আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

বিশ্বাসের সতীত্ব হারানোর গল্প

বাংলা আমি তোমার ভালোবাসায়, তোমার আঁচলের অপ্রতুলতা ঢাকতে মৃত্যুর সাথে চোহেলে জড়াবো।

শীতকে আলিঙ্গনে ব্যাথাটা বোধ হয় একটু বেশিই অনুভূত হয়। বাংলাকে ভালোবাসলেও হয়ত তাই। পার্থক্য শুধু শীতের শিরশিরিয়ে দেওয়ার ক্ষেত্রে কম্বলকে কাছে টেনে নিই। আর বাংলার ভালোবাসার বাড়াবাড়িতে আরবী, হিন্দি কিংবা ইংরেজী দিয়ে লুকিয়ে যাইনা।

বাংলা মাধ্যম থেকে ইংরেজী মাধ্যমে যাওয়ার পরই বাংলার প্রতি দরদটা একটু বেশিই বেড়ে গেল নিমীলের। অবস্থাপন্ন ঘরের বাউণ্ডুলে ছেলে সে। নবম শ্রেণীতে কৃতকার্য না হওয়ায় ও লেভেল পরীক্ষার জন্য এখন তার কোচিংগুলোতে দৌড়াদোড়ি। বাঙ্গালির এখানে খুব কদাচিৎ দেখা মেলে। বাঙ্গালির আচরণ, সংস্কৃতি, মূল্যবোধ সবকিছু যেন নন্দনতত্ত্ব, রাজনীতি, উৎসবের ভোগেই সীমাবদ্ধ।

মা-বাবা দুই জনই ধর্মীয় মূল্যবোধ চর্চায় ভীষণ সতর্ক। যদিও স্রষ্টা, সৃষ্টি নিয়ে নিমীলের কিছু প্রশ্ন আছে, তারপরও সে অন্যের বিশ্বাসের প্রতি যথেষ্ট আন্তরিক। বিশ্বাসই তো তাঁদের এত প্রতিকুলতার মাঝে স্বপ্ন দেখার সুযোগ করে দেয়। মা একদিন ‘১০০ মনীষির জীবনী’ বাংলায় অনুদিত একটি বই পড়তে দিয়ে বললেন, ক্রমানুসারে প্রথম মহাপুরুষের জীবনীটা পড়ে দেখতে। তাঁর প্রথমে থাকার কারণ জিজ্ঞাসে মা বললেন স্রষ্টার আশীর্বাদে তাঁর মনীষার কথা।

হঠাৎ টেলিফোনটা বেজে উঠতেই বুঝে গেল কোচিং-এ নিতে ড্রাইভার এসেছে। এক ঘন্টা হয়ে গেছে যান-জটের মধ্যে। হরতালে গ্যাস নেওয়ার সুযোগ হয়নি। গ্যাস আছে, কিন্তু খুব অল্প। এসি চালিয়ে এতটুকু গ্যাসে যাওয়াও যাবেনা, ফিরে যাওয়া তো নয়ই।

তাই এসি বন্ধ। গতকালই টানা কয়েকদিনের হরতাল শেষ হল। তাই আজ গাড়িগুলোর ভীষণ ব্যস্ততা। পাতলা শার্টটা ভিজে গেছে ভ্যাপসা গরমে। সামনের লোকাল বাসের জানালা দিয়ে ছোট একটি মেয়ে মাথা বের করে আছে।

মেয়েটির পিঠের উপর বয়স্ক একজন মহিলার হাত হালকা চাপ দিচ্ছে। মেয়েটি জানালার বাহিরে আরো ঝুঁকে গেল। নিষ্পাপ বালিকার প্রাণ বধে কোন ডাইনী হন্তা নয়তো! কিছুক্ষণ পর বোঝা গেল মেয়েটি বমি করছিল। যানজটের জট একটু খুলতেই গাড়িটা বাসটির পাশে গিয়ে থামল। মেয়েটিকে একহাতে জড়িয়ে ধরে মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে সাদা শাড়ি পরা একজন বৃদ্ধা।

বৃদ্ধার চোখ দুটোতে ক্লান্তি আর কষ্টের ছাপ। চুলগুলো সাদা-কালোয় মিশে অযত্নে আঁচড়ানো। ঘোমটার একদিকে ছেঁড়া। ওর কষ্ট হল দেখে। অবশেষে যানজটের জট খুলে গেল।

বাতাস লাগিয়ে, কবিতা শুনতে শুনতে কোচিং-এ পৌঁছাল নিমীল। ক্লাসে সংকর সংস্কৃতি, মূল্যবোধের চর্চা চলছে। হিন্দি, ইংরেজীর সংমিশ্রণে কথামালাগুলোই পরিপাটী, নিজ সংস্কৃতিমনা(?) তরুণের পরিচয়। কিছুক্ষণ পর স্যার ওরফে আসিফ ভাইয়া আসলেন। তিনিও দেরিতে আসার কারণ হিসেবে যান-জট, হরতালের ভূমিকার কথা বললেন।

সাথে দেশের সকল রাজনীতিক-কে এক নাগারে যা ইচ্ছে তাই বলে গেলেন। দাবী করলেন তিনি সাধারণ মানুষ, তিনি এভাবে বলার অধিকার রাখেন। সাধারণ নাকি নীতি-বহির্ভূত সুবিধাবাদী মানুষ তা নিমীল বুঝে। জীবনের হিসেব মিলাতে ব্যস্ত সময়ে হয়ত অনেক ভুল হয়ে যায়, কিন্তু অবসরে এমন সুবিধা নেওয়া নীতি সিদ্ধ নয়। ক্লাসের বাইরে ছাত্রীর সাথে একান্তে সময় পার করার সুনাম আছে আসিফ ভাইয়ার।

হ্যাঁ, এখানে নিজের দেশজ মূল্যবোধকে বলি দিয়ে দেওয়ার যোগ্যতাকে প্রতিভা হিসেবে মূল্যায়ন করা হয়। স্যারের লেকচারে শুরুতেই ইচ্ছে করেই শৌচাগারে যাওয়ার অনুমতি চাইল। যদিও এসব জরুরী প্রাকৃতিক কাজে অনুমতি নেওয়ার প্রয়োজন কেউ বোধ করে না। বিব্রত, ঈষৎ লাল তরুণ বয়সের ভাইয়ার মুখ। শৌচাগারের অনুবাদ আসিফের ভাষায় বাথরুমে অনুদিত করতেই হুঁশে এলো কথাটা।

বাথরুম থেকে ফিরে দেড় ঘন্টা ক্লাসে পার করল নিমীল। ক্লাস শেষে ভাইয়ার সাথে সবার যে কোন বিষয়ে আড্ডা দেওয়া হয়। কথার প্রসঙ্গে এখন চলছে নারী-পুরুষের মানসিক-শারীরিক, কামাতুর-নিষ্কাম প্রেম রসায়নের সফলতা-ব্যর্থতার গল্প। ভাইয়ার প্রথম প্রেম করার চেষ্টা এবং একরাশ ব্যর্থতার কথা বলছেন। তিনি স্কুল জীবনের প্রথম থেকেই ক্লাসের কোন এক সহপাঠীকে ভালবাসতেন।

ঠিক ও লেভেল দেওয়ার আগে বাথরুমের ফুটো দিয়ে দেখলেন অন্য এক ছাত্রের সাথে তার প্রিয় মানুষের রমণের দৃশ্য। বড় একটা নিঃশ্বাস নিয়ে ছাড়ার সময় শ্বাস থামিয়ে দিলেন, কালো পুরু ঠোঁটটা চওড়া করে লুকিয়ে ফেলে বোঝালেন কতটা বিমর্ষ তিনি। এত তাড়াতাড়ি আসিফের মত বিমর্ষ হতে ভাল লাগেনা নিমীলের। এখনো তো তার ভালবেসে আনন্দ পাওয়া, বিমর্ষ হওয়ার অনেক সুযোগ আছে। ক্লাস শেষে বেরিয়ে গেল।

অনিতা পিছন থেকে মাথায় একটা টোকা দিয়ে জানতে চাইল, পুল খেলতে যাবে কি না। ধ্রুপদী নাচের মুদ্রার মত মাথাটা ডানে-বায়ে করে জানিয়ে দিলো ও। গাড়ির দরজা খুলতেই দেখল লক করা। ড্রাইভার হয়ত গান শুনে ঘুমিয়ে পড়েছে। জানালা দিয়ে তাকাতেই দেখল সেখানেও নেই।

তাহলে চা খেতে গিয়েছে কিংবা পরিচিত কোন শিষ্যের সাথে গল্প জুড়ে দিয়েছে। অনিতাও দাঁড়িয়ে আছে রিক্সার জন্য। অনিতার সাথে গল্প করেই কিছু সময় এগিয়ে নিতে হবে। মেয়েটার সাথে কথা বললে শুধু তার নিজের গুণ কীর্তন, কোন ছেলে তার দিকে কিভাবে তাকিয়েছে, কোন ছেলেকে ট্রু অর ফল্‌স-খেলতে গিয়ে কি করেছে এসব ঝাল-মিষ্টি কথাবার্তা হয়। পিছনে তাকিয়ে নিমীলকে চোখ দিয়ে কিছু দেখতে ইশারা করল অনিতা।

ক্লাসের দুই রোমিও-জুলিয়েট একে বেকে পরস্পরকে উপভোগ করছে। অবশ্যই খোলা আকাশের নিচে নয়। একটি টয়োটার সিলিকা গাড়ির ছাদের নিচে নিজেদের ব্যাপারে তাদের এই কৌতুহল। অনিতা খুব রিনরিনে আওয়াজে হেসে বলল, “ দেখছিস কি আর্টিস্টিকলি সেক্স করতেছে। মেই বি কোন সেক্স গাইড বুক পড়ে আসছে।

” কথাটা চট করে কল্পনা করতেই খুব হাসল নিমীল। কল্পনায় ব্যাপারটা এরকম ছিল, ছেলেটি তার ল্যাপটপে দেখে বলছে, “জান্‌ তোমার এটা-ওটা ভাল লাগে?” অন্য পাশ থেকে মেয়েটি একই ভাবে তার ল্যাপটপে চোখ রেখে হ্যাঁ-না সহ বিভিন্ন ‘পরামর্শ’ দিয়ে যাচ্ছে। ড্রাইভার এসে গেছে, অনিতাও একটা রিক্সা ভাড়া করে উঠে পড়ল। আরো কয়েকটা কোচিং শেষে বাসায় ফিরল নিমীল। এখনো তেমন একটা ক্লান্ত হয়নি নিমীল।

মা কিছুক্ষণ পর সামাজিকতার বাঁধা-ধরা কিছু যোগাযোগ, কাজ-কর্ম শেষে বাসায় আসবে। বাবাতো অফিস থেকে রাত ১২:০০ টার আগে ফিরবেনা। এই একা সময়টা কিছু একটা করে ব্যস্ত থাকতে হবে। মা পড়ার টেবিলটায় বইটা রেখে গেছে। হযরত মুহাম্মদ (সাঃ), প্রথমে থাকা মনীষির জীবনীটা খুব আগ্রহ নিয়ে শেষ করল।

অসম্ভব কষ্ট সয়ে অলৌকিক কিছু সফলতা আসলেই বিশ্বাসীদের মনে তাঁর ব্যাপারে শ্রদ্ধা সৃষ্টি করে। ক্রম তালিকার অনেক পিছনে কার্ল মার্ক্স(১৮১৮-১৮৮৩)। তেমন গুরুত্বপূর্ণ কিছু নেই তার জীবনীতে। শুধুমাত্র আর্থিক টানাপোড়েনেও, অভুক্ত থেকে কিছু পাণ্ডুলিপি লেখা ছাড়া। তেমন কোন বৈষয়িক সাফল্য নেই।

তার উপর সন্তানদের মৃত্যুর ঘটনা। মার্ক্সকে তারা এত দূরে স্থান দিল কেন? সব ধর্মীয় মতবাদের প্রবর্তকদের শেষেও তো অন্তত তাকে রাখতে পারত। ভিজে আসে নিমীলের চোখ দুটো। কে বলেছে লোকটাকে এমন পাগলের প্রলাপে ভরা পাণ্ডুলিপি লিখতে! এই অত্যাচারিত লোকটার কি কোন অনুসারী নেই? মাও সে তুং(১৮৯৩-১৯৭৬), লোকটার জীবন কি বিপ্লবী, কত রক্তে শোণিত(রঞ্জিত)! শব্দটা আগের লোকটির জীবনীতেও পেয়েছিল নিমীল। ‘সমাজতন্ত্রী’ শব্দটা মাও-এর জীবনীতেও অনেকবার এসেছে।

নিমীলের মনে হচ্ছে দুই জনের আদর্শ মৌলিক ভাবে একই। লোকটা নিজ মাতৃভূমিতে সাম্রাজ্যবাদীর গেলমান, ভূমিদস্যু, লুটেরা শ্রেণিকে বিপ্লবের মাধ্যমে স্বদেশ থেকে তাড়িয়েছিল। নিমীল যদিও সমাজতন্ত্রী নয় অথবা সমাজতন্ত্র বলতেও কিছু বুঝেনা, তবে এটা বুঝে এই দুইজন মনীষির একজন সব আঘাত সয়ে কলম দিয়ে লড়েছে, আরেকজন আঘাতকে অস্ত্র আর রক্ত দিয়ে প্রতিঘাত করেছে।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।