আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

সংলাপ শুরু করে ঢাকা ছাড়লেন তারানকো

ছয় দিন বিরামহীন দৌড়ঝাঁপ করে দুই দলের সংলাপ শুরু করে দিয়েছেন, প্রথম দুই দফার বৈঠকে নিজেই ছিলেন মধ্যস্থতাকারী। এখন পরবর্তী অংশে মধ্যস্থতার দায়িত্ব দিয়েছেন বাংলাদেশে জাতিসংঘের আবাসিক সমন্বয়কারী নিল ওয়াকারকে। দুই দলও সমঝোতার মানসিকতা নিয়ে একটি 'চুক্তি'তে পেঁৗছতে সংলাপের বিষয়ে সম্মত হয়েছে উল্লেখ করে নিজের মিশনের মূল্যায়ন করতে গিয়ে জাতিসংঘ মহাসচিব বান কি মুনের বিশেষ দূত ও জাতিসংঘের রাজনীতিবিষয়ক সহকারী মহাসচিব অস্কার ফারনান্দেজ তারানকো বললেন, 'আমি এই মিশনের প্রাপ্তিতে অত্যন্ত খুশি। ' আর্জেন্টাইন এই ঝানু কূটনীতিক ছয় দিনের ঢাকা সফর শেষে গতকাল রাতে ঢাকা ত্যাগ করেছেন। এর আগে সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন, 'সংলাপ শুরু হয়েছে, এটি চলতে থাকবে।

দুই দলের দায়িত্বশীল নেতৃত্ব আলোচনায় বসেছেন। বৈঠকগুলোতে তারা প্রস্তাবনা তুলে ধরেছেন। আমি দেখেছি, তারা কিছু ক্ষেত্রে একমতও হয়েছেন। সারা বিশ্বে এভাবেই সমঝোতা হয়। '

পাঁচ সদস্যের জাতিসংঘ প্রতিনিধি দলের নেতৃত্ব নিয়ে গত ৬ ডিসেম্বর ঢাকা সফর শুরু করা অস্কার ফারনান্দেজ তারানকো গতকাল রাত ৯টার কিছু পরে এমিরেটস এয়ারলাইন্সের একটি ফ্লাইটে নিউইয়র্কের উদ্দেশে ঢাকা ত্যাগ করেন।

এই দিনটি ছিল তার মিশনের বর্ধিত দিন। কিন্তু ব্যস্ততার কমতি ছিল না। তার পরও নির্ধারিত সময় অনুসারে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে দ্বিতীয় দফায় বৈঠক হয়নি তারানকোর। গতকাল সকালে তার প্রতিনিধি দলের সদস্যরা ঢাকার বেশ কিছু দেশের কূটনীতিকদের সঙ্গে বৈঠকের মাধ্যমে দিনের কর্মসূচি শুরু করেন। কিন্তু তারানকো সকালেই চলে যান ঢাকায় জাতিসংঘের আবাসিক সমন্বয়কারী নিল ওয়াকারের বাসভবনে।

অনানুষ্ঠানিক আলোচনা চলে দুই দলের কূটনৈতিক সম্পর্কের দায়িত্বে থাকা দুই নেতার সঙ্গে। এরপর দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে জাতিসংঘ সংস্থা ইউএনডিপির একটি কার্যালয়ে সংলাপের দ্বিতীয় বৈঠকে বসেন আওয়ামী লীগ ও বিএনপি নেতারা। আড়াই ঘণ্টার এই বৈঠকে মধ্যস্থতাকারীরূপে উপস্থিত ছিলেন তারানকো। কয়েকবার পরিবর্তন করে গতকাল বিকাল ৪টায় তার বৈঠকসূচি ছিল প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে। কিন্তু সেটিও শেষ সময়ে হয়নি।

প্রধানমন্ত্রীর তথ্য উপদেষ্টা জানিয়েছেন, দুজনের ব্যস্ত কর্মসূচির কারণে এই বৈঠক সম্ভব হয়ে ওঠেনি। তবে আওয়ামী লীগ-বিএনপির সংলাপের পর তারানকো ঢাকার কূটনীতিকদের সঙ্গে বৈঠক করেছেন। প্রভাবশালী প্রায় প্রতিটি দেশের কূটনীতিকরা ঢাকার একটি পাঁচতারকা হোটেলে এই বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন। এই বৈঠকে জাতিসংঘ মহাসচিবের দূত হিসেবে শুরু করা সমঝোতা মিশন-এর সর্বশেষ অবস্থা সম্পর্কে ঢাকার বিদেশি কূটনীতিকদের জানান তারানকো। এরপরই আসেন জনগণের আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দুতে থাকা সংবাদ সম্মেলনে।

জনাকীর্ণ সংবাদ সম্মেলনে কূটনৈতিক প্রতিবেদকদের শেষ প্রশ্ন ছিল, তারানকোর মিশন কি ব্যর্থ? এর উত্তরে দীর্ঘ জবাব দিয়েছেন তারানকো। সব মিলিয়ে বলেছেন, যেখানে আলোচনার বিষয়ে দুই মেরুতে ছিল দুই দল, সেখানে তারা এক টেবিলে বসেছেন। এটা তাৎপর্যপূর্ণ সূচনা। আমি অত্যন্ত খুশি।

সংবাদ সম্মেলনের শুরুতে একটি লিখিত বক্তব্য উপস্থাপন করেন তারানকো।

এরপরই চলে যান প্রশ্নোত্তর পর্বে। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, দেশের প্রধান দুই রাজনৈতিক জোটের মধ্যে মতবিরোধের 'অচলাবস্থা' নিরসনে সংলাপের কোনো বিকল্প নেই। আমি সংলাপে এনেছি, দুই দফা বৈঠক হয়েছে, এখন তৃতীয় দফাসহ পরবর্তী সংলাপ আপনারা চালিয়ে যান। সমঝোতার মানসিকতা থাকলে সমাধান সম্ভব। তবে সংলাপ সফল না হলে কী হবে তা আমি বলব না।

তারানকো আরও বলেন, এদেশের রাজনীতিকদেরই সমাধানের আগ্রহ নিয়ে একটি সমঝোতায় আসতে হবে।

আরেক প্রশ্নের জবাবে বলেন, চলমান রাজনৈতিক সংকট বাংলাদেশের অনেক অর্জনকে ম্লান করে দিয়ে নানা বিষয়ে হুমকিতে ফেলবে। তিনি বলেন, প্রধান দুই রাজনৈতিক দলের মধ্যে সমঝোতার মানসিকতা থাকলে সংকট সমাধান সম্ভব। মিশনের উদ্দেশ্য ব্যাখ্যা করতে গিয়ে তারানকো বলেন, জাতিসংঘের প্রথম লক্ষ্য ছিল দুটি দলকে আলোচনায় নিয়ে আসা। আমরা তা শুরু করেছি।

সমাধান সম্ভব, তবে তা আসতে হবে নিজেদের মধ্য থেকে। তবে দুই দলই আলোচনা চালিয়ে যেতে সম্মত হয়েছে। তারানকো বলেন, জাতিসংঘ বিশ্বাস করে বাংলাদেশে নিরপেক্ষ, স্বচ্ছ ও সুষ্ঠু নির্বাচন হওয়া সম্ভব। এজন্য রাজনৈতিক দলগুলোর সদিচ্ছার বিকল্প নেই। প্রয়োজন আছে সব পক্ষের সমান সুযোগের।

একপক্ষীয় নীতিতে কোনো সমাধান হবে না। বিরোধী মতের নেতাদের স্বাধীনভাবে মতপ্রকাশের সুযোগ থাকতে হবে। তিনি বলেন, গত কয়েক দিন রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে তিনি একাধিকবার আলোচনা করেছেন। দুই দলের শীর্ষ নেতাদের নিয়েও তিনি বৈঠক করেছেন। নেতারা তাকে জানিয়েছেন, সংকট সমাধানে এ সংলাপ তারা চালিয়ে যাবেন।

তিনি বলেন, বিশ্ব সম্প্রদায় আশা করে বাংলাদেশ তার উন্নয়নের অগ্রযাত্রা অব্যাহত রাখবে।

ফারনান্দেজ তারানকো এবার তৃতীয়বারের মতো ঢাকা সফর করলেন। এবারের সফরে তিনি প্রধানমন্ত্রী, বিরোধীদলীয় নেতা, জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান, প্রধান নির্বাচন কমিশনার, সুশীল সমাজের প্রতিনিধি ও কূটনীতিকদের সঙ্গে দফায় দফায় বৈঠক করেন। এ ছাড়াও সংকট সমাধানে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির সিনিয়র নেতাদের বৈঠকে মধ্যস্থতা করেন জাতিসংঘ মহাসচিবের এই প্রতিনিধি। তবে বিরোধী দলের নেতার সঙ্গে সফরে দুই দফায় সাক্ষাৎ হলেও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে শেষ পর্যন্ত দ্বিতীয় দফায় সাক্ষাৎ আর হয়ে ওঠেনি।

তারানকোকে এ বিষয়ে প্রশ্ন করলে জবাবে বলেছেন, 'সবাই খুব ব্যস্ত; আমিও কিছুক্ষণ পরে বিমানে উঠব। তাই বৈঠক হয়নি। '

আশরাফ-ফখরুলের আড়াই ঘণ্টা বৈঠক : জাতিসংঘ মহাসচিবের দূত অস্কার ফারনান্দেজ তারানকোর মধ্যস্থতায় আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম ও বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর গতকাল প্রায় আড়াই ঘণ্টা বৈঠক করেছেন। দুপুর সাড়ে ১২টার কিছু পরে গুলশানে জাতিসংঘ সংস্থা ইউএনডিপির একটি কার্যালয়ে ওই বৈঠকে দুই দলের আরও তিনজন করে সিনিয়র নেতা উপস্থিত ছিলেন। এ ছাড়া জাতিসংঘের আবাসিক প্রতিনিধি নিল ওয়াকারও উপস্থিত ছিলেন।

বৈঠকের পর দুই দলের কোনো নেতাই আনুষ্ঠানিকভাবে কিছু বলেননি। দলীয় সূত্রগুলো বলছে, সংকট সমাধানে দুই দলের আলোচনায় খুব বেশি অগ্রগতি হয়নি। বৈঠকে আওয়ামী লীগের প্রতিনিধি দলে সৈয়দ আশরাফের নেতৃত্বে ছিলেন উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য আমির হোসেন আমু, তোফায়েল আহমেদ ও গওহর রিজভী। এ ছাড়া মির্জা ফখরুলের নেতৃত্বে প্রতিনিধি দলে ছিলেন স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন, ড. আবদুল মঈন খান ও ভাইস চেয়ারম্যান শমসের মবিন চৌধুরী। বেলা ১২টার মধ্যেই তারানকো ওই কার্যালয়ে এসে উপস্থিত হন।

এরপর বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিবের নেতৃত্বে দলের প্রতিনিধিরা ১২টা ৫ মিনিটে সেখানে আসেন। ১২টা ২২ মিনিটে আসেন আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদকের নেতৃত্বে চার সদস্যের প্রতিনিধি দল। তবে বৈঠক শেষে বিকাল পৌনে ৩টার দিকে তারানকো সাংবাদিকদের এড়িয়ে ভিন্ন পথ দিয়ে বেরিয়ে সবার আগে চলে যান। এরপর আওয়ামী লীগ ও বিএনপি নেতারাও সাংবাদিকদের সঙ্গে কোনো কথা না বলে দ্রুত চলে যান।

এদিকে আওয়ামী লীগ সূত্র জানিয়েছে, নির্বাচনকালীন সরকার নিয়ে প্রধান বিরোধী দল বিএনপি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে সরে দাঁড়ানো এবং নির্বাচন কমিশন ও মন্ত্রিসভার পুনর্গঠন দাবি করেন।

এ ছাড়া আটক নেতাদেরও মুক্তি দেওয়ার দাবি জানান। আওয়ামী লীগ নেতারা জানিয়েছেন, সংবিধানের বাইরে যাওয়ার কোনো সুযোগ নেই। নির্বাচনকালীন সরকারের প্রধান শেখ হাসিনাই থাকবেন। এতে কোনো ছাড় দেওয়া হবে না। গ্রহণযোগ্য নির্বাচন ও সব দলের অংশগ্রহণের জন্য অন্য বিষয়গুলো নিয়ে সর্বোচ্চ ছাড় দেওয়া হবে।

বৈঠকে অংশ নেওয়া বিএনপির একজন নেতা জানান, তারানকোর সফরে আশাবাদী হওয়ার কোনো কিছুই নেই। জাতিসংঘের এই বিশেষ দূত চলে যাওয়ার পর সংস্থাটির আবাসিক প্রতিনিধি নিল ওয়াকারের সঙ্গে বৈঠক কতটুকু ফলপ্রসূ হবে তা নিয়েও সংশয় রয়েছে। নির্বাচনকালীন প্রধান কে হবেন- সেখানেই আলোচনা আটকে গেছে বলেও মনে করেন তিনি।

 

 

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।