আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

শুন্য

সময়ের সমুদ্রের পার--- কালকের ভোর আর আজকের এই অন্ধকার

আমার স্ত্রী মীরা অপারেশন টেবিলে সরলরেখার মতো লম্বালম্বি হয়ে শুয়ে আছে। গর্ভের প্রথম সন্তানকে তার পেট থেকে বের করার চেষ্ঠা চলছে। প্রথম বাচ্চারা একটু খ্যাপাটে ধরণের হয়। এই বাচ্চাও হয়েছে। কোনভাবেই মায়ের পেট থেকে বের হবে না।

ছয়জন ডাক্তার মিলে বাচ্চা আর বাচ্চার মাকে টানাটানি করছে । রশি টানাটানি খেলার মতো। একদিকে ছয়জন আরেকদিকে দুইজন। উৎসব উৎসব ভাব ঝিলিক মারছে সবার চোখেমুখে।



আমি অপারেশন থিয়েটারের বাইরে দাঁড়ানো।



অস্থিরভাবে পায়চারী করছি। দুঃশ্চিন্তায় কুকড়ে যাচ্ছি। ঘামে ভিজে চপচপে হয়ে গেছি। গায়ের লাল পাঞ্জাবীর রঙ্গ উঠে গলে পড়ছে। মনে হচ্ছে সন্ত্রাসীরা আমাকে চাপাতি দিয়ে কুপিয়ে লাশ বানিয়ে রেখে গেছে।

সব ঠিকঠাক রেখে গেছে, শুধু লাশটাকে মাটিতে ফেলে রেখে যেতে পারে নি। লাশ ঠায় দাঁড়িয়ে পায়চারী করছে। লাশ ফেলে রাখার এতো সময় সন্ত্রাসীদের নেই।



মীরাকে নিয়ে মারাত্মক টেনশন হচ্ছে। প্রসব বেদনা কতটা ভঁয়ংকর হতে পারে স্বচক্ষ্যে দেখেছি।

শরীরের সবকটা হাড় ভাঙ্গলে যে কষ্ট পাই, তার চাইতেও বেশী ব্যাথা সন্তান জন্মাতে। অসম্ভব ব্যাথা। নারীজাতি কিভাবে এই ব্যাথা সহ্য করে পুরুষজাতির কোনকালেই বোধগম্য ছিল না। আমারও নেই।



মীরাকে অসংখ্যবার অনুরোধ করলাম।

বাচ্চা হবে সিজারিয়ান ডেলিভারি। বুঝতে না বুঝতেই বাচ্চা খালাশ। সে কোন কথা শুনল না। পেটে বাচ্চা নিয়েই সারাবাড়ী মাথায় তুলল। আমি আতঙ্কিত হয়ে পড়লাম।

কথা এক পাও এগোল না।

ডেলিভারীর সময় অনেক মেয়েকে দেখেছি যারা মিঁচমিঁচ করে হাসে। এক মহিলার সিজারিয়ান ডেলিভেরি হচ্ছে। ডাক্তাররা তার পেটের মধ্যে ছুরি চালাচ্ছে আর মহিলা রবীন্দ্র সঙ্গীত গাইছে। রমনীর কিন্নর কন্ঠের গানের মোহমহতায় ডাক্তারের ছুরিও থেমে যাচ্ছে।

কি বিশাল ক্ষমতা নিয়েই না মেয়েরা পৃথিবীতে আসে।

অদ্ভুত! মেয়ে জাতি বড়ই অদ্ভুত!!



সৃষ্টিকর্তা যদি সুযোগ দিত, একটা কথা জিজ্ঞাসা করতাম। জানতে চাইতাম পেটে বাচ্চা আসলেই মেয়েরা কিভাবে খুশীতে লাফালাফি করে। নিশ্চিত ব্যাথার কথা জেনেও গর্ভবতী মেয়ের আত্মীয়-স্বজনরা কেন এভাবে আনন্দিত হয়। মাঝে মাঝে মনে হয় এই আনন্দ বড়ই পৈশাচিক।





একটা জীবন সৃষ্টির পৈশাচিক আনন্দে আমি মাততে পারছি না। মনমরা হয়ে অপারেশন থিয়েটারের বাইরে পায়চারী করছি। হাতে সিগারেট। মস্তিষ্ককে ঠান্ডা রাখতে নিকোটিনের বিকল্প এক জীবনে এখনো খুজে পাই নি।



হুট করে অপারেশন থিয়েটারের দরজা খুলে গেল।

সাদা এপ্রোনের ডাক্তাররা বের হলেন। সব ডাক্তার অত্যন্ত দুঃখী দুঃখী আর কঁরুন মুখে আমার দিকে তাকাল।

আমি ভয় পেলাম। এই হাঁসি নিশ্চিত দুঃসংবাদের আলামত। সাধারনত রোগীর মৃত্যুও একজন ডাক্তারের মুখে বিচলিত ভাব আনতে পারে না।

কিন্তু এই ডাক্তারের মুখে এসেছে।



রোগী মরে যাচ্ছে আর ডাক্তাররা হাসতে হাঁসতে ধাঁরালো ছুরি-চাকু দিয়ে রোগীর পেট এফোঁড়-ওফোঁড় করছে। মন খারাপ করে, কান্নাকাটি করে লাভ নাই। রোগী বাঁচাতে হবে। অপারেশনের দীর্ঘসময়টাতে তারা বিচিত্র সব কর্মাকান্ডে মেতে থাকে।

এক পরিচিত ডাক্তার আছে যিনি, অপারেশনের সময় তার পোষা কুকুরটাকে সাথে করে আনেন। কুকুরের জন্য আলাদা মাস্ক-গ্লভস-টুপি। ডাক্তার কিছুক্ষন অপারেশন করেন, কিছুক্ষন কুকুরকে খাবার খাওয়ান। বিচিত্র কারনে কুকুরটা কিছু খেত না। রক্ত মাখা নাড়ী ভুঁড়ির দিকেই তার মনযোগ কেন্দ্রীভূত।

বিদেশী কুকুর হল তো কি? কুকুর তো। দেশী কুকুরদের মতো দৃষ্টি সমসময় রক্তে আর মলে।



পাঠকদের জন্য আরো একটা নমুনা দিচ্ছি...

পেট কেটে অপাঁরেশন হচ্ছে।

দীর্ঘদিনের পরিচিত একজন স্যার অপারেশন করছেন। কাঁটাকাটির সমানে অশ্লীল অশ্লীল কৌতুক চলছে।

বত্রিশ দন্ত উন্মুক্ত করে হাঁসতে হাঁসতে রোগীর টেবিলে গড়িয়ে পড়ছে ছাত্র-ছাত্রীরা।

‘বলতো রে বাঙ্গালীদের হাতে কয়টা আঙ্গুল?

ছাত্র-ছাত্রীরা শেয়ালের মতো একসাথে হুক্কা-হুয়া করে বলে,

‘দশটা স্যার। পাক্কা দশটা। ’

‘গুনে দেখেছিস?’

‘অবশ্যই স্যার। আমাদের সবার হাতেই দশটা করে।

এই দেখেন স্যার গুনে দেখাচ্ছি। এক দুই তিন চার.........দশ। ’

এবার স্যার তার অদ্ভুত ভঙ্গীটা করবেন। কিছুক্ষন চোখ পিটপিট, তারপর ঘাড়টাকে কয়েকবার ঘুরাবেন।

‘ভুল বললি রে গাধা।

বাঙ্গালীদের হাতে আটটা আঙ্গুল। ’

‘হতেই পারে না স্যার। ’

‘কেন হতে পারে না গাধা? একটা আঙ্গুল বাঙালীরা সব সময় আরেকজন বাঙ্গালীর পশ্চাতদেশে ঢুকিয়ে রাখে। চিরচেনা স্বভাব। আরেকটা আঙ্গুল কি করে বলতো?

ছাত্ররা মুখ টিপে টিপে হাসছে।

মেয়েদের দৃষ্টি অবনত। তারা লাজ রাঙ্গা হয়ে আছে। চেহারায় ফুটিয়ে তুলছে, ‘স্যার কি বলছেন এসব?

স্যার অপারেশন চালাচ্ছেন আর দিগুন উৎসাহে বলছেন,

‘আরেকটা আঙ্গুল ঢুকিয়ে রাখি নিজেদের পশ্চাতদেশে। যাতে আরেকজন বাঙালী আমাদের পশ্চাতদেশে আঙ্গুল না ঢুকাতে পারে। ’

আমরা পুরোপুরি হতভম্ভ হয়ে গেলাম।

অশ্লীল কৌতুকের প্রাথমিক ধকল কাটার পর সবাই একযোগে হাসাহাসি শুরু করলাম। অত্যন্ত আশ্চর্যের বিষয়, সাথে সাথে রোগীটাও মারা গেল। মৃত্যুতে ডাক্তারের ভুল ছিল না।

ডাক্তারের মুখে কোন বিচলিত ভাব আসল না। হাসতে হাসতেই লাশ সরিয়ে আরেকজনে আনা হলো।

শুরু হল আরেকবার অপারেশন। সাথে সাথে অশ্লীল জোকস।



আজকে ডাক্তারদের বিচলিত ভাব কিসের জন্য আসছে? আমার স্ত্রী-বাচ্চার কিছু হয়েছে কি?

আমি ভাবতে পারছি না। নিজের ইস্পাত-কঠিন নার্ভের সমস্ত আত্ম-বিশ্বাস হারিয়ে ফেললাম। ভয়ংকর কিছু শোনার জন্য প্রস্তুত।



ডাক্তার আমার কাঁধে হাত রেখে বলল,

'সরি ইয়াং ম্যান। '

আমার ভয় চুড়ান্ত সীমা অতিক্রম করল। এই অবস্থায় মাথাঘুরে পড়ে যাওয়া উচিৎ। আমি পড়লাম না। কারনে অকারনে মেয়েরা মাথাঘুরে পড়বে।

আমি পুরুষ মানুষ। আমার পড়লে চলবে না। যেকোন কঠিন খবরের জন্য প্রস্তুত হতে হবে। আমি প্রস্তুত হলাম। বউ-বাচ্চার মৃত্যুর সংবাদ দিলে হাসিমুখে নিতে হবে।

আগামী চল্লিশায় গরু মাংসের দাওয়াত আজকেই দিয়ে রাখতে হবে। মুখে হাঁসি এনে কোন মতে বললাম,

"ইটস ওকে, ওল্ড ম্যান। '

ডাক্তার হঁকচকিয়ে গেল।

ডাক্তারদের আত্ম-সম্মানবোধ প্রবল। ‘ওল্ডম্যান’ বলায় রাগ করতে পারে।

আমি অবশ্যি রাগ করার কোন কারন দেখিনা । আমাকে কেউ ‘ইয়াংম্যান’ বললে আমি তাকে ‘ওল্ডম্যান’ কেন বলতে পারব না?

ডাক্তারের দিকে তাকালাম। তার সমস্ত শ্বেত শুভ্র দন্ত একত্রে বিকশিত হয়েছে। একটাও পড়ে নি। অপারেশন থিয়েটারের টুপি মাথায়, তাই মাথার চুলগুলো দেখতে পাচ্ছি না।

দেখতে পেলে বয়স সম্পর্কে পুরোপুরি নিশ্চিত হওয়া যেত। যদিও ডাক্তার সম্প্রদায়ের মাথার কেশরাজি দেখে বয়স নির্ধারন করা অসম্ভব।

আমি আমার ভুল দ্রুত শুধরে ফেললাম। বিতর্কের মধ্যে না গিয়ে বললাম,

‘ইটস ওকে ম্যান। ’

শুধু ‘ম্যান’ বলায় সাপ মরল কিন্তু সাপ মারতে ব্যবহৃত তল্লা বাঁশ অখ্যাত থাকল।



ডাক্তার আরেকবার হকচকিয়ে গেল।

আশ্চর্য!! একজন সার্জন যদি কথায় কথায় হকচকিয়ে যায় তাহলে হবে কিভাবে? হকচকিত ডাক্তারের ভীত ঘর্মাক্ত মুখ দেখলে রোগীও তো ভয় পেয়ে যাবে। অপারেশনের টেবিল থেকে অজ্ঞান করা রোগীরাও “ইয়া শাফি... ইয়া মাফি” বলে ভয়ে লাফ দিয়ে দৌড়ে পালাবে।

আমি পরিস্থিতি শান্ত করতে বললাম,

‘বাঁচ্চার মা কি মারা গেছে? সাথে সাথে বাচ্চাও?’

সার্জন আবার হকচকিয়ে হলো। অদ্ভুত! এই লোকের কি কোন মানসিক সমস্যা আছে? মানসিক সমস্যা নিয়ে সার্জন হলো কিভাবে বোঝা যাচ্ছে না।



পরিস্থিতি সামাল দিতে আমি হাঁসতে শুরু করলাম। হো হো করে হাসতে হাসতে ডাক্তারদের গায়ে উলটে পড়ার সিদ্ধান্তও নিয়ে ফেললাম।

সিদ্ধান্ত মাঝ মাঠে গুরুতর আহত গেল । ডাক্তারদের পেছন থেকে একজন নার্স বের হয়ে আসল।

হাতে সাদা ধবধবে পোটলা।

সাদা পোটলা হাতে দিয়ে বললেন,

‘আপনার ছেলেকে নেন। ’

এবার আমি চমকালাম। আনন্দে আত্মহারা হলাম। খুশীতে লম্ফঝম্ফ টাইপ আত্মহারা। আমার সন্তান।

একমাত্র এবং প্রথম সন্তান। জীবন এবং মৃত্যুর যোগযুত্র। আমার স্ত্রীর সাথে ভালোবাসা-বাসির প্রথম পুষ্প।

ডাক্তার হাসিমুখে আমার ঘাড়ে হাত রাখল। হাঁসতে হাঁসতে বলল,

‘ইয়াং ম্যান, বাচ্চার নাম কি রেডি আছে?’

আমি হাসির দেনা হাসিতেই শোধ দিলাম।

কোমল গলায় বললাম,

‘জ্বী আছে। বাচ্চার মা নিজে এই নাম নাযেল করেছে। নাম বদলালে কেস খাওয়ানোর হুমকী দিয়েছে। ’

ডাক্তার উৎসুক হয়ে জিজ্ঞাসা করল,

‘কি নাম?’

আমি আমাদের সন্তানের মুখে তাকালাম। আমাদের ভালোবাসায় পৃথিবীতে আসা একমাত্র বংশধরের কঁপালে আলতো করে নিজের নিকোটিনে বিষাক্ত ঠোট ছুয়ে দিলাম।

আমার মত অভাজনের ঐরশে আসা একমাত্র স্বর্গীয় পুষ্পটির দিকে তাকিয়ে বললাম,

‘শুন্য। ’

‘শুন্য রাখার মানে কি?’

‘কিছু না। ’

‘তাহলে আপনার স্ত্রী এই নাম রাখার জন্য কেস খাওয়ানোর ভয় দেখাল কেন?’

‘সে ভালো জানে। ’

‘আজব বিষয়। আপনার ছেলে আপনিই তার নামের মানে জানেন না।

হাস্যকর!’

‘হাস্যকর কিছু নেই এখানে। সব কিছুত মানে থাকতে হবে কে বলেছে? মানে না থাকাই এখানে চমক। আমি চমকটা গ্রহন করেছি। বলতে পারেন, অতি আনন্দের সাথেই গ্রহন করেছি। আমার সন্তানও জন্মের প্রথম চমক আজকেই পেয়ে গেল।

সমগ্র জীবন তাকে এই চমক সাথে করে বয়ে বেড়াতে হবে। সবাই জানতে চাইবে তার বাবা-মা কেন এই নাম রাখল, সে বলতে পারবে না। শুধু তার বাবা-মা জানবে ‘শুন্য’ হলো পৃথিবীর প্রথম ও শেষ চমক। ’



'শুন্য'-রাজীব হোসাইন সরকার(https://www.facebook.com/nillchokh)

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।