আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

‘মাদিবা’র জাদুকরী ছোঁয়া ক্রীড়াঙ্গনেও

জগতে কিছু কিছু মানুষের আবির্ভাব হয়, যাঁরা বিস্ময়-জাগানিয়া জাদুর ছোঁয়ায় বদলে দেন গোটা পৃথিবীটাকেই। যাঁদের প্রতিটি কথা মানুষের কানে পৌঁছায় অমোঘ বাণী হয়ে। বিভেদ-দ্বন্দ্ব দূর করার অভাবনীয় ক্ষমতা তাঁদের মজ্জাগত। এমনই এক জাদুকর নেলসন ম্যান্ডেলা! দক্ষিণ আফ্রিকায় আদর করে তাঁকে ডাকা হয় ‘মাদিবা’ বলে। গতকালই তিনি পাড়ি জমিয়েছেন অসীম শূন্যতায়।

ম্যান্ডেলার দর্শনে খেলাধুলাও ছিল অপরিহার্য এক অনুষঙ্গ। তিনি একে স্রেফ বিনোদন হিসেবে দেখেননি, দেখেছেন দ্বন্দ্ব-বিরোধ উপশমের উপায় হিসেবে।  

ম্যান্ডেলা একবার বলেছিলেন, ‘পৃথিবীকে বদলে দেওয়ার অসম্ভব ক্ষমতা রয়েছে খেলাধুলার...এটি অনুপ্রাণিত করে...মানুষকে একতাবদ্ধ করে। ’ চীন কিন্তু ২০০৮ সালের অলিম্পিকে ম্যান্ডেলার  এ দর্শনকে অনুপ্রেরণা মেনেই সাফল্য পেয়েছিল।

২৭ বছর কারাবাসের পর ১৯৯০ সালের ১১ ফেব্রুয়ারিতে মুক্তি পাওয়ার পর বিভক্ত জাতিকে এক করার উপায় খুঁজছিলেন তিনি।

১৯৯৪ সালের বিপুল ভোটে জয়ী হয়ে দক্ষিণ আফ্রিকার প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ প্রেসিডেন্ট হওয়ার পর সুযোগটি এসেও গেল।   ১৯৯৫ সালের রাগবি বিশ্বকাপের আয়োজক হলো দক্ষিণ আফ্রিকা। ম্যান্ডেলার কাছে খেলাধুলা হচ্ছে সেই জাদুর কাঠি, যার ছোঁয়ায় মুহূর্তেই দূর করা যায় বিভেদ, গোটা জাতিকে এক পতাকার নিচে আনা যায় অনায়াসে।

কিন্তু ওই সময়ে রাগবি ছিল শ্বেতাঙ্গদের প্রিয় খেলা। ফলে স্প্রিংবোকে (দক্ষিণ আফ্রিকা রাগবি দলের ডাকনাম) সাদাদের আধিপত্যই ছিল বেশি।

সাদারা পছন্দ করে বলে কালোরা রাগবিকে ‘ঘৃণা’ করত। সংগত কারণে সবুজ জার্সিটা ছিল তাদের কাছে বর্ণবাদী অপশাসনের প্রতীক।     

১৯৯৫ সালের রাগবি বিশ্বকাপের আগে ম্যান্ডেলা নিজেও রাগবি খুব একটা পছন্দ করতেন না বা ভালোভাবে বুঝতেন না। তবে অন্য খেলা খুবই পছন্দ করতেন। পঞ্চাশের দশকে তিনি ছিলেন অপেশাদার বক্সার।

প্রতিদিন ভোরে দুই ঘণ্টা দৌড়াতেন। ম্যান্ডেলা রাগবি ভালো না বুঝলেও এর রাজনৈতিক প্রভাব বেশ ভালো করেই অনুধাবন করতেন। সংগত কারণেই সেবার রাগবি বিশ্বকাপটাকে তিনি জাতীয় ঐক্য গঠনের বিরাট মওকা হিসেবে নিয়েছিলেন।

কিন্তু ওই সময় রাগবি দলে ১৫ সদস্যের স্কোয়াডের মধ্যে কৃষ্ণাঙ্গ ছিল মাত্র একজন। ম্যান্ডেলা ইচ্ছা করলে সাদাদের বাদ দিতে পারতেন।

কিন্তু তিনি তা করেননি। বরং সে সময়ে দেশের সেরা রাগবি খেলোয়াড়দেরই (অধিকাংশই শ্বেতাঙ্গ) বিশ্বকাপ স্কোয়াডে রাখলেন। কালোদের বোঝালেন, তাঁরা নতুন জাতীয় সংগীতে অনুপ্রাণিত হয়েই খেলবেন। নতুন জাতীয় সংগীত বলতে, বর্ণবাদের বিরুদ্ধে কালোদের আন্দোলন সংগীত! স্প্রিংবোকরা একে একে ফ্রান্স, অস্ট্রেলিয়া এবং অন্যদের ধরাশায়ী করে পৌঁছাল ফাইনালে। প্রতিপক্ষ—রাগবির অন্যতম পরাশক্তি নিউজিল্যান্ড।

আদতে নিউজিল্যান্ডকে পরাজিত করার মতো দল ছিল না দক্ষিণ আফ্রিকা। কিন্তু স্প্রিংবোকদের পেছনে যে একজন জাদুকর রয়েছেন। ফলে তাঁদের হারায় সাধ্য কার! খেলা শুরুর আগে মাঠে ঢুকলেন ম্যান্ডেলা। স্টেডিয়ামে তখন ৬৫ হাজার দর্শকে ঠাসা। যাদের আবার অধিকাংশ শ্বেতাঙ্গ।

সবার পরনে সবুজ জার্সি; বর্ণবাদের পুরনো ‘প্রতীক’। অবাক কাণ্ড, ম্যান্ডেলা মাঠে প্রবেশ করা মাত্র গ্যালারিতে গর্জন উঠল—‘নেলসন! নেলসন!’

টান টান উত্তেজনাকর ম্যাচ। চিন্তায় দক্ষিণ আফ্রিকা সমর্থকদের গায়ে জ্বর আসার উপক্রম। উত্তেজনা ম্যান্ডেলাকেও স্পর্শ করেছিল। পরে বলেছিলেন, ‘ওই সময়ে যতটা টেনশনে ছিলাম, বোধ হয় গোটা জীবনে এমনটা হয়নি।

’    

অল ব্ল্যাকসদের আনন্দে ছাই ঢেলে রাগবি বিশ্বকাপ বগলদাবা করল দক্ষিণ আফ্রিকা। আরাধ্য ট্রফিটা যখন ম্যান্ডেলা দক্ষিণ আফ্রিকা অধিনায়কের হাতে তুলে দিতে মাঠে গেলেন, তখন স্টেডিয়ামে আবারও সেই শব্দের ঢেউ —নেলসন! নেলসন! তবে এবার সবার চোখে জল। একেই বুঝি বলে আনন্দাশ্রু!  সেদিন সাদা-কালো বিভেদ ভুলে গোটা দক্ষিণ আফ্রিকা আনন্দে সারা রাত একই সুরে গেয়েছিল, নেচেছিল।

কেবল রাগবিই নয়, অন্য খেলা যেমন—১৯৯৬ সালে আফ্রিকান ন্যাশনস কাপ জয়ের ক্ষেত্রেও দক্ষিণ আফ্রিকার অনুপ্রেরণা ছিলেন ম্যান্ডেলা। দক্ষিণ আফ্রিকা ২০১০ ফুটবল বিশ্বকাপ আয়োজক হওয়ার পেছনেও তাঁর ভূমিকা অবিস্মরণীয়।

কি রাগবি, কি ফুটবল, কি ক্রিকেট—খেলাধুলাকে দেখেছেন বিনি সুতোর মালা হিসেবে। যে মালায় গোটা দক্ষিণ আফ্রিকাকে তিনি গেঁথেছিলেন নিপুণভাবে।

সোর্স: http://www.prothom-alo.com

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।