আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

ভ্রম

মৌণ শব্দগুলো বীভৎস হৃষ্টতায় আপ্তমনের সাথে আপ্ততা করেছে...

‘পাহাড়ীকা এখন রীতিমত লোকাল বাসকেও হার মানায়। দু-চার কদম যেতে না যেতে কষে ব্রেক চাপে। ইচ্ছে হচ্ছে ড্রাইভার ব্যাটাকে কষে ঝাড়ি মারি । কিন্তু ও ব্যাটা, কথা এক কান দিয়ে ঢুকাবে, বাতাস ভেবে তা অন্য কান দিয়ে ছেড়ে দিবে। বলাটাই নিছক বাতুলতা!’ গজ গজ করে নিজের সাথে কথা বলছে আনন্দ বিকাশ চাকমা।

পাশের মধ্যবয়স্ক লোকটা সীটে হেলান দিয়ে নিশ্চিন্তে ঘুমাচ্ছে। নিজের রাগটাকে প্রশমিত করার তাগিদে লোকটার সহানুভূতি আশা করবে তাও ঠিক মনঃপুত হচ্ছে না।

গাড়ি ঘাগরা বাস স্ট্যান্ডে এসে থামল। নির্লিপ্ত মন নিয়ে সিটে বসে আছে আনন্দ। কিছুক্ষণের মধ্যেই বাসের খালি সিটগুলো ভরে গিয়ে পুরো বাসটাই এখন কানায় কানায় পরিপূর্ণ।

কয়েকজন হাতল ধরে দাঁড়িয়ে আছে। একজন পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। মুখ তুলে তাকাতে চোখ আটকে যায় আনন্দের। হরিণী চেহারার এক মানবী। মুখাবয়ব, আঁখি-পল্লব, অধর-ওষ্ঠ, গায়ের রঙ চোখ বেঁধে রাখতে বাধ্য।

চোখ উঁচিয়ে কয়েকবার তাকাল। সহাস্যে বলল, ‘আপনি বসুন। ’
মেয়েটা চোখে চোখ রেখে বলল, ‘না, আপনি বসুন। আমার সমস্যা হচ্ছে না। ’
কয়েকবারের অনুরোধও টলাতে পারেনি মেয়েটিকে।

মেয়েটি বসলই না। বাসে জন্ম নেওয়া বিরক্তিকর সময় পেরিয়ে মধুক্ষণে এসে থেমেছে। মেয়েটার সাথে কথা বলার তীব্র আকাঙ্ক্ষা বারে বারে নিজের ব্যক্তিত্বকে খুন করতে চাচ্ছে। দ্বিধা-দ্বন্ধের যুদ্ধ চলাকালেই গাড়ি এসে ভীড়ল মানিকছড়ি। মেয়েটার কঠোর ব্যক্তিত্বের কথা ভেবে কিছুটা হতাশা নিয়েই আনন্দ বাস থেকে নামলো।



বাস থেকে নেমে সিএনজি ধরল আনন্দ। গন্তব্য রাঙ্গামাটি কৃষি প্রশিক্ষণ ইনিস্টিটিউট। এই ইনিস্টিটিউ-এর ৫ম সেমিষ্টারের ছাত্র আনন্দ চাকমা। ইনিস্টিটিউট-এর ছাত্রাবাসেই থাকা হয়। ছাত্রাবাসে পৌঁছে নিজের রুমে না গিয়ে সোজা ঢুকল বন্ধুবর রিকেল চাকমার রুমে।

বন্ধু রিকেল বই হাতে নিয়ে বিছানায় এপাশ ওপাশ করছে। ছোঁ মেরে বই নিয়ে বলল
‘দোস্ত, বাসে একটা মেয়ে দেখলাম। এত্তো সুন্দর। চেহারা, গায়ের রঙ সবকিছু দেখে আমি মুগ্ধ। বিহঙ্গিনী।


আনন্দের নিষ্পাপ হাসি দেখে বিভ্রম রিকেল।
-‘হয়েছে কি? খুলে বল!’
প্রেমে পড়ার বিমূর্ত হাসি হেসে সব শ্লোক-গাঁথা বলল আনন্দ। জানাল, মেয়েটা তোদের ঘাগরা বাস স্ট্যান্ড থেকে উঠছে।
-‘মেয়েটা দেখতে কেমন? আর পরনে কি? হাতে কানে, গলায় কি পরা?’
বিস্তারিত সব জেনে কিছুটা উচ্চৈঃস্বরে বলল রিকেল, ‘ওরে আমি চিনি। আমাদের পাশের বাড়ির মেয়ে।

নাম মনতা চকমা। ’
-‘দোস্ত! প্লিজ, তুই কিছু একটা ব্যবস্থা কর। ’
-‘সব হবে! ধৈর্য ধর!’

প্রায়শ মনতার কথা জিজ্ঞেস করে আনন্দ। শতশত অনুরোধের ঢেঁকুর তোলে। বন্ধুবর রিকেল আশস্ত করে, সামনের বিঝুতেই তোকে আমাদের বাড়ি নিয়ে যাব।

তখন তোকে পরিচয় করে দিব। সময় খুন হওয়ার সাথে সাথে আনন্দের মনে দক্ষিণার মৃদু হাওয়া ভিড়তে থাকে।

বিঝুর দু’দিন আগে বিকেলে ঘাগরা বাসস্ট্যান্ডে নামে আনন্দ আর রিকেল। রিকেলের বাড়িটায় বাসস্ট্যান্ড থেকে হেঁটে যেতে পনেরো মিনিট-এর মত লাগে। ধীরলয়ে বাড়ির পথ ধরে দুজনে।

পথিমধ্যে খাটো ও মোটা এক মহিলা হেঁটে আসতে দেখে আনন্দ রিকেলকে মজা করে বলল, ‘মহিলাটাকে দেখে মনে হয় গাছের গুঁড়ি। ’ সম্মতি সূচক মাথা নেড়ে রিকেল বলল ‘আসলেই তো! গাছের গুঁড়ির মত। উনি আমার পিসি হন। ’
মহিলা সামনে আসার পর রিকেল নমষ্কার জানিয়ে আনন্দকে পরিচয় করিয়ে দেয় পিসির সাথে। বাসায় পৌঁছে ব্যাগ-পত্র রেখে গ্রামে ঘুরতে বের হয় দুজনে।

গ্রামের বন্ধুদের সাথে আড্ডা সেরে সন্ধ্যার আঁধার ঘন হওয়ার পর দু'জনেই বাসায় ফিরে। রিকেলের বড় ভাই সেনাবাহিনীর সদস্য হিসেবে বিদেশ সফরে আছেন। কংক্রিটের চার দেয়ালের ঘর আর নিত্য নতুন আসবাসপত্র ভাইয়ের বদৌলতেই হয়েছে।

ডাইনিং টেবিলের খাওয়ার ডাক পড়ে। রিকেল আর আনন্দ ডাইনিং টেবিলে এসে বসে।

দু’জনেই খাওয়ার পর্ব শুরু করে। আনন্দের সামনে এসে দাঁড়ায় সেই মোটা মহিলাটি। রিকেল এবার পরিচয় করিয়ে দেয়, ‘উনি আমার মা। ’ লজ্জায় মাথা নিচু হয়ে আসে আনন্দের। কাঁচুমাচু করে রিকেলের দিকে তাকায়।

চাপা চাপা হাসি হেসে খাওয়া বেড়ে দেয় রিকেল। খাওয়া শেষে লাজুক হাসি দিয়ে আনন্দ ক্ষমা চাইতে রিকেলের অট্টহাসি আরও বিব্রত করে তোলে তাকে।
পরদিন সকালে রিকেলের রুমে দু’বন্ধুর আড্ডা জমছে। রুমের পর্দা সরিয়ে সকালের নাস্তা নিয়ে মৃদু হেসে একটি মেয়ে হাজির হয়। মেয়েটির দিকে তাকাতেই হতবাক হয় আনন্দ।

‘এই সেই বিহঙ্গিনী’ আনন্দের অবচেতন মনে সুর-ঝংকার বেজে উঠে। আনন্দকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই রিকেল হাসিমুখে বলল, ও আমার ছোট বোন মনতা।
রিকেলের কন্ঠে কথাটা শোনার পর আনন্দের চারপাশ স্তদ্ধতায় জড়িয়ে যায়, আঁধার ঘনিয়ে আসে। আনন্দের চোখ আটকে গেছে মনতার স্মিত হাসির বেড়াজালে, খুন হয়ে যাচ্ছে সে...

১৩০১১৪

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।