আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

আমার আবেগ, বিক্ষিপ্ত কিছু চিন্তা অথবা গুরু জেমসকে নিয়ে আমার কিছু কথা

মানুষ আমি আমার কেনো. . . পাখির মত মন

“দুঃখকে বলে দিয়েছি,সে তোমাকে দুঃখ দেবেনা, বড় বিষন্ন তোমার দুঃখিনি মা। তাকে দাও সেই পয়গাম, বল ঈশ্বর আছেন, তিনি সবার মাঝেই থাকেন. . . ” সালটা এখোনো আমার স্পষ্ট মনে আছে ১৯৯৭ সাল, বাংলাদেশ আই.সি.সি টুর্নামেন্টের ফাইনালে উঠেছে। তবে এর আগেই বিশ্বকাপে নিজেদের আসন পাকা করে ফেলেছে ফাইনালে উঠেই। আমি তখন ক্লাস সেভেনে পরি। খেলার কিছু না বুঝলেও, এলাকার বড় ভাইদের সাথে বসে খেলা নিয়ে আলোচনা আর রেডিওতে কান পেতে বাংলাদেশের খেলার স্কোর শোনা এই নিয়ে বেশ কেটে যাচ্ছিলো দিন।

শুধু জানতাম বাংলাদেশ যদি এই টুর্নামেন্টে ফাইনাল পর্যন্ত যেতে পারে তবে বাংলাদেশ বিশ্বকাপে খেলতে পারবে! আবার এও শুনতাম না শুধু ফাইনালে উঠলেই হবেনা জিততে হবে। তখনকার দিনেতো ইন্টারনেট এতো সহজলভ্য ছিলোনা যে মুহুর্তের মধ্যেই ক্লিক করে জেনে নেয়া যাবে আসলে কি ঘটতে চলেছে, কি বা সেই হিসাব নিকাশ। তাই ভরসা ছিলো সেই বিকাল বেলা ক্রিকেট খেলার পর আড্ডা আর পত্রিকার পাতা। আর এরপর থেকে বাংলাদেশের প্রতিটা ম্যাচ জয় আর আমাদের একটু আধটু উদযাপন চলছিলো। এই উদযাপন বাধভাঙায় রুপান্তরিত হলো যখন বাংলাদেশ একে একে সবাইকে টপকে সেমিফাইনালে উঠে গেলো।

আর যেদিন বাংলাদেশ ফাইনালে জিতলো তখনতো পুরো দেশ ফেটে পড়লো আবেগে আনন্দে। সেদিনের সেই ছোট ছেলেটিও আনন্দে সামিল হয়েছিলো। মনে হচ্ছিলো বাংলাদেশ যেনো বিশ্বজয় করে ফেলেছে। সেই আবেগ আর উৎসবের রেশ চলেছিলো প্রায় একমাস যাবৎ যতটুকু আমার মনে আছে সেখান থেকেই বলছি। যাক কথা সেটা না, যেদিন বাংলাদেশ জিতলো, সেদিন অনেকগুলো বিক্ষিপ্ত ঘটনার মধ্যে আজও মনে আছে কে বা কারা একটি গান বাজাচ্ছিলো।

“চেয়ে দেখ উঠেছে নতুন সুর্য্য /পথে পথে রাজপথে চেয়ে দেখ রঙের খেলা/ ঘরে বসে থেকে লাভ কি বলো? /এসো চুল খুলে পথে নামি /এসো উল্লাস করি . . .” মনে আছে সদ্য কৈশোরে পা রাখা এই আমি সেই বাধভাঙা আনন্দের মাঝেও একটু থমকে দাড়াই। অবাক হয়ে ভাবি, গানের কথাগুলো কেমন যেনো অদ্ভুত। কেমন যেনো একটা আপন আপন ভাব আছে আর গায়কের কথা নাই বললাম, হেড়ে গলায় গেয়ে গেলেও শুনতে তেমন একটা খারাপ লাগছে না। মোটকথা বেশ অন্য রকম একটা অনুভুতি হচ্ছিলো, সেই শুরু. . . এর কিছুদিন বাদে আমি আমাদের এলাকার রাস্তায় ঘুরে বেড়াচ্ছি, আমার বাসাটা নিউমার্কেট এলাকা সংলগ্ন, কাজেই আমার এলাকায় ঘুরে বেড়ানো বলতে মার্কেটের ফুটপাত ধরে হাটাহাটিই বুঝাচ্ছি। আবার সেই গান ভেসে আসলো আমার পাশেরই একটি ক্যাসেটের দোকান থেকে।

দোকানটি আমার পরিচিত, আর সেই দোকানটিতে আড্ডা দিতো আমার পরিচিত বড় ভাইদের একটি গ্রুপ। কাজেই আমার সেই দোকানে যাওয়াটা কোনো বাধা ছিলোনা, এমনিই গল্প করতে করতে ঢুকে গেলাম সেই দোকানে। একফাকে একজন বড়ভাইকে জিজ্ঞেস করলাম, ভাই এটা কার গান? আমার সেই বড় ভাই বললো জেমস। ও আচ্ছা বলে বেড়িয়ে আসলাম। এরপর থেকে মাথায় একটাই চিন্তা কিভাবে ৩৫ টাকা জোগাড় করা যায়? কারণ এই শিল্পির গান বাসায় বসে শুনতে হবে।

এরপর দিন যায় আমার আর ৩৫ টাকা যোগাড় করা হয়ে ওঠেনা। কারণ ৩৫ টাকা সেই সময় আমার জন্য অনেক টাকা। তাই ওই গান শোনার জন্য প্রায়ই ওই দোকানে যেতে লাগলাম। যেহেতু ওই গানটা সেই সময় বেশ হিট ছিলো তাই কিছুক্ষণ পর পর বাজানো হতো আর আমিও শুনতে পারতাম। কয়েকদিনের মধ্যেই এক বড়ভাই ব্যাপারটা খেয়াল করলেন (যদিও সে আমার চেয়ে খুব বড় ছিলোনা, সে মাত্র কলেজে ভর্তি হয়েছে); আমাকে একদিন বাসার সামনে ধরলেন।

বললেন ওই তোর ব্যাপারটা কি বলতো? আমি অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম কি ব্যাপার ভাই? উনি বললেন যে ইদানিং আমি কেনো ক্যাসেটের দোকানে বার বার যাই? এবং আমার মতোন বয়সে ওখানে বসে তাদের সাথে আড্ডা দেয়াটা শোভনিয় নয়, বাসার কেউ দেখলে কি বলবে.... ইত্যাদি। লজ্জা ভেঙে বলেই ফেলি ভাই যাই তো গান শুনতে, এরপর তার প্রশ্ন তোর বাসায় ক্যাসেট প্লেয়ার নাই? আছে তো, কিন্তু ওই ক্যাসেটটা নাই। কোনটা? এরপর তাকে স্ববিস্তারে বর্ণনা এবং শেষমেষ তার কাছ থেকে আশ্বাস পাওয়া আচ্ছা আয় আমার বাসায় আছে নিয়ে যা। কিন্তু খবরদার তোকে যেনো ওই দোকারে না দেখি। গেলে ক্যাসেট কিনতে যাবি হুদাহুদি যাবিনা বুচ্ছস? আমি মাথা নেড়ে সায় দিলাম।

এতটুকু পড়ে নিশ্চয়ই মনে হচ্ছে আহা বড় ভাইটা না জানি কতো ভালো, একটা ছেলেকে সদুপদেশ দিচ্ছে যে দোকানে আড্ডা দেয়া ভালো না. . . তাই না? আসলে ঘটনা সেটা না, ঘটনা হলো আমি বা আমরা ছোটভাইরা সে দোকানে যাওয়ার কারণে তাদের আড্ডার টপিক খেলাধুলাতেই আটকে থাকে। এছাড়াও অনেক বিষয় তারা আলোচনা করতে পারেনা ছোটরা থাকার কারনে। যাক তার কারণ যেটাই হোক আমার ক্যাসেটতো পাওয়া হলো? এখন আর বাসায় বসে গান শোনার বাধা নেই. . . কিন্তু বাসায় ক্যাসেট নিয়ে আসার পর দুই একবার শোনার পর আর ভালো লাগেনা। কি সমস্যা! এতোদিন তো শুনতে ভালোই লাগতো, হঠাৎ কি হলো? বুঝতে পারছিনা। কিছুদিন পর বিকেল বেলা খেলা শেষে আড্ডা দিচ্ছি তো কথায় কথায় বড় ভাইরা গান বিষয়ক আলোচনা শুরু করলেন, এবং সেখানে অবধারিত ভাবেই জেমস ও চলে এলো; তো আমি আমার জ্ঞান জাহির করার জন্যই হোক অথবা জেমসের গানের প্রতি আমার খারাপ লাগাই হোক তা থেকে বলেই ফেললাম, ধুর জেমসের গান আবার গান নাকি কি সব আবোল তাবোল কথা।

আর এ কিরকম ক্যাসেটের কাভার? একটা মানুষ চাদর জড়ায় দুই হাত তুলে দাড়িয়ে এবং ফলশ্রুতিতে মনে আছে তাদের চোখের অবাক চাহনী। শেষে তো রেগে গিয়ে এক বড়ভাই চোখ মুখ পাকিয়ে মারতে এলেন ☺। সেদিন কি হয়েছিলো এখন আর মনে নেই . . . কিন্তু সেদিনের পর একটু জেদ চেপে গিয়েছিলো, কি এমন গান ধুর! এরপর একটু বিরতি, প্রায় মাসখানেক পর আমার মনে আছে, এরমধ্যে কোনো এক রাতে গান শুনতে শুনতে ঘুমানোর জন্য আবার হাতে এল সেই ক্যাসেট। বড় ভাইকে ফেরত না দেয়া ক্যাসেটটি আবার বের করলাম আর কি এক আশ্চর্য্য মোহিত সেই গানের কথা। প্রলয়ের শিঙায় ফু দিয়ে ওঠে ইস্রাফিলে/ চারিদিক থেকে কলবে কলবে রোল পড়ে যায়/ তলে তলে তল্লাটে তল্লাটে জিকির ওঠে।

বাহ্ খারাপ না তো ভালোইতো লাগছে। এরপর ভালোবাসার বাধনে জড়িয়ে যাওয়া জেমস এর গানের সাথে। দিন কেটে যেতে লাগলো দিনের নিয়মেই, এরমধ্যে আমিও বড় হতে হতে ক্লাস নাইনে উঠেছি। এরমধ্যে আমার গানের গুরু জেমস। কেউ যদি তাকে নিয়ে উল্টাপাল্টা কথা বলে হয় তার সাথে বিতর্ক করি অথবা সমবয়সি বা ছোট হলে তেড়ে মারতে যাই।

এর সাথে সাথে তার স্টাইল ফলো করাও চলতে থাকে, যেই আমি একদিন তার চাদর পড়া নিয়ে হাসাহাসি করতাম,সেই আমিই এখন পাঞ্জাবির সাথে চাদর পড়ে ঘুরাঘুরি করি। আর কি সেই গানের অবিস্মরণীয় কথা, যতই শুনি মুগ্ধ হই। এরমধ্যে কে যেনো বললো তার গানের আসল মজা কনসার্টে। সেখানে না গেলে নাকি জীবনের ষোলো আনাই মিছে। এখন আমাকে তো কনসার্টে যেতেই হবে।

কিন্তু বাসা থেকেতো আমাকে একা যেতে দিবেনা। এবং ইতিমধ্যেই বাসা থেকে আমাকে বলা এসব কিম্ভুত পোষাক আশাকে আগ্রহী হওয়ার জন্য তিরস্কার করা হচ্ছে। এখানে আবার আমার ত্রাণকর্তা হিসেবে আবির্ভাব হলেন সেই বড়ভাই যিনি আমাকে ক্যাসেট দিয়েছিলেন, তিনি বললেন আমি চাইলে তার সাথে কনসার্টে যেতে পারি, কিন্তু তারা কনসার্টে গিয়ে কি করেন সেটা বাসায় বলা যাবেনা। আমাকে কনসার্টে নিয়ে যাবেন আমি তো এতেই খুশি, যাই হোক আম্মাকে রাজি করিয়ে টাকা নিয়ে কনসার্টের টিকেট কিনে আনলাম, কিন্তু টিকেটে লেখা ১৮ বছরের কম বয়স্কদেও জন্য নহে। এবার টিকেট দেখে আমার বাবা বললেন এখানে তোমার যাওয়া হবেনা।

কারণ এটা তোমার জন্য নয়, আমি পড়লাম মহা ফাঁপরে। সেখান থেকেও আমাকে উদ্ধার করলেন সেই ভাই। তিনি আমার বাবাকে বোঝাতে সক্ষম হলেন এই কনসার্টেও স্পন্সর যেহেতু একটি সিগারেট কোম্পানি তাই এই নিষেধাজ্ঞা। যাই হোক সেটি ছিলো আমার প্রথম কনসার্ট এবং যা ছিলো আর্মি স্টেডিয়ামে। এক অভূতপুর্ব অভিজ্ঞতা, কনসার্টটিতে ফিলিংস (জেমসের ব্যান্ডের প্রাক্তন নাম, এখন যার নাম নগর বাউল) ছাড়াও ছিলো, সোলস, ফিডব্যাক, এল. আর. বি এবং আরো কিছু ব্যান্ড।

এবং এর স্পন্সর ছিলো বেনসন এন্ড হেজেস। এবং তখনকার আমলে কনসার্ট খুব বেশী একটা হতো না, তাই সেই সময়ের তরুণরা অপেক্ষা করতেন এর জন্য। যাই হোক আমার কনসার্ট অভিজ্ঞতায় ফিরে আসি, সবাইতো গেয়ে চলে যায়, জেমসতো আসে না। আমিও আমার বড়ভাই আর তার বন্ধুদের জ্বালিয়ে মারছি কখন আসবে জেমস? মনে আছে শীতের দিন ছিলো তাই ঠান্ডাও বাড়ছিলো সন্ধ্যা হবার সাথে সাথে। এরপর সন্ধ্যার বিরতীর পরে হঠাৎ মঞ্চথেকে ভেসে এল সেই বাণী, “দেখা হবে পথে বিপথে, কিংবা সুবহে সাদিকে।

পুরো আর্মি স্টেডিয়াম যেনো ফেটে পড়লো সেই ডাকে। এরপরের দুই ঘন্টা কেটে গেলো সুরের মূর্চ্ছনায় আর তার বিভিন্ন কথার মাঝে। আমি বিমোহিত, মুগ্ধ এবং বাকরুদ্ধ। পুরো জনসমুদ্র যেনো শাসন করছেন তার গীটারের তার আর কথা দিয়ে। এরমধ্যে কে বা কারা যেনো এককোণায় আগুন ধরালো, এবং আর্মিরা তাদের নিরস্ত্র করতে ব্যার্থ,জেমস বলে উঠলেন এই তোমরা আগুন নেভাও, আগুন জ্বালাবো গানে, মাঠে নয়।

তার এই কথার সাথে সাথে সবাই যেনো মন্ত্রমুগ্ধেও মতোন চুপ করে গেলো। আগুন নিভে গেলো আর আবার গান শুরু হলো। শুধু সেই দিন না, তার এই প্রভাব বিস্তার করার ক্ষমতার প্রমান পেয়েছি আরো বহুবার। অনেক কনসার্টে অনেকভাবে। আধুনিক তরুণদের মস্তিস্কের নিওরোন সেলে যেভাবে প্রভাব বিস্তার করেছেন তিনি প্রায় এক যুগেরও অধিক সময় ধরে এখনকার শিল্পীদেও সেই ক্ষমতা কোথায়? এখনও আমার মনে পড়ে সেই দিনগুলি, এখনো আমি শুনি তার গান।

কত মনখারাপ কে যে ভালো করে দিয়েছে আবার ভুলিয়ে দিয়েছে দুঃখ অবিরাম। তার ব্যাক্তিগত জীবনে তিনি হয়তো কারো জন্য অনুস্মরণীয় নয়, তবে আমি এই লেখার মাধ্যমে তাকে জানাতে চাই আমার তারুণ্য আরেকটু রঙ ছড়িয়েছে তার সান্নিধ্যে এসে। ভালো থাকুন গুরু, যেখানেই থাকুন যেভাবেই থাকুন…..

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.