আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

পিএসি, জেএসসির প্রশ্ন ফাঁস করে কোমলমতি শিশুদের প্রতিভাকে নষ্ট করবেন না।



গ্রামে জন্ম আমার, ছোটবেলার কিছুটা সময় গ্রামেই কেটেছে। তারপর শহরে আসা, শহরের স্কুলে ভর্তি হওয়া, এই সবই ৮০ দশকের ঘটনা। গ্রাম ছেড়ে চলে আসলেও গ্রামের আত্মীয় স্বজনদের সাথে ভালোই যোগাযোগ ছিলো। আমার বড়বোন যখন নব্বই দশকের মাঝামাঝি শহরের স্কুল থেকে এসএসসি পরীক্ষা দিলো, তখন গ্রামের অনেক আত্মীয়, স্কুল পড়ুয়া ভাতিজা এরা কেউ বিশ্বাস করছিলো না, নকল না করেই সে পরীক্ষা দিয়েছে, আবার পাসও করেছে। তাদের এক কথা, নকল না করে কিভাবে পরীক্ষায় পাশ করা সম্ভব? পরীক্ষা ব্যাপারটার সাথে নকল এতো বেশি ওতপ্রোতভাবে জড়িত ছিলো, নকল ছাড়া পরীক্ষার হলে যাওয়াটা ওদের কাছে অবিশ্বাস্য ছিলো।

এক চাচাতো ভাই শহরের মাদ্রাসা থেকে কামিল পাশ করেছিলো। পরীক্ষাচলাকালীন তিনি আমাদের বাসায় ছিলো, উনাকে দেখতাম পরীক্ষার হল থেকে সাদা খাতা নিয়ে আসতেন, আর পরীক্ষার আগের রাতে উনি বসে বসে উত্তর লিখতেন। পরদিন পরীক্ষার হলে গিয়ে যেসব কমন পড়তো, সেইসব উত্তর মূল খাতার সাথে জুড়ে দিতেন। আর একবড় ভাইকে দেখতাম, পরীক্ষার জন্য ২-৩ সেট নকল রেডি করতো। কারণ পরীক্ষার হল থেকে অনেক সময় শিক্ষকরা নকল কেড়ে নিচ্ছেন কিংবা ম্যাজিস্ট্রেট নকল নিয়ে নিচ্ছে।

যদি একসেট নকল নিয়ে যায়, তাই ব্যাকআপ হিসাবে আরো ২ সেট সাথে রাখতেন । ২০০০ সালের দিকের ঘটনা। এক ভাগ্নী গ্রামের স্কুলে পড়ালেখা করতো। কিন্তু সে পরীক্ষাকে মারাত্মক ভয় পেতো। কিন্তু নকলের সাথে সে সাবলীল হয়ে উঠতে পারে নাই কখনো।

নকল করা ছাড়া কিভাবে পাস করবে, সে এটা নিয়ে খুবই চিন্তিত ছিলো। তার এসএসসি পরীক্ষা ২০০১ সালের মার্চের দিকে (যতটুকু মনে পড়ছে)। আমরা তাকে শহরে নিয়ে আসলাম ২০০০ সালের আগস্টের দিকে, উদ্দেশ্য হলো, তার ভীতি দূর করা। শহরে তাকে ২টা স্যারের কাছে পড়তে পাঠানো হলো, নিয়মিত মডেলটেস্ট দিলো। আস্তে আস্তে সে কনফিডেন্স ফিরে পাচ্ছিলো দেখে খুব ভালো লাগছিলো।

যথা সময়ে সে পরীক্ষা দিতে গ্রামে গেল, তার সেন্টার পড়লো রাউজানের একটা কলেজে। আমি প্রথমদিন তার সাথে ঐ সেন্টারে গেলাম। চারপাশের অবস্হা দেখে আমার চোখ মাথায় উঠে গেল। স্কুলের পাশেই সুপারী আর নারকেল গাছ আছে, সেই গাছে মানুষ উঠে নকল সাপ্লাই দিচ্ছে। যাদের সাথে শিক্ষকদের "খাতির" আছে, তাদেরকে শিক্ষকরাই নকল এনে দিচ্ছে।

পুরো কলেজে সবাই নকল করছে, শুধু আমার ভাগ্নীটা ছাড়া। এটা যেন হজম করতে কষ্ট হচ্ছিলো ঐ রুমে দায়িত্বপ্রাপ্ত শিক্ষকদের। উনারা বার বার ভাগ্নীর খোজ নিতে আসছিলেন, তার কোন সাহায্য দরকার হবে কিনা? ঐ সেন্টারে ম্যাজিস্ট্রেট পরিদর্শনে গেলে শিক্ষকরা উনাকে ভাগ্নীর সাথে দেখা করাতে নিয়ে গেলেন, একমাত্র মেয়ে যে নকল করা ছাড়া পরীক্ষা দিচ্ছে। একটা সময় এই ছিলো দেশের অবস্হা। পরীক্ষার পরদিনই পত্রিকায় আসলো, নকলের মহোৎসব।

একটা সময় পরে এটা আস্তে আস্তে কমা শুরু করলো, সৃজনশীল বই এবং প্রশ্ন তৈরী করে নকলের সুযোগটা কমানো হচ্ছে, এটা নিঃসন্দেহে খুবই একটা ভালো উদ্যোগ। কিন্তু পরীক্ষা ব্যবস্হায় যথাযথ তদারকীর অভাবে এর সুফল পাচ্ছে না শিক্ষার্থীরা। আজকে থেকে ক্লাস ফাইভে পড়ুয়াদের পিএসসি পরীক্ষা শুরু হচ্ছে। আমার ভাই এর মেয়ে পরীক্ষা দিচ্ছে। সে যথেষ্ট বুদ্ধিমতি, পড়ালেখাতেও ভালো।

পরীক্ষার প্রস্তুতিও ভালো। হঠাৎ গতকাল রাত ১টার সময় বিশ্ববিদ্যালয়ের হলে থাকা এক ভাগ্নে ফোন করে আমার ভাইয়াকে বললো, প্রশ্ন তো ফাঁস হয়ে গেছে, তোমরা পেয়েছো নাকি? তারপর সে গড় গড় করে সব বলে দিলো, কি কি প্রশ্ন আসবে। যদিও প্রস্তুতি ভালো, তারপরও সকালে ভাতিজিকে সেই বিশেষ প্রশ্নগুলো আবার ভালো করে পড়ানো হলো। একটু আগে পরীক্ষা শেষ হলো, ভাতিজি বললো, সকালে পড়া ঐ প্রশ্নগুলো মিল আছে, যদিও সে আগে থেকেই এগুলো পারতো। কথা হলো, প্রশ্নটা কিভাবে ফাঁস হচ্ছে? এই প্রশ্ন তৈরী, ছাপানো, বিলি বন্টন করার কাজে যারাই থাকেন, তাদের নৈতিকতা প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে আজকাল।

কোন কোন শিক্ষক কিংবা দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা নিজের ছেলে মেয়ের জন্য, আত্মীয় স্বজনদের জন্য প্রশ্ন ফাঁস করেন, তারপর সেটা দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে সবখানে। এখন তো ফ্যাক্স, ইমেল, মোবাইল এসএমএস কত মাধ্যম আছে দ্রুত যোগাযোগের জন্য। আবার অনেক সময় প্রশ্ন ফাঁস করা নিয়ে কিছু কিছু কোচিং সেন্টার ব্যবসা করে। তারা টাকার বিনিময়ে প্রশ্ন ফাঁস করে। বিসিএস পরীক্ষা, চাকুরীর নিয়োগ পরীক্ষা, এসএসসি পরীক্ষা, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষা, ভর্তি পরীক্ষা এমন কোন পরীক্ষা নাই, যার প্রশ্ন এদেশে ফাঁস হয় নাই, তাই বলে ক্লাস ফাইভে পড়ুয়া ছোট বাচ্চাদের প্রশ্ন ফাঁস করতে হবে? এই বাচ্চারা কিছু বুঝে উঠার আগেই জেনে যাবে, পরীক্ষার প্রশ্ন তো পরীক্ষার আগেই পাওয়া যায়, তাহলে কষ্ট করে পড়ার দরকার কি? ছোটবেলাতেই প্রশ্নফাঁসের এই কুফল তাদের হয়ত আজীবন ভোগাতে পারে।


সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে ২৭ বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।