আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

বঙ্গভবনে খালেদা জিয়া

দেশের বিদ্যমান রাজনৈতিক সংকট নিরসনে উদ্যোগ নেওয়ার জন্য রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদকে অনুরোধ জানিয়েছে বিএনপি নেতৃত্বাধীন ১৮-দলীয় জোট। বিএনপি চেয়ারপারসন ও ১৮-দলীয় জোট নেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে ২০ সদস্যের একটি প্রতিনিধি দল গতকাল সন্ধ্যায় বঙ্গভবনে রাষ্ট্রপতির সঙ্গে সাক্ষাৎ করে এ অনুরোধ জানায়। সাক্ষাৎ শেষে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর সাংবাদিকদের এ কথা জানান। এদিকে বঙ্গভবন থেকে বেরিয়ে এসে সরাসরি গুলশান কার্যালয়ে গিয়ে আবারও ১৮-দলীয় নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করেন বেগম জিয়া। পরে রাষ্ট্রপতির সঙ্গে বৈঠকের বিস্তারিত সাংবাদিকদের জানান মির্জা ফখরুল।

গুলশানের বাসা থেকে বিকাল ৫টার দিকে রওনা হয়ে নির্ধারিত সময়ের প্রায় ৪০ মিনিট আগে বঙ্গভবনের একেবারে নিকটে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) সামনে এসে পৌঁছান খালেদা জিয়া। নির্ধারিত সময়ের অনেক আগে আসায় সেখানে প্রায় ২৫ মিনিট গাড়িতে অবস্থান করতে হয় তাকে। সন্ধ্যা সোয়া ৬টায় বঙ্গভবনের ভেতরে প্রবেশ করেন তিনি। নিশান পেট্রোল কারটির পেছনের সিটে বসে ছিলেন অফ হোয়াইট শাড়ি পরা বিএনপি-প্রধান। তার পেছনের গাড়িতে ছিলেন স্থায়ী কমিটির সদস্য ব্যারিস্টার জমিরউদ্দিন সরকার।

বঙ্গভবনে রাষ্ট্রপতি বিরোধীদলীয় নেতাকে স্বাগত জানান। রাষ্ট্রপতি খালেদা জিয়াকে নিয়ে বৈঠকের নির্ধারিত হলরুমে প্রবেশ করেন। বঙ্গভবনে আগেই উপস্থিত হয়েছিলেন প্রতিনিধি দলের অন্য সদস্যরা। রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ প্রতিনিধি দলের সদস্যদের সঙ্গেও কুশল বিনিময় করেন। বেগম খালেদা জিয়ার গাড়ি বঙ্গভবনের ফটকে পেঁৗছানোর সময় দৈনিক বাংলা মোড়ে জড়ো হয়ে স্লোগান দিতে দেখা যায় বিএনপির একদল নেতা-কর্মীকে।

নেতা-কর্মীরা তার গাড়ির পেছনে মিছিল নিয়ে রাজউক পর্যন্ত আসেন। পরে পুলিশ নেতা-কর্মীদের সরিয়ে দেয়। বৈঠক শেষে বেরিয়ে এসে মির্জা ফখরুল সাংবাদিকদের জানান, চলমান রাজনৈতিক সংকট নিরসনে ২০ সদস্যের একটি প্রতিনিধি দল রাষ্ট্রপতির সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছি। চলমান রাজনৈতিক অবস্থা কী, তা আমরা রাষ্ট্রপতির কাছে তুলে ধরেছি। যেহেতু তিনি রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ অভিভাবক, তাই তাকে সংলাপ ও সমঝোতার উদ্যোগ নিতে অনুরোধ জানিয়েছি।

তিনি সংবিধানের মধ্যে থেকে তার যে ক্ষমতা আছে, সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নেবেন। আমরা সংকট নিরসনে উদ্যোগ নেওয়ার জন্য রাষ্ট্রপতিকে অনুরোধ জানিয়েছি। তিনি (রাষ্ট্রপতি) আমাদের বলেছেন, সংবিধানের মধ্যে থেকে যথাযথ উদ্যোগ গ্রহণ করবেন। সংলাপে বসাতে রাষ্ট্রপতিকে কোনো সময়সীমা বেঁধে দেওয়া হয়েছে কি না_ জানতে চাইলে মির্জা ফখরুল বলেন, এ ধরনের কোনো ডেডলাইন দেওয়া হয়নি। রাষ্ট্রপতির সঙ্গে বৈঠকে বেগম খালেদা জিয়ার সঙ্গে মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ছাড়াও ২০ সদস্যের প্রতিনিধি দলে ছিলেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন, ব্যারিস্টার জমিরউদ্দিন সরকার, ড. আবদুল মঈন খান, আ স ম হান্নান শাহ, মির্জা আব্বাস, নজরুল ইসলাম খান, গয়েশ্বর চন্দ্র রায়, ১৮-দলীয় জোটের নেতাদের মধ্যে জামায়াতে ইসলামীর কেন্দ্রীয় নায়েবে আমির অধ্যাপক এ কে এম নাজির আহমদ, এলডিপির কর্নেল (অব.) অলি আহমদ, ইসলামী ঐক্যজোটের মাওলানা আবদুল লতিফ নেজামী, বিজেপির আন্দালিভ রহমান পার্থ, জাগপার শফিউল আলম প্রধান, কল্যাণ পার্টির মেজর জেনারেল (অব.) মুহাম্মদ ইবরাহিম, লেবার পার্টির ডা. মুস্তাফিজুর রহমান ইরান, এনপিপির শেখ শওকত হোসেন নিলু, বাংলাদেশ ন্যাপের জেবেল রহমান গানি, ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক পার্টির সভাপতি গোলাম মোর্তুজা, খেলাফত মজলিশের আমির মাওলানা মুহাম্মদ ইসহাক।

রাষ্ট্রপতিকে দেওয়া ১৮ দলের লিখিত বক্তব্য : রাষ্ট্রপতির সঙ্গে বৈঠকের সময় ১৮ দলের পক্ষে একটি লিখিত বক্তব্য উপস্থাপন করেন মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। লিখিত বক্তব্যে মির্জা ফখরুল রাষ্ট্রপতির উদ্দেশে বলেন, আমরা রাষ্ট্রের অভিভাবক হিসেবে আজ আপনার কাছে এসেছি। মহামান্য রাষ্ট্রপতি, আপনার কাছে আমাদের সনির্বন্ধ অনুরোধ, আপনি সরকারকে বলুন, তারা যেন অবিলম্বে সংঘাত, হানাহানি ও হিংস তার পথ পরিহার করে সংলাপের একটি সুষ্ঠু পরিবেশ সৃষ্টি করেন। তারা যেন অবিলম্বে নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে সব দলের অংশগ্রহণের ভিত্তিতে অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠানের লক্ষ্যে একটি সমঝোতার পথে অগ্রসর হয়। মির্জা ফখরুল বলেন, আমরা দেশে গণতন্ত্র, শান্তি, স্থিতিশীলতা ও জননিরাপত্তা বজায় রাখার স্বার্থে এখনো সংলাপের পক্ষে।

সমঝোতায় পেঁৗছে নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে সব দলের অংশগ্রহণের ভিত্তিতে সুষ্ঠু, অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন চাই। সরকার তাদের জোটের সদস্যদের নিয়ে মন্ত্রিসভা পুনর্গঠন এবং বিরোধী দলের শীর্ষস্থানীয় নেতাদের মিথ্যা মামলায় গ্রেফতার করে সংলাপের পথে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করেছে। আমরা স্পষ্ট ভাষায় বলতে চাই_ নির্দলীয়, নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে ছাড়া ১৮ দল কোনো নির্বাচনে যাবে না। তিনি বলেন, সংবিধান থেকে উৎসারিত আপনার ক্ষমতা ও সীমাবদ্ধতা সম্পর্কে আমরা সচেতন রয়েছি। কিন্তু কখনো কখনো এমন পরিস্থিতি আসে, যখন রাজনীতিকদের হাতে প্রণীত এবং সংকীর্ণ স্বার্থে রদবদলকৃত সংবিধানের ধারা-উপধারা জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষার সঙ্গে সংগতিপূর্ণ থাকে না তখন তা সংকট নিরসনের পথনির্দেশনা দিতে সক্ষম হয় না।

এ ধরনের পরিস্থিতিতে প্রজাতন্ত্রের মালিক জনগণের প্রত্যাশাকেই সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিয়ে সংবিধানকে পুনর্বিন্যস্ত করতে হয়। রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ ব্যক্তিকেও তখন ইতিহাস-নির্ধারিত দায়িত্ব পালন করতে হয়। আমরা মনে করি, আজ জাতীয় জীবনে তেমনই একটি সময় এসেছে। দেশ-জাতির এই ক্রান্তিলগ্নে জনগণের ঐক্যের প্রতীক হিসেবে আপনি নিজে উদ্যোগী হয়ে তেমনই একটি ঐতিহাসিক ভূমিকা পালন করবেন, দেশবাসীর সেটাই প্রত্যাশা। আমরাও সে আশাই করি।

পরে রাষ্ট্রপতির প্রেস সচিব ইহসানুল করিম সাংবাদিকদের বলেন, বিরোধী দলের বক্তব্য রাষ্ট্রপতি সরকারের কাছে পেঁৗছে দেবেন। রাষ্ট্রপতি বলেছেন, দুই দলকে সংলাপের উদ্যোগ নিতে হবে। তিনি আরও বলেন, সমস্যা সমাধানে আলোচনা করা প্রয়োজন। বৈঠকটি প্রাণবন্ত করে রাখেন রাষ্ট্রপতি : বিএনপি নেতারা জানান, বৈঠকে রাষ্ট্রপতি তার স্বভাবসুলভ হাসি-মশকরাও করেছেন। বিভিন্ন কথা বলে আলোচনা প্রাণবন্ত করে রেখেছিলেন।

আলোচনার এক পর্যায়ে তিনি বলেন, 'আমার তো এত বড় বাড়িতে এত বড় রুমে থাকার অভ্যাস নেই। আপনারা তো আমার অভ্যাস খারাপ করে ফেলছেন। চাকরি শেষ হলে পরে কীভাবে ছোট রুমে থাকব। ' বৈঠকের শুরুতেই রাষ্ট্রপতিকে চলমান রাজনৈতিক অবস্থা এবং তার দলের অবস্থান ব্যাখ্যা করে স্বাগত বক্তব্য দেন মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। এরপর খালেদা জিয়া কথা বলেন।

তবে তার বক্তব্য ছিল খুবই অল্প। এ ছাড়া ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন, কর্নেল (অব.) অলি আহমদ, ব্যারিস্টার জমিরউদ্দিন সরকার, গয়েশ্বর চন্দ্র রায় ও আন্দালিভ রহমান পার্থও কথা বলেন। বৈঠকে অংশ নেওয়া বিএনপির এক নেতা জানান, রাষ্ট্রপতি বলেছেন, তিনি বিরোধী দলের বক্তব্য সরকারকে জানাবেন। কিন্তু তার সংবিধানের বাধ্যবাধকতা রয়েছে। অনেক কিছুতেই সীমাবদ্ধ তিনি।

এ সময় মির্জা ফখরুল বলেন, আমরা তো এগিয়ে এসেছি। জবাবে আবদুল হামিদ বলেন, বর্তমান পরিস্থিতিতে যারাই আলোচনায় বসার উদ্যোগ নিয়ে এগিয়ে আসবেন, তারাই দেশবাসীর কাছে প্রশংসিত হবেন। এ সময় বিএনপির এক নেতা রাষ্ট্রপতিকে জানান, সংলাপে বসার আগ্রহের কথা জানাতে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলামকে মির্জা ফখরুল ইসলাম বার বার ফোন করেছেন, কিন্তু তিনি রিসিভ করেননি। সৈয়দ আশরাফকে চিঠিও দেওয়া হয়েছে বলে জানানো হয়। রাষ্ট্রপতি এ সময় সৈয়দ আশরাফ চিঠি গ্রহণ করেছেন কি না জানতে চান।

জবাবে মির্জা ফখরুল বলেন, হ্যাঁ তিনি নিজেই গ্রহণ করেছেন। এরপর রাষ্ট্রপতি বলেন, তাহলে তিনি সৈয়দ আশরাফের সঙ্গে এ বিষয়ে কথা বলে চিঠি পাওয়ার পর যা করণীয় তা করার অনুরোধ করবেন। জোটের এক নেতা জানান, বৈঠকের পরিবেশ ছিল চমৎকার, শান্ত। তবে এ বৈঠকের মধ্য দিয়ে কোনো ফলাফল বেরিয়ে আসবে বলে তাদের মনে হয়নি। বৈঠকে উপস্থিত নেতারা বার বার জোর দিয়ে একটা কথা বলেছেন, বিদ্যমান ব্যবস্থায় বিএনপি নেতৃত্বাধীন জোট নির্বাচনে অংশ নেবে না।

হাস্যোজ্জ্বল স্বভাবসুলভ ভাষায় রাষ্ট্রপতি আরও বলেন, তার অনেক সীমাবদ্ধতা রয়েছে। আপদকালীন কিছু করার ক্ষমতা রাখা হয়নি। তিনি বলেন, তাকে মন্ত্রিসভার বক্তব্য পড়ে শোনাতে হয়। নিজের কিছু বলারও সুযোগ নেই। এদিকে রাষ্ট্রপতির সঙ্গে সাক্ষাৎ শেষে দল ও জোটের নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করেন খালেদা জিয়া।

এ ছাড়া কয়েকজন নেতার সঙ্গে আলাদাভাবে বৈঠক করেন তিনি। এ সময় প্রধানমন্ত্রী সরে গেলে রাষ্ট্রপতি কিংবা স্পিকারের অধীনে নির্বাচনে যাওয়ার পক্ষে বিএনপির একটি অংশ মত দেন বলে জানা গেছে। তবে এতে দলের বড় একটি অংশের আপত্তি রয়েছে। তারা বলছেন, সরকারপ্রধান নির্দলীয়-নিরপেক্ষ হতে হবে। এ জন্য আন্দোলন প্রয়োজন।

আন্দোলন করলে সরকার দাবি মানতে বাধ্য হবে। জানা গেছে, রাষ্ট্রপতির সঙ্গে আলোচনার পর সমস্যা সমাধানে কয়েক দিন 'সময়' দেবেন খালেদা জিয়া। শুক্রবারের মধ্যে ফলপ্রসূ কিছু না হলে ওইদিনই ১৮ দলের বিক্ষোভ সমাবেশ থেকে নতুন কর্মসূচি ঘোষণা করা হতে পারে। সে ক্ষেত্রে আগামী রবিবার থেকে টানা হরতাল কিংবা অবরোধ কর্মসূচির দিকে যাবে বিএনপি জোট।



অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।