আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

হিন্দু জনপদে জামায়াতি তা-ব আরেক '৭১ তৈরির ষড়যন্ত্র



হামলা, লুটপাট, ভাঙচুর ও হত্যাযজ্ঞ চালিয়ে আরেকটি একাত্তর সৃষ্টির চেষ্টা করছে একাত্তরের ঘাতকচক্র জামায়াত-শিবির। এ ক্ষেত্রে তারা প্রধান টার্গেট হিসেবে বেছে নিচ্ছে হিন্দু জনগোষ্ঠীকে, যেন হিন্দুদের ওপর হামলার মাধ্যমে ব্যাপক সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা সৃষ্টি করা যায়। এর পরের টার্গেট হলো আওয়ামী লীগসহ মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী সমর্থক জনগোষ্ঠী, যেন তাদের ইসলামবিরোধী আখ্যা দেয়া যায়। টার্গেট অনুযায়ী জামায়াত-শিবির একের পর এক হামলা, নাশকতা, তা-ব চালিয়ে যাচ্ছে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বন্ধের মূল লক্ষ্য অর্জনে।

১৩ ডিসেম্বর রাত সাড়ে ১২টা।

ততক্ষণে যুদ্ধাপরাধী কাদের মোল্লার ফাঁসির খবর সারাদেশে ছড়িয়ে পড়েছে। আর ফাঁসির প্রতিশোধ নিতে জামায়াত-শিবির চক্র হিংস্্র ও ক্ষুধার্ত হায়েনার মতো সারাদেশে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী লোকজনের গ্রাম, বাড়ি, ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে ধারালো অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ছে। দিনাজপুরের খানসামা উপজেলার রামনগর এবং চিরিরবন্দর উপজেলার ভুষিরবন্দরে সেদিন জামায়াত-শিবির যে তা-ব চালায় সেই ভয়াল রাতের কথা বলতে গিয়ে এখনও আঁৎকে ওঠেন ওই এলাকার ক্ষতিগ্রস্তরা।

১৮ ডিসেম্বর সকাল ১০টায় রওনা দিলাম জামায়াত-শিবিরের হামলায় ক্ষতিগ্রস্ত এলাকা চিরিরব্দরের ভুষিরবন্দর ও খানসামার রামনগর যাওয়ার জন্য। ভুষিরবন্দর দিনাজপুর জেলা সদর থেকে ২৫ কিলোমিটার দূরত্বে।

এরপর আরও ৮-৯ কিলোমটার দূরে রামনগর। অবরোধ কর্মসূচির কারণে নিজের মোটরসাইকেল না নিয়ে একবার রিকশা, দুইবার অটোবাইক এবং দুইবার রিকশাভ্যানের সাহায্য নিয়ে আমি ক্ষতিগ্রস্ত এলাকায় যাই। যাতায়াতে আমার খরচ হয় আড়াইশ' টাকা। অথচ স্বাভাবিক পরিস্থিতিতে একশ' টাকাও খরচ হতো না।

অবরোধের নামে শত শত গাছ কেটে রাস্তায় রাস্তায় প্রতিবন্ধকতা তৈরির চেষ্টা এখন যেন একটা সাধারণ বিষয় হয়ে গেছে।

দিনাজপুর থেকে দশমাইল-রামডুবি হয়ে ভুষিরবন্দর যাওয়ার পথে এরকম শত শত কাটা গাছ দেখা গেল। ১৮ ডিসেম্বর সকালেও তুলা উন্নয়ন বোর্ড কার্যালয়ের সামনে থেকে রামডুবি পর্যন্ত রাস্তার উপর অনেক গাছ পড়েছিল। কিন্তু বিজিবি এসে সেসব গাছ সরিয়ে ফেলায় অটো, ভ্যান, রিকশা, মোটরসাইকেল চলছে প্রচুর পরিমাণে।

রামনগর খানসামা উপজেলার ৫নং ভাবকি ইউনিয়নের একটি প্রত্যন্ত গ্রাম। এর অবস্থান রসুনের জন্য বিখ্যাত কাচিনিয়া বাজার থেকে প্রায় পাঁচ কিলোমিটার দক্ষিণে।

এ গ্রামের কয়েকটি হিন্দু পরিবার যুদ্ধাপরাধী কাদের মোল্লার ফাঁসির রাতে জামায়াত-শিবিরের পরিকল্পিত ও ভয়ঙ্কর হামলার শিকার হন। জামায়াতি তা-বে সেই রাতে গ্রামটির ফোকাসাপাড়া নিবাসী গৌরহরি শাহ'র ১০০ বিঘা জমির ১৬টি ধানের গোলাসহ বাইরের খোলানে থাকা ৫টি ঘর, নিখিল চন্দ্র রায়ের দুটি শোয়ার ঘরসহ ঘরের সব মালামাল, নিরঞ্জন রায়ের দুটি ঘরের সব মালামাল, রামনগর-ম-লপাড়া নিবাসী ফনীন্দ্রনাথ রায়ের বাড়ি ও ধানের গোলায় আগুন লাগিয়ে সব কিছু পুড়িয়ে দেয়া হয়।

এ রাতেই ভুষিরবন্দরে ব্যবসায়ী ও দিনাজপুর জেলা মোটর পরিবহন মালিক গ্রুপের সভাপতি ভবানী শংকর আগরওয়ালার বাড়ি ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে হামলা, ভাঙচুর ও লুটতরাজ চালানো হয়। তার ৭টি ট্রাকে আগুন লাগিয়ে জ্বালিয়ে দেয়া হয়। দুটি গোডাউন ভর্তি সারসহ কোটি টাকার মালামাল লুট করা হয়।

চিরিরবন্দরের ১১নং তেঁতুলিয়া ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান সুনীল কুমার সাহার ২০ বিঘা জমির ধানও আগুন লাগিয়ে পুড়িয়ে দেয়া হয়। হামলাকারীরা লোকজনকে বেদম মারধরও করে। হামলাকরীরা ৪নং খামারপাড়া ইউনিয়নের দঃ বালাপাড়ায় বটেরহাটে অবস্থিত গৌরহরি শাহ'র হাসকিং মিলের মিটার, মর্টার ও বারান্দার চালা ভেঙে ফেলে। কালির বাজারে অবস্থিত নিরঞ্জন রায়ের ওষুধের দোকানটি ভেঙে তছনছ করে।

সেই রাতে দুই থেকে তিন হাজার লোক ধারালো অস্ত্র, লাঠিসোটা, মশাল নিয়ে নারায়ে তাকবির সেস্নাগান দিয়ে হিন্দু জনপদগুলোতে হামলা চালায়।

তবে কারা হামলা চালিয়েছে, তা বলছেন না কেউ। এ প্রতিবেদক গত ১৮ ডিসেম্বর ক্ষতিগ্রস্ত রামনগর মহল্লায় গিয়ে জানতে চান, হামলার সঙ্গে কারা জড়িত? কিন্তু গ্রামটির সবাই তখনো আতঙ্কগ্রস্ত। ভয়ে কেউ কোন ব্যক্তি বা দলের নাম বলতে রাজি হননি।

৭৮ বছর বয়সী গৌরহরি হামলার সময় বাড়ির দরজা খুলে বাইরে এসেছিলেন হামলাকারীদের নিবৃত্ত করতে। কিন্তু হামলাকারীরা তাকে দেখেই 'এই যে মালাউন পাওয়া গেছে' বলে তার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে এবং বেদম মারধর করে।

সেই মারে জ্বর এসে যায়। একটি লাঠির প্রচ- আঘাতে তার ডান হাতের উপরের অংশে বিরাট কালশিরা দাগ পড়েছে। সেই দাগ দেখিয়ে জ্বরে কাঁপতে কাঁপতে বললেন, স্বাধীন দেশে এভাবে কেন আমাদের মার খেতে হবে? আমাদের কি অপরাধ?

৭০ বছর বয়সী ফনীন্দ্রনাথ রায় বলেন, কাদের মোল্লার ফাঁসি হয়েছে কি হয় নাই, আমরা জানতাম না। কিন্তু কাদের মোল্লার ফাঁসির রাতে হঠাৎ করে হাজারখানেক লোক একসঙ্গে আমাদের গ্রাম ঘেরাও করে আগুন লাগানো শুরু করে। তারা বেছে বেছে হিন্দুদের বাড়িতে আগুন দেয়।

তারা চিৎকার করে বলতে থাকে 'হিন্দুক ধরো, আগুন লাগাও। ' কেউ কেউ বলতে থাকে 'গণহত্যা হবে, সব হিন্দুকে কচুকাটা করা হবে। '

খানসামার রামনগর অথবা চিরিরবন্দরের ভুষিরবন্দরে হামলাকারী পুরুষদের সঙ্গে অনেক মহিলাও ছিল! তারা ছিল পুরুষদের পেছনে। পুরুষরা ধারালো অস্ত্র আর মশাল নিয়ে হিন্দু বাড়ি ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে হামলা, ভাঙচুর, অগি্নসংযোগ আর লোকজনকে মারধর করছিল, অপরদিকে তাদের পেছনে থাকা মহিলারা বস্তা ও ব্যাগের মধ্যে ওইসব বাড়ি ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের মূল্যবান মালামাল ঢুকিয়ে নিচ্ছিল। একথা জানান রামনগরের বিমল রায়।

তিনি বলেন, রাজনৈতিক প্রতিহিংসা চরিতার্থ করার পাশাপাশি লুটপাট করাও হামলাকারীদের অন্যতম উদ্দেশ্য ছিল।

ভুষিরবন্দরে হিন্দুদের বাড়ি ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে হামলা হয়েছে আগেও। সম্প্রতি অবরোধের সময়গুলোতে এ হামলার ঘটনা ঘটে। হামলায় হিন্দুদের ১০-১২টি বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান ও দোকান ভাঙচুর হয়। এ হামলার সঙ্গে জামায়াতের পাশাপাশি স্থানীয় বিএনপিও জড়িতরা।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন ভ্যানচালক জানান, হিন্দুদের দোকানপাটে হামলার পেছনে বিএনপি নেতা আবুর মদত আছে। এ কারণে ক্ষতিগ্রস্তরা আবুর দোকানও বন্ধ করে দিয়েছে। ক্ষতিপূরণ না দিয়ে অথবা কোন সমঝোতায় না এসে আবু দোকান খুললেই ওই দোকান পুড়িয়ে দেয়া হবে।

খানসামার রামনগর এবং চিরিরবন্দরের ভুষিরবন্দর বসবাসরত হিন্দু জনগোষ্ঠী এখনও আতঙ্কের মধ্যে আছে। আবারও হামলার শিকার হওয়ার আশঙ্কা করছেন কেউ কেউ।

সাবেক ইউপি সদস্য গণেশ চন্দ্র রায় বলেন, দেশে রাজনৈতিক হানাহানির জের ধরে নিরীহ হিন্দুদের ওপর কাপুরুষের মতো হামলা চালানো হচ্ছে। এ হামলা বন্ধ না হলে পরিণতি খুবই ভয়ঙ্কর হয়ে উঠতে পারে। কাচিনিয়া হাই স্কুলের প্রাক্তন শিক্ষক ক্ষণিষ চন্দ্র রায় বলেন, হিন্দুদের নিরাপত্তায় সরকারের উপযুক্ত ব্যবস্থা নেয়া উচিত।

জামায়াত-শিবিরের রাষ্ট্রবিরোধী-গণবিরোধী কর্মকা-ের বিরুদ্ধে সরকার যখনই কোন অ্যাকশন নেয় তখুনি তারা হিন্দু জনগোষ্ঠীসহ সংখ্যালঘুদের ওপর তা-ব চালিয়ে সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্প ছড়ানোর চেষ্টা করে। এ ধরনের গণবিরোধী কর্মকা-ের বিরুদ্ধে সরকারের কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণের পাশাপাশি জনগণের পজেটিভ ভূমিকাও প্রয়োজন।

দিনাজপুরের রামনগর ও ভুষিরবন্দরে ১৩ ডিসেম্বর জামায়াত-শিবির কাপুরুষোচিতভাবে নিরীহ হিন্দুদের ওপর যে বর্বরোচিত তা-ব চালিয়েছে তেমন ঘটনা তারা দেশের আরও অনেক সংখ্যালঘু অঞ্চলেই ঘটিয়েছে। এর আগে চিরিরবন্দরের বলাইবাজার, কক্সবাজারের রামুতেও তারা একই রকম ঘটনা ঘটিয়েছে। সাম্প্রদায়িকতাই তাদের রাজনীতি এটা তারা বারবার প্রমাণ করেছে। তাদের এ অপরাজনীতির মোকাবিলা সরকার ও জনতা সবাইকে সম্মিলিতভাবে করতে হবে।

 


অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.