আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

প্রেসিডেন্ট কিম জং উনের দুই কোরিয়া একত্রিতকরণ প্রচেষ্টা সফল হবে কি?

সময়ের কাজ সময়ে করতে পছন্দ করি জাহেদুল ইসলাম ২০১৩ সালের শুরুতে নতুন বছরের শুভেচ্ছা ভাষণ প্রদানকালে উত্তর কোরিয়ার নেতা কিম জং উন কোরিয়া উপদ্বীপের শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য দুই কোরিয়ার একত্রিতকরণের প্রস্তাব দেন। এই সময় তিনি দুই কোরিয়ার সমন্বয়ে ‘ডেমোক্রেটিক পিপল’স রিপাবলিক অব কোরিয়া’ গঠনের প্রস্তাব করেন। কিন্তু প্রশ্ন হলো তাঁর এই ইচ্ছার বাস্তবায়ন সম্ভব হবে কি? আদৌ কি দুই কোরিয়ার একত্রিতকরণ সম্ভব হবে? সাম্প্রতি এই অঞ্চলের রাজনীতিতে অনেক পরিবর্তন এসেছে। গত ১২ডিসেম্বর উত্তর কোরিয়া সোহা মহাকাশ গবেষণা কেন্দ্র থেকে উনহা-৩ ক্ষেপনাস্ত্রের সফল উৎক্ষেপন করে। যার মাধ্যমে নিজেকে শক্তিশালী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার প্রচেষ্টাকে আরো একধাপ এগিয়ে নিলেন উত্তর কোরিয়ার নেতা কিম জং উন।

উত্তর কোরিয়ার এধরনের আচরণ দক্ষিণ কোরিয়া, জাপান, যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া সহ সহকলেই নেতিবাচক ভাবে দেখে, এমনকি সহযোগী রাষ্ট্র চীনও এই ক্ষেপনাস্ত্র উৎক্ষেপনকে স্বাভাবিক ভাবে নেয়নি। অপরদিকে দক্ষিণ কোরিয়ার রাজনীতিতেও এসেছে বড় পরিবর্তন। গত ১৯ডিসেম্বর দেশটিতে অনুষ্ঠিত হলো প্রেসিডেন্ট নির্বাচন। সেখানে প্রথম নারী প্রেসিডেন্ট হিসেবে নির্বাচিত হয়েছেন পার্ক জিউন-হাই। যিনি নিউ ফ্রন্টিয়ার পার্টির সদস্য হিসেবে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন।

তার বাবা ছিলেন উত্তর কোরিয়ার সাবেক সেনা শাসক যাকে অর্থনৈতিক মুক্তির রূপকার বলা হয়ে থাকে। পার্ক অনেকটা রক্ষনশীল এবং জাতীয় স্বার্থের বিষয়ে তিনি অনড়। তিনি দীর্ঘদিন রক্ষণশীল ন্যাশনাল পার্টির সভানেত্রী হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন। তার নির্বাচনি প্রচারনার অন্যতম একটি ইস্যু ছিল উত্তর কোরিয়াকে শক্ত হাতে দমন করা বা উত্তর কোরিয়ার যে কোন আগ্রাসনকে প্রতিহত করা। কোরিয়া উপদ্বীপের রাজনৈতিক চিত্র যখন এরূপ বিপরীতমুখী ঠিক তখনই কিম জং উন দুই কোরিয়ার একিত্রীকরণের প্রস্তাব দিলেন।

কিন্তু প্রশ্ন হলো তাই এই প্রস্তাবের পক্ষে উদ্দ্যোগ নেবে কে? দুই কোরিয়াকে কে আলোচনার টেবিলে নিয়ে আসবে? দেশদুটির মাঝে দীর্ঘ দিন থেকেই কোন কূটনৈতিক যোগাযোগ নেই বললেই চলে। গত ৫৪ বছরে কোরিয়া অঞ্চলের রাজনীতির ইতিহাসে মাত্র দু’বার এই দেশদুটির শীর্ষ নেতৃবৃন্দের মাঝে বৈঠক হয়। ২০০০ সালের ১২ জুন উত্তর কোরিয়ার প্রেসিডেন্ট কিম জং ইল এবং দক্ষিণ কোরিয়ার প্রেসিডেন্ট কিম দাই জং প্রথমবারের মতো একটি শীর্ষ বৈঠকে মিলিত হয়েছিলেন। দুই কোরিয়া একত্রিকরণ প্রচেষ্টার জন্য এসময় কিম দাই জংকে নোবেল শান্তি পুরষ্কারও দেওয়া হয়েছিল। এরপর ২০০৬ সালে পারমানবিক বিস্ফোরনের মাধ্যমে উত্তর কোরিয়া অষ্টম পারমানবিক শক্তি হিসেবে নিজেকে প্রকাশ করলে বিশ্ব শক্তিগুলো উদ্বীগ্ন হয়ে পড়ে এবং কোরিয়া উপদ্বীপের শান্তি প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়।

কিন্তু ২০০৭ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারী চীনের সহায়তায় উত্তর কোরিয়াকে একটি চুক্তিতে আবদ্ধ করা হয় যাতে ইয়ংবাইঅনস্থ পারমানবিক পরীক্ষা কেন্দ্রটি বন্ধ করা এবং ৬০ দিনের মধ্যে তা আন্তর্জাতিক মহলের কাছে পরিদর্শনের সুযোগ দিতে সম্মত হয় উত্তর কোরিয়া। এই চুক্তির ফলে দক্ষিণ কোরিয়ার সাবেক প্রেসিডেন্ট বোহ মু হিউম ২০০৭ সালের ২ অক্টেবর উত্তর কোরিয়া সফর করেন এবং কিম জং ইলের সাথে বৈঠক করেন, যেটা ছিল দুই দেশের রাষ্ট্রপ্রধানদের দ্বিতীয় শীর্ষ পর্যায়ের বৈঠক। তবে তাদের এ বৈঠক যথেষ্ট ফলপ্রুসু ছিল কি-না তা নিয়ে বিতর্ক আছে। তবে ফলপ্রুসু হউক বা নাই হোক তাদের এই প্রচেষ্টার বাইরে দুই কোরিয়া একত্রিকরণ বা শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য এর চেয়ে বড় উদ্দ্যোগ ৫৪ বছরের সংকটের ইতিহাসে আর তেমন লক্ষ্য করা যায় না। উল্লেখ্য যে, যুক্ত কোরিয়া এক সময় চীন ও জাপানের উপনিবেশ ছিল।

১৯০৪ সালের রুশ-জাপান যুদ্ধের পর কোরিয়ার নিয়ন্ত্রন চলে যায় জাপানের হাতে। কিন্তু দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জাপানের পরাজয়ের পর কোরিয়ায় অবস্থানরত জাপানী সেনাদেরকে তারানোর জন্য সেখানে মার্কিন এবং সোভিয়েত সেনাবাহিনী প্রবেশ করে। এসময় তারা কৌশলগত কারণে কোরিয়াকে দু’ভাগে ভাগ করে। যার এক অংশে থাকে সোভিয়েত বাহিনী, যাদের নেতৃত্বে সেখানে একটি সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হয়, আজকে যা উত্তর কোরিয়া নামে পরিচিত। অন্যদিকে থাকে মার্কিন বাহিনী যাদের নেতৃত্বে প্রতিষ্ঠিত হয় পুজিবাদী গণতান্ত্রীক রাষ্ট্র দক্ষিণ কোরিয়া।

১৯৪৬ সালে উত্তর কোরিয়ায় ‘কোরিয়ান ওয়ার্কাস পার্টি’ গঠিত হয় এবং ১৯৪৮ সালের ৯ সেপ্টেম্বর একটি স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। এরপর থেতে দুই কোরিয়ার মাঝে সংঘর্ষের সূচনা হয়। ১৯৫০ সালে উত্তর কোরিয়ার সেনাবাহিনী ৩৮তম সীমান্ত রেখা অতিক্রম করে দক্ষিণ কোরিয়ার সীমান্তে প্রবেশ করলে সেখানে যুদ্ধ শুরু যায়। জাতিসংঘ এ যুদ্ধে দক্ষিণ কোরিয়াকে সমর্থন করে মাঞ্চুরিয়া সীমান্তে সৈন্য পাঠালে চীন উত্তর কোরিয়াকে সমর্থন দেয় এবং ১৯৫০ সালের ২৬ নভেম্বর চীনা সৈন্যরা দক্ষিণ কোরিয়ায় প্রবেশ করে। ১৯৫১ সালে জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদ যুদ্ধ বিরতির প্রস্তাব দেয় এবং তা ১৯৫৩ সালের ২৭ জুলাই কার্যকর হয়।

১৯৫০-৫৩ সালের কোরিয়া যুদ্ধের রাজনৈতিক উত্তেজনা এখনো শেষ হয়নি, তারা অস্ত্র সংবরণ করেছে মাত্র। দক্ষিণ কোরিয়াকে সহযোগীতার জন্য এখনো প্রায় ৩০ হাজার মার্কিন সেনা মোতায়েন রয়েছে। অথচ উত্তর কোরিয়ার পক্ষে কোন চীনা সৈন্য নেই। তখন থেকে উত্তর ও দক্ষিন কোরিয়া দুটি আলাদা রাষ্ট্র হিসেবে নিজেদেরকে শাসন করে আসছে। সূতরাং দীর্ঘ দিনেও যে কাজটি করা সম্ভব হয়নি তা কি করে চলমান রাজনৈতিক উত্তেজনার মধ্য দিয়ে সম্ভব হবে তা ঠিক বলা যায় না।

তবে ইতিহাসে এধরণের একত্রিকরণের ঘটনা বিরল নয়। আমরা দেখেছি বর্তমান ইয়েমেন একসময় অটোমান স¤্রাজ্যের অধীনে ছিল। ১৮৩৯ সালে ব্রিটেন দক্ষিণ ইয়েমেন দখল করে নেয়। অপরদিকে উত্তর ইয়েমেনে অটোমান স¤্রাজ্যের কর্তৃত্বই বজায় থাকে। কিন্তু ১৯১৮ সালে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর অটোমান স¤্রাজ্যের পতন ঘটলে তার কর্তৃত্ব খর্ব হয় এবং দীর্ঘ ৪৪ বছর উত্তর ইয়েমেন ধর্মীয় নেতাদের দ্বারা শাসিত হয়।

১৯৬২ সালে ব্রিটিশ শাসনের অবসান এবং ইয়েমেন স্বাধীনতা লাভ করলে দুই ইয়েমেন একত্রিত হওয়ার চেষ্টা শুরু করে। অবশেষে ১৯৯০ সালের ২২ মে ‘রিপাবলিক অব ইয়েমেন’ নামে দুই কোরিয়া আনুষ্ঠানিকভাবে একত্রিত হয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জার্মানির পরাজয়ের পর যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন, রাশিয়া ও ফ্রান্সের সমান কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হয় জার্মানির উপর। এসময় জার্মানির এক অংশ সমাজতন্ত্রে দিকে ঝুকে পড়ে আর অন্য অংশ থাকে পুজিবাদের দিকে। ফলে সমাজতান্ত্রিক ব্লককে রক্ষার জন্য রাশিয়া ১৯৬১ সালে বার্লিন প্রাচীর নির্মান করে।

কিন্তু একসময় তাদেরও একত্রিকরণ সম্ভব হয়। ১৯৯০ সালের ৩ অক্টোবর দুই জার্মানি একত্রিত হয় এবং পূর্ব জার্মানি পশ্চিম জার্মানির সাথে মিশে যায়। সেখানে আজ আর সমাজতন্ত্র নেই, পুজিবাদের সাথে তারা এক হয়ে গেছে। চীন আর একটি গুরুত্বপূর্ন অঞ্চল যার সাথে আছে তাইওয়ান ও হংকং একত্রিত হওয়ার বিষয়টি। চীনে আজ কট্টর মার্কসবাদী সমাজতনন্ত্র নেই, দেং জিয়াও পিং সেখানে এক দেশ দুই নীতি চালু করে গেছেনÑ উদ্দেশ্য একটাই হংকং কে চীনের কর্তৃত্বের মধ্যে রাখা।

যার ফলে হংকং তার নিজস্ব পুজিবাদী ব্যবস্থা বজায় রেখেই আজ চীনের সাথে একত্রিত হয়েছে। একই নীতি গ্রহন করা হয়েছে তাইওয়ানের ক্ষেত্রেও। এখন প্রশ্ন হলো তবে কি দুই কোরিয়া এক হবে? দীর্ঘ দিনে যে কাজটি সফল হয়নি তা আজ সহজে বাস্তবায়ন সম্ভব হবে না। কারণ দুই কোরিয়া একত্রিত হওয়ার পর তাদের সমাজ ব্যবস্থা কি হবে তা নিয়ে একটা বড় সংকট থেকেই যাবে। পূর্ব জার্মানি পশ্চিম জার্মানির পুজিবাদের সাথে যেভাবে মিশে গেছে উত্তর কোরিয়া সেভাবে দক্ষিণ কোরিয়ার সাথে মিশতে পারবে না, তাতে বাধা হবে চীন।

কারণ চীন উত্তর কোরিয়ার অন্যতম একটি মিত্র রাষ্ট্র এবং যুক্তরাষ্ট্র বিরোধী জোট গঠনে একটি সহায়ক ভূমি। অপরদিকে দক্ষিণ কোরিয়ার পক্ষে সমাজতান্ত্রিক আদর্শের দিকে অগ্রসর হওয়াটা আকাশ কুসুম কল্পনা ছাড়া আর কিছুই নয়। কারণ একদিকে সেখানে রয়েছে কট্টরপন্থি শাসন অপরদিকে আছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রত্যক্ষ মদদ, যে কখনই চাবে না দক্ষিণ কোরিয়ায় সমাজতন্ত্রের প্রভাব পড়–ক। যার ফলে এই জটিল অবস্থা থেকে বেরিয়ে এসে দুই কোরিয়ার একত্রিকরণ সম্ভব হবে না। তবে অনেকে মনে করেন দুই কোরিয়ার ক্ষেত্রে চীন-হংকং এর নীতি অনুসরনীয় হতে পারে।

কিন্তু তারপরও সেখানে প্রশাসনিক বা সরকার কাঠামো নিয়ে বড় বিভেদ তৈরি হবে। রাষ্ট্র ক্ষমতা কার হাতে থাকবে বা কে দুই কোরিয়ার নেতৃত্ব দেবে এ নিয়ে একটি বড় সংকট থেকেই যাবে। তবে আশার কথা হলো উত্তর কোরিয়ার নেতা কিম জং উন যেহেতু একত্রিকরণ প্রস্তাব দিয়েছে সেহেতু দক্ষিণ কোরিয়া যদি এগিয়ে আসে তবে ইতিবাচক ফল আশা করা যেতে পারে। এক্ষেত্রে সহায়ক হতে পারে চীন ও যুক্তরাষ্ট্রকে। কারণ চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাবই মূলত উত্তর কোরিয়া ও দক্ষিণ কোরিয়ার রাজনীতি ও পররাষ্ট্রনীতি নিয়ন্ত্রন করে।

তবে তাদের সহযোগীতা ছাড়া যেমন দুই কোরিয়ার একত্রিতকরণ সম্ভব নয়, তেমনি তাদের সহযোগীতাও দুই কোরিয়ার একত্রিতকরণ প্রচেষ্টাকে কতটুকু সফল করতে পারে তাও সুনিশ্চিত নয়। তাই কিম জং উনের স্বপ্ন অনেকটা অনিশ্চয়তার মধ্যেই থেকে যাবে বলে মনে হয়। জাহেদুল ইসলাম শিক্ষার্থী, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.