আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

গালি যখন শিল্প

ক্রিকেট নাকি ভদ্রলোকের খেলা! যে ভদ্রলোক এই অমৃতবচন জন্ম দিয়ে মৃত্যুবরণ করেছেন, তাঁর আত্মা শান্তি লাভ করুক। কারণ হাল আমলে ক্রিকেট মাঠে হররোজ যেসব কাণ্ডকারখানার জন্ম হচ্ছে, তাতে স্বর্গে বসে ওই ভদ্রলোক নিশ্চয় মাথার চুল ছিঁড়ছেন রাগে-ক্ষোভে-হতাশায়। অবশ্য মাঠে ব্যাট-বলের পাশাপাশি দুই পক্ষের কথার লড়াইটাও কিন্তু ক্রিকেটের ইতিহাসের মতোই শতবর্ষী পুরোনো। কেতাবি ভাষায় যেটিকে বলে ‘স্লেজিং’।
এবারের অ্যাশেজের বদৌলতে এই স্লেজিং ব্যাপারটা বেশ আলোচনায় উঠে এল আবার।

অ্যাশেজ যে আবার উত্তাপ ছড়াতে শুরু করেছে। একসময় গালি জিনিসটাকে শিল্পের পর্যায়ে নিয়ে গিয়েছিল অস্ট্রেলীয়রা। আবারও যেন হারানো সেই সুদিন ফিরে আসতে শুরু করেছে তাদের। এবারের অ্যাশেজের প্রথম টেস্টে শুধু ব্যাটে-বলেই নয়, কথা দিয়েও তারা ঘায়েল করেছে ইংলিশদের। জোনাথন ট্রট শেষমেশ তো রণেভঙ্গ দিয়ে ‘পালিয়ে’ই গেলেন!
ক্রিকেটে একটা কৌতুক বেশ প্রচলিত।

স্লেজিংয়ের জুতসই সংজ্ঞা দিতে গিয়ে জনৈক ক্রিকেটবোদ্ধা বলেছেন, ‘অস্ট্রেলীয়রা যাহা বলে তাহাই স্লেজিং!’ তার মানে কী? অস্ট্রেলীয়দের মুখে সব সময় খিস্তিখেউরের তুবড়ি ছোটে? ওই বোদ্ধার জবাব, ‘না, তা কেন। অনেক সময় তারা ভালো ভালো কথাও বলে। ’ কখন? ‘যখন তাদের মুখ বন্ধ থাকে!’
তার মানে কিন্তু এই না, অস্ট্রেলীয়রাই স্লেজিংয়ের জন্মদাতা। আসলে আধুনিক ক্রিকেটের জনক ডব্লিউ জি গ্রেস সেই আদ্দিকালে ক্রিকেটের বেশ কিছু স্মরণীয় স্লেজিংয়ের জন্ম দিয়ে গেছেন। যেগুলোকে চুটকি বলাই ভালো।

যেগুলো শ্রবণ বা প্রকাশ-অযোগ্য নয়।
একবার ডাক্তার গ্রেস বোল্ড হওয়ার পর আম্পায়ারের দিকে ফিরে গিয়ে বলেছিলেন, ‘আসলে ঝোড়ো বাতাসে বেল পড়ে গেছে। ’ প্রত্যুত্তরে ওই আম্পায়ার বলেছিলেন, ‘আশা করি, বাতাসটি আরেকটু ঝোড়ো গতি পেয়ে ডাক্তার সাহেবকে প্যাভিলিয়নে নিয়ে যেতে সাহায্য করবে। ’
আরেকবার গ্রেস গেছেন এক গ্রামে খেলতে। সেখানকার এক অখ্যাত বোলার একেবারে প্রথম বলে আউট করে দিল গ্রেসকে! কিন্তু গ্রেস হাল ছাড়বেন কেন? ‘ট্রায়াল বল হিসেবে প্রথম বলটা ভালোই করেছ বাছা।

বেশ তবে, এবার শুরু হোক আসল খেলা’ বলে আবারও গিয়ে দাঁড়ালেন উইকেটে!
আউট হতে একেবারেই ইচ্ছে করত না গ্রেসের। আম্পায়াররাও বোধ হয় তাঁর এই ইচ্ছেটাকে সম্মান করতেন। ১৮৯৮ সালের এক ম্যাচে গ্রেসের বিপক্ষে একাধিকবার এলবিডব্লিউর আবেদন করে প্রত্যাখ্যাত হলেন ফাস্ট বোলার চার্লস কোর্টনাইট। শেষে রেগেমেগে একেবারে দুটো স্ট্যাম্পই দিলেন উপড়ে। বোল্ড! এরপর গ্রেসের দিকে এগিয়ে গিয়ে বললেন, ‘ডক্, তুমি এবারও নিশ্চয়ই মাঠ ছাড়বে না।

একটা স্ট্যাম্প তো এখনো দাঁড়িয়েই আছে, নাকি?’
আউট না হতে চাওয়ার পরিষ্কার যুক্তি ছিল গ্রেসের। ‘লোকে গাঁটের টাকা খরচ করে আমার ব্যাটিং দেখতে এসেছে, তোমার বোলিং নয়’—বোলারের উদ্দেশে এই ছিল তাঁর বাণী!

কিন্তু স্লেজিং এমন নির্দোষ চটুল বাক্যবিনিময়ে সীমাবদ্ধ থাকেনি। অস্ট্রেলীয়রা সেটিকে নিয়ে গেছে শিল্পের পর্যায়ে। এর অধিকাংশ ছাপার অক্ষরে সুধীসমাজে প্রকাশযোগ্য নয়। তার পরও ঘষেমেজে, সেন্সর করে কয়েকটি ভদ্রগোছের স্লেজিং পরিবেশন করাই যায়।

এক অ্যাশেজের ঘটনা। ব্যাট করতে এসেছেন ইয়ান বোথাম। রড মার্শ এগিয়ে গিয়ে তাঁকে ‘স্বাগত’ জানালেন, ‘হাই ইয়ান, তোমার বউ আর আমার বাচ্চারা কেমন আছে?’ বোথামের জবাব, ‘বউ ভালোই আছে। কিন্তু বাচ্চারা সব বিকলাঙ্গ হয়ে জন্মেছে দেখছি!’ পরের এই গল্পটাতেও বোথাম আছেন। এখন যেমন কোনো দল পাকিস্তান সফরে রাজি নয়, তেমনি নিরাপত্তা শঙ্কায় আগেও ভুগেছে দলগুলো।

আশির দশকে পাকিস্তান সফর থেকে ফেরার পর বোথাম তো ঘোষণাই দিয়ে দিলেন, ‘পাকিস্তান এমন একটা দেশ, যেখানে আপনি আপনার শাশুড়িকে পাঠিয়ে দিতে পারেন। ’ ইঙ্গিত পরিষ্কার, ব্রিটিশদের জামাই-শাশুড়ির চিরায়ত দ্বন্দ্ব দিয়ে পাকিস্তানের পরিস্থিতি বোঝানো। সেটা ভালোই বুঝেছিলেন পাকিস্তানের আমির সোহেল। প্রতিশোধ নিয়েছিলেন ১৯৯২ বিশ্বকাপের ফাইনালে। প্রতিটা রানের জন্য যুঝতে থাকা বোথামকে গিয়ে বলেছিলেন, ‘তোমার বদলে তোমার শাশুড়িকে ব্যাট করতে পাঠাও।

নিশ্চয় তিনি তোমার চেয়ে ভালো করবেন। ’

পরের এই ঘটনার নায়ক গ্লেন ম্যাকগ্রা আর জিম্বাবুয়ের ১১ নম্বর ব্যাটসম্যান এডো ব্র্যান্ডেস। ম্যাকগ্রার বল কিছুতেই ব্যাটে লাগাতে পারছিলেন না ব্র্যান্ডেস। কিন্তু আউটও হচ্ছিলেন না। অধৈর্য হয়ে ম্যাকগ্রা ধীর পায়ে এগিয়ে গেলেন ব্র্যান্ডেসের দিকে, ‘এডো, তুই কেন এত মোটা বল তো?’ ম্যাকগ্রার পেস সামলাতে না পারলে কী হবে, এই ‘বাউন্সার’ দুর্দান্ত সামলালেন ব্র্যান্ডেস, ‘হব না, যতবার তোমার স্ত্রীর কাছে যাই, ততবারই ও আমাকে যে বিস্কুট খেতে দেয়।

শরীরের আকার-আকৃতি নিয়ে খোঁচা দেওয়ার বেশ কয়েকটা গল্প আছে ক্রিকেটে। ১৯৯১ সালের অ্যাডিলেড টেস্টে মার্ভ হিউজকে ‘মোটকু বাস কন্ডাক্টর’ বলেছিলেন জাভেদ মিয়াঁদাদ। সম্বোধনটা হিউজের পছন্দ হয়নি। তাঁর বলেই মিয়াঁদাদ আউট হওয়ার পর হিউজ বড়েমিয়াঁর গতিরোধ করে দাঁড়ান। এক হাত পেতে দিয়ে বলে ওঠেন, ‘টিকিট, প্লিজ!’

ফাস্ট বোলাররা তাঁদের বলের গতির মতোই মেজাজধারী হন বলে অধিকাংশ স্লেজিংয়ের জোগান তাঁদের কাছ থেকেই পাওয়া যায়।

আবার ফাস্ট বোলারদের খোঁচা দেওয়ার সবচেয়ে মোক্ষম জায়গা হলো তাঁদের বলের গতি নিয়ে প্রশ্ন তোলা। বিশ্বের অন্যতম দ্রুতগতির বোলার ব্রেট লিকে একবার ইনজামাম-উল হক কী বলেছিলেন জানেন? বলেছিলেন, ‘অফ স্পিন করা বাদ দাও। ’

মজার ব্যাপার হলো, স্টিভ ওয়াহসহ সাবেক অস্ট্রেলীয় ক্রিকেটারদের অনেকেই এবার স্লেজিংয়ের বিরুদ্ধে বেশ উচ্চকণ্ঠ হয়েছেন। ক্রিকেট পরিসংখ্যানে স্লেজিংয়ের ‘পারফরম্যান্সে’র কোনো পরিসংখ্যান থাকে না। থাকলে এঁদের এহেন গান্ধীবাদী কথাবার্তায় একটা কথাই মনে হতো, ‘ভূতের মুখে রামনাম!’



সোর্স: http://www.prothom-alo.com

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।