আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

শচিন টেন্ডুলকার - মৃদু মানুষের ঈশ্বর

এইটা আমার ব্লগ।

আমি খোদাকে দেখছি, উনি তিন নাম্বারে ব্যাটিং করে। শচিন টেন্ডুলকার এর রিটায়ারমেন্ট নিয়ে যে বাড়াবাড়ি উচ্ছ্বাস তার একটা একজাম্পল দিলাম। গত কয় দিন টেন্ডুলকারকে নিয়ে ভারত, পাকিস্তান এবং বাংলাদেশের ক্রিকেট প্রেমী জনতার যে উচ্ছ্বাস সেইটা নিয়া কিছু বলতে দুই দিন সময় নিলাম, নইলে মাইর খাওয়ার চান্স ছিল। আমি কিছু কন্ট্রভারসিয়াল কথা বলব।

মাইন্ড কইরেন না। প্রথমত , আই লাভ শাচিন। এমন একটা মানুষ যার ভক্ত না হয়ে পারা যায় না। ব্যক্তি শচিন একজন সত্যকার এর রোল মডেল। এত টাকা পয়সা সম্মান প্রাপ্তির পরেও সে ফ্যামিলিকে যেই ভাবে গুরুত্ব দেয় - তা একটা উদাহরণ।

জীবনের শেষ খেলার ভাষণে যে বলে, আমার সেরা ইনিংস আমার ওয়াইফ এর সাথে তাকে আপনার রেস্পেক্ট করতেই হবে। এবং ইতিহাসের সর্বোচ্চ সংখ্যক ম্যাচ খেলে সর্বোচ্চ রান, সর্বোচ্চ সেঞ্চুরি টেস্ট, ওয়ানডে তে একটা টেন্ডুলকার এর মত একজন অবিস্মরণীয় ব্যক্তির দ্বারাই সম্ভব। আমি টেন্ডুলকার এর সমসাময়িক প্লেয়ার ক্যালিস, বায়ার্ন লারা, পন্টিং এদের সাথে টেন্ডুলকার এর ২০০০ , ৩০০০ রান এবং ৭/৮ টা কম সেঞ্চুরি, গড়, বেশি খেলা, ভারতের ব্যাটিং ফ্রেন্ডলি উইকেট, এবং ক্রিটি-কাল ম্যাচ এর পারফরমেন্স এবং টিমকে জিতিয়ে আনার মত পারফরমেন্স ইত্যাদি তুলনামূলক পজিশন দিয়ে টেন্ডুলকার এর এচিভমেন্ট কে ছোট করতে চাই না। টেন্ডুলকার গ্রেট এবং তার মত এত দীর্ঘ সময় ধরে ফিটনেস ধরে রেখে খেলা যাওয়া এবং ক্রিকেট ইতিহাসের সর্বোচ্চ এচিভমেন্ট করা নিয়া একটু বাড়াবাড়ি করাই যায় কিন্তু টেন্ডুলকার বন্দনা এত বেশি হইছে যে সেই বাড়াবাড়িটা একটু বেশি বাড়াবাড়ি হয়ে গ্যেছে বলেই লাগছে । কই পন্টিন ও রিটায়ার করল, বায়ার্ন লারা রিটায়ার করলো কিন্তু তাদের নিয়া ত এইরকম হয় নাই।

তারাও গ্রেট। টেন্ডুলকার হয়তো তাদের সবার থেকে বেশি অর্জন করছেন কিন্তু এমনতো না যে তাদের সবার থেকে টেন্ডুলকার অতীব সুপারলেটিভ প্লেয়ার । তারা প্রত্যেকেই একই সময়ে আলো ছড়িয়েছেন এবং একটা ভদ্র সম্মত রিটায়ার নিয়েছেন - যেইটায় এই রকম দৃষ্টিকটু উচ্ছ্বাস হয়নি। এমন মোটেও না যে তারা শচিন টেন্ডুলকার এর সাথে তুলনীয় না। এর কারণ যদি দেখেন, তাইলে দেখবেন , টেন্ডুলকারকে নিয়ে যে উচ্ছ্বাস তাকে পুরো ভারতীয় উপমহাদেশীয় সর্ব ভারতীয় জাতির বিশ্ব প্রেক্ষাপটে ক্রিড়াঙ্গন ও অন্যান্য ক্ষেত্রে ক্রমাগত পরাজিত হওয়ার হীনমন্যতা থেকে বের হয়ে আসার জন্যে ক্রিকেটকে আঁকড়ে ধরে নিজেকে গ্লরিফাই করার একটা চেষ্টা মাত্র ।

ক্রিকেট ইট-সেলফ একটা অভারহাইপড খেলা। পৃথিবীতে এখনো ২০ টা দেশ সিরিয়াসলি ক্রিকেট খেলেনা। যেই খেলা গুলো সারা বিশ্বে খেলা হয় যেমন ফুটবল, রাগবি , এথলেটিক্স এই সবে আমরা পুরো ভারতীয় উপমহাদেশের লোক সারা বিশ্বে বেইল পাই না। এর কারণ, অনেক দিক থেকে ক্রিকেট খুব দুর্বল একটা স্পোর্টস। আপনি ২ ঘণ্টা খেলার পরেও হয়ত আপনার শরীর ঘামাবেনা।

ক্রিকেট খেলতে অনেক প্রস্তুতি নিতে হয়। গরিব মানুষ ক্রিকেট খেলতে পারেনা। তাই কোন জনপদ বা দেশে ক্রিকেট খেলা যদি প্রধান খেলা হয় তা সেই জনপদের দুর্ভাগ্য। কারণ, ওই জনপদের বা দেশের সর্ব শ্রেণির লোক খেলাটাকে সাপোর্ট করতে পারবে, কিন্তু নিজে খেলতে পারবেনা। কিন্তু এই ক্রিকেটকে ওভার হাইপ করার দরকার পরছে, ইন্ডিয়ান পাকিস্তানি, শ্রীলঙ্কান এবং সিরিয়াল ধরে বাংলাদেশের ও ।

কারণ, এরা দেখছে এরা আর কোন খেলাতেই বাকি বিশ্ব ত দূরের কথা এশিয়ান লেভেলেই টিকতে পারতাছেনা। ফলে মাত্র ১২ টা দেশ খেলে এমন একটা খেলাকে এই জাতি গুলো প্রমোট করা শুরু করছে। কারন, বারোটা দেশ যেই খেলা খেলে সেই খেলায় আপনি খারাপ খেললেও সারা বিশ্বে ১০ নাম্বার আর ফুটবল বা এথলেটিক্সে আপনি অনেক চেষ্টা করেও সারা বিশ্বে ১৫০ নাম্বার। এবং এই হাইপ টারে সৃষ্টি করছে এডভারটাইজার রা। ৯০ এর দশকে যখন ইন্ডিয়া ভারতীয় উপমহাদেশের দেশ গুলোতে কাচা টাকা ঢুকা শুরু করছে, মধ্যবিত্তের সাইজ বাড়া শুরু করলো তখন বড় বড় এমএনসির কাছে ইন্ডিয়া এবং এই অঞ্ছল একটা গুরুত্তবপুরন মার্কেট হয়ে উঠে।

তারা জানে, মানুষের মন জয় করার সব চেয়ে সহজ রাস্তা দেশপ্রেম বেচা। এবং ইজি দেশ প্রেম বেচা যায় , খেলা ধুলায় এচিভমেন্ট দিয়া। এবং তারা দেখল এক মাত্র ক্রিকেটেই দেশ গুলো কিছু অর্জন করতে পারতাছে কারন, মাত্র ১০ টা দেশ সিরি্যাস্লি ক্রিকেট খেলে। এবং ইন্ডিয়া হচ্ছে এই অঞ্ছলে সব চেয়ে বড় বাজার ফলে ইন্ডিয়ার ১০০ কোটি লোকের বড় বাজার ধরার জন্য তারা ক্রিকেটে পয়সা ঢালা শুরু করলো। তাছাড়া ক্রিকেট অসম্ভব এডভারটাইজমেন্ট ফ্রেন্ডলি খেলা।

প্রতি পাচ মিনিট পর পর এডভারট দেখানো যায়, প্রতি বলের পর এক মিনিটে চাইলে এদ্ভারটাইজমেন্ট দেখানা যায়। এবং লম্বা সময় ধরে খেলাটা চলে। অন্য যে কোন খেলায় প্রায় ৪৫ মিনিট অপেক্ষা করতে হয় । এবং টাকা ঢালাতে অটোমেটিক ইন্ডিয়া ,পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কার খেলা ইম্প্রুভ করে কারণ খেলাতে যেহেতু টাকা ধুকছে, পলাপাইন ধুমসে ক্রিকেটে মনোযোগ দিছে। বাংলাদেশও কম বেশি ইম্প্রভ করছে কিন্তু নিজেদের প্রশাশনিক দুর্বলতার কারনে, পিছায় পড়ে বাট সেইটা অন্য গল্প।

এবং এই সময় এই সব বামনদের মধ্যে সব চেয়ে লম্বা লোক টেন্ডুলকার । ইভেন ৯০ এর আগে, ক্রিকেটে ছিল, ওয়েস্ট ইন্ডিজ আর অস্ট্রেলিয়ার রাজত্ব। বিংশ শতকের প্রথম দশকে এসে ইন্ডিয়া ডমিমেন্ট হয়। এই সময় ইন্ডিয়ান মার্কেট আরও এট্রাক্টিভ হইছে নব্য বেড়ে যাওয়া মধ্যবিত্তের কারণে। ফলে, স্পন্সর আর এদ্ভারটাইজারদের পোয়া বারো ।

তারা ক্রিকেটকেই ইন্ডিয়ার এবং এই এলাকার অন্যান্য দেশে মান সম্মান ইজ্জত এবং সব চেয়ে বড় অর্জন হিসেবে দেখান শুরু করে। এবং তা ইন্ডিয়া অর্জন করেও। ফলে ইন্ডিয়ার মধ্যবিত্তএর মনে, নিজেরে বিশ্বের সেরা দেখার যে বাসনা তা পূর্ণ হতে থাকে। কয়টা দেশে ? এখনো ১২ টা দেশের মধ্যে। এই সময়কার সেরা আইকন টেন্ডুলকার।

তাই, টেন্ডুলকার কে শুধু গ্রেট না - বানান হয় দেবতা । বানান এডভারটাইযাররা অথচ, আমি যত দূর ক্রিকেট দেখছি, টেন্ডুলকার অনেক বিচারে তার সমসাময়িক প্লেয়ার থেকে অনেক আহামরি বেশি নন যে উনি খোদার মর্যাদা পাবেন । এমন কি তুলনা করলে টেন্ডুলকার অনেক ক্ষেত্রেই রুহুল দ্রাবিড় থেকে পিছিয়ে পরেন । জয়দীপ ভারমা নামের এক এনালিস্ট , ইন্ডিয়ার ম্যাচ গুলোতে কার রান এর ইমপ্যাক্ট বা ম্যাচ জয়ে অবদান কে কাল্কুলেট করে দেখাইছে রাহুল দ্রাবিড় ইন্ডিয়াকে ৮টা সিরিজ জিতাইছে টেন্ডুলকার জিতাইছে ৬ টা। ২০ টার উপর ম্যাচ খেলছে এই লিস্টের অলটাইমে টেন্ডুলকার এর রান গড় ১৭ তম।

ব্রাডমেন যদি, আরও ৬২ টা ম্যাচ খেলত এবং প্রতিটা ম্যাচ এ ০ রান করতো, তাও টেন্ডুলকার থেকে বেশি গড় থাকতো। টেন্ডুলকার এর অর্জন কে ছোট করে দেখান এই লেখার উদ্দেশ্য না। উনি আসলেই তার সময়ের বা হয়ত অলটাইম সেরা ব্যটসমেন। ওয়ানডে এবং টেস্ট দুইটায় উনার যে অর্জন তা হয়ত কেও ভাঙ্গতে পারবেনা। আবার এও ঠিকযে তার থেকে ভাল কেও আসবেনা তা নয় তার কারণ, হয়ত টেস্ট ক্রিকেট আর ওয়ান ডে আর এত পরিমাণ খেলা আর হবেনা।

এর কোন কিছু টেন্ডুলকার এর অর্জন কে খাটো করেনা, কিন্তু বিষয় হইলো টেন্ডুলকারকে দেবতা বানানোর যে প্রোপাগান্ডা এবং তাকে নিয়ে বাড়াবাড়ি সেইটা মূলত প্রডাক্ট বিক্রির ধান্দা। টেন্ডুলকার যদি খোদা হয় ত খোদা যেই পেস্ট দিয়ে দাঁত ব্রাশ করবে, তা আপনারও ব্যবহার করা উচিত- সেই মামলা। সেইটা অল্প অর্জন কারি, হীনমন্যতায় ভোগা পুরো ভারতীয় জনগণ খাইছে, কারণ সেইটা তাদের কিছু সেন্স অফ এচিভমেন্ট দেয় মনের মধ্যে । আমরা বাংলাদেশি বাঙালিরাও খাইছি, কারণ আমরা বিগত ১০ বছরে আমাদের কালচারাল কাপিটাল গুলো হারিয়ে ভারতীয় কালচার এর দাস হইছি ফলে এখন ইন্ডিয়াকে নিজেদের গুরু মনে করি, তাদের দেবতা মানে আমাদের গুরুর দেবতা । সে ত আরও বড় জিনিষ।

তাই গত কয় দিন টেন্ডুলকার এর বিদায় নিয়ে যে মারসিয়া গীতি চারিদিকে দেখতাছি তা দেইখা একটু দুক্ষ লাগছে। আর আমার বার বার আশরাফুল ছেলেটার কথা মনে পড়ছে। ভারতের একটা জেনারেশানের সেরা ব্যাটস্মান মান সম্মান টাকা পয়সা সব কিছু নিয়ে পুরো ভারত বাসির কাছে দেবতার মর্যাদা নিয়া রিটায়ার করছে আর আমাদের একটা জেনারেসানের সেরা ব্যাটসম্যান অল্প কয়টা টাকার লোভ সামলাইতে না পেরে বেটিং কইরা এখন ইতিহাসের আস্তা-কুড়ে নিক্ষেপিত হইছে। এই পোলাটার ট্যালেন্ট কম ছিলনা- সেও সুযোগ পেলে হয়তো মৃদু মানুষের ঈশ্বর হইতে পারত ।


অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.