আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

অভীষ্ট গন্তব্যে পৌঁছাতে হলে

বহুল আলোচিত দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন হয়ে গেল ৫ জানুয়ারি। নির্বাচনে জামায়াত-বিএনপি জোট অংশগ্রহণ করেনি। শুধু অংশগ্রহণ করেনি বললে কম বলা হবে, নির্বাচন প্রতিহত করার জন্য তারা সর্বাত্দক শক্তি নিয়োগ করেছে। কিন্তু এতকিছু করেও তারা নির্বাচন ঠেকাতে পারেনি। ১৫৩ আসনে বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচন হওয়ার পর বাকি ১৪৭ আসনের জন্য মোট ১৮ হাজার কেন্দ্রের মধ্যে ৪৪৯টি কেন্দ্রে ভোট হতে পারেনি, যা শতকরা হিসাবে মাত্র আড়াই শতাংশের কাছাকাছি।

যে কোনো স্ট্যান্ডার্ড নির্ধারণে তা নগণ্য। তবে এটা ঠিক রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে এই নির্বাচনকে সর্বগ্রাহ্য বলা যাবে না এবং যেখানে ৩০০ আসনের মধ্যে বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বিতায় ১৫৩ জন সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন, তাকে স্বাভাবিক বলারও সুযোগ নেই। তাই এ নির্বাচনকে ঘিরে দেশে-বিদেশে বিতর্ক চলছে এবং চলবে সেটাই স্বাভাবিক। কিন্তু রাষ্ট্রের সংবিধান ও আইন মোতাবেক এ নির্বাচন শতভাগ বৈধ।

ইতিহাসে এ নির্বাচনের স্থান কী হবে সেটি ইতিহাস তার আপন গতিতেই এক দিন নির্ধারণ করবে।

কথা হলো এমন একটি নির্বাচন কেন হলো, এটাই এখন সবচেয়ে বড় প্রশ্ন। এ প্রশ্নের সঠিক উত্তরের মধ্যে পাওয়া যাবে বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংকটের মূল বা শেকড়ের সন্ধান। এই সমস্যা সঠিকভাবে চিহ্নিতকরণ এবং তার সমাধান না হওয়া পর্যন্ত বাংলাদেশের মানুষ জ্বালাও-পোড়াও ও ধ্বংসযজ্ঞের রাজনীতি থেকে মুক্তি পাবে না। আজকের লেখায় এ বিষয়ের ওপর আলোকপাত করব। প্রথম কথা হলো জামায়াত-বিএনপি নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়কের দাবিতে আন্দোলনের নামে যে ভয়ঙ্কর সন্ত্রাস চালিয়েছে এবং নৃশংস নির্দয়ভাবে নিরীহ মানুষকে আগুনে পুড়িয়ে মেরেছে, তার কাছে নতি স্বীকার করে নির্বাচন পিছিয়ে দিলে ভবিষ্যতের জন্য সেটি হতো একটি ভুল এবং ভয়ঙ্কর উদাহরণ।

দ্বিতীয়ত, পঁচাত্তরের মর্মান্তিক ঘটনার কুফলে একাত্তরের পরাজিত শক্তি, যারা বাংলাদেশ চায়নি, এখনো চায় না এবং যারা পাকিস্তানের প্রতিভূ হিসেবে এ দেশে বিচরণ করছে সেই জামায়াতের সন্ত্রাসী ও ধর্মান্ধ রাজনীতি থেকে রাষ্ট্রকে মুক্ত করার জন্য এই নির্বাচনটি ছিল অপরিহার্য।

৫ জানুয়ারির নির্বাচনের আগের দিন বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমান লন্ডনে বসে ভিডিওবার্তার মাধ্যমে তার দলকে নির্বাচন প্রতিহত করার হুকুম দিয়েছেন এই বলে যে, এই নির্বাচন প্রতিহত করা না গেলে দেশ আবার বাহাত্তরের গণবিরোধী সংবিধানে ফিরে যাবে। অর্থাৎ পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ২৩ বছরের সংগ্রাম ও একাত্তরের ৩০ লাখ শহীদের ফসল হিসেবে যে বাহাত্তরের সংবিধান রচিত হয়েছিল সেটিকে তারেক রহমান বলছেন গণবিরোধী। তাই এই নির্বাচনকে কেন্দ্র করে বিএনপি-জামায়াত ও তাদের সমর্থক বুদ্ধিজীবী ও নাগরিক সমাজ একদিকে অবস্থান নিয়েছে, আর অন্যদিকে রয়েছে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের সব রাজনৈতিক দল এবং সব শ্রেণী-পেশার নাগরিক সমাজ। এবারের এ বিভাজনে প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ার অবস্থানটিও স্পষ্ট বোঝা গেছে।

বিভাজনের রেখা শুধু দেশের অভ্যন্তরে নয়, সীমান্ত পেরিয়ে আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও সেটি ছিল চোখে পড়ার মতো। আন্তর্জাতিক অঙ্গনের বিভাজনটিও প্রায় সেই একাত্তরের মতোই, তবে বড় দুয়েকটি ব্যতিক্রম আছে। আমেরিকা ও তার লেজুড় ইউরোপীয় ইউনিয়নের অবস্থান যেমন স্পষ্ট, তেমনি ভারতের অবস্থানও স্পষ্ট। অন্যদিকে বিশ্ব অঙ্গনের বড় দুই খেলোয়াড় রাশিয়া ও চীনের অবস্থান ততটা স্পষ্ট না হলেও বিশ্ব রাজনীতিতে রাশিয়া ও চীন এখন একসঙ্গে আমেরিকার দ্বিমুখী ও সাম্রাজ্যবাদী বেনিয়া আচরণের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে। সুতরাং যারা বলছেন এ নির্বাচনের মাধ্যমে বাংলাদেশ বন্ধুহীন হয়ে পড়েছে তারা বাস্তবতাকে অস্বীকার করছেন, আর নয়তো মানুষকে হতাশ করার জন্য বিভ্রান্তি ছড়াচ্ছেন।

আমেরিকা ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ইতিহাসের দিকে তাকালে দেখা যায় কোনো নীতি-আদর্শ নয়, যেখানে যতদিন তাদের স্বার্থ আছে সেখানে তারা ততদিন নিজেদের জড়িত রাখবে। ইসরায়েলের প্রতি পশ্চিমাদের চরম পক্ষপাতিত্ব, তাদের মধ্যপ্রাচ্য নীতি এবং সাম্প্রতিক সময়ে আমাদের প্রতিবেশী মিয়ানমারের প্রতি আমেরিকার প্রবল আকর্ষণ এ কথার যথার্থতা প্রমাণ করে। ভূরাজনৈতিক অবস্থানের কারণে এবং যে সম্ভাবনার দুয়ার উন্মোচিত হয়েছে তার কারণেই আগামী দিনে আমেরিকা ও তার মিত্ররা বাংলাদেশের সঙ্গে জড়িত থাকবে। তারা দূরে সরে গেলে আমাদের যতটুকু ক্ষতি, সে তুলনায় তাদের কৌশলগত স্বার্থের ক্ষতিও কম হবে না।

আমেরিকা কেন শেখ হাসিনার সরকারের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে সে কাহিনী লম্বা, নিবন্ধের কলেবরে তা কুলাবে না।

শুধু এতটুকু বলব, ২০০০ সালে আমেরিকার তৎকালীন প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটন বাংলাদেশ সফরে এসেছিলেন। তখন আমেরিকার চাওয়ার বিপরীতে শেখ হাসিনার যে অবস্থান ছিল সেই লেগেসি থেকে আমেরিকা এখনো বের হতে পারেনি। আর জামায়াতকে আমেরিকা বাংলাদেশে কেন টিকিয়ে রাখতে চায় সেটি বোঝার দূরদৃষ্টি আমাদের দেশপ্রেমিক বুদ্ধিজীবীদের থাকতে হবে। সন্ত্রাসী জন্ম দেওয়া যাদের আদর্শ সেই জামায়াতকে যখন আমেরিকা বাঁচিয়ে রাখতে চায় তখন তাকে কোনো শুভ লক্ষণ বলে গণ্য করা যাবে না। আমেরিকা এখনো বিশ্বের একমাত্র পরাশক্তি হলেও আগের মতো দাপট আর নেই।

সিরিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেও পিছু হটতে হয়েছে। ইসরায়েল ও আমেরিকার অভ্যন্তরে অদৃশ্য সরকার বলে খ্যাত ইহুদি লবির ঘোর বিরোধিতা সত্ত্বেও আমেরিকা আপাতত ইরানের সঙ্গে এক টেবিলে বসে চুক্তি করতে বাধ্য হয়েছে। আমেরিকার নিজস্ব সৃষ্টি আফগানিস্তানে হামিদ কারজাই এখন আমেরিকাকে বুড়ো আঙ্গুল দেখাচ্ছে।

জামায়াতের মূল আদর্শের জন্মস্থান সৌদি আরবের মানুষ ওয়াহাবিতন্ত্রকে সরাসরি প্রত্যাখ্যান করতে শুরু করেছে। চার-পাঁচ দিন আগে খবরে দেখলাম সৌদি আরবের ৬০ জন নারী একত্রে গাড়ি চালানোর মহড়া দিয়ে মোটামুটি জামায়াতি আদর্শ ওয়াহাবিতন্ত্রের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছে।

লক্ষ্য করার বিষয় হলো- আমেরিকা ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন কাদের মোল্লার ফাঁসি কার্যকরের বিপক্ষে থাকলেও সৌদি আরব ও মধ্যপ্রাচ্যের অন্যান্য দেশ এ ব্যাপারে কোনো উচ্চবাচ্য করেনি। ১৯৫৩ সালে জামায়াতের মূল নেতা আবুল আলা মওদুদীকে পাকিস্তান সরকার ফাঁসির আদেশ দিলে সৌদি আরব মওদুদীকে রক্ষা করেছিল। ১৯৯৯ সালে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট জেনারেল মোশাররফ নওয়াজ শরিফকে ফাঁসিতে ঝুলানোর ষড়যন্ত্র করলে সৌদি আরব নওয়াজ শরিফকে আশ্রয় দিয়েছিল। সুতরাং বলা যায় বাংলাদেশ বন্ধুহীন হয়নি, হবেও না। বিপ্লবের পর চীন প্রায় ২১ বছর জাতিসংঘের সদস্য হতে পারেনি আমেরিকার বিরোধিতার কারণে।

এই ২১ বছর চীন পুরো বিশ্ব থেকে প্রায় বিচ্ছিন্ন ছিল বলা যায়। কিন্তু লাখো-কোটি মানুষের রক্তের বিনিময়ে অর্জিত বিপ্লবের আদর্শ থেকে তারা সরে আসেনি বলেই চীন আজ বিশ্বের দ্বিতীয় শক্তিশালী দেশ। মনুষ্য আরোপিত অভিশাপ থেকে একটা জাতিকে মুক্ত করার জন্য প্রয়োজন দৃঢ়চেতা, সাহসী ও লক্ষ্যভেদি নেতৃত্ব। ২০০৭ সালের এক-এগারো থেকে শুরু করে ক্ষমতা গ্রহণের মাত্র ৫১ দিনের মাথায় পিলখানার ভয়াবহ ক্রাইসিস এবং কাদের মোল্লার ফাঁসি কার্যকর করা পর্যন্ত প্রবহমান ঘটনাবলি বলে দেয় শেখ হাসিনা সেই নেতৃত্ব দেখাতে সক্ষম হয়েছেন, যদিও পাঁচ বছরের সরকার পরিচালনা প্রসঙ্গে অনেক সমালোচনা আছে এবং সে সমালোচনার কিছু যথার্থতাও আছে।

বাংলাদেশের মূল সমস্যা হলো অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে জামায়াতের উপস্থিতি।

যে জামায়াত বাংলাদেশের জন্মের মৌলিক আদর্শকে শুধু অবিশ্বাস ও অস্বীকারই করে না, সেগুলো ধ্বংস করার জন্য তারা সন্ত্রাসী, জঙ্গিবাদী কর্মকাণ্ড থেকে শুরু করে জ্বালাও-পোড়াও পর্যন্ত এহেন ধ্বংসযজ্ঞ নেই যা তারা করছে না। বাংলাদেশের অস্তিত্ব তাদের কাছে বড় নয়, তাদের কাছে বড় ধর্মান্ধতা। তাই বাংলাদেশের অভীষ্ট লক্ষ্য এখন জামায়াত যুদ্ধাপরাধীমুক্ত বাংলাদেশ এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় সমৃদ্ধ বাহাত্তরের সংবিধানে রাষ্ট্রকে পরিপূর্ণভাবে ফিরিয়ে নেওয়া। এই অভীষ্ট গন্তব্যে পেঁৗছতে ৫ জানুয়ারির নির্বাচন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে যদি মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের দল ও মানুষ লক্ষ্যভ্রষ্ট না হয় এবং নৈতিকতার পদস্খলন না ঘটে। যা এখন করণীয় তাহলো-

এক. বিএনপি বাংলাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম রাজনৈতিক দল।

জনগোষ্ঠীর বড় একটি অংশ এই দলের সমর্থক। মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাস করে এমন মানুষ বিএনপির ভেতরেও আছে। কিন্তু দলের সুপ্রিম নেতৃত্ব ও দলের জন্মগত ত্রুটি এবং আদর্শের কারণে বিএনপি জামায়াতের সঙ্গে এমনভাবে জড়িয়ে পড়ছে যে বিএনপি স্বইচ্ছায় আর জামায়াতের কব্জা থেকে মুক্ত হতে পারবে না। কিন্তু গণতন্ত্রের স্বার্থেই বাংলাদেশের রাজনীতিতে বিএনপির টিকে থাকা দরকার। তাই বাংলাদেশের সচেতন মানুষ, তরুণ সমাজ এবং সব শ্রেণী-পেশার মানুষকে এখন অগ্রণী ভূমিকা নিতে হবে।

দেশের ৮৫ হাজার গ্রাম, সাড়ে চার হাজার ইউনিয়ন, প্রায় পাঁচশর মতো উপজেলাসহ পাড়া-মহল্লায় গণজাগরণের সৃষ্টি করতে হবে, যাতে জামায়াতকে ত্যাগ করতে বিএনপির হাইকমান্ড বাধ্য হয়। আর তা না হলে জামায়াতের সঙ্গে বিএনপির অস্তিত্বও বিলীন হবে এবং আওয়ামী লীগের বিপরীতে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিশ্বাসী জনসমর্থিত নতুন রাজনৈতিক দলের উত্থান ঘটবে। ইতোমধ্যে এরকম ছোট্ট একটি ঘটনা ঘটে গেছে গাইবান্ধা জেলার গোবিন্দগঞ্জ উপজেলায়। সেখানে আওয়ামী লীগ-বিএনপি এক হয়ে জামায়াত-শিবিরের সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছে। সারা দেশ যখন গোবিন্দগঞ্জের মতো হবে তখন আমরা ফিরে পাব নিষ্পাপ নিষ্কলুষ বাহাত্তরের বাংলাদেশ।

এমন বাংলাদেশই আমরা চাই।

দুই. যে সব সাংবাদিক, শিক্ষক ও অন্যান্য শ্রেণী-পেশার বুদ্ধিজীবী, যারা অন্তর থেকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় সমৃদ্ধ বাংলাদেশ দেখতে চান, তাদের এ প্রশ্নে সব নিরপেক্ষতার মুখোশ খুলে ফেলে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষ-বিপক্ষের চলমান যুদ্ধে নিজ নিজ অবস্থান থেকে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের একেকজন বলিষ্ঠ সৈনিক হিসেবে যুদ্ধ চালাতে হবে। আপস সমঝোতা গণতান্ত্রিক রাজনীতির অলঙ্কার। কিন্তু জলে আর তেলে কখনো আপস হয় না, বিগত দিনের ঘটনাপ্রবাহই তার প্রমাণ। রেললাইনের মতো সমান্তরাল ও বিপরীতমুখী মৌলিক রাষ্ট্রীয় দর্শন এবং আদর্শের কখনো মিলন হতে পারে না।

মিলিত হতে গেলে সংঘর্ষ অনিবার্য।

তিন. আমাদের নাগরিক সমাজে ও ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র কয়েকটি রাজনৈতিক দলের কিছু নেতা আছেন যারা সব সময় মুক্তিযুদ্ধের চাদর গায়ে চড়িয়ে ঘুরে বেড়ান। কিন্তু কথাবার্তা ও কাজকর্ম যা করেন তাতে মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষ শক্তিই বলিয়ান হয়। ফলে মানুষ বিভ্রান্ত হয়। এদের মধ্যে আবার কেউ কেউ আছেন যারা জামায়াতের সঙ্গে একই মঞ্চে বসতে এবং একই টেবিলে বসে খানাপিনা করতে দ্বিধা করেন না।

৫ জানুয়ারির নির্বাচনকে কেন্দ্র করে তাদের বলতে শোনা গেছে শেখ হাসিনা পদত্যাগ করলে এক মিনিটে সমস্যার সমাধান হয়ে যায়। কিন্তু তারা এ কথা বলেন না যে, বিএনপি জামায়াতকে ত্যাগ করলে এবং যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের পক্ষে দাঁড়ালে এক মিনিটে বাংলাদেশের সহিংস রাজনৈতিক সংকট দূর হয়ে যায়। তারা ভালো করে জানেন, বাংলাদেশের রাজনীতির মূল যে সংকট তা নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকার দ্বারা সমাধান করা সম্ভব নয়। তাই যদি হবে তাহলে এতদিনে রাজনীতিতে এমন সংকট এখন আর থাকার কথা ছিল না। কারণ ইতোমধ্যে পরপর তিনটি নির্বাচন নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার দ্বারা হয়েছে।

তারা এটাও জানেন, এ সময় শেখ হাসিনা যদি প্রধানমন্ত্রী না থাকতেন তাহলে কাদের মোল্লার ফাঁসির রায় কার্যকর হতো না। মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় ভাস্বর রাজনীতি প্রতিষ্ঠা করার জন্য যথার্থ নির্বাচন আবশ্যিক একটি উপায়, তবে মনে রাখা দরকার মূল লক্ষ্য থেকে একটি মাত্র উপায়কে যেন বড় করে দেখা না হয়। তাই মুক্তিযুদ্ধের চাদর গায়ে চড়িয়ে যারা বিভ্রান্তি ছড়াচ্ছেন তাদের মুখোশ উন্মোচন করা এখন জরুরি।

চার. কিছু মানুষ সব সময় হতাশার বাণী ছড়াতে থাকেন। কোনো বিবেকবান মানুষই সংঘাত-সংঘর্ষ চায় না।

কিন্তু মনুষ্য সভ্যতার ক্রমবিকাশের ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় উন্নয়ন ও আলোর পথের সন্ধান পেতে হলে অন্ধকারকে মাড়িয়ে কণ্টকাকীর্ণ পথ পাড়ি দিয়ে, তবেই না সেখানে পেঁৗছানো যায়। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় সব দেশই কোনো না কোনো সময়ে এরকম সংকট পেরিয়ে তারপর একটি স্থিতি অবস্থায় পেঁৗছেছে। ইংল্যান্ডে এখন যে ওয়েস্ট মিনস্টার মডেলের গণতন্ত্র আমরা দেখি তা কিন্তু সহসা হয়নি। ১২৬৫ সাল থেকে যাত্রা শুরু, তারপর পর্যায়ক্রমে সংগ্রাম করতে করতে সর্বশেষ ১৬৪২ থেকে ১৬৪৯ পর্যন্ত সাত বছরের গৃহযুদ্ধের পর পরিপূর্ণ গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়। স্বাধীনতা অর্জনের প্রায় ১০০ বছর পর আমেরিকায় দীর্ঘমেয়াদি গৃহযুদ্ধ হয়েছে।

ফরাসি বিপ্লবের সময়ও কত মানুষ নিহত হয়েছে। চীন ও রাশিয়ার বিপ্লবে তো কোটি কোটি মানুষ প্রাণ হারিয়েছে। বাংলাদেশের অভীষ্ট লক্ষ্য মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশ বিনির্মাণের পথ যতই অন্ধকার ও কণ্টকাকীর্ণ হোক না কেন, সেখানে পেঁৗছানোর শক্তি জোগাবে ৩০ লাখ শহীদের রক্ত। নিয়তি বা ইতিহাস যা-ই বলি না কেন, এতবড় আত্দত্যাগের মাহাত্দ্য বৃথা যেতে পারে না। তাই হতাশা নয়, পঁচাত্তরে যা আমরা হারিয়েছিলাম, ২০১৪ সালে তা পুনরুদ্ধারে নতুন করে মুক্তিযুদ্ধের সোপানের ওপর বাংলাদেশকে আমরা প্রতিষ্ঠিত করব।

সুতরাং বলতে চাই- 'মেঘ দেখে কেউ করিসনে ভয়, আড়ালে তার সূর্য হাসে। ' সত্যের জয় চিরদিন হয়। জয়ের পথের অভিযাত্রায় নতুন সরকারের সামনে আশু বড় চ্যালেঞ্জ হলো, সব ধরনের সন্ত্রাস কঠোর হস্তে দমন করে মানুষকে ভয়ভীতি থেকে মুক্ত করা এবং নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। দ্বিতীয়ত, হরতাল, অবরোধ ও জ্বালাও-পোড়াওয়ের অপসংস্কৃতি থেকে বাংলাদেশের রাজনীতিকে বের করে আনা। এ দুটি আশু চ্যালেঞ্জকে সফলভাবে মোকাবিলা করার জন্য সর্বাগ্রে প্রয়োজন দক্ষ, অভিজ্ঞ এবং ক্লিন ভাবমূর্তির একটি শক্তিশালী মন্ত্রিসভা।

জাতির পিতার কন্যা শেখ হাসিনার কাছে মানুষের প্রত্যাশা- বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত আত্দজীবনীর অনুপ্রেরণা যেন হয় নতুন সরকারের মন্ত্রী, উপদেষ্টা ও সংসদ সদস্যদের চলার পথের পাথেয়।

লেখক : নিরাপত্তা বিশ্লেষক।

ই-মেইল :sikder52@gmail.com

 

 

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।