আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

শিকড় থেকেই শিখরে: জ্ঞান ভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠায় জ্ঞান ভিত্তিক আণ্দোলন চাই



সামাজিক ও অথনৈতিক জীবন যদি জ্ঞানভিত্তিক হয় তবে সংগঠনের মূল সম্পদ হিসাবে জ্ঞানের প্রতি মনোযোগ বৃদ্ধি গুরুত্বপূণ। জ্ঞান কেন্দ্রিক অনেক প্রডাক্ট ও সাভিস এখন মাকেটে। বতমান নলেজ ওয়াকারদের উদ্ভাবনী কমতৎপরতায় অনেক প্রতিষ্ঠিত জ্ঞান প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়েছে। প্রশ্ন উঠেছে কে নলেজ ওয়াকার? কোন বিশেষজ্ঞ বা বিশেষ বিষয়ে কোন পারদশী ব্যক্তি?এটা কি শিক্ষার কোন ব্যাপার? শুধুমাত্র উচ্চশিক্ষিত মানুষগণ? এটা দ্বিধাহীনভাবে বলা যায়, জ্ঞান অত্যন্ত মূল্যবান বা প্রয়োজনীয় বস্তু। জ্ঞান হচ্ছে এমন বস্তু যা অজনযোগ্য,ব্যবহারযোগ্য,সংরক্ষণযোগ্য,স্থানান্তরযোগ্য।

জ্ঞান হচ্ছে, ১. অবগতি (a act of knowing) ২. জ্ঞাত বা জ্ঞেয় বিষয় (what is known or is to be known) ৩. সংবাদ বা তথ্য (Information) অথাৎ the state of knowing about a particular fact or situation ৪. শিক্ষা বা বিদ্যা (Instruction) অথাৎ Understanding and skills that you gain through education or experience. ৫. ব্যবহারিক জ্ঞান বা দক্ষতা (Practical skill) ৬. অভিজ্ঞতা (Experience)। কিছু তথ্য আছে যা প্রায় সবজনে জানে অথাৎ সবজনবিদিত তথ্য-এই common knowledge টা থাকা সামাজিক মানুষ হয়ে বাঁচার স্বাথেই অপরিহায। পাশাপাশি বিভিন্ন সময়ে অতিব প্রয়োজনীয় জ্ঞান যাহা সকলেরই থাকা উচিৎ অথাৎ সাধারণ জ্ঞান-এই general knowledge ছাড়া ব্যক্তিত্ববান মানুষ রুপে জীবন পরিচালনা অসম্ভব। সম্মানজনক জীবন যাপন ও মানসম্মত জীবিকা লাভের জন্যেই knowledgeable হওয়া জরুরী এমনটি নয় জীবনের সাথে জগতের উন্নততর সমন্বয়ের স্বাথেও জ্ঞানসম্পন্ন ও বুদ্ধিমান মানুষের দরকার। জ্ঞানের উৎকষতা সাধনে জ্ঞানাহরণগত ও প্রায়োগিক কিছু জটিলতা আছে।

ভেতরে ও বাইরে জ্ঞানগত উন্নতি ও সহযোগিতার কৌশলই সংগঠনের জন্যে প্রয়োজনীয়। একবিংশ শতাব্দীতে জ্ঞানকে সংগঠনের প্রাথমিক সম্পদ (Primary resource) হিসাবে বিবেচনা করা হয়। জ্ঞানের প্রবাহ অথনৈতিক প্রবাহের চাইতেও বেশি গুরুত্বপূণ হয়ে ওঠেছে। তাই জ্ঞানভিত্তিক সংগঠনগুলো- মানব সম্পদ উন্নয়নে বহুবিধ কাযসম্পাদন করে, জ্ঞান উৎপাদন ও পুনরুৎপাদনের যৌক্তিক প্রক্রিয়াগুলোকে সচল রাখে। নব জ্ঞান তৈরির সংগঠনগুলোর সাংগঠনিক সংস্কৃতিই হচ্ছে জ্ঞানাজন-জ্ঞান বিতরণ-জ্ঞান সংরক্ষণের পরিবেশকে নিশ্চিত করা এবং এজন্যে নয়া নয়া কৌশল অবলম্বন করা।

জ্ঞানভিত্তিক সংগঠনের একটি নিজস্ব কাঠামো থাকতে হয় এবং শক্তিশালী ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করতে হয়। আধুনিক জ্ঞান বিজ্ঞান, তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির ব্যবহার সুনিশ্চিতকরণ ছাড়া সময়ের দাবি পূরণ করবে এমন যুগোপযোগী কোন জ্ঞানভিত্তিক সংগঠনের চিন্তাও অলিক কল্পনা ছাড়া কিছুই নয়। জ্ঞানভিত্তিক সংগঠনগুলো নানান ভাবে নলেজ সোসাইটির সক্রিয় তৎপরতা বৃদ্ধি করে। যেমন:১. জ্ঞান চচাকারী, উৎপাদনকারী,পুনরুৎপাদনকারী, সংরক্ষণকারী, জ্ঞানের বিকাশ ও প্রচারকারী, জ্ঞানের প্রসারে বহুবিধ আয়োজনকারী প্রতিষ্ঠান হিসাবে ২.শিক্ষা ও গবেষণা সংগঠন হিসাবে ৩. বুদ্ধিবৃত্তিক কমপ্রচেষ্টা চালানো বা উন্নততর বোধশক্তি সম্পন্ন বুদ্ধিমান ও সচেতন মানুষ তৈরির প্রয়াস চালাতে। সংগঠনের আভ্যন্তরীণ ও বাহ্যিক কমকান্ডে জ্ঞান অত্যন্ত গুরুত্বপূণ।

নব জ্ঞান সঙ্গতিপূণভাবে তৈরিকৃত, সংগঠনের প্রয়োজনে সম্পূণভাবে প্রচারিত এবং নতুন প্রডাক্ট বা সাভিসে দৃঢ়ভাবে ব্যবহিত। সংগঠনের সফলতা নিভর করে তার ভিশন এবং কৌশলের পদ্ধতি বাস্তবায়নে কাযকর নীতি ও সাংগঠনিক দৃঢ় কাঠামোর ওপর। লক্ষ্য যদি হয় জ্ঞান -অর্জন, সংরক্ষণ, বিতরণ ও ব্যবহার | তবে উদ্দেশ্য হতে হবে,নলেজ ভিত্তিক মুভমেন্টের মাধ্যমে বুদ্ধিবৃত্তিক নেতৃত্ব তৈরি ও আলোকিত সমাজ গড়ে তোলা| সংগঠনের ধরণটা হবে, সৃজনশীল, উদার, মানবপ্রেমিক, বুদ্ধিমান প্রজন্মের দ্বারা প্রতিষ্ঠিত গবেষণা ও মানবকল্যাণমূলক সংগঠন| জ্ঞানভিত্তিক আন্দোলনকে বেগবান করতে গড়া জ্ঞানভিত্তিক সংগঠনের কর্মসুচি হতে পারে, জ্ঞান র্চচার পরিবেশ ও অধ্যয়নের মানসিকতা তৈরির যুগোপযুগী আয়োজন করা। জ্ঞান বিতরণে আধুনিক উপায় ও উপকরণের ব্যবহার এবং যোগ্য,মানবিক মূল্যবোধে উজ্জীবিত ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি সম্পন্ন সুবিবেচক লেখক, বক্তা কিংবা চিন্তাশীল ব্যক্তিত্ব তৈরিতে বহুবিধ প্রশিক্ষণ প্রদান। জ্ঞান সংরক্ষণে নানান ধরণের শক্তিশালী ব্যবস্থা গড়ে তোলা।

জ্ঞানভিত্তিক সংগঠনের স্বতন্ত্রতা ঠিক করার ক্ষেত্রে দৃষ্টিভঙ্গি থাকতে হবে যে,আমাদের উদ্যোগই র্সবপ্রথম কিংবা র্সবশেষ নয়। অপেক্ষাকৃত বেশী যারা জানে তাদের কাছ থেকে শিখব আর যারা কম যারা জানে তাদেরকে শিখাব। দেশ ও মানবতা নিয়ে যে বা যারাই কাজ করছে সবাই আমাদের সহযোগী বন্ধু। আমরা কাউকেই শত্রু মনে করিনা। রাজনৈতিক মতর্পাথক্য কিংবা যেকোন সংকীর্ণতার উর্ধ্বে ওঠে আমরা কাজ করব।

আমাদের প্রচেষ্টার সাথে একাকার হয়ে যেতে কারো একাডেমিক ব্যাকগ্রাউন্ডগত ভিন্নতা প্রতিবন্ধক নয়। ধর্ম, র্বণ, শ্রেণী বা লিঙ্গগত ভিন্নতার কারণে কোন ভেদাভেদ থাকবেনা। প্রশ্ন উঠতে পারে কাজের উপায় ও পদ্ধতি নিয়ে। উপায় চারটি:১. আমরা নিজেরা জানব ২.আমরা যতটুকু জানি তা অপরকে জানাব ৩. যারা চিন্তা গবেষণায় অগ্রসর কিন্তু কর্মে পিছিয়ে অথবা যারা চিন্তা গবেষণা ও র্কমে অগ্রসর তাদের সাথে সর্ম্পক তৈরি। ৪.যারা চিন্তা গবেষণায় পশ্চাদপদ কিন্তু র্কমে অগ্রসর অথবা চিন্তা গবেষণা ও র্কমে পশ্চাদপদ তাদের অবস্থার পরির্বতনে বা উন্নয়নের চেষ্টা।

আর পদ্ধতি এমন হতে পারে যে, আধুনিক যৌথ উদ্যোগ, সংস্কার ও তত্ত্বগুলোকে বিবেচনায় অগ্রাধিকার দিব। সস্তা জনপ্রিয়তা ও চমকপ্রদ কিছু করে তাক লাগিয়ে দিয়ে তড়িৎ ফলাফল প্রত্যাশীদের দ্বারা নলেজ মুভমেন্টকে এগিয়ে নেয়া অসম্ভব। স্বীকৃতি ও প্রাপ্তির লোভ বিসজন দিয়েই স্বপ্নের জগৎটাকে বাস্তব জগতে নিয়ে আসা সম্ভব। যৌক্তিক, সময়োপযোগী ও গ্রহণযোগ্য কমকৌশল ঠিক করে সামনে এগুতে হবে। অন্যদের কাজের পদ্ধতি জানাটাকেও জ্ঞানের একটি বিশেষ অংশ হিসাবে ধরে নিতে হবে।

নিজেদের ধারণা পরিচ্ছন্ন হলেই কেবল অন্যকে সেব্যাপারে সচেতন করাটা সম্ভব হবে। যেহেতু বিলাসী জীবন ও আরামদায়ক সময় কাটানো নয় বরং আমরা কষ্টকর পথে হাটতে সংকল্পবদ্ধ সেহেতু পরিশ্রম,সাধনা ও অধ্যবসায়ের মাধ্যমেই আমরা আমাদের বহুবিধ প্রশ্নের উত্তর নিজেরাই খুজে বের করতে পারব এবং অনুসন্ধিৎসু মন সময়োপযোগী পথ ও পদ্ধতির সন্ধান পাবে। চিন্তাশীল নয় এমন শিক্ষিত ব্যক্তি কিংবা অশিক্ষিত চিন্তাশীল ব্যক্তি-কেউই আসলে খুব সুবিধেজনক নয়। তাই লোক বাছাইয়ের ক্ষেত্রে হঠাৎ দেখেশুনে নেয়াটাই যথেষ্ট হবেনা বহু পরীক্ষা নিরীক্ষা করে নিতে হবে। যে কোন ব্যাপারে মন্তব্য কিংবা উত্তর প্রদানের ক্ষেত্রে উদ্যোক্তা বা স্বপ্নদ্রষ্টাদের খুব কৌশলী হওযাটা জরুরী।

দীঘস্থায়ী সত্যিকার কল্যাণ লাভ কখনই বক্র ও আবেগনিভর পথে হতে পারেনা। বিদ্যমান সমস্যার সমাধানেই দৃষ্টিসীমার চূড়ান্ত আবদ্ধতা নয় বরং গবেষণার মাধ্যমে নব পথ-পদ্ধতি ও কৌশল বের করতে সক্ষম হতেই হবে। সদস্য বাছাইয়ের ক্ষেত্রে কার অভিজ্ঞতা বেশি এই হিসাব না কষে অভিজ্ঞতাকে কিভাবে কাজে লাগাচ্ছে তা দেখাটাই বেশি জরুরি বোধহয়, উচ্চশিক্ষিত অথচ বুদ্ধি কম এমন মানুষকে এড়িয়ে যাওয়াতেই কল্যাণ। স্বাপ্নিক চিন্তাশীলরাই সমাজের চোখকে বদলাতে পারে। অনাগত ভবিষ্যতকেও দেখতে না পারলে স্বপ্নদ্রষ্টা হওয়া যায়না।

নিজে স্বপ্ন দেখা আর সেই স্বপ্ন অন্যের মাঝে ছড়িয়ে দিতে পারাটা এককথা নয়। নিজের ধ্যান ধারণা ও পরিকল্পনার সাথে অন্যের সম্পৃক্ততার চেষ্টার আগে কিছুটা পরিপক্কতা অজন দরকার। পরিণত বুদ্ধিমানের পক্ষেই সম্ভব যাবতীয় দ্বিধা দ্বন্ধের অবসানে কঠিন সংগ্রামে অবতীণ হয়ে সরল পথেই সফলতার সন্ধান লাভ। প্রশিক্ষণ বা জ্ঞানবিতরণের পরিকল্পনার মানেই হচ্ছে,মানবাত্মা গঠনের মহৎ প্রচেষ্টায় অংশগ্রহণের সিদ্ধান্ত; যেই সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের প্রক্রিয়া জ্ঞানের পূণতা লাভকে সহজসাধ্য করবে। ফিদেল ক্যাস্ট্রো বলেছিলেন, যদি সঠিক কমসূচী এবং গভীর বিশ্বাস থাকে তাহলে শত বাধা সত্ত্বেও জয় সুনিশ্চিত।

কিছু ব্যাপারে চরম বিশ্বাসী মানেই যে, সব ব্যাপারে সন্দেহপ্রবণতার উধ্বে ওঠতে হবে-এমনটি মনে করিনা। জাঁ পল সাত্র বলেছেন, অণ্বেষণ করো, অনুসন্ধান করো, জানতে চাও, প্রশ্ন করো, প্রশ্নের উত্তর খোঁজো-সত্য বেড়িয়ে আসবেই। আমিও মনে করি,অনুসন্ধান ও অনুসন্ধিৎসার চেতনাবোধ সম্পন্ন মানুষই অনেককে বিস্মিত করে অজানা কোন বিষয়কে একেবারে দিবালোকের ন্যায় স্পষ্ট করে তুলতে পারে। চিন্তা, কল্পনা, বিশ্বাসেই ব্যক্তির অন্তরের মানবপ্রকৃতির প্রতিফলন ঘটে। একজন জ্ঞানী, বুদ্ধিমান, অন্তদশী ও গভীর নিয়মনিষ্ঠ মানুষই কোন উদ্দেশ্য বাস্তবায়নে পযাপ্ত সময় দিতে পারে।

তাড়াহুড়া অনেক সহজ বুদ্ধিতে সম্পন্ন করার উপযোগী কাজকেও মারাত্মকভাবে জটিল করে ফেলে। বুদ্ধিমত্তা না থাকলে প্রয়োজনের সময় বিচক্ষণতার পরিচয় দেয়া কখনই সম্ভব নয়। এক্ষেত্রে পুথিঁগত বিদ্যার পাশাপাশি উপলব্ধির ক্ষমতা তীব্রতর হওয়ার প্রয়োজন আছে। একজন প্রকাশকের পক্ষে যেমন একজন লেখকের মতো স্বাদ নেয়া সম্ভব হয়না তেমনি লাইব্রেরীয়ান হলেই পাঠকের তৃপ্তি পাওয়া যায়না। এটা ঠিক যে, সবাই সব কাজের উপযুক্ত নয় আর সবারই একইরকম হওয়াটাও জরুরী নয়।

পূজনীয় ও বরণীয় হবার আশা সবধরনের ক্ষেত্রে না থাকাটাই ভাল। কারণ হিসাবে বাট্রান্ড রাসেলের একটি উক্তি উল্লেখ করতে চাই; তিনি বলেছেন- প্রতিভাবান অন্যের অবজ্ঞাকে অবজ্ঞা করে সামনে এগোয়, প্রতিভাহীনের কাজ ছেড়ে দেয়াই ভালো। জ্ঞান ভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠার জন্যে জ্ঞান ভিত্তিক আন্দোলন গড়তে জ্ঞান ভিত্তিক সংগঠন ও প্রতিষ্ঠানের আয়োজন জরুরী। এক্ষেত্রে স্পষ্ট হওয়া প্রয়োজন,জ্ঞান কী? কীভাবে জ্ঞান উৎপন্ন হয়? জ্ঞানের উৎস কী? জ্ঞানের প্রকৃতি ও জ্ঞানচর্চার মাধ্যম কি? জ্ঞানাজনের প্রক্রিয়া ও সুনিদিষ্ট পদ্ধতি কি? জ্ঞান ভিত্তিক সমাজ বা জ্ঞান ভিত্তিক আন্দোলনের স্বরুপ কি? জ্ঞানের ব্যবহার তথা প্রায়োগিক দিক কী? কে জ্ঞানী? জ্ঞান ব্যবস্থাপনার কৌশল কী? জ্ঞানের প্রয়োজনীয়তা কেন? জ্ঞান আহরণ, জ্ঞান বিতরণ, জ্ঞান সংরক্ষণ, জ্ঞান সৃষ্টি- এগুলোর মধ্যকার যোগসূত্র বা সম্পকের ধরণ কেমন? জ্ঞান কেন্দ্রিক কমতৎপরতায় পরিবতনের ধারাবাহিকতা কেমন? অজ্ঞতার দুভোগ বুঝার জন্যে খুব গভীর উপলব্ধির প্রয়োজন হয়না। তীক্ষ্ণ পযবেক্ষণে সক্ষম না হলেও চারপাশের নিদশন ও বিদ্যমান আলামত কিছু ক্ষেত্রে প্রায় সঠিক ধারণা তৈরিকে সম্ভব করে।

তবে পদ্ধতিগত নিভুলতা ছাড়া অভিজ্ঞতা জ্ঞান সব সময় সম্পূণ সত্য নাও হতে পারে। তাই বিবেক বা চিন্তাকেই জ্ঞানের একমাত্র উৎস বলে মনে করার মাঝে বিভ্রান্তির আশংকা তীব্রতর। শুদ্ধ যুক্তিই কেবল মানুষকে সত্য জ্ঞানের সন্ধান দিতে পারে বলে মনে করার ক্ষেত্রে মতানৈক্য রয়েছে। জ্ঞান কি সত্য ও বিশ্বাসের সমষ্টিগত কোনো বিষয় নাকি একক-এটিও বিবেচনায় আনতে হবে। যে জ্ঞানটা বিবৃতিমূলক জ্ঞান বা প্রকাশিত তা জানার জন্যে যেভাবে জ্ঞান সাধককে চেষ্টা করতে হয় সেভাবেই বুদ্ধিবৃত্তিক গুণকে সাধারণ স্তরের উধ্বে ওঠানো সম্ভব নয়।

মনে রাখা জরুরী যে, তাত্ত্বিক জ্ঞান বস্তু সমন্বয়ের সক্ষমতা দেয় কিন্তু ব্যবহারিক জ্ঞান কীভাবে চলতে হবে, বলতে হবে তার ক্ষমতা দেয়। বিচারিক ক্ষমতাকে প্রবল করতে হলে অভিজ্ঞতা নিভর বোধকে গুরুত্ব দেয়ার পাশাপাশি সচেতনতার মাত্রাকে সূক্ষ বিবেচনার উপযোগী পযায়ে নিয়ে যেতে হবে। এটা নি:সন্দেহে সত্য যে, অভিজ্ঞতার মাধ্যমেও লাভ হয় জ্ঞান । কিন্তু অভিজ্ঞতাটা কি প্রত্যক্ষ নাকি পরোক্ষ-সেটি বুঝাটাও গুরুত্বপূণ। আহসানকে জ্ঞানী হিসেবে বিশ্বাস করা মানে আহসান জ্ঞানী এ বিবৃতিকে সত্য বলে স্বীকার করা।

বিশ্বাসটা ব্যক্তিভেদে ভিন্ন হতে পারে। কিন্তু এটা যদি প্রতিষ্ঠিত ব্যবস্থায় প্রমাণিত ও গ্রহণযোগ্য হয়, সামষ্টিক পযায়ে গ্রহণযোগ্য হয়ে ওঠে তবে তা আর ব্যক্তিগত বিষয় থাকেনা। সংকটটা হল পরীক্ষিত নয় এমন বিশ্বাস ভুলও হতে পারে। শুধু তাই নয় অনেকদিনের চচিত ও প্রমাণিত সত্যও সময়ের ব্যবধানে পাল্টে যেতে পারে, মিথ্যা প্রমাণিত হতে পারে। আসলে অনেক ক্ষেত্রে সময় ও স্থানটাও বিবেচ্য বিষয় হয়ে ওঠে।

ফলে পযবেক্ষণ নিভর জ্ঞানকে অনেকে বিশ্বাসগত উপলব্ধির সাথে তুলনা করে শ্রেষ্টত্ব দিতে চান। কেউ যদি জ্ঞানকেই সত্য বিশ্বাসকে নিধারণের ক্ষমতা দিয়ে দেন তখন এনিয়ে বিতক বাড়তেই থাকে। অনেকটা ডিম আগে নাকি মুরগি আগের মত-প্রমাণ আগে নাকি বিশ্বাস আগে? বিশ্বাসের জন্য বিচার করার বিষয়টি অবশ্য অভ্রান্ত হতে হবে। গাণিতিক বা যান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় উৎপাদিত জ্ঞান আর অভিজ্ঞতালব্ধ বা পযবেক্ষণলব্ধ জ্ঞানকে একইভাবে বিবেচনা করা যাবে না। গবেষণাগার, ল্যাব আর সমাজ কিংবা পরিবার, কৃত্রিমতা ও প্রাকৃতিক- এক নয়।

বিশ্বাসকে কেবল তখন জ্ঞান হিসেবে গ্রহণ করবে যখন এটা নিভরযোগ্য বিশ্বাস গঠনের প্রক্রিয়ায় উৎপাদন করা হবে। আস্থার ভিত্তিতে বিশ্বাস আর পরীক্ষা নিরীক্ষার মাধ্যমে বিচার বিশ্লেষণ করে বিশ্বাস –এক কথা নয় । অবশ্য আধ্যাত্মিক জ্ঞান আর বৈষয়িক জ্ঞানকে একই যুক্তির মানদন্ডে বিচার করতে চাওয়ার প্রচেষ্টা যৌক্তিক হবে না। অথাৎ জ্ঞান কোনো বিচারীকৃত সত্য বিশ্বাস নয় বরং এর সাথে আরো কিছুর সমষ্টিও। বিশ্বাস কিংবা অবিশ্বাস ঘটতে হবে কারণগতভাবে, সঠিক অথে এবং নিভরযোগ্য আলামতের মাধ্যমে।

মনের বাইরে গিয়ে বাহ্যিকভাবে দেখা, শুনা ও বুঝার মত ঘটনার মাধ্যমে জ্ঞান অজন করা সম্ভব। ইন্দ্রিয়ের মাধ্যমে তাৎক্ষণিকভাবে অনুভূত প্রপঞ্চ সত্যের দিকে চালিত করতে পারে। আসলে জ্ঞান অজনের অবস্থা মনোজগতে নিধারিত হয়ে থাকে। তবে যারা জ্ঞান প্রাপ্ত হয়, তারা নিজেদের মন দিয়ে জ্ঞানকে উপলব্ধি করার চেষ্টা থাকেন। বিশুদ্ধ ও বিমূত যুক্তি দ্বারাও জ্ঞান সৃষ্টি হতে পারে।

জটিল বিষয়কে বুঝার জন্য সেটাকে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অংশে বিভক্ত করার দরকার যেমন পড়ে তেমনি অনেকক্ষেত্রে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বিষয়কে সমন্বয় করে বুঝার প্রয়োজন পড়ে। একটা ব্যপার গুরুত্বপূণ যে, চেতনাকে ভিত্তি হিসেবে বিবেচনা করলে মানুষের সীমাবদ্ধতার কারণেই ভুল হবার সম্ভাবনা থেকে যায়। গবেষণা করার জন্য একটি সুনিদিষ্ট পদ্ধতি প্রতিষ্ঠা করা জরুরী। এমন কিছু ব্যাপার আছে যা সব মানুষের পক্ষে জানা সম্ভব নয় তবে কিছু মানুষের পক্ষে আয়ত্বে আনা সম্ভব আবার কিছু ব্যাপার আছে যা কোন মানুষের পক্ষেই আয়ত্ব করা সম্ভব নয়। নিজের কিংবা অন্যের অভিজ্ঞতার আলোকে জ্ঞানকে আয়ত্ব করা যায়।

পাচটি ইন্দ্রিয়ের মাধ্যমে প্রাপ্ত পাঁচ প্রকারের অনুভূতির সাহায্যে পাঁচ প্রকারের পযবেক্ষণ তৈরি হয়। তবে এই পযবেক্ষণ সবার কাছে সমান অথ বা তাৎপয বহন করতে পারে না। আমাদের নবী (সা যখন সংঘাতময় পরিস্থিতিতে শান্তি প্রতিষ্ঠাকল্পে হিলফুল ফুযুল করেন তখন তিনি হেরা গুহায় ধ্যান করতেন না। ড. ইউনুস গ্রামীণ দারিদ্র নারীদের লোন দেয়া শুরু করেন তখন এমন না যে আর কেউ এই অসহায়দের সমস্যাটা দেখেননি। প্রায়োগিকভাবে ব্যবহারের জন্য প্রযোজ্য জ্ঞানই সমাজ পরিবতনে সক্রিয় ভুমিকা রেখেছে।

অবশ্য ডিনামাইটের আবিষ্কারক কিংবা আইনস্টাইনের আপেক্ষিক তত্ত্ব তার প্রয়োগ তাদের উদ্দেশ্যানুযায়ী পরবতীতে হয়নি। অথাৎ জ্ঞানটা হলো চন্দ্র সূযের প্রাকৃতিক নিয়মের মতই সেটা যার মগজ প্রসূতই হোক না কেন সেটা ফ্যাক্টর না বরং কে ব্যবহার করছে, কোন উদ্দেশ্যে ব্যবহার করছে সেটাই বিবেচনার বিষয়। ঠিক একটি অস্র উৎপাদনকারীর চিন্তাধারার বাইরে এসেই সেটির ব্যবহারকারীর দৃস্টিভঙ্গির সক্রিয় প্রতিফলন বিবেচনার ক্ষেত্রে শক্তিশালী হয়ে ওঠে। ফলে জ্ঞান উৎপাদনকারীর কাছ থেকে প্রয়োগকারী বা ব্যবহারকারীর কাছে গেলেই তা স্বথকতা লাভ করে। তবে হ্যাঁ এমনও হতে পারে জ্ঞান উৎপাদনকারী ও ব্যবহারকারী একই ব্যক্তি আবার এমনও হতে পারে উভয়ে ভিন্ন ভিন্ন সত্তা।

তাহলে সম্পদের মত জ্ঞানেরও মালিকানা পরিবতন হতে পারে। জ্ঞানের স্বরুপ নিয়ন্ত্রণ করে মানুষের দৃষ্টিভঙ্গিও নিয়ন্ত্রণ করা যায়। মাকড়সা নিপুণ দক্ষতায় বুনে জাল, পাখি অপূর্ব কৌশলে বাঁধে বাসা । বৈচিত্রহীন একই ধরণের কাজের কারণ তাদের সীমাবদ্ধ জ্ঞান। কিন্তু মানুষও যখন তার সৃজনশীলতা, সৃষ্টিশীলতা হারিয়ে ছক বাঁধা নিরস অস্তিত্বের স্বাক্ষী হয় সে দৃষ্টান্ত অনাকাংখিত বাস্তবতাকেই হাজির করে।

যেহেতু মানুষের শরীরে যতগুলো কোষ রয়েছে তার থেকে ১০ গুণ বেশি জীবাণু ব্যাক্টেরিয়া পরজীবী সেখানে রয়েছে। গর্বের শরীর অণুজীব পরজীব ব্যাক্টেরিয়ার ভাল বাসস্থান ছাড়া কিছুই নয়। তাই শরীর খাটানোই যথেষ্ট নয় মাথা খাটানোকেও আমার গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়। অন্যবিধ জ্ঞানের সাহায্য ছাড়াই বিষয়বস্তুর স্বরুপের উপলব্ধি করতে শিখতে হবে। র্অন্তজ্ঞানকে বাড়াতে হবে।

বাহ্যরুপের আড়ালে লুকিয়ে থাকা অন্তর্নিহিত রুপ আবিষ্কারের প্রয়োজনীয় র্অন্তদৃষ্টি জাগাতে হবে। চিত্তে সৃষ্টি করতে অন্তর্নিহিত গভীর শক্তি, সত্যিকার উপলব্ধি করার ক্ষমতা বাড়াতে হবে। জ্ঞানভিত্তিক আন্দোলনের নেতৃত্ব কখনোই ফটোকপি হবেনা। যেটা আপনি করছেন সেটা যদি এর চেয়ে ভালো অন্য কেউ করে তবে সেটা আপনি না করলেও চলবে। নিজের প্রত্যাশা অন্যের ওপর না চাপিয়ে সমাজের ভবিষ্যত আকাংখার সাথে প্রাসঙ্গিক স্বপ্ন দেখুন এবং নিজেকে প্রস্তুত করুন।

মানুষের বিবেককে জাগানো, অচেতন মনে চেতনা জাগলে, হৃদয়কে আলোকিত করা, অন্তরে যা-সুন্দর, ভাল, কল্যাণকর তার প্রতি আকর্ষণবোধ তৈরি করা, পূণ্যের প্রতি আগ্রহ সৃষ্টি এবং যাতে পাপ, যেখানে পঙ্কিলতা তা বর্জন করার মানসিকতা তৈরি হয় ধর্মীয় বা নৈতিক জ্ঞান থেকে। যদিও বর্তমানে জ্ঞানের সাথে বাস্তব চিত্রে বেশ অমিল পরিলক্ষিত হচ্ছে। ধর্মীয় জ্ঞানে অগাধ পাণ্ডিত্য অর্জকারীদের মধ্যেও জ্ঞানীর চেয়ে জ্ঞানপাপীদের সংখ্যাই বেশি দেখা যায়। তোতা পাখির মত মুখস্ত করে ধর্মীয় গভীর জ্ঞান উপলব্ধি হয় না। অনেক হাফেজে কুরআনেরও ধর্মের সুস্পষ্ট ধারণা থাকে না।

ধর্মের যে দাবি, যে বক্তব্য, দৃষ্টিভঙ্গি সেটি স্পষ্ট রূপে না বুঝায় অনেক ধরণের কুসংস্কার ও গোঁড়ামী মিলে তৈরি হয় ধর্মান্ধতা। নানা অন্ধবিশ্বাস আর অস্পষ্টতার সমন্বয়ে সৃষ্ট সংকট আর জটিলতার ঘূর্ণাবর্তে অপ্রয়োজনীয় বিষয়কে প্রয়োজনীয় মনে করে। গুরুত্বপূর্ণ বিষয়কে গুরুত্বহীন মনে করে-ফলে ঘোলাটে পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়। অনাকাঙ্ক্ষিত বিপর্যয় ডেকে আনে। অপ্রত্যাশিতভাবে বয়ে আনে অভিশাপ।

সৃষ্টি হয় নানা বিভ্রান্তির। জ্ঞানের জগৎটা বিশাল। জীবন ও জগৎ থেকে, প্রকৃতি থেকে, বাস্তবতা থেকে শিখার আছে। জ্ঞানকে সমৃদ্ধ করার জন্য শুধু বই পড়াই যথেষ্ঠ নয়। এতে জ্ঞান পরিপূর্ণ হয় না, শুধু তত্ত্ব তৈরি হয়; সে তত্ত্বের প্রয়োগের জন্য উপযোগী জ্ঞানের শূন্যতা বিরাজ করে।

তবে হ্যাঁ তাত্ত্বিকেরও প্রয়োজন আছে; সেটি আমি অস্বীকার করি না। জ্ঞানের আলোকে সর্বস্তরে ছড়ায়ে দিতে হলে জ্ঞানাহরনের পদ্ধতিতেও ব্যাপক পরিবর্তন আনতে হবে। সীমিত সিলেবাস সংকীর্ণ দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন আবশ্যক। পৃথিবীতে অনেকেই নিজেকে সীমাবদ্ধ একটা পরিসরে আবদ্ধ করে ফেলতে চায় না, সীমানা বা সীমারেখাকে অতিক্রম করে যায়। চিন্তা করি, যারা লিখে বিশ্বজোড়া সুনাম, সুখ্যাতি ছড়িয়েছেন, মানুষকে আলোকিত করেছেন, সমাজকে শান্তিময় করতে ভূমিকা রেখেছেন, তাদের লেখা পড়লে, জীবনী পড়লে অনেক কিছুই জানা যাবে, শিখা যাবে; জ্ঞান উত্তরোত্তর সমৃদ্ধি হবে।

হৃদয়ের সর্বোচ্চ ভালবাসায় সিক্ত স্থানে সমাসীন বইয়ের সাথে মিতালী করি। যেন মুক্ত বাতাসে দম নেই, প্রশান্তির নিঃস্বাস বের হয়। সময় ও যুগের দাবি পূরণের উপযুক্ত যোগ্যতা সম্পন্ন ব্যক্তিত্ব হিসেবে গড়ে উঠার স্বপ্ন দেখি, চেষ্টা করি। লেখনী তৈরি জ্ঞানচর্চার উচ্চতর মাধ্যম। বক্তার বক্তৃতা শ্রোতা পর্যন্ত সীমাবদ্ধ থাকলেও লেখকের লেখা অনন্তকাল ধরে অসংখ্য মানুষের কাছে পৌঁছায়।

ভাল একজন লেখক তাই লাভ করে চির অমরত্ব। লিখতে হলে বেশি বেশি পড়ার বিকল্প নেই। গড়ে তুলতে হবে ব্যক্তিগত ও পারিবারিক লাইব্রেরী। বিশ্বকবি নোবেল বিজয়ী রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গ্রন্থাগারকে 'মহাসমুদ্রের শত বৎসরের কল্লোলের' সাথে তুলনা গ্রহণযোগ্য ও যৌক্তিক নিঃসন্দেহে। আমাদের জ্ঞানে সমৃদ্ধ হতে হবে।

অজানাকে জানার আগ্রহ মানুষের সহজাত প্রবৃত্তি। জ্ঞানের সন্ধানে মানুষ পৃথিবীর দুর্গম অঞ্চল, অপারসমুদ্র ও মহাশূন্যে বিচরণ করে অর্জন করছে নিত্য নতুন জ্ঞান। জ্ঞান আহরণে কার্পণ্য প্রদর্শন বুদ্ধিহীনতার চরম দৃষ্টান্ত স্থাপন। যারাই পৃথিবীতে চির অমরত্ব লাভে ধন্য হয়েছেন তারা জ্ঞানহীন ছিলেন না। মানব সভ্যতার ইতিহাস সাক্ষী কালের ঘূর্ণিপাকের বিবর্তনে সৃষ্ট সমস্যা ও সংকটাপন্ন পৃথিবী যে মহাপুরুষদের আবির্ভাবে ধন্য হয়েছে তারা সবাই জ্ঞান সাধনা করেছে।

যাদের প্রেমের অমৃত সেচনে দুঃখ তপ্ত মানব-চিত্ত স্নিগ্ধ হয়, মানব সমাজের যুগ-যুগান্তরের কুক্ষিগত কালিমা ও রশ্মির মধ্য হতে সূর্যের ন্যায় উত্থিত হয়ে পাপের কুহক যারা ভেঙ্গেছেন তারা অনেক কষ্ট ও ত্যাগ স্বীকার করেছেন। সত্য ও প্রেমে সঞ্জীবিত করে সুন্দর জীবন পথে যিনি টেনে নেবেন তাকে গতানুগতিক হলে চলবে না। যে জ্ঞানী মানসিকভাবে স্বার্থপর ও সংকীর্ণ চিন্তাধারার অধিকারী তার দ্বারা মানবতার খুব বেশি কল্যাণ হয় না। মানসিক স্বার্থপরতা জগতের কোনো কল্যাণকে সাধন করতে পারে না। স্রোতহীন নদীতে যেমন অজস্র শৈবালদল এসে নিজের স্থান দখল করে নেয় এবং স্রোতধারায় বাঁধা সৃষ্টি করে মানসিক স্বার্থপরতা তেমনি ব্যক্তির মানসিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক বিকাশ, উন্নতি ও অগ্রগতিকে ব্যাহত করে।

সে নবীনদের দ্বারাই সমাজে গঠনমূলক পরিবর্তন সম্ভব যাদের জ্ঞানসাধনার অদম্য স্পৃহা রয়েছে, নিঃস্বার্থভাবে নিজেকে বিলিয়ে দেবার প্রস্তুতি রয়েছে, নিজেদের মেধা মনন ও যোগ্যতার বিকাশে সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা রয়েছে, কর্মস্পৃহা রয়েছে। বড় চিন্তা না করলে বড় কাজ হয় না। সুতরাং শারীরিক শক্তি, ব্যবহার করতে হবে মাটি ও মানুষের কল্যাণে। পরের সেবায় নিজেকে নিয়োজিত করার মানসিকতা হৃদয়ে এক দারুণ প্রশান্তি ছড়ায়। নিজের ভাগ্য পরিবর্তনে নিজে উদ্যোগী না হলে কখনোই সৌভাগ্যদান করে না।

সেটি আশাও করা যায় না। জ্ঞানী মানুষই সত্যিকার মানুষ। চরিত্রবান, সৎ এবং যথার্থ মূল্যবোধ সম্পন্ন মানুষকে অর্থের দ্বারা কেনা যায় না। অর্থের প্রভাব প্রবল হলে অনেক সময় সত্যের কণ্ঠস্বর শুনা যায় না। জ্ঞানও অর্থ আনতে পারে।

এর মানে জ্ঞানার্জনের উদ্দেশ্য শুধুমাত্র অর্থ উপার্জন-এটা ঠিক নয়। চাঁদের জন্য লক্ষ স্থির করলে যদি লক্ষ ভ্রষ্টও হয় তবে অন্তত তারকা হওয়া সম্ভব। জ্ঞানীরা মস্তিষ্কের উর্বরতা ও তার প্রয়োগে ফলাফলটা বিচার করেই মূল্যায়ন করে ব্যক্তিকে। আবশ্যকতাবোধ না জাগলে উদ্যমশীলতা জাগে না। আদর্শের তাত্ত্বিকতা ও জগতের বাস্তবতাকে মিলিয়ে বুঝাটা জরুরী|অপরকে তুচ্ছ জ্ঞান করার অর্থ নিজের জ্ঞানের পরিধিকে সংকীর্ণতার বেড়াজালে আবদ্ধ করা।

জ্ঞানের প্রয়োগেই স্বাথকতা। অজিত জ্ঞান, শিক্ষা, অভিজ্ঞতা ব্যবহারিত না হলে তা বড়ই মূল্যহীন হয়ে পড়ে। যে জ্ঞানকে উৎপাদন করে, পুনরুৎপাদন করে কিংবা ব্যবহার করে উভয়েই জ্ঞানী। কিন্তু জ্ঞানকে সংরক্ষণ বা ধারণকরাটা অনেক সময় অথহীন বিবেচিত হতে পারে। কারণ শুধুই তথ্য সমৃদ্ধ মগজধারীকে অন্যের দয়া ও অনুকম্পা নিয়েই অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে হয়।

ফলে জ্ঞান অজনই যথেষ্ট নয় চচা বা অনুশীলনটা গুরুত্বপূণ বটে। একটি লাইব্রেরী কিংবা বই যেমন অনেক তত্ত্ব আর তথ্যের ভান্ডার তেমনি তত্ত্ব আ তথ্য সমৃদ্ধ মগজধারী ব্যক্তিও ঠিক তেমনি নিথর, নিস্তব্ধ, নিরব। মূলত সংরক্ষণ করার সামথ্যই শুধুমাত্র মূল্যবান এমনটি নয় বরং প্রয়োগ, ব্যবহার ও চচাটাই মূখ্য। লাইব্রেরী বা বই জড়, লেখক-পাঠক জীব; জড় থেকে জীব কিছু সংগ্রহ বা আহরণ করতে পারে কিন্তু প্রয়োগ ও চর্চা না করলে কিছুই জীবন্ত হয়ে ওঠেনা,প্রাণচাঞ্চল্য বা প্রাণপ্রাচুযতা আসেনা। অপদাথ ও অক্ষম বিবেচিত হবার জন্যে এটাই যথেষ্ট যে,অভিজ্ঞতা ও শিক্ষাকে কাজে লাগাতে পারছেনা।

কারো খাদ্য আছে কিন্তু খাবার সামথ্য নেই, সম্পদ আছে কিন্তু সম্পদ ব্যয়ের ক্ষমতা নেই- এর যে অবস্থা ঠিক তেমনি পুথিঁগত বিদ্যানের অবস্থা। বই, লাইব্রেরী কিংবা কম্পিউটারের যেমন নিজস্ব ক্ষমতা নেই; পরিবতন, পরিবধন বা পরিমাজনের সিদ্ধান্ত নেয়ার সামথ্য নেই ঠিক বাস্তবক্ষেত্রে প্রয়োগে অক্ষম বিদ্যান, জ্ঞানীকেও অন্যের উপরই নিভরশীল হয়ে চলতে হয়। সে ব্যবহারিত হয়, অন্যের সিদ্ধান্তে পরিচালিত হয়, অন্যের পরিকল্পনা বাস্তবায়নের হাতিয়ার হিসাবে টিকে থাকে। ফলে জ্ঞান অজনের পাশাপাশি তা প্রয়োগে সক্ষম হিসাবে নিজেকে প্রস্তুত করতে পারাতেই কল্যাণ। আপনি কি আখ থেকে রস বের করার মেশিন দেখেছেন? যেখানে আখগুলো মেশিনের নিধারিত পদ্ধতি বা প্রক্রিয়ার সাথে যুক্ত হয়ে নিজেকে উজার করে দেয়।

সিস্টেমটা এমন যে, স্থান বা বৈশিষ্টগত পাথক্যের উধ্বে ওঠে তারা নি:সরণ করে রস, নি:শেষ হয় সবটুকু বিলিয়ে। কৌশলটা শক্তিশালী হওয়ায় সব আখের ভাগ্যে একটি নিদিষ্ট পরিণতিই এসেছে এবং নিয়ন্ত্রক বা পরিচালকের উদ্দেশ্যানুযায়ী ব্যবহারিত হয়ে নিয়ন্ত্রকের কাংখিত ফলাফল হাসিলে চূড়ান্তভাবে ভুমিকা রেখেছে। কিন্তু যে ব্যবহারিত হচ্ছে, সে যদি খাঁটি না হত বা ভেঁজাল হত অথাৎ আখ না হয়ে লোহার রড ঢুকলে সিস্টেমটাই অচল হবে,মেশিনটাই বিকল হবে। এক্ষেত্রে সতকতা পরিচালকের, আয়োজকের। কিন্তু প্রতিষ্ঠিত সিস্টেমের সাথে মিলে মিশে একাকার হয়ে সমপণ করেছে যে আখগুলো তারা কিন্তু রসটা পায় না।

সিস্টেমটা টিকিয়ে রাখার স্বাথে আখগুলো জরুরী বটে কিন্তু তারা সুবিধাভোগী নয়, বিলিয়ে দেয়াতেই যেন তাদের ধম হয়ে পড়ে। তাই মূলত সিস্টেমটাকে সচল রাখার জন্যে যারা গুরুত্বপূণ তারা মেশিনকে সচল রাখতে প্রয়োজনীয় তৈলের মতই ক্রিয়াশীল। আমার দৃষ্টিতে কোন প্রতিষ্ঠিত সিস্টেমের সাথে একাকার হয়ে অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখা নি:সন্দেহে সহজ, স্বাভাবিকভাবেই সরল পদ্ধতি। যারা সিস্টেম গড়ে তুলেন আর যারা তা টিকিয়ে রাখতে ব্যবহারিত হনতারা এক নয়। কোন প্রতিষ্ঠিত ব্যবস্থাকে চ্যালেঞ্জ করে নতুন সিস্টেম দাঁড় করানো মোটেই সহজ কাজ নয়।

সুতরাং নিরুপায় বা বাধ্য হয়ে সম্পৃক্ততা আর সম্পৃক্ত থেকে আনন্দ লাভ ও উপভোগ্য মনে করতে পারার অবস্থা একই রকম নয়। ফলে আপনি পুরাতন প্রথাকে চ্যালেঞ্জ করলে সেই প্রক্রিয়া থেকে যারা সুবিধাভোগী ছিল নিশ্চিত তারা এটাকে ভালভাবে নেবেনা। ফলে নতুনকে পুরাতন ব্যবস্থার শক্তির চেয়ে কিছুটা বেশি শক্তি নিয়েই টিকে থাকতে হবে। এটি ঠিক যে, প্রতিটি সিস্টেমেই কিছু সুবিধাভোগী থাকবে। তুলনামূলকভাবে যেটি বেশি যৌক্তিক,গ্রহণযোগ্য,অধিকাংশের জন্যে কল্যাণকর সেটিই গ্রহণযোগ্য বা উৎকৃষ্ট বিবেচিত হতে পারে।

ব্যক্তিগঠন বা আত্মগঠন না করে জাতি, ধম, মানবতার কল্যাণ বিধান করার চিন্তা অবান্তর। সুনিপুণ কারিগর না হয়েই বিরাট খেদমত করার স্বপ্ন হাস্যকর। ব্যক্তিকে উপেক্ষা করে সামষ্টিক ক্ষেত্রে সাফল্য দু:স্বপ্ন। বাস্তবতা বজিত আবেগই অনেককে চালিত করে। প্রয়োজনীয় দক্ষতা ছাড়া ব্যক্তি ড্রাইভার বা পাইলট হলে যেমন যাত্রীর জীবন বিপণ্ণ হবার সম্ভাবনা; সংগঠন বা সমাজের নেতৃত্বও তেমনি।

খেলোয়াড়কে মাঠে যেমন সুণিপুণতার সাথে পারদশীতা প্রদশন করেই প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করতে হয়, জরুরী অপারেশনের সময় রোগীর প্রতি ডাক্তারকে যেমন অত্যন্ত তীক্ষ্ণ নজর রাখতে হয়, সদা তৎপর ও সচেতন থাকতে হয় আসলে বিভিন্ন তত্ত্ব নিয়ে খেলা করার মত বুদ্ধিমান, জ্ঞানী, প্রজ্ঞাবান ও দূরদশী মানুষও তেমনি প্রয়োজন। বহুবিধ কনসেপ্ট সংক্রান্ত পরিচ্ছন্ন ধারণা ছাড়া,চচিত প্রসঙ্গে ব্যাপক দখল ও গভীর পান্ডিত্য ছাড়া বিদ্যমান জ্ঞানকে নিয়ে খেলা করে নতুন জ্ঞানের উৎপত্তি ঘটানো সম্ভব নয়। সাধারণ ও স্বাভাবিক স্তর পেরিয়ে যেতে পারলেই কেবল সম্ভব ভারি, রসকসহীন, শুষ্কতার মধ্য থেকেও রস বের করে নিয়ে আসা। পিপীলিকার মত পরিশ্রমী,মৌমাছির মত কারিগর হলেই কেবল সম্ভব বিশাল বিস্তৃত পরিসর থেকে মূল্যবান মণিমুক্তা বের করে আনা। প্রসারিত দৃষ্টি, উন্নত মগজ, উৎকৃষ্ট হৃদয় ও মানসিক হিম্মত ছাড়া জ্ঞানের জগতে প্রয়োজনীয় হয়ে ওঠা অসম্ভব।

সঠিকটাকে বাছাই তখনই সম্ভব যখন বিবেচনা ক্ষমতা থাকে তীব্র। বিচার করে সঠিক সিদ্ধান্ত নেয়া তখনই সম্ভব যখন সকল বিকল্প মত, পথ, পদ্ধতি সম্পকে থাকে স্বচ্ছ ধারণা। ডাক্তার না হয়ে যেমন প্রেসক্রিপশন দেয়ারই কোন অধিকার নেই তেমনি সংকীণতা, নীঁচুতার উধ্বে ওঠা ছাড়া, তূলনামূলক মূল্যায়নের ক্ষমতা অজন ছাড়া রায় দেয়া বা সমালোচনা করার কোন অধিকার নেই। জ্ঞানের উৎপাদন, পুনরুৎপাদন করার সক্ষমতা অজন করতে প্রবল সাধনার বিকল্প কোন সহজ পথ নেই।


সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.