আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

ফিল্ডে মুক্তিযুদ্ধ বনাম স্ট্যাটাসে লাইক: মিনা ফারাহ।



ফিল্ডে মুক্তিযুদ্ধ বনাম স্ট্যাটাসে লাইক মিনা ফারাহ ১৯৭১ সালের এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহ। শেরপুর থানাটি সীমান্তের খুব কাছে হওয়ায় বৃহত্তর ময়মনসিংহের বিভিন্ন এলাকা থেকে সংখ্যালঘুরা আসতে শুরু করলে, প্রথম চোটে দখল হলো বসতবাড়ি। এমনকি একটি গণ্যমান্য পরিবারের সম্মানে বাবা- মাকে ছেড়ে দিতে হলো শয়নকটিও। কয়েক ঘণ্টার মধ্যে দখল হলো খাটের তলা থেকে বারান্দা এবং নাটমন্দির থেকে গদিঘর। এরপর শুরু মানুষের ঢল।

দুই এক দিন পর আমাদের নিজস্ব বলতে কিছু থাকল না। কয়েক দিনের ব্যবধানে ১০ হাজারের বেশি মানুষ ব্রহ্মপুত্রের এ- পারে এসে গোটা শেরপুরের রাস্তাঘাট সর্বত্রই আশ্রয় নিলো। এ ছাড়া উপায়ও নেই। অন্যথায় মরতে হবে। এখন কথায় কথায় পুঁজিবাদ কিংবা পরিবেশ বিপর্যয়ের বিরুদ্ধে মন্তব্য করলেও তখন আসলেই কী ঘটছিল, একজন কিশোরীর বোঝার কথা নয়।

বরং ক’দিন ধরেই যুদ্ধ যুদ্ধ ভাব এবং বাড়িভর্তি মানুষ দেখে ‘উৎসব উৎসব’ লাগছিল। সারা দিন ভিড়ের মধ্যে দল বেঁধে ঘুরে বেড়াই। খোলা হলো লঙ্গরখানা, ভলান্টিয়াররা কোমরে গামছা বেঁধে জগাখিচুড়ি বানায়, আমরাও পানির কলস নিয়ে ভিড়ের মধ্যে ঘুরতে থাকি। শুরু হলো পালিয়ে যাওয়ার জন্য দফায় দফায় বৈঠক। উত্তেজিত সংখ্যালঘুরা।

হইচই শুরু হলো, মধুপুর পর্যন্ত এসে গেছে পাকবাহিনী, ব্রহ্মপুত্রের এ-পারে আসতে মাত্র দু’দিন বাকি। গভীর রাতে গুলির আওয়াজ শোনা যায়। অতীতেও দাঙ্গা-যুদ্ধ, সামরিক শাসন, আন্দোলনÑ সব দেখেছি; কিন্তু এমন উৎকণ্ঠা আগে কখনোই দেখিনি। মধ্যরাতে প্রায় ২০টি ডিজেলের ড্রাম গর্ত করে বাগানে পুঁতে ফেলার সময় অস্থির বাবা বললেন, ‘তেল মজুত করছি পালানোর জন্য, দেশে আর থাকা যাবে না। ’ হিন্দুপ্রধান শহরে ব্যবসার জন্য সারা দেশ থেকে আসা প্রায় ১০০ বাস-ট্রাক আটকে গেলে ঠিক হলো, পালানোর কাজে ব্যবহার করা হবে এগুলো।

মধ্য রাতে দুই লাখ টাকায় মুসাবিদা হলে শুরু হলো ১০ হাজারের বেশি মানুষের শহর ছাড়ার পালা। তখনো অন্ধকার। ১০ এপ্রিল ভোরে মরা কান্না। বাসে বসে বাসার দিকে তাকানো মায়ের মরা কান্না দেখি। নাড়িপোঁতা বাড়িটি রেখে কাঁদতে কাঁদতে আমরাও বাসে উঠলাম বস্তাভর্তি জিনিসপত্র নিয়ে।

বাবা এসেই বাসনপত্রগুলো ফেলে দিলেন। কোনো গাড়িতেই তিলধারণের জায়গা নেই। রাস্তার দু’ধারে সারি সারি আতঙ্কিত মানুষ। ভলান্টিয়াররা রিফিউজি নিয়ন্ত্রণে গলদঘর্ম। চার ঘণ্টার মধ্যে শহর ছাড়তে হবে, মাইকে এই খবর দ্রুত রটে গেলে স্থানীয়রা রাস্তায় দাঁড়িয়ে গেলেন।

চোখের পানিতে বিদায় দেয়ার পালা। তখন নরম সকাল। শেষপর্যন্ত যখন বাবার দেখা পাওয়া গেল, মনে হলো, আপন কেউ মারা গেছে। দু’চোখ তার জবাফুল। গাড়ি চলতে শুরু করল।

বাবা বাসের টিনে মাথা কুটছেন শিশুর মতো। দেশ বিভাগ হলো, রায়ট হলো; কিন্তু মাতৃভূমি ছেড়ে কখনোই চলে যাননি। এসেছিলেন কিশোর বয়সে এক মারোয়াড়ীর কর্মচারী হয়ে। বাসের বহর চলতে শুরু করলে হাজার হাজার মানুষের আহাজারিতে এক বিস্ময়কর দৃশ্যের অবতারণা। গাড়ি চলেছে মেঘালয়ের দিকে।

এমন বাজে রাস্তা যে, নাড়িভুঁড়ি হজম হয়ে যায়। ১ ঘণ্টার রাস্তা ৬ ঘণ্টায়। দুপুরে বাস থামল ডালু পাহাড়ের হাজার হাজার তাঁবুর কাছে। বিশাল পাহাড়ে বন্যহাতি আর সাপের কথা জানানো হলো। রোমাঞ্চকর অনুভূতি দিয়ে শুরু হলো তাঁবুর নিচে রিফিউজি জীবন।

বাবা ক্যাম্প অফিস থেকে নিয়ে এলেন মোমবাতি আর খুচরো খাবার। প্রথম রাতেই মায়ের শরীরের ওপর অজগর। ক্যাম্পের লাবড়া খেয়ে কলেরার ধুম। লাগল মড়ক। হেঁটে হেঁটে পরিচিতজনদের খুঁজি।

মেঘালয়ে কমপে এক লাখ রিফিউজি। শ্মশানের কাছে পেলাম আমাদের দীর্ঘ দিনের কাজের লোক অতুলদাকে। মড়া পোড়ানোর কাজটি সে করছে, আমি থ! চার দিকে বিভিন্ন জাতের বিষাক্ত পোকা। হামেশাই রক্তচোষা জোঁকের কবলে ক্যাম্পের মানুষ। তাঁবু রেখে বাবা তুরা পাহাড়েই মাসিক আট টাকায় একটি কুঁড়েঘর ভাড়া করলেন।

তিন সপ্তাহ পর আত্মীয় এসে নিয়ে গেলেন বালুরঘাটে। বাসে পাহাড়টি পার হওয়ার মতো দুঃসহ অভিজ্ঞতা কারোই যেন না হয়। সীমান্তসংলগ্ন হওয়ায় বালুরঘাটে নিয়মিত যুদ্ধ চলছিল। ‘ভাই ও বেহেনো’ বলে ইন্দিরা গান্ধী জওয়ানদের উদ্দেশে বক্তৃতা দিলেন, সেটাও দেখলাম। শেলিং শুরু হওয়ার আগে সাইরেন বাজার সাথে সাথে ভোর রাতে বাংকারে লুকিয়ে থাকা হলো রুটিন।

সকাল হলে লাশ দেখতে বের হই। এক দিন বাড়ির উল্টো দিকের ক্যাম্পে মারা গেল আমার দুই বান্ধবী। বাবার হাতে মৃত কন্যা, বাবা হাসপাতালে যেতে উদগ্রীব। ওই বিপদে কে কাকে দেখে! এ দিকে চোখের সামনে ১৪ আগস্ট নকশালের হাতে খুন হলেন আমার ফুফাতো ভাই। রক্তে ভাসছে তার বিরাট দেহ।

নকশাল আর মুক্তিযুদ্ধের চাপে নাস্তানাবুদ হিন্দুস্তান। আমার হীরের টুকরো বাবা জলপাইগুড়িতে খাঁ- খাঁ রোদে রাস্তায় বসে টাকা বাটা করার কাজ নিলেন। বাবার কষ্ট দেখে সবাই কাঁদি, যার নিজেরই কর্মচারীর সংখ্যা প্রায় ২০০, তার এ কী হলো! ইয়াহিয়া খান পাকিস্তানি টাকা অচল ঘোষণা করলে সেটাও বন্ধ হয়ে গেল। লাখ লাখ রিফিউজির লুকিয়ে আনা টাকাগুলো অচল হলে মাথায় বজ্রপাত। দুই লাখ অচল টাকা হাতে তালই মশায় ফিট।

বাবার ওপরে নির্ভর করে অনেক মুখ। আমরা জানি না, ভাগ্যে কী আছে। এই অবস্থাতেও আমাদের বাড়িতে রিফিউজিদের ঢল। সীমান্ত কাছে হওয়ায় বালুরঘাটের অবস্থা তখন শেরপুরের মতোই। বাবা কাঁদেন, কবে দেশে ফিরবেন।

লাল রঙের ফিলিপস্ ট্রানজিস্টারের ডায়াল ঘুরিয়ে প্রতিদিন আসর করে দেশের খবর শুনি। একজন খবর দিলো, আমাদের বাড়িটি বদর ক্যাম্প, মুক্তিযোদ্ধারা শেল মেরে দেয়ালে বিশাল গর্ত করেছে। মা বললেন, ‘আমার কিছু ভালো লাগে না। তোরা কোথাও গিয়ে ভর্তি হ’। কোথায় ভর্তি হবো? শেষপর্যন্ত শুধু রিফিউজিদের জন্য বানানো টাইপ শেখার স্কুলে ভর্তি হলাম।

একদিন শেলিংয়ে সেটাও উড়ে গেল। তখন আমরা কলকাতায়। মাসিক ৪০০ টাকায় বাসা ভাড়া করে, বাবা ফিরে গেলেন জলপাইগুড়িতে। কলকাতার ফুটপাথ ভরে গেছে রিফিউজি। আমাদের খবর পেয়ে দেশীরা আসেন।

কোথা থেকে খবর পেয়ে জীবন থেকে নেয়া ছবিটির খোঁজে পরিচালক জহির রায়হান এসে হাজির। অচেনা শহরে মায়ের চোখ অপারেশনের দায়িত্ব পড়ল আমার ওপর। একা একাই পার্ক সার্কাস থেকে ময়দান মার্কেট চষে বেড়াই। পশ্চিমবঙ্গের মানুষদের সাথে কিছুতেই খাপ খায় না, ‘বাঙাল’ বলে ভেংচায়। ভারতে তখন হিপ্পিদের জয়জয়কার।

সুরেন্দ্রনাথ ব্যানার্জি রোডের ‘লোটাস হলে’ হিপ্পি কাহিনী নিয়ে জিনাত আমানের বিখ্যাত দম মারো দম সিনেমা দেখার অভিজ্ঞতা। ট্রানজিস্টার হাতে উন্মুখ থাকি, কবে স্বাধীন হবে দেশ। পাশের বাড়ির সর্দারজির আত্মীয় মুক্তিযুদ্ধে শহীদ হলে দেখতে গেলাম। এরপর ১৬ ডিসেম্বর। বাবা একাই ফিরে গেলেন, ১৫ দিন পর গেলাম আমরা।

বিধ্বস্ত শহরে আরো অদ্ভুত অভিজ্ঞতা। ধরপাকড় আর খুনের ধুম। মানুষ আবার ফিরতে শুরু করলে শুরু হলো তৃতীয় জীবন। যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশে শত্র“ না মিত্র প্রশ্নে ধেয়ে এলো সামাজিক বিভক্তি। সব জিনিসেরই অগ্নিমূল্য।

মজুতদার, কালোবাজারিদের তাণ্ডবে তিন টাকা কেজির চিনি এক লাফে ৩০ টাকা। মুক্তিযুদ্ধের তীব্র উত্তেজনায় কথায় কথায় বিশেষ পরিচয় দেখিয়ে চাঁদা; ট্রাক-বাস না দিলে ভয় দেখায়। দুর্ভি, রীবাহিনী, হাতে হাতে অবৈধ অস্ত্রসহ নৈরাজ্য যখন চরমে, তখন দুর্ভিরে মধ্যে একদিন বাবাকেও ধরে নিয়ে গেল রীবাহিনী। যখন ফিরলেন, সারা শরীরেই সিগেরেটের পোড়া দাগ। এভাবেই যুদ্ধে যুদ্ধে জীবন।

মুক্তিযুদ্ধ এর একটি অংশ মাত্র। এসব কেন বলছি! ১৯৮০-তে প্রবাসী হলাম; কিন্তু ৪২ বছরেও বলতে পারিনি, মাতৃভূমিতে শান্তি বলে কিছু এসেছে। প্রতিটি মুহূর্তই রাজনৈতিক অস্থিরতা এবং জীবনহীনতায় জর্জরিত। চরম অসভ্যতার উদাহরণ হয়েছে সমূহ রাজনীতি। আফ্রিকার ওয়ার্ল্ড লর্ডরা যা করে, গণতন্ত্রের দোহাই দিয়ে আমরা করছি তার চেয়ে বেশি।

যুদ্ধের মাধ্যমে সবচেয়ে বেশি পেয়েছি দু’টি আদর্শে ১০০ ভাগ বিভক্ত একটি জাতি, যাদের ভাষা-সংস্কৃতি-ধর্ম এক। ইহুদি- মুসলমান সমস্যা নেই। তা সত্ত্বেও এদের অবস্থা রক্তাক্ত ইসরাইল- ফিলিস্তিনের মতো। আজীবন মতা ধরে রাখার জন্য জাতির পিঠে জগদ্দল পাথর হয়ে বসে থাকার বার বার অপচেষ্টার মধ্যে ক্যু- সামরিক শাসন, স্বৈরগণতন্ত্র। পিন্ডির হাত থেকে মুক্ত বলটি আরো বড় স্বৈরাচারীদের কোর্টে।

মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে যা পেলাম, এ জন্য নেতাকে কতটুকু ধন্যবাদ জানাব? বরং ষড়যন্ত্র থিওরি নিয়ে প্রশ্ন তোলার সময় এখন। কেন এবং কার স্বার্থে মুক্তিযুদ্ধ? ঢাল নেই, তলোয়ার নেই, নিধিরাম সর্দারের চেয়ে বড় প্রশ্ন সততা। প্রধানমন্ত্রী হওয়ার জন্য ধূর্ত ইয়াহিয়া-ভুট্টোর সাথে বৈঠকটি সাড়ে সাত কোটি মানুষের সাথে চালাকি। বরং সুপ্ত বাসনা মনে, নেতা যদি নিজেই রণেেত্র নেতৃত্ব দিতেন, তা হলে ৪২ বছর পর জাতীয়তাবাদের প্রশ্নে এই অসমাপ্ত যুদ্ধ ভোগ করতে হতো না। অপরিকল্পিত যুদ্ধে সাড়ে সাত কোটি মানুষকে কামানের মুখোমুখি করার অধিকার কারোই ছিল না।

এতে অহেতুক মৃত্যুই বেশি হয়েছে। একটি যুদ্ধ মানেই, একটি বিশেষ দিনে পাবলিক উত্তেজিত করা কিংবা হুমকি-ধমকি আর লগি- বৈঠার আমন্ত্রণ নয়। বরং ওই বক্তৃতাটি ছিল পরিকল্পনাহীন এবং দায়িত্বহীনতার পরিচয়। জীবনে অনেক বড় নেতার জীবনী পড়েছি। এই মাপের যুদ্ধে লাগে মেধা, লাগে পরিকল্পনা।

এরপর তিনি দুই হাজার মাইল দূরে। দেশে কী হচ্ছে, তার অজ্ঞাত। ভারতীয়দের সহায়তায় মুক্তিযুদ্ধের নৈতিকতা নিয়ে প্রশ্ন। থিয়েটার রোডে কিছু অস্থায়ী সরকারের কর্মকর্তার কর্মকাণ্ড নিয়ে প্রশ্ন। মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্বে কে, তা নিয়ে ধোঁয়াশা।

রাজনীতিকদের সুবিধা হলো, মেধাহীনতাকে পুঁজি করা আর গডফাদারদের অবাধ দুর্নীতির সুযোগ করে দিয়ে মতায় থাকা। প্রধানমন্ত্রী হওয়ার বিষয়ে আলোচনা চলতেই পারে, তবে ৭ মার্চ-পরবর্তী পরিস্থিতিতে হোটেল ইন্টারকনে মতা হস্তান্তরের আলোচনার আগে যে কোনো নেতারই বোঝার কথা, ‘সোয়াত’ জাহাজে করে পিন্ডি থেকে গোলাপ ফুল আসছে না। কিসিঞ্জার, ইয়াহিয়া, মাও ব্লক ভালোবাসার মেসেজ দিচ্ছে না। মুজিবের জানার কথা, ছয় মাস আগেই পাকবাহিনীর যুদ্ধ পরিকল্পনা এবং অস্ত্র কেনার জন্য চীনা দূতাবাসের মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্রের সাথে চুক্তি সই হয়েছিল। চীনের সাথে মার্কিনিদের ৪০ বছরের শীতল সম্পর্ক অবসানের অন্যতম কারণ মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধে নিক্সন-মাও-এর একক অবস্থান।

বিনিময়ে নিরাপত্তা পরিষদে চীনের ভেটো মতা অর্জন। এসব ঘটনা এক দিনে বা এক মাসে হয়নি। যেকোনো সুস্থ নেতারই জানার কথা, ইতোমধ্যে প্রায় ৮০ হাজার সৈন্য পৌঁছে যার যার কর্মস্থলে চলে গেছে। এক ঘণ্টার নোটিশে কখনো ‘অপারেশন সার্চলাইট’ সম্ভব? মুজিবের বেলায় সব কিছুই ব্যতিক্রম। ইন্টারকনে যখন বৈঠক চলছিল, তলে তলে অপারেশন সার্চলাইটের প্রস্তুতিই ছিল আসল।

সুতরাং ৪২ বছর পরেও যে দেশে স্বাভাবিক মৃত্যুর গ্যারান্টি নেই, এরকম একটি দেশের ‘জাতির পিতার’ প্রশ্নটির মীমাংসা জরুরি। উপরিউক্ত অভিজ্ঞতাগুলো আমার মতো কোটি কোটি মানুষের। এমন অনেকেই আছেন মুক্তিযুদ্ধে যারা সব হারিয়েছেন; কিন্তু স্বাধীনতার সুফল খাচ্ছে অন্যরা। এমনই একজনের নাম গীতা। বিয়ের চার বছরের মাথায় স্বামীটি গেল।

ছেলেমেয়েসহ ঢাকা শহরে একদিন ভিে করতে দেখলাম, এরপর তার খবর নেই। আরো দেখলাম, থিয়েটার রোডে যারা আরাম-আয়েশে থেকেছেন, দেশে ফিরে তারা নাকি বড় মুক্তিযোদ্ধা! ২ মুক্তিযুদ্ধের সময় কেউ অন্তঃসত্ত্বা হবে না, এমন কথা বেদে লেখা নেই। তবে যা দেখেছি, সন্তান পেটে প্রাণের ভয়ে মাইলের পর মাইল ছুটে চলা নারী, যারা পাকবাহিনীর ন্যূনতম সহমর্মিতাও পায়নি। এমনকি, আমার নিজের বোনেরও প্রসব হলো একটি নোংরা বাথরুমে। তবে ’৭১-এ যারা ঢাকার সবচেয়ে নামকরা হাসপাতালে নিরাপদে সন্তানের জন্ম দিতে পারেন, তাদের সৌভাগ্যের প্রশংসা করব।

এই ভাগ্য ক’জনের হয়েছে? তাদেরই হয়েছে, যারা কাক হয়েও ময়ূর সেজে জগৎকে ঠকাতে চান। ’৭১-এ যারা আমার মতো রিফিউজির অভিজ্ঞতা অর্জন না করে বরং ঢাকা শহরেই নিরাপদে ছিলেন, তাদের বিরুদ্ধেও ােভ নেই। যারা ক্যাম্পে আমার মতো সাপ-জোঁকের মুখোমুখি হননি, তাদের সততা নিয়ে প্রশ্ন তুলছি না। ফিল্ডে মুক্তিযুদ্ধের আসল চেহারা যারা দেখেননি, এখন তাদের প্রতারণা নিয়েও বিব্রত নই। যখন রণাঙ্গনে না গিয়ে নেতা চলে যান দুই হাজার মাইল দূরে, তাতেও দুঃখ নেই; কিন্তু দুঃখ একটাই।

যারা মুক্তিযুদ্ধ করেননি কিংবা মুক্তিযুদ্ধে একান্ত স্বজন হারাননি, এমনকি রিফিউজি হওয়া দূরে থাক বরং পাকবাহিনীর নিরাপত্তায় সহিসালামতে ছিলেন, কিংবা ’৭১-এ যারা নিরাপদে ভূমিষ্ঠ হলেন... তাদের মুখ থেকে মুক্তিযুদ্ধের উপদেশ বড়ই ‘টক’ লাগে। এরাই যখন মুক্তিযুদ্ধের চেতনা এবং রাজাকার চেনান, তখন তাদের আমার চিনতে কষ্ট হয়। মুক্তিযুদ্ধকে যারা ফেসবুকের লাইক স্ট্যাটাসে নিয়ে যায়, সেসব মওসুমি মতালোভীদের হাত থেকে বাংলাদেশকে মুক্ত না করলে ছারখার হয়ে যাবে। গায়ে কালো কোট চড়ালেই নেতা হওয়া যায় না। ডান হাতের তর্জনী দেখিয়ে ধমকা-ধমকি করলেই যা নয়, তা দাবি করা যায় না।

সহিসালামতে আল্লাহর করুণায় ১৭ জুলাই ১৯৭১-এ যে ছেলেটির জন্ম হলো ঢাকা মেডিক্যালে, সেই ছেলেটি যখন ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়ে মুক্তিযুদ্ধের কাস নেন, কিংবা রাজাকার চিনতে নির্দেশ জারি করেন, দলে দলে তখন বুদ্ধিবৃত্তিক আত্মহত্যা ছাড়া উপায় নেই। ৩ মুক্তিয্দ্ধু চেতনার মানে কী, আমাকে কেউ বোঝালে খুশি হবো। যারাই চেতনার নামে সোচ্চার, তাদেরই একজন শেখ হাসিনা, মুক্তিযুদ্ধে যিনি অংশ নেননি বরং ছিলেন অন্তঃসত্ত্বা। সন্তান প্রসবের পর যথেষ্ট সময় পাওয়া সত্ত্বেও মুক্তিযুদ্ধে যাননি। কেন যাননি? ম্যাক্সিম গোর্কির ‘মা’ উপন্যাসে পড়েছি কৃষাণী ওয়াংলাং মাঠেই সন্তান প্রসব করে আবার ধান তুলতে গেছেন।

তাই চেতনার কথা তার মুখে কতটুকু মানায়? মুক্তিযুদ্ধের চেতনা আর পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে যে যত বলবে তার ভাগ্য তত ভালো। পাকিস্তানিদের যারা মুরগি সরবরাহ করত, তাদের মুখেও শুনি, গণহত্যার জন্য মা চাইতে হবে। বুঝলাম; কিন্তু কিসের মা? ১৪৯২ সালে কলম্বাস আমেরিকায় অবতরণের পর প্রায় ৩০ লাখ রেড ইন্ডিয়ান হত্যার মাধ্যমে আজ যে ওয়াশিংটন, মার্কিনিরা কি সে জন্য অবশিষ্ট তিন লাখ রেড ইন্ডিয়ানের কাছে মা চেয়েছে? মেধার বিকল্প নেই। ২০০ বছর ভারত শাসনের ফলে অসংখ্য গণহত্যার জন্য মা চায়নি ব্রিটিশ। ১৪ আগস্টের মধ্য রাতের পর থেকে প্রায় দুই মিলিয়ন মানুষ মারা গেছে।

’৪৭-এর আগে থেকেই গণহত্যা, ধর্ষণ এবং বাস্তুহারার ইতিহাস। সংখ্যালঘু ইস্যু, অর্পিত সম্পদ এবং দাঙ্গা। ব্রিটিশ কারো কাছেই মা চায়নি। কারো কাছেই মা চাননি সম্রাট নেপোলিয়ান। পরাজিত ব্রিটিশরা কি জেনারেল জর্জ ওয়াশিংটনের কাছে মা চেয়েছিল? মেধার বিকল্প নেই।

ভুললে চলবে না, ২৪ বছরের মাথায় আমরাই কারো অবিভক্ত দেশকে বিভক্ত করেছি। সে জন্য দুই পই দুই পকে প্রয়োজনীয় খুন, ধর্ষণ, লুণ্ঠন সব করেছি। এর পরেও কেন মা চাইতে হবে? ১৬ ডিসেম্বরের গন্ধ পেয়েই বিপুল গণহত্যা শুরু হলে জাতিসঙ্ঘ এবং ভারতীয় সেনাবাহিনীর তত্ত্বাবধানে আনা হলো যুদ্ধবন্দীদের। নিরাপত্তা বলয়ে ঘিরে ফেলা হলো প্রায় ৩০০ বিহারি ক্যাম্প, পরে যা জেনেভা ক্যাম্প। খুনাখুনির বেগ দেখে যুদ্ধাপরাধীদের দ্রুত নিয়ে চলে গেল ভারতীয়রা।

অসংখ্য ফুটেজ ইউটিউবে। সুতরাং মুক্তিযুদ্ধের সত্য ইতিহাস জানলে, কেউ কারো কাছে মা চাইবে না। ৪ ট্রুথ কমিশন গঠন করে নেলসন ম্যান্ডেলা আর বিশপ টুটু যা অর্জন করলেন, তা অনুসরণ করলে কি তি হতো? মেধার কোনোই বিকল্প নেই। বিনিয়োগ করলে যদি মূলধন নিয়ে টানাটানি, তাহলে বিনিয়োগ করব কেন? ম্যান্ডেলা ছয় মাসেই যা অর্জন করেছেন, তা বিশ্বের জন্য বিস্ময়কর। জগৎজুড়ে ম্যান্ডেলার জয়গান।

তাই কাউকেই তার ফটো বহন করে দেশে দেশে প্রচারের জন্য এ পর্যায়ে নামতে হয় না। ৪২ বছর পর যুদ্ধাপরাধীদের মা করা কোনোক্রমেই অযৌক্তিক ছিল না; বরং রক্তপাত এড়ানো যেত। এই কাজে বিবেকবানদের সহযোগিতা পাওয়া যায়নি। এই মাপের রক্তপিপাসা, এই উচ্চতায় ‘ফাঁসি চাই, ফাঁসি চাই স্লোগানের তাণ্ডব... জাতির মনোজগতের কী পরিমাণ তি হয়েছে, বলবেন মনস্তত্ত্ববিদেরা। গত ৫ বছরে দেশপ্রেম এবং ধর্মপ্রেমে শেখ হাসিনা অনেক সুনাম অর্জন করেছেন।

যুদ্ধাপরাধীদের রায় কার্যকর করার বিষয়ে তিনি দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। কেউ অন্যায় করলে তার শাস্তি সে ভোগ করবেÑ এ বিষয়ে সন্দেহ নেই; কিন্তু ১৯৭৪-এর ওআইসি সম্মেলনে বাংলার জল্লাদ নামে কুখ্যাত টিক্কা খানের সাথে করমর্দনরত বঙ্গবন্ধুর ছবিটি কি সে কথা বলে? কিংবা ১৯৯৪ সালে শেখ হাসিনা এবং নিজামী, সাজেদা চৌধুরীর মিটিং কি সে কথাই বলে? ছবিগুলো দেখে সত্যিই খুব অসহায় হয়ে পড়ি। কেন অসহায় হয়ে পড়ি, এর উত্তর দিতে পারবেন একমাত্র সত্যিকারের দেশপ্রেমিক এবং ধর্মপ্রেমিক মানুষেরাই। ১৯৫ জন শীর্ষ এবং ৯৮ হাজার সাধারণ যুদ্ধাপরাধীকে মা করেছিলেন শেখ মুজিব; কিন্তু ১৬ ডিসেম্বরের পর তাদেরই হত্যা করতে চেয়েছিলেন মুক্তিযোদ্ধারা। অবশ্যই এর পেছনে কারণ আছে।

সুতরাং একই বিষয়ে আওয়ামী লীগের বার বার অবস্থান পরিবর্তনকে সুবিধাবাদী আচরণ বললেই যথার্থ। তা হলে এই যে সন্দেহযুক্ত বিচার যার বিরুদ্ধে সারা বিশ্বে তোলপাড়, রায় ঘোষণার পর ফাঁসির উদ্দেশ্যে আইন সংশোধন... কার স্বার্থে? ওআইসি সম্মেলন ১৯৭৪ করমর্দনরত টিক্কা খান এবং শেখ মুজিব। নিউ ইয়র্ক প্রবাসী, মানবাধিকার কর্মী

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।