আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

ঐ মহামানব আসে

(এ লেখাটি এ বছর প্রথম আলোর ঈদ সংখ্যায় প্রকাশিত হয়েছিল। লেখাটি ব্যক্তি, রাজনীতিক, রাষ্ট্রনেতা সর্বোপরি মানুষ হিসেবে নেলসন ম্যান্ডেলাকে আবার পাঠকের কাছে পরিচয় করিয়ে দেবে। ম্যান্ডেলার মৃত্যুতে তাঁর প্রতি প্রথম আলোর শ্রদ্ধার্ঘ হিসেবে লেখাটি পুনঃপ্রকাশ করা হলো। )

 

মানুষ হিসেবে আমরা অনেকে যার যার কল্পলোকে সত্যিকারের এক নায়কের স্বপ্ন দেখি। বর্তমান সময়ে সব বিচার শেষে নেলসন ম্যান্ডেলাই সত্যিকারের সেই নায়ক হিসেবে আমাদের সামনে প্রতিভাত হন।

সদা হাস্যোজ্জ্বল, আত্মত্যাগের মহান প্রতীক নেলসন ম্যান্ডেলা এখন বিশ্বের লক্ষ-কোটি মানুষের কাছে পুণ্যবান (saint), পরিপূর্ণ এক মানুষের নাম।

খুব শক্ত মনের মানুষ নেলসন ম্যান্ডেলা। কিন্তু খুব সহজেই তিনি ব্যথিত হন। তাঁর মধ্যেও রয়েছে অনেক দ্বন্দ্ব-সংঘাত। ছোট্ট প্রজাপতিও হয়তো তাঁর দ্বারা কষ্ট পাবে না, কিন্তু তিনিই আবার আফ্রিকান ন্যাশনাল কংগ্রেসের সামরিক শাখার প্রথম প্রধান ছিলেন! একদিকে দক্ষিণ আফ্রিকার জনগণের সত্যিকারের নেতা, অন্যদিকে বিশ্বের সবচেয়ে সম্মানিত সেলিব্রেটি তিনি।

যিনি সবাইকে আনন্দ দিতে চান, আবার কাউকে ‘না’ বলতেও দ্বিধা করেন না। তিনি কৃতিত্ব নিতে চান না। কিন্তু জেনে যান, কখন তিনি সেটা পাবেন। তিনি রান্নাঘরের সকলের সঙ্গেও হাত মেলান, আবার নিজের দেহরক্ষীদেরও চিনতে পারেন না। বর্ণবাদবিরোধী কৃষ্ণাঙ্গ এই নেতা প্রেসিডেন্ট হলে অনেকের আপত্তি সত্ত্বেও নিজের প্রধান দেহরক্ষী নিযুক্ত করেন একজন শ্বেতাঙ্গকে।

এত বড় জীবনের ক্যানভাস যাঁর, সেই ম্যান্ডেলার রয়েছে সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম বিষয়ের প্রতিও তীক্ষ দৃষ্টি। তিনি যদি একটি টিস্যু হাতে তোলেন টিস্যুবক্স থেকে, অত্যন্ত সুচারুভাবে তা ভাঁজ করে ঢুকিয়ে নেন বুকপকেটে। জেলখানায় থাকা অবস্থায় যত চিঠি পেয়েছেন—পাওয়া আর উত্তর দেওয়ার তারিখসহ লিখে রেখেছেন ডায়েরিতে। উত্তরে কী লিখেছেন, তা-ও কপি করে রেখেছেন ডায়েরির পাতায়। কখনো কোনো অনুষ্ঠানে উপস্থিত হতে তিনি বিলম্ব করেননি।

সময়ানুবর্তিতার ব্যর্থতাকে তিনি মনে করেন চরিত্রের দুর্বলতা।

২৭ বছরের কারাজীবন থেকে বেরিয়ে তিনি আফ্রিকান ন্যাশনাল কংগ্রেসকে (এএনসি) নতুন করে সংগঠিত করেছেন। বহুবিধ সংকট-সন্ত্রাস-আক্রমণ-বিপদের খাদ পেরিয়ে ম্যান্ডেলা দেশের প্রথম সাধারণ নির্বচনের পর শ্বেতাঙ্গদের দল ও উগ্র অশ্বেতাঙ্গ গোষ্ঠীর সঙ্গে মিলে জাতীয় ঐকমত্যের গণতান্ত্রিক সরকার গঠন করেন। একই সঙ্গে দক্ষিণ আফ্রিকার প্রথম অশ্বেতাঙ্গ রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে শাসনভার গ্রহণ করেন। খুব অল্প সময়েই দক্ষিণ আফ্রিকাকে বিশ্বের বুকে একটি সম্মানজনক রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠা করে মাত্র এক মেয়াদ সম্পন্ন করেই প্রেসিডেন্টের পদ থেকে বিদায় নেন নেলসন ম্যান্ডেলা।

এই স্বল্প সময় রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করে দক্ষিণ আফ্রিকার চরম বর্ণবাদী শাসনব্যবস্থাকে তিনি গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় উন্নীত করেন, যাতে প্রতিফলন ঘটে তাঁর অসাধারণ প্রজ্ঞা আর রাজনৈতিক দূরদর্শিতার। তিনি ‘এক নতুন দক্ষিণ আফ্রিকা’ গড়ে তোলার পথ উন্মুক্ত করেছেন।

কলেজে অধ্যয়নকালেই তিনি সক্রিয় হয়েছিলেন বর্ণবাদবিরোধী রাজনীতির সঙ্গে। সেই থেকে জীবনের এক পর্ব থেকে আরেক পর্ব কেটেছে তাঁর জেল-জুলুম, সংগ্রাম আর সশস্ত্র আন্দোলনের প্রস্তুতির পেছনে। জীবনের এক বাঁকে ২৭ বছর তাঁকে কারা ভোগ করতে হয় রববেন দ্বীপের কারাগারসহ অন্যান্য কারাগারে।

নেলসন ম্যান্ডেলা বিশ্বের সর্বাধিক জনপ্রিয় রাষ্ট্রনেতা, যিনি নিজেকে জীবন্ত কিংবদন্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। একজন পিতা, একজন স্বামী, একজন দাদা, একজন নানা, একজন বন্ধু—এভাবে তিনি একজন সম্মানিত মানুষ বিশ্বের সর্বত্র।

১৯৯০ সালে জেল থেকে মুক্ত হয়ে আসার পর বিগত দুই দশকে অসংখ্য প্রকাশনা, ব্যাপক প্রচার আর বহুমুখী আলোচনায় এসেছেন তিনি। ১৯৯৪ সালে তাঁর আত্মজীবনী লং ওয়াক টু ফিডম প্রকাশের পর থেকে এখন পর্যন্ত এটি সারা বিশ্বে সর্বাধিক বিক্রীত বই হিসেবে সমাদৃত। এ ছাড়া তাঁর অফিস থেকে, তাঁর ফাউন্ডেশন থেকে শত শত বক্তৃতা, বিবৃতি আর বাণী দিয়েছেন তিনি।

আরও প্রকাশিত হয়েছে তাঁর বই কনভারসেশন উইথ মাইসেল্ফ্: নেলসন ম্যান্ডেলা ও নেলসন ম্যান্ডেলা: ইন বিজ ঔন ওয়ার্ডস।

এই বই দুটিতে সংকলিত ম্যান্ডেলার চিঠিপত্র, নোটবই, সাক্ষাত্কার ও ভাষণের খণ্ড খণ্ড অংশ সাজিয়ে তুলে ধরা হলো তাঁর সারা জীবনের অভিজ্ঞতা ও উপলব্ধির কথা।

 

নিজেকে নিয়ে ম্যান্ডেলা

আত্মজীবনীর অহমিকা

আমি কিছুতেই আমাদের প্রতিজ্ঞা থেকে বিচ্যুত হব না—কোনো পরিস্থিতিতেই আমি অন্যের জন্য অপ্রীতিকর কিছু বলব না...। তবে অসুবিধা একটা আছে, অধিকাংশ সফল মানুষই, কোনো না কোনো অহমিকাবোধের শিকারে পরিণত হয়। তাঁদের জীবনে এমন একটা পর্যায় আসে, যখন তাঁরা ভাবেন যে, তাঁদের অসাধারণ সফলতার কারণে জনগণের কাছে দাম্ভিক আত্মপ্রচারণা করা যেতেই পারে।

আত্মপ্রশংসার মনোভাবটি গোপন রাখতে ইংরেজি ভাষায় কী চমত্কার একটি শব্দ সৃষ্টি করা হয়েছে। তাঁরা একে ‘আত্মজীবনী’ বলতে ভালোবাসেন, যেখানে অনেক সময়ই অপরের অক্ষমতার বিপরীতে লেখক নিজেই নিজের প্রশংসনীয় সব সাফল্যের বিশদ বর্ণনা করতে পারেন। আমি আদৌ আমার প্রেক্ষাপট সম্পর্কে লিখতে বসব কি না, সে বিষয়ে আমার নিজেরই যথেষ্ট সন্দেহ আছে। আমার এমন কোনো অর্জন নেই, যা নিয়ে গৌরব করতে পারি। তা ছাড়া এ ক্ষেত্রে আমার দক্ষতাও নেই।

জীবনের প্রতিটি দিন আয়েশহীনভাবে কাটালেও আত্মজীবনী লেখার চেষ্টা করার মতো সাহস আমার নেই।

মাঝে মাঝে মনে হয়, আমার মধ্য দিয়ে সৃষ্টি যথার্থই একটি মাঝারি মানের মানুষকে বিশ্বের কাছে উপস্থাপন করছে। কোনো কিছুই আমাকে আত্মপ্রচারণায় প্রলুব্ধ করতে পারবে না। আত্মজীবনী লিখতে পারলেও হয়তো সেটির প্রকাশ আমার অস্থি মাটিতে মিশে যাওয়ার আগ পর্যন্তই বিলম্বিত হতো, আর তাতে হয়তো আমার প্রতিজ্ঞার বিপরীত কোনো ইঙ্গিতও থাকতে পারত।

মৃত ব্যক্তিদের কোনো উদ্বেগ থাকে না, যদি তাদের সম্পর্কে সব সত্য উদ্ঘাটিতও হয়ে যায়।

আজীবন নীরবতার ভেতর দিয়ে আমি যা রক্ষা করেছি, তা যদি ধ্বংসও হয়ে যায়, সে দায় পরবর্তী প্রজন্মের কাঁধেই বর্তাবে, আমাদের নয়। আমি তেমনই একজন মানুষ, বহু বিচিত্র বিষয়ে যার ভাসা ভাসা তথ্য জানা রয়েছে, কিন্তু দেশ ও জনগণের ইতিহাস-সম্পর্কিত যে বিষয়টিতে বিশেষজ্ঞ হওয়া উচিত ছিল, তাতেও আমার গভীর কোনো জ্ঞান নেই।

ফাতিমা মীরকে ১ ১ মার্চ ১৯৭১-এ লেখা চিঠি

 

বিয়ে থেকে পালিয়ে

গোষ্ঠীপতি হওয়ার জন্য আমাকে প্রস্তুত করা হচ্ছিল,...কিন্তু আপনি জানেন, একটি বাধ্যতামূলক বিয়ের উদ্যোগ থেকে রক্ষা পেতে আমাকে সেদিন পালিয়ে যেতে হয়েছিল...। ২ ঘটনাটি আমার জীবনের পথটাকেই পাল্টে দিয়েছিল। আপনি কি জানেন, সেদিন আমি যদি বাড়িতেই থাকতাম, তাহলে এত দিনে একজন সম্মানিত গোষ্ঠীপতি হয়ে যেতে পারতাম? আমার একটা বিরাট ভুঁড়ি থাকত, আর থাকত প্রচুর গরু-মহিষ আর ভেড়া।

রিচার্ড স্টেঙ্গেলের৩ সঙ্গে আলাপচারিতা

 

দেশি সাহিত্য

অধিকাংশ মানুষই তাদের অতীত জীবনের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে থাকে। ২৩ বছর বয়স পর্যন্ত আমি একটা পল্লিতে বেড়ে উঠেছি, তার পর আমি গ্রাম ছেড়ে জোহানেসবার্গে চলে আসি। তখন অবশ্য আমার অধিকাংশ সময়ই স্কুলে কাটত। শুধু জুন আর ডিসেম্বরের ছুটিতে বাড়ি যাওয়ার সুযোগ পেতাম। জুন মাসে মাত্র এক মাস আর ডিসেম্বরে প্রায় দুই মাসের ছুটি পেতাম।

তাই বছরের অধিকাংশ সময়ই স্কুলে থাকতে হতো। ২৩ বছর বয়সে ১৯৪১ সালে জোহানেসবার্গে চলে আসার পর থেকেই আমি পাশ্চাত্য জীবনধারা ও আনুষঙ্গিক নানা বিষয়ে অভ্যস্ত হয়ে উঠতে শুরু করি। কিন্তু গ্রামে থাকতেই আমার নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে উঠেছিল, আর তাই আপনি লক্ষ করে থাকবেন যে, আমাদের নিজস্ব দেশজ সংস্কৃতির প্রতি আমার গভীর শ্রদ্ধা আছে।

অবশ্য পাশ্চাত্য সংস্কৃতি এমন একটা বিষয়, যা ছাড়া আমরা বাঁচতেও পারি না। সুতরাং আমি এ দুটি ভিন্ন সংস্কৃতির আবহেই প্রভাবিত হয়েছি।

আমি যদি বলি যে, পাশ্চাত্য ধারা আমার অস্বাভাবিক মনে হয়, তাহলে অসততা হবে, আমাদের জনগোষ্ঠীর অনেকেই এর দ্বারা প্রভাবিত। আমি নিজেও ইংরেজিতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করি। কারণ, অনেকগুলো বছর এখানেই কেটেছে আমার, কাটাতে হয়েছে জেলখানাতেও। সত্যি বলতে কী, জোসা সাহিত্যের সঙ্গে আমি আমার সংযোগটাই হারিয়ে ফেলেছিলাম। অবসর গ্রহণের পর আমি আফ্রিকার সাহিত্যসহ বিভিন্ন সাহিত্য পাঠের সুযোগ পাব বলে আশা করছি।

যে বিষয়গুলোর জন্য আমি সবচেয়ে বেশি অপেক্ষা করে আছি, এটি তার একটি। জোসা ও সোথো সাহিত্য আমি পড়তে পারি, পড়তে পছন্দও করি। ৪ কিন্তু রাজনৈতিক ব্যস্ততার কারণে আমি কিছুই পড়তে পারিনি। এ জন্য আমার অনেক বেদনাবোধ রয়েছে।

রিচার্ড স্টেঙ্গেলের সঙ্গে আলাপচারিতা

 

গোষ্ঠীপতি ও গির্জা

আমার অভিভাবক গোষ্ঠীপতি চাইতেন না যে আমি কুনুতে যাই।

তাঁর বক্তব্য ছিল, সেখানে গেলে আমি কুসংসর্গে পড়ে স্কুল থেকে পালিয়ে যেতে পারি। তিনি আমাকে মাত্র কয়েক দিনের জন্য বাড়ি যাওয়ার অনুমতি দিতেন। অন্যান্য সময় তিনি আমার মাকেই আমার সঙ্গে সাক্ষাতের জন্য রাজকীয় নিবাসে নিয়ে আসার ব্যবস্থা করতেন। কিন্তু কুনুতে গিয়ে মা, বোনেরা ও পরিবারের অন্য সদস্যদের সঙ্গে মিলিত হওয়ার বিষয়টি আমাকে খুবই আকর্ষণ করত। বিশেষ করে আমার চাচাতো ভাই আলেকজান্ডার ম্যান্ডেলার সঙ্গে সাক্ষাতের সময়টা আমি দারুণ উপভোগ করতাম।

আমার জীবনের প্রথম দিককার দিনগুলোতে সে শিক্ষাবিষয়ক নানা প্রশ্নের আলোচনা করে আমাকে সব সময় উত্সাহিত ও অনুপ্রাণিত করত। সে আর আমার চেয়ে বয়সে অনেক বড় চাচাতো বোন ফাথিবে রানুগু সম্ভবত আমাদের গোষ্ঠীতে প্রথম শিক্ষকতা পেশায় যাওয়ার যোগ্যতা অর্জন করে। আমি বিশ্বাস করি, তাদের উপদেশ ও সতত ধৈর্যশীল প্ররোচনার ফলেই আমি শ্রেণীকক্ষের বাইরের সহজ জীবনের হাতছানি এড়াতে সফল হয়েছিলাম।

তখনকার দিনগুলোতে গোষ্ঠী-নেতৃত্ব ও গির্জাসংক্রান্ত ভাবনা আমাকে প্রবলভাবে প্রভাবিত করত। কারণ, আমি যে বীরদের কথা তখন শুনতাম, তাঁরা সবাই বিভিন্ন গোষ্ঠীর প্রধান ছিলেন।

কৃষ্ণাঙ্গ ও শ্বেতাঙ্গ—উভয়ের কাছ থেকে তাঁরা যে সম্মান পেতেন, সেটাই হয়তো আমার মনে ওই প্রতিষ্ঠান সম্পর্কে বাড়তি গুরুত্বের ধারণা তৈরি করেছিল। আমার মনে হতো গোষ্ঠীপতিকে ঘিরে শুধু সমাজজীবনটাই আবর্তিত হয় না, বরং তাঁরাই সমাজের মূল প্রভাবক, ক্ষমতাশীল ও মর্যাদাপূর্ণ ব্যক্তি হিসেবে মান্য।

একই রকম গুরুত্বপূর্ণ ছিল গির্জার অবস্থানও। যদিও বাইবেলের নির্দেশমতো বৈষয়িক ও মতবাদভিত্তিক দিক থেকে আমি সরাসরি গির্জার সঙ্গে বিশেষ যুক্ত হইনি, তবু ব্যক্তিগতভাবে রেভারেন্ড মাতিওলোর সঙ্গে আমার গভীর যোগাযোগ ছিল। সামাজিক বলয়ে জনপ্রিয়তায় তিনি শাসকের সমকক্ষ ছিলেন।

তা ছাড়া আধ্যাত্মিক দিক থেকেও তিনি গোষ্ঠীপতিদের কাছেও সম্মানিত ও নেতৃস্থানীয় ছিলেন। তা ছাড়া তিনিই ছিলেন গির্জার সীমাহীন ক্ষমতার অধিকারী। তার চেয়ে বড় কথা, আমাদের জনগোষ্ঠী যতটুকু অগ্রগতি করতে পেরেছে—যে স্কুলে আমি পড়াশোনা করেছি, যে শিক্ষকেরা আমাকে পড়িয়েছেন, সরকারি অফিসের কেরানি ও দোভাষীরা, কৃষি প্রদর্শনকারী ও পুলিশ বাহিনীর সদস্য—তাঁরা সবাই মিশনারি স্কুলে পড়াশোনা করেছিলেন।

পরে জনগণের প্রতিনিধি ও সরকারি কর্মকর্তা হিসেবে গোষ্ঠীপতিদের দ্বৈত ভূমিকা পর্যবেক্ষণ করে সমগ্র বিষয়টি আমি বাস্তবভিত্তিকভাবে পুনর্মূল্যায়ন করতে বাধ্য হই। এ ক্ষেত্রে কেবল আমার পারিবারিক প্রেক্ষাপটের অভিজ্ঞতা কিংবা যেসব ব্যতিক্রমধর্মী গোষ্ঠীপতি জনগণের সংগ্রামের সঙ্গে একাত্ম হয়েছিলেন, তাঁদের প্রসঙ্গেই নয়, আমি আরও ব্যাপকতর পরিসরেই ভাবনাচিন্তা শুরু করেছিলাম।

উচ্ছেদবিরোধী যুদ্ধে যে বিখ্যাত বীরদের সন্তানেরা আমাদের সংগ্রামের সাথি হয়েছিলেন এবং প্রথাগত ঐতিহ্যের কারণে প্রধানেরা যে সম্মান-মর্যাদা ভোগ করে থাকেন—সবকিছু মিলিয়েই নতুন করে ভাবতে হয়েছিল। যে সরকারকে কৃষ্ণাঙ্গদের শত্রু বলে গণ্য করা হয়, তাদের প্রতিনিধি হিসেবে গোষ্ঠীপতিরাও সমালোচনা ও বিরূপতার মুখে পড়েছিলেন। গোষ্ঠীপতি নামে পরিচিত প্রতিষ্ঠানটিকে সরকার করায়ত্ত করে ফেলায় সেটিও অত্যাচারের অন্যতম যন্ত্রে পরিণত হয়েছিল।

আমার অভিজ্ঞতাই মিশনারিদের ভূমিকা সম্পর্কে অধিকতর সুষম পুনর্মূল্যায়নের সূত্রসন্ধানে আমাকে উদ্বুদ্ধ করেছিল। আমি উপলব্ধি করতে পেরেছিলাম যে গির্জার পাদরিদের সঙ্গে শুধু ব্যক্তিগত সম্পর্কের ভিত্তিতে বিষয়টি যাচাই করা ঠিক নয়।

তবে এ কথাও আমি বুঝতে পেরেছিলাম যে গোষ্ঠীপতি ও গির্জা—জনগণের ওপর এ দুটি প্রতিষ্ঠানের প্রভাব অবমূল্যায়ন করাও ঠিক নয়। তাই এ দুটি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে কাজ করার ক্ষেত্রে আমি নিরন্তর সাবধানতার সঙ্গেই অগ্রসর হয়েছি।

কারাবন্দী অবস্থায় লেখা আত্মজীবনীর অংশ

 

ঐতিহ্য বনাম কুসংস্কার

আফ্রিকান ন্যাশনাল কংগ্রেসের (এএনসি) সঙ্গে যুক্ত থাকার ফলে আমি উপলব্ধি করতে পেরেছি যে একটি জাতীয় আন্দোলনের মধ্যে মৌলিক এবং অন্য রকমের বহু বিচিত্র ধরনের স্ববিরোধিতার উপাদান থাকতেই পারে। একই সংগঠনে বিভিন্ন শ্রেণী ও সামাজিক গোষ্ঠী সমবেত হওয়ায় গুরুত্বপূর্ণ সময়ে তাদের দীর্ঘস্থায়ী স্বার্থের সংঘাতের ফলে সংগঠনের মূল লক্ষ্যটি বিঘ্নিতও হতে পারে। দৃশ্যমান একটি ঐক্যবদ্ধ সংগঠনের ভেতরে বিদ্যমান বিভিন্ন রকমের সংঘাতের ফলে আগাগোড়া বিচ্ছিন্নতা ঘটে যেতে পারে।

বিভিন্ন শ্রেণী ও গোষ্ঠী একত্র হলে খতনার৫ মতো বিভিন্ন ধরনের আচরণগত কুসংস্কারের প্রভাবও প্রকট হয়ে উঠতে পারে। ফোর্ট হেয়ারে অবস্থানকালে আমার এক বন্ধু সেই প্রথাটি অনুসরণ করেনি জানামাত্রই আমার কি তীব্র প্রতিক্রিয়া ও বিরক্তি হয়েছিল, তা এখনো স্মরণ করতে পারি। তখন আমার বয়স মাত্র ২১ বছর। পরে এএনসির সাহচর্যে বিভিন্ন প্রগতিশীল আদর্শের সঙ্গে পরিচিত হয়েছিলাম, যা আমাকে যৌবনকালের বহু কুসংস্কার থেকে মুক্ত করতে সহায়তা করে, আমি সব মানুষকে সমমর্যাদায় গ্রহণ করতে শিখি।

আমি উপলব্ধি করেছিলাম যে, আমার নিজস্ব প্রথা সম্পর্কে যত গৌরববোধই থাকুক না কেন, তার ভিত্তিতে অপরের বিচার করতে পারি না।

কোনো একজন একটি নির্দিষ্ট সংস্কার মানে না বলেই তাকে অবজ্ঞা করার বিষয়টি প্রকৃতপক্ষেই উত্কট সংস্কারপ্রিয়তার লক্ষণ। আমি অবশ্যই আমার নিজস্ব সংস্কার ও ঐতিহ্যকে বিনম্র সম্মানের সঙ্গে পালন করি, কিন্তু সেটি ততক্ষণ পর্যন্ত, যতক্ষণ সেগুলো আমাদের সবাইকে ঐক্যবদ্ধ রাখতে পারে এবং জাতিগত নির্যাতনবিরোধী আমাদের সংগ্রামে কোনোভাবে অন্তরায় সৃষ্টি না করে। কিন্তু আমি কখনোই আমার পালনীয় কোনো প্রথা অন্যের ওপর চাপিয়ে দেব না এবং নিজেও এমন কোনো আচরণ করব না, যা আমার সংগ্রামের কোনো সাথিকে বিরক্ত করতে পারে। স্বাধীনতা এখন যথার্থই বিশেষভাবে মহার্ঘ্য হয়ে ওঠায় বিষয়টি অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে।

কারাবন্দী অবস্থায় লেখা আত্মজীবনীর অংশ

 

ফোর্ট হেয়ারে শিক্ষা গ্রহণ

‘তুমি এখন ফোর্ট হেয়ারে পড়তে এসেছ।

ভবিষ্যতে তোমাকেই তোমার জনগণের নেতৃত্ব গ্রহণ করতে হবে। ’৬ শিক্ষকেরা এমন কথা বলায় আমি গৌরববোধ করেছিলাম। হ্যাঁ, নিশ্চয়ই গৌরববোধ করেছিলাম। সারাক্ষণ আমাদের এ ধরনের কথাই শোনানো হতো। এ কথাও ঠিক যে, তখনকার দিনে একজন কৃষ্ণাঙ্গ মানুষের জন্য ডিগ্রি অর্জন করার বিষয়টি যথার্থই গ।

সোর্স: http://www.prothom-alo.com

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.