আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

হেলিকপ্টারে চড়ে হিমালয়-জয়ী কে এই বঙ্গমানব?

জাগো মানুষ আজ জাগো, ভেবনা তুমি বাঙালী কি বাংলাদেশী....কেটে যাবে রোদ ভাঙ্গবে আঁধার, আমি দেখব মাগো তোমার মুখের হাসি

ভোর বেজে পাঁচটা। পূর্বাকাশে ভোরের লালিমা রেখা পর্বতশৃঙ্গের ধবধবে সাদা বরফে মিশে গিয়ে এক মায়াবী আলো-আধাঁরী'র ভূবন মনে এক অধরা শিরশিরে অনুভূতি'র সৃষ্টি করে। এরই মাঝে হেলিকপ্টারের ককপিটের স্বচ্ছ কাঁচ ভেদ করে চোখের সামনে ভেসে উঠে এভারেস্ট সামিট ক্যাম্পের আবছায়া প্রান্তরটি। বরফের চাদরে মুড়ে পর্বতের গায়ে পড়ে থাকা কোটি মানুষের ঈপ্সিত এ ভূমিটির দিকে তাকালে কেন যেন প্রাচীণ কোন প্রার্থনাগারের কথা মনে পরে যায়। এটাই তো সেই জায়গা যা এতো বছর ধরে লাখো-কোটি মানুষের মনে কোন কিছু জয় করার দূর্নিবার আকাঙ্খা জাগিয়ে চলেছে প্রতিক্ষণ, এটাই তো সে আগুন যেখানে কিনা জেনে-শুনে ফিনিক্স পাখির মত আত্মাহূতি দিতে জীবন বাজি রেখে প্রতি বছর সারা বিশ্ব থেকে ছুটে আসে হাজারো তরূণ-প্রবীণ মানুষের দল।

রোটরের ঘূর্ণনে তুষারে নীচে ঝড় তোলা বায়ুর দিকে তাকিয়ে এতোক্ষণ সাতপাশ এসবই ভাবছিলো বাংলাদেশ থেকে আসা আগুন্তুকটি। হেলিকপ্টার ইতিমাঝে পৌছে গিয়েছে ক্যাম্প এলাকায়। ভূমি থেকে মাত্র পাঁচ ফুট উপরে যান্ত্রিক ফড়িংটিকে নামিয়ে এনে পাইলট তাকায় আরোহী'র দিকে। চোখে সম্মতি'র দৃষ্টি। আর দেরী করে না তরূণটি, এক হাতে বাংলাদেশের লাল-সবুজ পতাকাটি বুকের মাঝে আগলে ধরে দরজা খুলেই নীচে ঝাপ মারে ইতিহাসের সোনালী প্রান্তরে....



একটু কি নাটকিয় হয়ে গেলো ভূমিকাটি? অনেকে হয়তো ভেবে বসেছেন এটা কোন ফিকশন বা এডভেঞ্চার গল্প কিনা।

আসলে তা নয়। নিজে হয়তো কখনো যাইনি, এমনকি কোন এভারেস্ট বিজয়ীর সাথেও এ নিয়ে কথা হয়নি। কিন্তু এভারেস্ট বিজয়ে যারা জীবন বাজি রেখে ধেয়ে গিয়েছেন, শৃঙ্গে উঠার ঠিক আগের মূহুর্তে তাদের মনের অবস্থা কি রকম হতে পারে, সেইটা কল্পনা করতে দোষ কোথায়! ছোটবেলা থেকেই আমার মত হয়ত অনেকেরই ইচ্ছে ছিলো এভারেস্টের বুকে নিজ দেশের পতাকা উড়াবার। কিন্তু, সেই সাধ তার অস্তিত্বের সীমানা পেরিয়ে বাস্তব ভূবনে বেরিয়ে আসতে আসতে ইতিমধ্যেই চার-চারজন বাংলাদেশী বঙ্গমানব-মানবী সেখানে পৌছে গিয়েছেন। যতদূর খবর পেয়েছি, আরো অনকেই প্রস্তুত হচ্ছেন।



কিন্তু, কথা হচ্ছে, একই জায়গায় একই দিক দিয়ে বারবার যাওয়ার ফায়দাটা কোথায়? বিশেষ করে যেখানে অন্য পথও রয়েছে! হতে পারে ব্যক্তিগত খায়েশ পূরণ। কিন্তু, তার মাঝে নতুনত্ব আনতে বাঁধাটা কোথায়? জল, স্থল ও অন্তরীক্ষ- মর্তে তো এ তিনটি মাধ্যম। স্থল দিয়ে এভারেস্ট জয় করা হয়ে গিয়েছে ইতিমধ্যে। বাকি দুই মাধ্যমের মধ্যে জল পথে এভারেস্ট শৃঙ্গে যাওয়া সম্ভব নয়। বলাই বাহুল্য, এভারেস্ট শৃঙ্গ আকাশে।

তাই, জল মাধ্যম বাদ। বাকি থাকলো, আকাশ পথ। এই দিক দিয়ে কি এভারেস্ট জয় সম্ভব? আর, এ ভাবনা থেকেই ইন্টারনেটে একটু খোঁজ করতেই বেরিয়ে পড়লো উত্তর। সম্ভব! খুবই সম্ভব!

হেলিকপ্টারে চড়ে প্রথম এভারেস্ট জয়ী'র কাহিনী:

২০০৫ সালের ১৪ মে। আমার উপরের গল্পের মতই তখন সবে সকাল হয়েছে।

তবে, তখন স্থানীয় সময়ানুযায়ী ঘড়ির কাটায় ৭টা বেজে ০৮। ঠিক এসময়ে Eurocopter কোম্পানীর তৈরী Ecureuil/AStar AS350 B3 মডেলের হেলিকপ্টারটি ২৯,০৩৫ ফুট উচ্চে অবস্থিত এভারেস্ট শৃঙ্গের বরফ উপত্যকায় নেমে আসে যান্ত্রিক গর্জন তুলে। বাতাসে'র টাল-মাটাল অবস্থার মাঝে যান্ত্রিক ফড়িংটিকে সেই অসাধ্য সাধন করান টেস্ট-পাইলট দিদিয়ের দেলসালে (Didier Delsalle)। সেই সাথে ইতিহাসের সোনালী পাতায় এই ফরাসী লোকটির নাম ঢুকে যায় হেলিকপ্টারে চড়ে এভারেস্ট জয়ী পৃথিবী'র প্রথম মানব হিসেবে। একই সাথে আরেকটি ইতিহাসও গড়েন এই সাহসী মানুষটি।

মাটি হতে সর্বোচ্চ অলটিচিউডের কোন ভুমিতে কোন আকাশযানের নামার সেইটা ছিলো একটি বিশ্ব রেকর্ড। এটি আর কেউ কখনো ভাঙ্গতে পারবে না, কারণ, পৃথিবীতে এরচেয়ে উঁচু আর কোন ভুমিই নেই। তবে যদি এমন হয় যে, এভারেস্টের উচ্চতা কয়েক ফুট/ইঞ্চি বেড়ে গেলো, তখন অবশ্য আবারো একটি সম্ভাবনা দেখা দিবে নতুন একটি বিশ্বরেকর্ড গড়ার। কিন্তু, এই এভারেস্ট বিজয়ে স্যার এডমন্ড হিলারী আর তেনজিং নরগে-এর নামের মত দিদিয়ের দেলসালে'র নামও কখনও ভুলে যাবার নয়!

দিদিয়েরের এই কর্মটি স্থলপথে'র এভারেস্টের অভিযাত্রীদের চেয়ে কিন্তু কোনক্রমেই কম নয়। কারণ, ঐ উচ্চতায় বাতাসের গতিবেগ কত জানলে যে কারো পিলে চমকে উঠার কথা।

ঘন্টায় ২৯৯ কি,মি, (১৮৬ মাইল)! আমাদের দেশের প্রলয়ঙ্করী সাইক্লোন সিডরের বাতাসের গতিবেগ কত ছিলো জানেন? মাত্র ২৬০ কি,মি, (১৬০মাইল)/ঘন্টা! এভারেস্ট শৃঙ্গের সাথে তুলনা দিতে গেলে মাত্রই তো! বাতাসের এহেন সাইক্লোনসম গতিবেগের মাঝে একটি এক ইঞ্জিন বিশিষ্ট হাল্কা ওজনের ঐ হেলিকপ্টারটি নিয়ে নামার চেষ্টা করতে অসম সাহস লাগে। আর, এর আগের ১০ বছর সার্চ ও রেস্কু তথা উদ্ধার অভিযানে হেলিকপ্টার চালিয়ে অনেক মানুষের জীবন বাঁচানো এ লোকটি কিন্তু নিজের অসম সাহসের আরেকটি পরিচয় দেন এভারেস্টের শৃঙ্গে যান্ত্রিক ফড়িংটি নামিয়ে। শুধু কি তাই? পরের দিন (১৫ মে, ২০০৫) আবারো তিনি ফিরে আসেন একই জায়গায় শুধু এইটি প্রমাণ করতে যে প্রথম বারের ল্যান্ডিংটি শুধু ভাগ্যের জোরে কোন কাকতালীয় ব্যাপার ছিলো না। দ্বিতীয় বারে ৪৮ বছর বয়সী এই পাইলটটি হেলিকপ্টার নামানোর পর সেখানে অবস্থান করেন চার মিনিট। প্রথম বারে অবশ্য এভারেস্ট শৃঙ্গে নেমে তিনি ৩ মিনিট ৫০ সেকেন্ড ছিলেন।

এখানে উল্লেখ্য যে, আন্তর্জাতিক এরোনটিক ফেডারেশন (Federation Internationale Aéronautique)-এর নিয়মানুযায়ী কোন টেক-অফের অফিসিয়াল স্বীকৃতি পেতে হলে যেকোন উড়ন্তযানকে মাটিতে নামার পর কমপক্ষে দুই মিনিট অবস্থান করা লাগে।

ঢেঁকি স্বর্গে গেলেও ধান ভাঙ্গে:

আগেই একবার বলা হয়েছে যে, দিদিয়ের ছিলেন একজন উদ্ধার অভিযানের পাইলট। আর, এভারেস্ট জয়ে গিয়েছিলেন Eurocopter কোম্পানীর তৈরী ঐ মডেলের হেলিকপ্টারটি কতটা মজবুত তা প্রমাণ করতে। মজার ব্যপার হচ্ছে, সেইখানে গিয়েও তিনি একজন উদ্ধারকারী হিসেবে আবির্ভুত হোন। সেই সময়ে জাপানের দুই পর্বতারোহী গিয়েছিলেন এভারেস্ট জয় করতে।

কিন্তু, বিধি বাম। আটকা পড়েন ১৬০০০ ফুট উচ্চতায়। খবর পেয়ে দিদিয়ের সেইখান থেকে তাদের উদ্ধার করেন হেলিকপ্টারে উড়িয়ে।

যেভাবে করে হেলিকপ্টারের করে এভারেস্ট যাওয়া যাবে:

আমার মত অনেকেরই হয়তো এভারেস্টে চড়ার সাধ এখনো রয়ে গেছে। কিন্তু, সাধ আর সাধ্য তো একসাথে হয়না সব সময়।

স্থলপথে এভারেস্ট যেতে অনেক খরচ। কয়েক বছর ধরে প্রস্তুতি নিয়ে এভারেস্ট যাত্রায় প্রায় অর্ধ কোটি টাকা লেগে যায়। আর, খারাপ আবহাওয়ার কারণে মাঝপথে যাত্রা ভেস্তে যাওয়ার সম্ভাবনার কথা নাহয় বাদই রাখলাম। তবুও রক্ষা নেই। আমাদের সামু'র মত কিছু ব্লগারের এতে শ্যেন দৃষ্টি পড়ে তো সব কিছু শেষ।

হাজার চেষ্টা করেও বোঝানো যাবে না যে পর্বত শৃঙ্গে উঠা গেছে। তাই, এতো ঝক্কি -ঝামেলা'র কি দরকার! পর্বতের উপর উঠতে পারা নিয়ে যখন এতো ঝামেলা, সেইখানে যে কোন উপায়ে উঠতে পারলেই তো হলো!

এভারেস্টে এক ঘন্টা হেলিকপ্টার দিয়ে ঘুরতে খরচ পড়ে সর্বোচ্চ ৬৫৪০ আমেরিকান ডলার, বাংলাদেশী টাকায় প্রায় পাঁচ লক্ষ টাকা। ইন্টারনেটে একটু খোঁজ লাগালেই পেয়ে যাবেন এমন কিছু ট্রাভেল এজেন্সী'র ঠিকানা। এখানে জানা প্রয়োজন, এভারেস্টে যাওয়ার সময় হচ্ছে দু'টি- (১) মার্চ-মে, (২) সেপ্টেম্বর-ডিসেম্বর। তবে, এসব ট্রাভেল কোম্পানীর হেলিকপ্টারে চড়ে আপনি সর্বোচ্চ ৬৫০০ মিটার পর্যন্ত উঠতে পারবেন।

আর, দিদিয়েরের মত কোন পাইলটকে জোটাতে পারলে এভারেস্টের সর্বোচ্চ শৃঙ্গে যেতে সব মিলিয়ে খরচ পরবে প্রায় ৩১,০০০ আমরেরিকান ডলার। খরচের পরিমাণটা একটু হয়তো বেশি, কিন্তু, ক্ষতি কি! স্থলপথের অভিযাত্রীদের চেয়ে তো অনেক কম! এর পাশাপাশি ইতিহাসের পাতায় নাম লিখানোর সাথে সাথে সামু'র ব্লগারদের তীর্যক বাণী হতে অন্ততঃ বাঁচতে পারবেন! কারণ, তখন আপনাকে ব্যাকিং দিবে আন্তর্জাতিক এরোনটিক ফেডারেশন আপনার হেলিকপ্টারের ফ্লাইট রেকর্ড চেক করে। ফলে, কারো কিছু বলার থাকবে না।


পরিশেষ:
এবার শুধু অপেক্ষার পালা। যান্ত্রিক ফড়িঙে চড়ে এভারেস্ট বিজয়ী বঙ্গমানব-মানবী হয়তো খুব তাড়াতাড়িই আমরা পেয়ে যাব।

আর, তাদের কেউ একজন এই লেখা পড়ে আগ্রহী হয়ে থাকলে তো কেল্লা ফতে! সেই বঙ্গমানব-মানবী'র সাথে সাথে এই ব্লগারেরও থাকলো ইতিহাসের পাতায় ঢুকে যাওয়ার সম্ভাবনা! অবশ্য যদি উনারা আমার কথা তখন মনে করেন, শুধু তাহলেই! সেই আশাতেই বুক বেঁধে থাকলাম।



তথ্যসূত্র: ইন্টারনেটের বিভিন্ন ওয়েবসাইট ও উইকিপিডিয়া

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.