গভূমিকে সত্যিই যদি সোনায় মুড়ে দেবার আকাক্সক্ষা হয়ে থাকে, তাহলে মানুষ ভাবুক− আগামী দিনের কারিগর কি সেই লাল-সবুজকে বুকে জড়িয়ে রাখা এবং দেশের মাটিকে কামড়ে পড়ে থাকা দেশপ্রেমী, ধর্মভীরু ও মাছ-ভাতে লালিত তরুণেরা, নাকি সুইসব্যাংকের একাউন্টধারী এবং জার্মান-ল-ন সভ্যতায় আদর্শধারী ‘ব্যাঙকুইট’ আর ‘হটডগ’ খেকো পরজীবী, অর্বাচীন ও নব্য রাজাকরের চেলা-চামুণ্ডারা। দুই. হেফাজতের কারণে ভোগবাদী ও সমাজবাদীদের দহন জ্বালায় পড়ার আরো দু’টি কারণ আছে।

প্রথমত: হেফাজত নারীর শালীনতার ভেতর দিয়ে মূলত নারীর অধিকারের শেকড়ের কথাটা বলে দিয়েছে। যুগে যুগে নারীকে ভোগ্য করার তীব্র প্রতিবাদ জানিয়েছে পরোক্ষ অথচ ধারালো ভাষায়। ফলে সমাজবাদীদের কলজের আবরণে টান পড়েছে স্বভাবতই। কারণ এই ‘দফা’ তো ওদের পয়সা কামানো ব্রান্ড− যেই বিন্দুতে পুজিবাদীদের সঙ্গে অকথিত মিলন হয়েছে মার্কস-লেলিন আর ফয়েরবাখ সম্প্রদায়ের। হেফাজত বলেছে, গ্রামের পথ থেকে, প্রান্তর থেকে ধরে এনে চাকরির লোভ দেখিয়ে এই যে গার্মেন্টস, হসপিটাল, মাল্টিন্যাশনাল অফিসের শ্রমিক, বুয়া, আয়া, পি.এস, হাউজ ওয়াইফ অথবা ক্রীতদাসী বানিয়ে ওদের দেহ-মন চুষে খেয়েছো তোমরা, দিনের সবটুকু আলো নিংড়ে নিয়ে আঁধারের উদ্দেশে নিক্ষেপ করেছো, বিনিময় কী দিয়েছো ওদের ? গোশত খসানো পরিশ্রম করেও মাসের পর মাস একটুকরো খাবার গোশতের সামর্থ্য দাওনি।

আব্রু বিক্রি করেও পেটের জামিন পায় নি। অথচ এরপরও ওরা আচরণে ভদ্র, পোশাকে শালীন, এবাদতেও অতৃিপ্ত নেই। কর্মের পেষণে ভেঙ্গে পড়া শরীরে দেখানোর মতো জৌলুস তো হারিয়েছে সেই কবেই। কিন্তু ওদেরকে পণ্য করে কালো টাকার পাহাড়ের এ্যাডভেঞ্চারে কাটায় যেই পুঁজিপতিরা, তাদের উচ্চশিক্ষিত কন্যা, জায়া ও জননীরা নি:সঙ্কোচে নির্বিবাদে বখে যায়, উচ্ছন্নে যায়। সমাজের আয়নায় ভেসে ওঠে তারা প্রভা, তিন্নি, মুন্নি, প্রাচী কিংবা পারমিতা নামের নট-নটীর চেহারায়।

মুঠোফোনের পর্দায়, প্রেক্ষাগৃহের দরজায় আর বারবণিতার পাড়ায় সাঁটা পোস্টারে ওদের চিত্রটা দেখে ঠেলামজুর জগলু কিংবা রিক্সাওয়ালা বাদশা ‘বেশ্যা’ বলে দৈনন্দিন খিস্তির তালিকায় আরেকটা শব্দ বেশি যোগ করে। সুতরাং শালীনতার স্লোগান তুললে এদের কণ্ঠ চেপে ধরবে যে তাদেরই আয়া-বুয়া আর ক্রীতদাসীর দল। তাতে মালিকের জাত যাবে না ! প্রণামের বদলে থুথু জুটবে না কপালে ! তখন ? দ্বিতীয়ত : ক্ষমতালোভী আর রগকাটা অপবাদের তকমা লাগানো হয়ে থাকে এদেশের মডারেট ইসলামের ধারকদের গায়ে। দেয়া হয় একাত্তরের একরাশ কলঙ্কের প্রলেপ। সে কারণে এতদিন ইসলামপন্থীদের দোষারোপ করার বিশাল একটা মওকা ছিলো ধর্মবিদ্বেষীদেও হাতে।

এবার সে মওকা কেড়ে নিয়েছে হেফোজত। না, হেফাজতকে ক্ষমতালোভী বলার কোনো উপায় নেই। পুঁতিগন্ধময় রাজনীতির ছোঁয়ারোগ থেকে সে মুক্ত। ক্ষমতাধরদেরকে এরা থোড়াই কেয়ার করে। জঙ্গীবাদের খাতায়ও হেফাজতের দাগ নেই।

এদিকে বেকায়দায় তাদের পড়েছে ‘উলুখাগড়া’কে আপ্তনীতি মেনে চলা মিডিয়া। দীর্ঘসময় জুড়ে এই প্রচারমাধ্যমের বক্তব্য মানুষ ধর্মগ্রন্থের চেয়ে বেশি ‘পবিত্র’ ভাবতো। সেখানেও বাগড়া দিয়েছে হেফাজত। বিস্মিত মানুষ ঘোর ভেঙ্গে দেখেছে, এন্টিবায়োটিকের বদলে কী স্ববিনাশী বিষ গিলেছে তারা এ যাবত। অতএব... তিন. ৫ মে রাতে বর্ষিত হওয়া একলক্ষ ষাট হাজার বুলেটের কথা জানা আছে।

জানা আছে সহ¯্রাধিক হ্যান্ডগ্রেনেড আর অজ¯্র মারণাস্ত্রের খবর। কিন্তু জানা নেই শহীদের সংখ্যা তিনশ’, নাকি তিনহাজার, নাকি ত্রিশহাজার। যেমন আজো জানা হয় নি একাত্তরের নৃশংসতায় নিহত শহীদের সঠিক সংখ্যা। সুতরাং হেফাজত যদি বলে, মিডিয়ার অগোচরে গভীর রাতে দশলাখ মানুষের উপর হত্যাযজ্ঞ চালানোর পরেও যদি ত্রিশ হাজার মানুষ শহীদ না হয়, তাহলে একাত্তরের সাড়ে ৭ কোটি মানুষের উপর চালানো নৃশংসতায়ও ত্রিশলাখ লোক শহীদ হওয়া সম্ভব নয়− তাহলে তাকে কোন যুক্তিতে আপনি প্রত্যাখ্যান করবেন ? তবে একাত্তর বলেন আর ৫ মে বলেন, দু’টোই ছিলো স্বাধীনতার আন্দোলন। একটি বহি:শত্রু থেকে স্বাধীনতা, অন্যটি দেশীয় শত্রু থেকে।

উভয়ের উদ্দেশ্য এক ও অভিন্ন− সর্বোচ্চ ত্যাগের মাধ্যমে প্রভুর সান্নিধ্য অর্জন। শুধু এই কারণেই আমরা উভয় প্রেক্ষাপটে নিহত মানুষকে শহীদ বলতে পারি। শাহাদাতের সেই আতীব্র তৃষ্ণা মানুষকে পরাধীনতার বিরুদ্ধে দৃঢ়পদ রেখেছে। এটাই একাত্তরের সাথে ৫ মে’র সবচে’ বড় মিল। আরেকটা চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দেয়া যায়।

সে রাতে নির্বিচারে মানুষকে মেরে এখন ‘রঙ মাখা’ তত্ত্ব ফলায় যারা, তাদেরকে বলি, আট-দশলাখ মানুষের পক্ষে প্রতিরোধ গড়ে তুলে সরকারি পেটুয়া বাহিনীর দু’-দশ হাজারকে পিটিয়ে মেরে ফেলা কি অসাধ্য কিছু ছিলো ? কিন্তু নিরীহ মানুষ তো সে পথে যায় নি। কা-জ্ঞান বিবর্জিত সরকার প্রধানের বক্তব্যে মনে হয়, তিনি তেমন কিছু হলেই খুশি হতেন। হেফাজত সে পথে যায় নি, যাবেও না। কারণ তারা মানুষ। সরকার না।

পাশবিক চেতনা নিয়ে আসে নি তারা। এসেছে দেশ মাতৃকার বুকে দীনের সার্বভৌমত্ব সমুন্নত রাখতে। একাত্তর দেখি নি। পড়েছি। বড়দের মুখে মুখে শুনেছি নারীর তিতিক্ষার কথা।

কিন্তু হেফাজতের ৬ এপ্রিল কিংবা ৫ মে চাক্ষুস করিয়েছে নারীর সেই মহিমাময় রূপ আবারও নতুন করে। শাহাদাতের সংবাদে দু’হাত তুলে শোকর করেছে সতীত্বের কসম খাওয়া যে নারীরা, ছেলের কপালে চুমো দিয়ে, স্বামীকে শেষ আলিঙ্গনে ফিরিয়ে দিয়ে, বাবাকে অশ্রুসিক্ত আল-বিদা জানিয়ে আর ভাইয়ের মাথায় দোপাট্টার কাফন পরিয়ে শাপলা চত্বরে পাঠিয়েছে যেই মানবীরা, ভবিষ্যত ইতিহাসের আয়েশা, রোকেয়া, নাফিসা আর উম্মে আইমান নামের মহীয়সীরা, তাদের আলোচনায় শ্রদ্ধার নিবেদনে নিভৃতে চোখের দু’ফোটা জল বেশি ফেলছে শেষরাতের ডাহুক− ¯্রষ্টার প্রতিদানে উপর অবিচল আস্থায় বিশ্বাসী বান্দারা। প্রসঙ্গত : বলতে হয়, হেফাজতের দাবিতে খেলাফত ব্যবস্থার সুর আছে। সেই সুরের বিকৃতি ঘটিয়ে দুমুর্খেরা উল্লেখ করে ব্লাসফেমির কথকতা। প্রমাণ জোগাতে চায় আফগান-পাকিস্তানের কতক ‘কদর্যতা’ দিয়ে।

সে ক্ষেত্রে মনে রাখা দরকার, আফগান-পাকিস্তান হেফাজতের রোলমডেল নয়। হেফাজতের দাবির সাথে মিশে আছে মদীনার রাষ্ট্রব্যবস্থার নীতিমালা। খেলাফতে রাশেদার স্বর্ণযুগের আখ্যান। আজো, এই একবিংশ শতাব্দির রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরাও যাকে কেবল ‘অলৌকিক’ শব্দ দিয়ে ব্যাখ্যা করতে সহজবোধ করেন। সর্বশেষ কথা।

এই নিবন্ধে প্রতিটি বাক্যে সংক্ষেপে শুধু হেফাজতের আন্দোলনে জাতীয় ও বৈশ্বিক প্রভাবের ইঙ্গিত দেয়ার চেষ্টা করা হয়েছে। প্রতিটি বাক্যই তাই ব্যাখ্যা সাপেক্ষ। তবে অমূলক নয়। প্রমাণ উপস্থাপন করতে গেলে স্মারকেও শেষ হবে না। আলোচ্য নিবন্ধে বারবার উঠে এসেছে মানুষ, বন্দেগি ও স্বাধীনতা− এই তিনটি শব্দ।

বৈশ্বিক পরিম-লে এই তিনশব্দের যুগ্মবার্তাই পৌঁছে দিতে পেরেছে বাংলার হেফাজত। একটি স্বাধীন ভূখ-কে বলা হয় দেশ। এটাই দেশ-এর সবচে’ সংক্ষিপ্ত সংজ্ঞা। সবাই জানে, দেশ মানে মাটি ও মানুষ। মানুষ মানে আল্লাহর বান্দা।

আর মাটি হলো বন্দেগির জমিন। স্মরণে বিস্মরণে এই আলোটুকু আজন্ম লালন করে এ দেশের নিরানব্বইভাগ মানুষ। নব্বইভাগ মুসলমান। কিন্তু কোন এক অজানা কারণে একাত্তরের পরে দীর্ঘবছর অবধি এই কথাটুকু মুখ ফুটে বলতে পারে নি এই স্বাধীন দেশের মানুষেরা। বুকের পাঁজরে ধিকধিক জ্বলতে থাকা এই আলোটুকু প্রদীপের শিখায় তুলে দেয়া হয় নি, এমনকি রাষ্ট্রের সংবিধানেও অঙ্কন করা যায় নি যে কেন, সে এক বিরাট প্রশ্ন।

অর্ধশতাব্দি ধরে ঘুরপাক খেতে থাকা এই প্রশ্নটি তেরটি দফার ভেতরে অত্যন্ত কৌশলে ও সাবলীল ভাষায় বলে ফেলেছে হেফাজত। অভিভূত হয়েছে মানুষ। নেচে উঠেছে মাটি। কেঁপে উঠেছে দেশ ও ধর্মের চেনা শত্রুর ভিত। কিন্তু আমাদের প্রশ্ন, মাটির নৃত্যে ও মানুষের চিত্তে যে আলোড়ন জেগেছে আজ, তাতে সরকার এত ভয় পাচ্ছে কেন ? তাহলে কি আমাদের সরকার, এদেশের সরকার, মানুষের স্বজাত নয় ? নাকি সে-ও অর্বাচীন ? এ মাটির তৈরি আদম নয় ? নাকি... হেফাজত গণমানুষের ভালোবাসা পেয়েছে।

ভালোবাসা দিয়েছেও। এই ভালোবাসার অধিকার মানুষ সবাইকে দেয় না। সবাই তাই পায়ও না। মানুষের এই দুর্দিনে ভালোবাসা অনেকটা দুর্লভ বিষয় হলেও, কাকে ভালোবাসা যায়, আর কার সামনে জীবনের তাগিদে অভিনয় করতে হয়, সেই জ্ঞানটুকু এখনও বিলুপ্ত হয় নি। সিটি নির্বাচনের চপেটাঘাত অন্তত এতটুকু সবাইকে বুঝতে সাহায্য করেছে।

রাষ্ট্রও খুব তাড়াতাড়ি এই ভালোবাসার মর্ম বুঝে ফেলবে নিশ্চিত। কিন্তু সরকার বুঝবে কি ? বুঝবে না; যতদিন রাষ্ট্র, সরকার আর মানুষ আলাদা অর্থ বহন করবে।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.