আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

বাংলাদেশীরা বর্ডারে যায় কেন?

সফল ব্লগার নয়, সত্যবাদী ব্লগার হওয়াই হোক আমাদের লক্ষ্য। [পোস্টের শুরুতেই বলে নিচ্ছি, ভাদা, ছাগু আর ছাগীয়তাবাদীরা কোন রকম ফাউল যুক্তি তর্ক নিয়ে কমেন্ট করবেন না। ইচ্ছা হলে পড়তে পারেন, তবে নাপড়লেও ক্ষতি নাই] ছবি: বর্ডারে লাশ হয়ে পড়ে আছে নিরীহ বাংলাদেশী! আমি একজন নিরীহ টাইপ ব্লগার। কখনোই কাউকে ব্যক্তিগত আক্রমণ তো দুরের কথা কটু কথাও বলি না। কিন্তু এই প্রথম খুব দু:খ আর রাগ নিয়ে এই পোস্টটি লিখতে বসলাম।

বাংলাদেশ-ইন্ডিয়া বর্ডারে নিরীহ বাংলাদেশীদের হত্যার ব্যাপারে কথা উঠলেই কিছু ভারতপ্রেমী (ভাদা) "বাংলাদেশীরা বর্ডারে যায় কেন" "আইন ভঙ্গ করলে শাস্তি তো পেতেই হবে" টাইপ মন্তব্য করে। যারা এই ধরণের মন্তব্য করেন তাদের কে বলছি, আপনি কি কখনো সীমান্ত এলাকায় গেছেন? দেখেছেন কি ভাবে বেঁচে আছে সেখানকার মানুষগুলো? আবার ছাগু এবং ছাগীয়তাবাদীরা বিএসএফ এর এই হত্যাকান্ডকে রাজনৈতিক স্বার্থসিদ্ধির জন্য নানা সময় নানা ভাবে উপস্থাপন করে। আমার এই পোস্টে তাদের নোংরা বিতর্কেরও কোন জায়গা নেই। ভাবছেন এই ব্যটাকে তো ব্লগে আগে কখনো দেখি নাই! এ আবার কোনখান থেকে উড়ে এসে জুড়ে বসলো, তাই না? আমি রাজনীতি অথবা আন্তর্জাতিক নীতি সম্পর্কে বিশেষজ্ঞ নয়। আবার ব্লগের কোন বিখ্যাত লেখকও নই।

পোস্টে হিট পাওয়ার জন্য আমি লিখি না। এখন বলবেন, তাহলে কে আমি যে ভারত-বাংলাদেশের একটি স্পর্শকাতর ইস্যু নিয়ে দীর্ঘ পোস্ট লিখতে বসেছি? আমি সেই বর্ডার এলাকার মানুষগুলোর একজন....। এমনিতেই হাজারো সমস্যায় জর্জরিত আমাদের দেশ। দেশের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা দিতেই ব্যর্থ আমাদের গণতান্ত্রিক লেবাসধারী দুই দল। আরেক দল তো কথায় কথায় ধর্ম নিয়ে ব্যবসা করেন।

এত কিছুর মধ্যে সীমান্ত এলাকার এ মানুষগুলোর দিকে দৃষ্টি দাওয়ার মতো সময় কারো নাই! তারা মরলেই কি, বাঁচলেই কি! তাই না? বিএসএফ যখনই কাউকে হত্যা করে তখন বলে গরু পাচারকারী আর না হয় তাদের উপর হামলা হয়েছিলো তাই মেরেছে। মানলাম গরু পাচারকারী, কিন্তু আমাদের দেশ থেকে তামা, ঔষধ, কেরোসিন, ডিজেল, পেট্রল, কয়েন ইত্যাদি পাচার হয় তখন কিছু বলে না কেন? আর পাচার তো একতরফা ভাবে হয় না, ভারতের লোকও এর সাথে জড়িত থাকে, কিন্তু তাদের কে মারা হয় না কেন? আর গুলি যদি করতেই হয় তো এমন ভাবে করুক যেন না মরে, কিন্তু তাদের রুলস মনে হয় "শুট টু কিল"! আমার জন্ম প্রায় বর্ডারেই বলতে পারেন। ছোটবেলা সেখানেই কেটেছে। বর্ডার আমাদের কাছে ডাল-ভাত। কিন্তু এখানকার মানুষের জীবন যাত্রার মাণ দেখলে আপনারা অবাক হয়ে যাবেন।

প্রায় সারা বছরই কোন কাজ থাকে না। কৃষি জমি এখানে যা আছে তা অল্প কয়েকটি পরিবারের দখলে। বেশীর ভাগ মানুষই ভূমিহীন। ভূমিহীন এ মানুষগুলোর জন্য তাই বর্ডার ছাড়া কোন গতি নাই। এই বর্ডার কেড়ে নিয়েছে কারো বাবা, কারো ভাই, কারো স্বামী আবার কারো সন্তানকে।

মাত্র ২০০-৮০০ টাকার জন্য এরা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে বর্ডার পার হয়। আর তাদের এই কাঝে ঠেলে দেয় সামান্য কিছু পশুরূপী মানুষ যারা বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের ছত্রছায়ায় থাকে। আর এই চোরাচালানের অর্থের মূল অংশটুকুই যায় স্থানীয় নেতা, বিডিআর, পুলিশ আর প্রশাসনের পকেটে। বর্ডার আর নিরীহ এই মানুষগুলোকে ব্যবহার করে এই সব নরকের কীটগুলো দিন দিন ফুলে ফেঁপে বড়লোক হয়েছে, কিন্তু সেই নিরীহ মানুষ গুলো এখনো অর্ধাহারে অনাহারে কোন মতে বেঁচে আছে! আমি ৮/৯ বছরের বাচ্চা ছেলে-মেয়েদেরকেও দেখেছি চিনির বস্তা মাথায় নিয়ে ভীত খরগোশের মত দৌড়াতে। আবার ৭০/৮০ বছরের বৃদ্ধরাও যায়।

এদের পেটে ভাত নাই, ঘরের চাল নাই। রোগ-বালাই সারাক্ষণ লেগেই আছে। একটি ঘটনা বলি, তখন ১৯৯৯ সাল, গ্রামের বাড়ি, প্রত্যন্ত বর্ডার এলাকা। বর্ডারের ধার ঘেষেই আমাদের কিছু ধানের জমি আছে। আমাদের রাখালরা গরু নিয়ে সেই বর্ডারে যায়।

কৃষকেরা চাষাবাদ করে। আবার এই বর্ডার দিয়েই অবৈধ অস্ত্র, মাদক, গরু, শাড়ি ইত্যাদি পাচার হয়। যখন যে দল ক্ষমতায় থাকে তখন তারাই নিয়ন্ত্রণ করে বর্ডারের এই অবৈধ ব্যবসা। তবে যে দিনের ঘটনা বলছি সেদিন সকালে আমি রাখালদের সাথে গরু নিয়ে গেছিলাম বর্ডারে। সেখান আমাদের গ্রামেরই মন্টু নামের এক কৃষক আর তার ভাই নিজের জমিতে হাল চাষ করছিলো।

দুপুর হলে তারা সঙ্গে নিয়ে আসা রুটি আর ভাজি দিয়ে খাচ্ছিলো। কিন্তু হঠাৎ হালের মহিষ দুটো ঘাস খেতে থেতে বর্ডার পার হয়ে প্রায় ৩০০ গজ ভিতরে চলে গেলো। এ ঘটনা দেখে সবার তো মাথায় হাত! এখন কি হবে! কিন্তু দরিদ্র্য মন্টু চাচা তার একমাত্র সম্বল হালের মহিষ দুটো ফিরিয়ে আনার জন্য বর্ডারের অপার যেতে চাইলো। সবাই অনেক বোঝালেও সে তার সিদ্ধান্তে অনড়, শেষে তার ভাইও তার সাথে যাবে বলে ঠিক করলো! ওপারে ভারতের সিঙ্গাবাদ বর্ডার, বিএসএফ এর ক্যাম্প আছে। অত্যাধুনিক সব অস্ত্র আর গাড়ি নিয়ে দুর্বল ট্রেইনিং প্রাপ্ত নির্বোধ বিএসএফরা সব সময় টহল দেয়।

মন্টু চাচা আর তার ভাই মহিষ আনার জন্য ওপারে গেল। মহিষ দুটো ধরে তারা যখন ফিরতি পথ ধরলো তখনই ঘটলো বিপত্তি! টহলরত দুজন বিএসএফ সদস্য তাদের পথ আটকালো। তারা দাবি করলো যে মহিষ দুটো নাকি চুরি করা। মন্টু চাচা যতই বোঝায় যে মহিষ দুটো তার, বেখেয়ালে এপারে চলে এসেছে তারা ততই বোঝে না! এক পর্যায়ে কোন রকম উষ্কানি ছাড়াই একজন বিএসএফ সদস্য তার দিকে বন্দুক উঁচিয়ে গুলি করতে গেলো! মন্টু চাচা তখন সেই বিএসএফটিকে ঝাপটে ধরে কাদায় গড়াগড়ি খেতে লাগলো আর তার ভাইকে চিৎকার করে পালিয়ে যেতে বললো। মন্টু চাচার ভাই ভয়ে নড়তে পারছিলো না।

অপর বিএসএফটি বন্দুক তাক করে গুলি করার সুযোগ খুজতে লাগলো, একপর্যায়ে মন্টু চাচাকে লাথি মেরে দুরে সরিয়ে তারা দুজন মিলে নির্মম ভাবে বুকে ও পেটে গুলি করে মারলো। মন্টু চাচার ভাইকেও তারা বুকের ওপর পা তুলে পয়েন্ট ব্ল্যাংক রেঞ্জ থেকে মাথায় গুলি করে মারলো। আর এ সবই ঘটলো আমাদের চোখের সামনে! পাখির মতো গুলি করে মারা হলো বাংলার দুই নিরীহ দরিদ্র কৃষককে। দুই ভাইকে মারার পর তারা আমাদের দিকেও গুলি ছোড়া শুরু করলো। আমরা কোন মতে গরুর আড়াল নিয়ে দুরে সরে গেলাম।

এর মধ্যে একজন বিডিআর ক্যাম্পে খবর দিলো। কিন্তু সেখান থেকে বিডিআর আসতে আসতে বিকাল হয়ে গেল। মন্টু চাচা আর তার ভাইয়ের লাশ পড়ে রইলো নোম্যান্স ল্যান্ডে! এর পরের কাহিনী বিশেষ কিছু না, বিডিআর-বিএসএফ এর ফ্ল্যাগ মিটিং, বিডিআরের প্রতিবাদ, আর পুলিশের পোস্ট মর্টেম। ঘটনা এটুকু মনে হলেও আসলেই কি তাই? মন্টু চাচা আর তার ভাইয়ের উপর নির্ভর করে তাদের দুজনের সংসার, ছেলে-মেয়ে এবং বৃদ্ধ বাবা-মা বেঁচে ছিলো। কিন্তু তারা দুই ভাইয়ের মৃত্যুর পর তাদের কে পথে নামতে হয়।

শিশু গুলোর ভবিষ্যৎ অন্ধকার হয়ে যায়। কাজের ব্যস্ততা আর শহরকেন্দ্রিক জীবনের কারণে বহুদিন তাদের খোঁজ নেওয়া হয় না। জানি না এই ২০১৩ সালে কেমন আছে তারা....! আর এরকম একটি নয়, শত শত মানুষ মারা যাচ্ছে বর্ডারে....এই ঘটনা গুলোর বিচার তো দুরের কথা অনেক সময় লাশও পায় না হতভাগা পরিবার গুলো। তারপরও কি আমরা চুপ করে থাকবো? এরপরও কি আপনারা বলবেন যে "বাংলাদেশীরা বর্ডারে যায় কেন" "আইন ভঙ্গ করলে শাস্তি তো পেতেই হবে"? ঘটনাটি যে সময় ঘটেছে তখন মিডিয়া-টিভি বর্তমান সময়ের মতো ছিলো না। আর সেই অজো পাড়া গাঁয়ে যেয়ে রিপোর্ট করার মতো সাংবাতিকও ছিলো না।

সেসময় পত্রিকার ভেতরের পাতায় মাত্র কয়েকটি লাইনে ঠাঁয় পেয়েছিলো এই ঘটনাটি। কিন্তু ভুক্তভোগী মানুষ গুলোর জীবনে তা এক অভিশাপ হিসাবে আবর্তিত হয়েছে। উপরের এই ঘটনাটি ছাড়াও প্রায়ই বিএসএফের প্রহরায় বর্ডার পার হয়ে ইন্ডিয়ার ডাকাত-সন্ত্রাসীরা এপারে এসে ডাকাতি করে, গরু ছাগল নিয়ে যায়, ঘর জ্বালিয়ে দেয়, নিরীহ মানুষকে ধরে নিয়ে যায় আরো কত কি! তাই সবাইকে বলছি, অযথা না জেনে শুনে বর্ডারে হত্যাকান্ড নিয়ে যা খুশি তা বলবেন না। অবৈধভাবে বর্ডার ক্রস করা অবশ্যই অপরাধ, তবে হত্যাকান্ড দিয়ে এ অপরাধ বন্ধ করা যাবে না। হত্যা এর সমাধান নয়।

বর্ডার এলাকায় যারা থাকে তারাও মানুষ, তাদের ক্ষুধা আর মৃত্যু ভয়হীন জীবন-যাপন করার অধিকার আছে। তাদের জন্য একটু এগিয়ে আসুন। বর্ডারের বাস্তব পরিস্থিতী দেখতে চাইলে আপনাকে স্বাগতম, আমি নিজে গাইড হয়ে আপনাদেরকে দেখাবো সব, ১৯৯৯ এর চেয়ে ২০১৩ সালে পরিস্থীতি তো ভালো হয়ইনি বরং আরো খারাপ হয়েছে। আর এর জন্য দায়ী দুই দেশের সরকার, আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এবং কিছু স্বার্থলোভী মানুষ। আমাদের সবাইকে বর্ডারের এই নৃশংস হত্যা কান্ড বন্ধে এগিয়ে আসতে হবে, এর প্রতিবাদ জানাতে হবে।

বর্ডার এলাকার মানুষগুলোকে সুশিক্ষা, খাদ্য, কর্ম আর নিরাপত্তা দিতে হবে, তাদের মধ্যে সচেতনতা সৃষ্টি করতে হবে। দুই দেশের সরকারকে এগিয়ে আসতে হবে। তাহলেই এই নৃশংসতা অনেকটাই নাই হবে যাবে। দেশের সীমান্ত এলাকার মানুষ গুলো নিশ্চিন্তে ঘুমাতে পারবে। ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.