আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

জার্নালঃ আর্মি স্টেডিয়াম (দ্বিতীয় দিন)

অর্থ নয়, কীর্তি নয়...আরো এক বিপন্ন বিস্ময়/আমাদের অন্তর্গত রক্তের ভেতরে খেলা করে

বেঙ্গলের ক্ল্যাসিক্যাল মিউজিক ফেসটিভালে গতবার যেতে পারিনি। মনে খুব খেদ ছিল। কিন্তু এবার যখন দ্বিতীয় দিনের আয়োজনে পূর্বায়ন চ্যাটার্জি তাঁর সেতারে ঝঙ্কার তুললেন, আগের সব না পাওয়া যেন সুদাসলে উসুল হয়ে গেল। ইচ্ছা ছিল গেট খোলার সাথে সাথেই ঢুকব। হল না।

গিয়ে দেখি বিদুষী অ্যালারমেল ভ্যালি'র ভরতনাট্যম শুরু হয়ে গেছে। ঠিক কী কারণে বলতে পারবনা, নৃত্য আমাকে খুব টানে না। কিন্তু সেই সন্ধ্যায় নৃত্যশিল্পীর অপূর্ব ভাষণ আর অসাধারণ পারফরম্যান্সে আমি সত্যিই মন্ত্রমুগ্ধ হয়েছিলাম। মনে হল অনেকটা আমাদের পালাগানের সাথে মিল আছে। এখানেও এপিসোড এপিসোডে ভাগ করে একটা কাহিনীর মত ঘটনা প্রবাহ থাকে।

বিদুষী অ্যালারমেল ভ্যালি তিনটা এপিসোড পারফর্ম করেছেন। তারপর সাকেত সাহু বেহালা নিয়ে মঞ্চে উঠলেন। তিনি বললেন তিনি বেহাগ পরিবেশন করবেন। ইলেকট্রিক তানপুরা শুরু হল। আমি অবাক হয়ে খেয়াল করলাম তানপুরার সাজ চেনা জানা সা-পা-সা্‌ নয়।

জানতাম ক্ষেত্রবিশেষে সা-মা-সা্‌ কিংবা সা-ধা-সা্‌ হয়ে থাকে। এখানে শুনলাম সা-না-সা্‌ !! এবং তা যুগপৎ নয়। সা শেষ হওয়ার পর না এবং না শেষ হওয়ার পর সা্‌ !! অদ্ভুত লাগল। আমি ঠিক জানিনা বেহাগের সঙ্গে তানপুরার এমন সাজ আগে থেকেই চলে আসছে নাকি এটা শিল্পীর ইন্নোভেশন। অপূর্ব লাগল।

বেহালার মূর্ছনা শেষ না হতেই বিদুষী বোম্বে জয়শ্রী উঠলেন। আমি দক্ষিণের সঙ্গীত খুব একটা শুনি না, তেমন টানেও না। তাই এই পারফরম্যান্স চলতে চলতে খেয়ে নিলাম। খাবার কর্নারেও একটা স্ক্রিন। সত্যিই বেঙ্গল ইজ গ্রেট।

সিকিউরিটি দেখলাম খুব কড়া। এরপর মঞ্চে এলেন আমাদের অসিত দে। সত্যি কথা বলতে কী, তাঁর পারফরম্যান্স আমাকে খুব মোহিত করে নি। যেন এই অপ্রাপ্তি পূরণ করার জন্যই সেতার নিয়ে মঞ্চে আবির্ভূত হলেন পণ্ডিত পূর্বায়ন চ্যাটার্জি। জয়জয়ন্তী রাগে সেতার যেন কথা বলতে লাগল।

আমি আবিষ্ট হয়ে থাকলাম ঘণ্টাখানেক! এরপর মঞ্চে উঠলেন পণ্ডিত অজয় চক্রবর্তী !!! একলব্যের মত যাঁকে দ্রোণাচার্য ভাবি। বিনয় যে সর্বিদ্যার ভূষণ তাঁকে না দেখলে শিখতাম না কখনো। মালকোষের ওপর দীর্ঘ বিস্তার করে তারানায় ঢুকে গেলেন। শেষ করলেন যোগিয়া রাগাশ্রিত একখানি গান দিয়ে। ধন্য আর্মি স্টেডিয়াম।

শেষ পারফর্মার ছিলেন ওস্তাদ রইস খান। তাঁর সাথে তাঁর ছেলেও ছিল। নাম সম্ভবত ফারহান খান। বাবা ছেলে মিলে কী যে করলেন শুধু তারাই জানেন যারা সেখানে ছিলেন। ওস্তাদজির সম্ভবত আশা পূরণ হয় নি।

আমার মনে হয়েছে যিনি তবলায় সঙ্গত করেছেন তিনি ওস্তাদজির সাথে নিয়মিত সঙ্গত করেন না। এক সময় ওস্তাদজি লয় বাড়াতে বাড়াতে আশাহত হয়ে দেখলেন তবলায় যিনি আছেন তিনি তাঁর লয়ের সর্বশেষ সীমায় উপনীত হয়েছেন। তাঁর পক্ষে আর লয় বাড়ানো সম্ভব হয় নি। অনুষ্ঠান শেষে দর্শকের জন্য ট্রান্সপোর্টের ব্যবস্থা করা হয়েছে। বিভিন্ন রুটে অনেকগুলো বাস।

সেই অবরোধের ভোরে এই সার্ভিসটার জন্য বেঙ্গলের কাছে আমাদের চিরকৃতজ্ঞতা। তবে কিছু হাস্যকর আর তিক্ত অভিজ্ঞতাও হয়েছে। সাকেত সাহু'র পরিবেশনের সময় যখন ইলেকট্রিক তানপুরা শুরু হল, আমার পেছনে বসা এক দর্শক তার পাশের জনকে প্রশ্ন করছেন- সেতারটা বাজাচ্ছে কে ? বলতে খারাপ লাগছে আমি এক বড় ভাই এর সাথে বসে দেখছিলাম। পণ্ডিত পূর্বায়ন চ্যাটার্জি যখন আলাপ দিয়ে রাগের ভেতরে আস্তে আস্তে ঢুকছেন তিনি তখন বলে উঠলেন- আলাপ আমার কাছে বিরক্তিকর লাগে। 'বিরক্তিকর'- কি অসাধারণ শব্দ চয়ন ! যে জিনিস বিরক্ত লাগে তা দেখার জন্য কেউ তো জোর করেনি ভাই।

স্বেচ্ছায় এসে কেন একথা বলছেন? সামনে বলতে না পেরে এখানে বললাম। তিনি আরেকবার আমাকে বিরক্ত করলেন। পণ্ডিত পূর্বায়ন চ্যাটার্জি যখন বললেন যে তাঁর গুরু পণ্ডিত অজয় চক্রবর্তী সামনে বসে আছে তাই তিনি তাঁর কাছে ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছেন ভুল ত্রুটির জন্য, তখন দস্তুর অনুযায়ী তিনি তাঁর গুরুর নাম নেওয়ার সময় কানে হাত দিলেন। আমার সেই ভাইটি তখন বললেন- নাম তো বলা লাগতেই পারে, তার জন্য কানে হাত দেওয়ার কী আছে ? সামনে একেবারে এমন কে বসে আছে যে নাম নিলে কানে ধরতে হবে ? তিনি আরো দু'একবার এ ধরণের কথা বললেন। যাক।

আর বড় করব না। এর মধ্যে পাশের একটা গ্রুপ এই বিষয়ক আলোচনা চালাতে লাগল। শোনার চেয়ে আলোচনায় তাদের মনযোগ বেশি মনে হল। তাদের একজন বলছিলেন যে আগের দিন নাকি সেতার পারফর্ম্যান্সের সময় এক জায়গায় একটা 'প্রোগ্রেসিভ পার্ট' চলছিল। জনরা টার্ম ট্যাগ করে দেওয়া এখনকার ছোকরাদের একটা ভারী বদ অভ্যাস হয়ে দাঁড়িয়েছে।

স্থান কাল পাত্র নাই ওটা প্রোগ্রেসিভ রক, তমুকটা আলটারনেটভ মেটাল। আমি বিরক্ত। যাক, বিরক্তিকে ছাপিয়ে আয়োজনের ভাললাগা মন প্রাণ কানায় কানায় পূর্ণ করে তুলেছিল। অপূর্ব এই আয়োজন। অপূর্ব !


অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।