আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

"২১শে ডিসেম্বর" ফুয়াদ উদ্দিন।

বিদ্রোহি রণ ক্লান্ত আমি সেই দিন হব শান্ত

”২১ শে ডিসেম্বর” ফুয়াদ উদ্দিন জবাবদিহিঃ ”২১ শে ডিসেম্বর” একটি সরাসটি রাজনৈতিক উপন্যাস । রাজনৈতিক কাহিনীতে কাল একটি বড় বিষয় । রাজনীতি নিদিষ্ট সময়ের গন্ডীতে এক ধরণের আবেদন সৃষ্টি করে । সময়ের ব্যবধানে সেই আবেদন ফিকে হয়ে যায় । “২১ শে ডিসেম্বর“ সমসাময়িক রাজনৈতিক সংকটের উপর লেখা ।

কচু পাতার উপরে টলমল করে ভাসছে কয়েকফোটা শিশির । ভোরের কুয়াশার মধ্যে বসে ঝিমুচ্ছে মাছরাঙা পাখি । একটা অর্ধেক ন্যাংটা ছেলে বগলে স্লেট । মাথায় একটা গোলটুপি । গায়ে চাদর ।

ভেজা পথ ধরে স্কুলে যাচ্ছ। কতগুলো পাখি নিজেদের ভাষায় কখা বলে চলছে। একটানা কখা বলছে । কেউ কারো কথা শুনছে না। শুধু বলে যাচ্ছে ।

কতগুলো মুখ । মিছিলের মুখ । এগিযে আসছে সামনে। বন্দুকের আর রাইফেলের নলগুলো রোদে চিকচিক করছে। প্রচন্ড শব্দে সহসা অগুন ঠিকরে বেরুলো ।

গুলির শব্দ। কচুপাতার উপর থেকে শিশির ফোটাঁগুলা গড়িয়ে পড়লো মাটিতে। মাছরাঙা পাখিটা ছুটে পালিয়ে গেল ডাল থেকে । অর্ধেক ন্যাংটা ছেলেটার হাত থেকে পড়ে গেল স্লেটটা। মেয়েগুলো সব স্তব্ধ নির্বাক দৃষ্টিতে পরস্পর এর দিকে তাকালো ।

২১ শে ডিসেম্বর ২০১৩ সাল। খুব ছোট ছোট স্বপ্ন দেখতো। চাষার ছেলে আলম। একটা ছোট্ট ক্ষেত । ছোট্ট কুড়ে ঘর।

একটা মিষ্টি বউ। ক্ষেতের মানুষ সে । লেখাপড়া করেনি। সারাদিন ক্ষেতের কাজ করতো। জোহরাকে দেখেছিলো একদিন পুকুর ঘাটে।

ঘোমটার আড়ালে ছোট্ট একটি মুখ । কাচাঁ হলুদের মত মুখ। ভাল লেগেছিল । বিয়ের প্রস্তাব পাঠাতে মেয়ের বাবা রাজি হয়ে গেল। ফর্দ হলো।

আলমের মনে খুশি যেন আর ধরে না। জোয়ালে বাধাঁ জীর্ণ-শীর্ণ গরু দুটোকে ছেড়ে দিয়ে চিৎকার করে বললো--- যা আজ তোদের ছুটি । আলম শহরে যাবে । বিয়ের ফর্দ নিয়ে। সবকিছিু নিজ হাহে কিনবে সে।

শাড়ি চুড়ি আলতা ইত্যাদি। অনেক কষ্টে জমানো কতগুলো টাকা রুমালে বেধেঁ নিলো সে। তিতাসের ওপর দিয়ে শহরে আসবে আলম। বিয়ের বাজার করার জন্য। দুচোখে ঘর বাধাঁর স্বপ্ন ।

২য় পর্ব । আহমেদ হোসেন। পুলিশের লোক। অতি সচ্চরিত্র। তবু প্রমোশন হয় না তারঁ ।

কারণ , ফারহান হোসেন রাজনীতি করে। ছাত্রদের সভায় বক্তৃতা দেয় । সরকারের সমালোচনা করে। ছেলেকে বুঝিয়েছেন বাবা। যারঁ দমকে দাগি আসামি চোর ডাকাত খুনি আসামিরা ভঁায়ে থরথর করে কাপতো – তার অনেক শাসন তর্জ্ন গর্জনেও ফারহানের মন টললো না।

মিছিলের মানুষ সে । মিছিলেই রয়ে গেলো। মা কাদঁলেন। বোঝালেন । আত্মীয় – স্বজন সবাই অনুরোধ করলো।

মা-বাবার প্রতি বোনদের প্রতি দায়িত্বশীল হতে। প্রমোশনটা বন্ধ হয়ে আছে। কিন্তু নিষ্ঠুর হৃদয় ফারহান বাবার প্রমোশন মায়ের কান্না আত্মীয়ের অনুরোধ সংসারের প্রয়োজন সবকিছূকে উপেক্ষা করে মিছিলের মানুষ মিছিলেই রয়ে গেল। আলেয়া ভালবাসত তাকেঁ । চাচাতো বোন।

দেখা হত। কথা হত না। তবুও মনে হতো অনেক দূরের মানুষ। আলেয়ার হৃদয়ের কোমল ক্ষতটির কোনো খোজ-থবর রাখত না সে। বহুবার চেষ্টা করেছে আলেয়া ।

বলতে বুঝাতে । মোতাহার আলী। সরকারী কর্মচারী । লেজার খাতায় টাকার অঙ্ক লিখে রাখা তারঁ কাজ। দিনের শেষে রাতে ঘরে ফিরে এসে স্ত্রীর সঙ্গে ঝগড়া করেন।

যখন এ দেহ মন জীবন আর পৃথিবীটাকে নোংরা একাটা ছেড়া কাথাঁর মতো মনে হয় তখন একান্তে বসে সোনালী দিনগুলোর কথা ভেবে আবেগে আরো দুঃখিত হয় । মোতাহারের জীবনে অনেক দুঃখ। স্ত্রীর দুঃখ থাকার দুঃখ বাচারঁ দুঃখ আবেগের দুঃখ। শুধু একটি আনন্দ অছে তার জীবনে। যখন অফিস থেকে বেরিয়ে পানের দোকান থেকে কয়েকটা পান কিনে মুখে পুরে চিবুতে থাকেন।

পথ চলতে চলতে আনন্দে ভরে উঠে তার সারা দেহ । ঘর আর অফিস । অফিস আর ঘর ছাড়া অন্য কোথাও যান না। যেতে ভাল লাগে না তাই । কিছু ভালো লাগে না তার।

অর্থ আর প্রাচুর্যের অফুরন্ত সমাবেশ । অভাব বলতে কিছু নেই আলী আহমেদের জীবনে । বাড়ি আছে । গাড়ি আছে । ব্যাংকে টাকা আছে ।

ছেলেমেয়েদের নামে ইনসুরেন্স আছে কয়েকখানা। ব্যবসা একটা নয় । অনেকগুলো । সারাক্ষণ ব্যস্ত থাকতে হয় তাকে । কখনো মন্ত্রীর দফতরে ।

কখনো আমলাদের সভা-সমিতিতে। তার জীবনেও অনেক দুঃখ । শ্রমের দুঃখ জাগতিক দুঃখ উৎপাদনের দুঃখ দেশের দুঃখ । এই অনেক দুঃখের মধ্যেও একটা আনন্দ আছে তারঁ । যখন সারাদিন ব্যস্ততার শেষে রাতে ক্লাবের এক কোণ চুপচাপ বসে বোতলের পর বোতল নিঃশেষ করেন তিনি ।

তখন অদ্ভুত এক আনন্দে ভরে উঠে তার চোখ মুখ । স্ত্রী বিলকিস বেগম এর সাথে তারঁ কদাচিৎ দেখা হয় । একই বাড়িতে থাকে এক সাথে বিছানায় শোন । কিন্তু কাজের চাপে টেলিফোনের অহরহ যন্ত্রনায় স্ত্রীর সঙ্গে বসে কথা বলার সময় পান না তিনি। অথচ স্ত্রীকে ভীষণ ভালবাসেন ।

স্বামীর সঙ্গ পান না সেজন্য বিলকিস বেগমের মনে কোনো ক্ষোভ নেই । কারণ সঙ্গ দেয়ার লোকের অভাব নেই তারঁ জীবনে । সেলিম মিয়াও স্বপ্ন দেখে । একটা সিএনজি অটোরিকশা কেনার স্বপ্ন। ছয় বছর ধরে মালিকের রিকশা চালিয়ে ক্লান্ত হয়ে পড়েছে সে।

সারাদিনের পরিশ্রম শেষে ২০০-৩০০ টাকা রোজগার হলে ৫০ টাকা মালিককে দিয়ে দিতে হয়। অবশিষ্ট টাকায় বউ আর বাচ্চাটাকে নিয়ে দিনের খাওয়া হয়। তারও পোষায় না । সভা-সমিতি মিছিলে লোকজনগুলো কেন এত মাতামাতি করে তার অর্থ সে বোঝে না । পুলিশেরা যখন ছাত্রদের ধরে ধরে পেটায় তখন সে অবাক চোখে চেয়ে চেয়ে দেখে ।

কোনো মন্তব্য করে না। একটা সিএনজি অটোরিকশা কিনতে হবে। আবো ভাবনা অছে তার। ছেলেটা আর একটু বড় হলে তাকেও সিএনজি চালানোর শেখাতে হবে। নৌকা ঘাট পেরিয়ে শহরে এলো আলম শহরে নেমেই সে অবাক হয়ে দেখলো মানুষগুলো সব কেমন যেন উত্তেজনায় উত্তপ্ত করছে তারা।

খবরের কাগজের হকাররা অস্থিরভাবে ছুটাছুটি করছে । কাগজ কেনার ধুম পড়েছে চারদিকে । নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারই হবে এদেশে । না ! না ! চিৎকার করে উঠলেন মোতাহার । অমি মানি না।

মুষ্টিবদ্ধ হাত তারঁ। স্বামীকে এত জোরে চিৎকার করতে কোনোদিন দেখিনি সে । কেন কী হয়েছে ? ওরা বলছে বাংলাদেশে দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন হবে। জানো – সালেহা্ দুদল কেউ কাউকে বিশ্বাস করে না সেখানে দলীয় সরকারের অধীন নির্বাচন হবে কি করে । এটা মেনে নেয়া যায় না।

সে কিগো ! আমরা তাহলে কি করবো ? ভর্য়াত দৃষ্টিতে স্বামীর দিকে তাকায় সালেহা । বজ্র থেকে ধ্বনি নিয়ে গজর্ন করে উঠলো ফারহান। এই সিদ্ধান্ত আমি মানি না। আমরা মানি না ! মানি না !! মানি না !!! কলেজপাড়ায় ছাত্রদের সভাতে অনেকগুলা কন্ঠ একসুরে বলে উঠলো আমরা মানি না। আমলাদের সভায় মেপে-মেপে কথা বলছে আলী আহমেদ।

আদর করে মানাতে হবে না মানলে চাবুকটাকে তুলে নিতে হবে হাতে। মানতে বাধ্য হবে তখন। কতগুলো মুষ্টিবদ্ধ হাত আকাশের দিকে তুলে শ্লোগান দিচ্ছে নারায়ে তাকবির আল্লাহু আকবার নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীন নির্বাচন চাই। দলীয় নির্বাচন মানি না । মানব না।

এক দফা এক দাবি। তত্ত্বাবধায়ক দেশের দাবি সংখ্যাগরিষ্ট জনগণের দাবি। আজ পান খাওয়া ভূলে গেলেন মোতাহার। ভূলে গেলেন কখন পথের মাঝখানে – দাড়িয়ে পড়েছেন। তিনি দেখছেন মিছিলের মুখগুলো ।

পেছন থেকে কে যেন ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিলো তাকেঁ। কী স্যার ? রাস্তার মাঝখানে দাড়িয়ে কী দেখেন ? বেল বাজাই শোনেন না ? রিকশার চালক সেলিম । ছেলেগুলোর চিৎকারে তার কোন উৎসাহ নেই। ৩য় পর্বঃ গদগদ কন্ঠে স্ত্রীকে বোঝাবার চেষ্টা করলেন মোতাহার। ছেলেরা খেপেছে ।

তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রতিষ্ঠা না করে ওরা ছাড়বে না। স্ত্রী পান খাচ্ছিলো । চুন মুখে তুলে বললো – হ্যাঁ গো তত্ত্বাবধায়ক হলে তোমার বেতন-ভাড়া বাড়ে যাবে ? ক’টাকা বাড়বে বলোতো ? কি হবে দেশের জানিনা । বিদেশী চর এসে ভরে গেছে পুরো দেশটা । স্ত্রীর সঙ্গে বহুদিন পরে আজ কথা বলতে বসলেন- আহমেদ হোসেন ।

তত্ত্বাবধায়-নির্দলীয় –সর্ববদলীয় আমি কিছু বুঝিনা। আমার সোজা কথা তোমার ছেলেকে সাবধান করে দাও। ও যদি আবার সভা-সমিতি আর আন্দোলন করে তাহলে এদ্দিন প্রমোশন বন্ধ ছিল এবার আমার চাকরিটাই যাবে। উত্তেজনায় থরথর করে কাপঁতে লাগলেন । তার স্ত্রীও শিউরে উঠলেন ।

অনাগত ভবিষ্যতের অনিশ্চয়তার কথা ভাবতে গিয়ে চোখে পানি এসে গেলো তারঁ । তুই কেমন নিষ্ঠুর ছেলেরে ! চাকরিটা চলে গেলে আমরা খাব কী? ফারহান নিশ্চুপ । আলেয়া বললো- চাচা ক’দিন ধরে আপনার চিন্তায় খাওয়া-দাওয়াও ছেড়ে দিয়েছে । এবসব কাজ না করলেই তো পারেন ? কী হবে এসব করে ? আলেয়ার দিকে অবাক হয়ে তাকালো ফারহান । এর মধ্যে অনেক কিছু বলতে ইচ্ছা হয়েছিলো তারঁ ।

শুধু বললো-তুমি এসব বুঝবে না । আনন্দবাজার যেখানে অনেকগুলো খেয়ানৌকা ভিড় করে থাকে তার কাছাকাছি একটা ইট টেনে নিয়ে বসে পড়লো আলম । খিদে পেয়েছে আলম । পুটলিটা ধীরে ধীরে খুললো সে । শহরের লোকজনদের সে বলতে শুনছে – কাল নাকি হরতাল ।

শহরের সমস্ত দোকান বন্ধ থাকবে । গাড়ি চলবে না । হরতাল কি আলম বুঝে না । পিঠা খেতে-খেতে সে নানাভাবে হরতালের একটা অবয়ব চিন্তা করতে লাগল । কিন্তু হরতালের কোনো সঠিক চেহারা র্নিণয় করা তার পক্ষে সম্ভব হলো না ।

সে ভাবলো- এটা হয়ত শহরেরই বিশেষ রীতি-নীতি । মাঝে মাঝে শহরের লোকজন এ-রকম হরতাল পালন করে থাকে । পানি পান করে গামছায় মুখ হাত মুছলো । কাল দোকান বন্ধ থাকবে । কেনাকাটা আজকেই শেষ করতে হবে ।

মূহুর্তে জোহরার মুখ মনে পড়লো তার । কী করছে এখন ? হয়তো পুকুরঘাটে পানি নিতে এসেছে । অথবা কচুবনে ঘুরে কচুশাক তুলছে । সাতদিন পর বিয়ে । ভাবতে বড় ভালো লাগলো আলমের ।

সহসা বিকট আওয়াজ শুনে চমকে তাকালো আলম । মাইক থেকে আওয়াজ আসছে --- কাল হরতাল । জাতীয় নেতৃবৃন্দের মুক্তি দাবি ও সংবিধান সংশোধন করে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রতিষ্ঠার দাবিতে কাল – হরতাল । সবাই হরতাল পালন করুন । আলম অবাক হয়ে শুনলো ।

সে ভাবলো কাউকে জিজ্ঞাসা করবে ব্যাপারটা কী ? কিন্তু সাহস পেল না । কিসের হরতাল ? আমি হরতাল মানি না । রিকশার ব্রেকটা ঠিক করতে করতে আপনমনে গজগজ করে উঠলো সেলিম । রিকসা না চালালে আমি রোজগার করবো কোথেকে ? আমি খাব কী ? আমার বউ খাবে কী ? ওসব হরতালের মধ্যে আমি নেই । এমন সময় পেছন থেকে কে যেন ডাকলো –ভাড়া যাবে ? সেলিম দেখলো একটা ছেলে হাতে বই ।

বগলে একগাদা কাগজ। কোথায় যাবেন ? কলেজে । উঠেন । ফারহান রিকশায় উঠে বসতেই সেলিম প্রশ্ন করলো – আপনারা কাল হরতাল করছেন কেন ? রিকশা না চালালে আমরা রুজি-রোজগার করবো কেমনে ? হাওয়া খেয়ে বেচেঁ থাকবো নাকি ? কিছু সময় নিয়ে ফারহান ধীরে ধীরে বললো – আমরা তত্ত্বাবধায়ক সরকার চাই । ওরা দলীয় সরকারের অধীন নির্বাচন করতে চায় ।

সেলিম বিজ্ঞের মতো বললো – আমার বউ সাতক্ষীরার মেয়ে । সে এসব বোঝে । আমরা দলীয়-তত্ত্বাবধায়ক সরকার সমানভাবে চাই । কিন্তু হরতাল চাই না । হরতাল করছেন কেন ? হরতালের মাধ্যমে আমরা বিক্ষোভ জানাতে চাই ।

আমাদের প্রতিবাদ জানাতে চাই । অ------ কিছু না বুঝলেও বারকয়েক ঘাড় দোলালেন সেলিম । (অসমাপ্ত)

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।