আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

সাতক্ষীরা বিচ্ছিন্ন, মানুষ জিম্মি

বাইরের সঙ্গে যোগাযোগ পুরোপুরি বিপর্যস্ত। র‌্যাব-পুলিশ-বিজিবিও স্বাভাবিকভাবে চলতে পারছে না। শহরবাসী চার বর্গকিলোমিটার এলাকার মধ্যে অবরুদ্ধ। দুই সপ্তাহে নিহত হয়েছেন ১১ জন। সাতজনই আওয়ামী লীগ ও এর সহযোগী সংগঠনের নেতা।

এ চিত্র সাতক্ষীরা জেলা শহরের।
দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলীয় এ জেলায় ঢোকা বা বেরোনোর কোনো উপায় নেই। সব রাস্তা কাটা। অনেক জায়গায় গাছ কেটে বা গাছের গুঁড়ি ফেলে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করা হয়েছে। শহরের সঙ্গে ছয় উপজেলার যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন।

সাংবাদিক, পুলিশ, প্রশাসন এবং বিভিন্ন স্তরের মানুষের সঙ্গে কথা বললে তাঁরা প্রশ্ন তোলেন, সাতক্ষীরা কি তাহলে বাংলাদেশের বিচ্ছিন্ন এক জেলা? সরকারের কি কোনো নিয়ন্ত্রণই নেই? পুলিশ, প্রশাসন—সবাই কি ব্যর্থ?
১৮-দলীয় জোটের হরতাল-অবরোধ কর্মসূচির কারণে টানা দুই সপ্তাহ ধরে শহরবাসী অবরুদ্ধ। এর আগে ২৮ ফেব্রুয়ারি সাঈদীর ফাঁসির রায়কে কেন্দ্র করে সেখানে ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ চালায় জামায়াত-শিবির। এর পর থেকেই এ জেলায় অস্থিতিশীল পরিস্থিতি বিরাজ করছে। চরম আতঙ্কিত শহরবাসী এ অবস্থা থেকে দ্রুত মুক্তি চায়।
সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সাতক্ষীরা জেলা সভাপতি সুভাষ সরকার মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমার মনে হচ্ছে, একাত্তরের পরিস্থিতিও এতটা ভয়াবহ ছিল না।

শহরে যখন-তখন জামায়াত-শিবির মিছিল করছে। শহরবাসী আতঙ্ক নিয়ে চলাফেরা করছে। গ্রামের অবস্থা আরও ভয়াবহ। গ্রামের লোক শহরে আসতে পারছে না। শহরের লোক গ্রামে যেতে পারছে না।

রাস্তাগুলো কেটে ফেলা হয়েছে। চারপাশে অবরোধ। ’

সাংবাদিকদের জন্যও এখন দেশের সবচেয়ে বিপজ্জনক জেলা সাতক্ষীরা। একজন সাংবাদিককে হত্যা করা ছাড়াও অবরোধ-হরতালের এই সময়ে হামলার শিকার হয়েছেন ১২ জন সাংবাদিক ও দুজন সংবাদপত্রসেবী। পুলিশ ও স্থানীয় প্রশাসনের লোকজনদের সঙ্গে ঢাকা থেকে যোগাযোগ করা হলে তাঁরা তাঁদের অসহায়ত্বের কথা জানান।

তাঁরা বলেন, পরিস্থিতি এতই ভয়াবহ যে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের বেশির ভাগ নেতা-কর্মী এলাকা ছেড়ে পালিয়েছেন। শুধু আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পক্ষে এ পরিস্থিতি সামাল দেওয়াও কঠিন।

স্থানীয় লোকজন জানিয়েছেন, ২৮ ফেব্রুয়ারির পর থেকে সদর উপজেলার আগরদাড়ি, বাঁশদাহ, বৈকারি, ঘোনা, কুশখালী ও শিবপুর ইউনিয়নে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার লোকজনও স্বাভাবিকভাবে চলাফেরা করতে পারছেন না। একই অবস্থা আশাশুনি উপজেলার প্রতাপনগর ইউনিয়ন; কলারোয়ার জয়নগর ইউনিয়নের মানিকনগর, বসন্তপুর, গাজনা, সরসকাটি, ক্ষেত্রপাড়া ও জয়নগর; যুগীখালী ইউনিয়নের ওফাপুর, কামারালি ও বামনখালী এলাকার। কলারোয়ার মানিকনগর এলাকার খোর্দ্দবাটরা-বস্তপুর সড়কের বড়তলা এলাকায় ও আবদুর রউফের বাড়ির পাশের সড়কটি গত মার্চ থেকেই কাটা।

ওফাপুর প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পাশে গাজনা এলাকায় বাঁশকল দিয়ে রাখা হয়েছে দীর্ঘদিন ধরে। এসব এলাকার বাসিন্দাদের রাত আটটার আগেই গ্রামে ঢোকার নির্দেশ জারি করেছে জামায়াত-শিবির।

পরিস্থিতি সম্পর্কে জানতে চাইলে সাতক্ষীরার জেলা প্রশাসক আনোয়ার হোসেন হাওলাদার প্রথম আলোকে বলেন, ‘আগে রাজনীতি ছিল শহরকেন্দ্রিক। এখন রাজনীতি হচ্ছে গ্রামের ভেতরে। নিরপরাধ লোক, হয়তো কোনো দল করেন, তাঁকেও কুপিয়ে মারা হচ্ছে।

তবে আগের তুলনায় পরিস্থিতি স্বাভাবিক রয়েছে।

একের পর এক খুন: গত ২১ নভেম্বর হত্যা করা হয় দেবহাটা উপজেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক ও দৈনিক জন্মভূমির উপজেলা প্রতিনিধি আবু রায়হানকে। দেবহাটা উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মুজিবর রহমানের দাবি, জামায়াত-শিবিরের কর্মীরা পরিকল্পিতভাবে রায়হানকে হত্যা করেছেন।

২৬ নভেম্বর অবরোধের সময় কলারোয়ার দেয়াড়া ইউনিয়ন যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক মাহমুদ হাসানকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়। এর সাড়ে পাঁচ ঘণ্টা পর বিকেলে একই ইউনিয়নের স্বেচ্ছাসেবক লীগের সাধারণ সম্পাদক রবিউল ইসলামকে কুপিয়ে হত্যা করা হয়।

ওই দিন গভীর রাতে পুলিশ-র‌্যাব ও বিজিবির সদস্যরা সাতক্ষীরা সদরের জামায়াত-অধ্যুষিত আগরদাড়ি গ্রামে অভিযান চালাতে গেলে আক্রমণের শিকার হন। এ সময় সংঘর্ষ বেধে গেলে শামছুর রহমান নামের একজন নিহত হন। জামায়াত তাঁকে নিজেদের কর্মী দাবি করে আগরদাড়ি বাজারে আওয়ামী লীগ-সমর্থকদের দোকানপাট লুটপাট করে। এরপর তারা আওয়ামী লীগের তাপস আচার্য ও গোপাল ঘোষালের বাড়ি ভাঙচুর করে আগুন ধরিয়ে দেয়।

৩ ডিসেম্বর অবরোধের সময় পুলিশ-বিজিবির সঙ্গে জামায়াতের ব্যাপক সংঘর্ষে হোসেন আলী ও আরিজুল ইসলাম নামের দুই কিশোর নিহত হয়।

বিকেলে মোটরসাইকেলে করে সদর উপজেলার মাহমুদপুরে যাচ্ছিলেন যুবলীগের কর্মী গিয়াসউদ্দিন। পথে তালবাড়িয়া এলাকায় তাঁকে লাঠি ও রড দিয়ে পিটিয়ে হত্যা করা হয়।

একই দিন রাতে সাতক্ষীরার কালীগঞ্জে ঘুমিয়ে থাকা অবস্থায় মুক্তিযোদ্ধা আলাউদ্দিন খোকনকে (৬৫) কুপিয়ে দেহটি পাশের ডোবায় ফেলে রাখা হয়। অবরোধের কারণে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন থাকায় তাঁকে সদর হাসপাতালে পর্যন্ত নেওয়া যায়নি। এ অবস্থায় পরদিন সকালে মারা যান তিনি।

৫ ডিসেম্বর গুলিতে নিহত হন স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতা সিরাজুল ইসলাম (৫৩)। সর্বশেষ গত শনিবার হত্যা করা হয় সাতক্ষীরা সদর উপজেলা আওয়ামী লীগের কর্মী এজাহার আলী মোড়লকে।

সাতক্ষীরা জেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আবু আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘অবরোধের আগে-পরে সাতক্ষীরায় একের পর এক আওয়ামী লীগের নেতা খুন হলেও পুলিশ আসামিদের গ্রেপ্তার করতে পারেনি। উল্টো মার খেয়ে ফিরে আসছে পুলিশ। তিনি বলেন, মূল আসামি জামায়াতের নেতারা গ্রেপ্তার হলেই তৃণমূল নেতা-কর্মীরা সাহস পেতেন না।

কিন্তু এখন অবস্থা দেখে মনে হচ্ছে, সাতক্ষীরা যেন আসলেই বাংলাদেশ থেকে বিচ্ছিন্ন। এখানকার কিছু এলাকা যেন তারাই চালাচ্ছে।

জেলা জামায়াতের আমির ও সাবেক সাংসদ আবদুল খালেকের মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি সব শুনলেও কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি।

তবে জেলা জামায়াতের প্রচার সম্পাদক আজিজুর রহমান বলেন, সরকারি দলের নেতা-কর্মীরা হয়তো পারিবারিক বা বিভিন্ন দ্বন্দ্বের কারণে খুন হচ্ছেন। তাঁর দাবি, তাঁদের নেতা-কর্মীদের সঙ্গে এর কোনো সংশ্লিষ্টতা নেই।

অবরোধ করে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে রাখা সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘কয়েক বছরে এখানে অনেক মামলা হয়েছে। আমিও কয়েক দিন আগে জেল থেকে বের হয়েছি। আমি দেখেছি, জেলখানায় আমাদের নেতা-কর্মী ৩০-৪০ ভাগ, অন্যরা সবাই সাধারণ মানুষ। এখন সেই সাধারণ মানুষই হয়তো অবরোধ করছে। তারা সরকারি দলের বিরুদ্ধে রাস্তায় নেমেছে, প্রতিরোধ করছে।

জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক আবদুল আলিম প্রথম আলোকে বলেন, একাত্তরে মানুষ যেমন শত্রু ঘায়েল করেছে, এখন সাতক্ষীরাতেও যেন তা-ই হচ্ছে। তবে বিএনপি কোনো ন্যক্কারজনক ঘটনা ঘটায়নি।

বর্তমান পরিস্থিতি সামাল দিতে পুলিশও কঠোর হওয়ার সাহস পাচ্ছে না। জেলা পুলিশ সুপার মোল্লা জাহাঙ্গীর হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, সাতক্ষীরায় আওয়ামী লীগ সাংগঠিনকভাবে খুব দুর্বল। সাধারণ মানুষের মধ্যেও সচেতনতা নেই।

সব লোকই যেন একটি বিশেষ পক্ষের। ফলে পুলিশের পক্ষে কাজ করা কঠিন।

 

সোর্স: http://www.prothom-alo.com

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.