আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

সুচিত্রা সেন - মহানায়িকার মহাপ্রস্থান।



রাতে ঘুমাতে যাবার আগে দুঃসংবাদ শুনতে নেই। এতে ঘুমের ব্যাঘাত ঘটে। দুঃস্বপ্ন দেখে বারবার ঘুম ভাঙ্গে।
কালকে রাতে ঘুমাতে যাবার আগে আগেই একটা দুঃসংবাদ শুনতে হলো। সুচিত্রা সেন আর নেই।

আমার মাথায় প্রথমেই যে চিন্তা এলো তা হচ্ছে, আজকে ঘুমের বারোটা বাজলো!
এরপরে সারারাত থেকে থেকে একটার পর একটা স্মৃতি ভেসে উঠতে লাগলো মনে। ফিরে গেলাম সেই শৈশবে। বিশ পঁচিশ বছর আগের সাদা কালো এবং রঙিন দিনগুলোতে।
আমরা তাঁর সময়ে বেড়ে উঠিনি। আমার জন্মের আগে থেকেই তিনি স্বেচ্ছা নির্বাসনে।

আমাদের শৈশবে নায়িকা বলতে ছিলেন রেখা, জয়াপ্রদা এবং পরবর্তিতে মাধুরী, শ্রীদেবী, জুহী চাওলা। সুচিত্রা সেন সাদা কালো যুগের নায়িকা। তাঁর সিনেমা দেখতে যাব কেন?
তখনও কেবল টিভি দেশে আসেনি। বিনোদন বলতে বিটিভি এবং ভিসিআরের জন্য ভাড়া করে আনা ক্যাসেট। একটা ক্যাসেট ভাড়া করতে দশটাকা লাগতো।

আব্বু প্রায়ই অফিস থেকে ফেরার পথে একটা সিনেমা নিয়ে আসতেন, সেটাই আমরা বিরতি দিয়ে দিয়ে দুই তিনদিন লাগিয়ে দেখতাম। প্রতিদিন এক-আধ ঘন্টার বেশি একটানা সিনেমা দেখা যেত না। মাঝে থাকতো আব্বুর এশার নামাজ, রাত দশটার ইংরেজী সংবাদ এবং বিটিভিতে কোন নাটক বা ‘ইত্যাদি’ থাকলেতো কথাই নেই। দেখা যেত, একটা সিনেমা যখন ক্লাইমেক্সে পৌছে গেছে, তখন দুইদিন আগে দেখা তার প্রথম দৃশ্যের কথা কিছুতেই মনে করতে পারছিনা।
আব্বু প্রায়ই সাদা কালো বাংলা সিনেমা নিয়ে আসছেন।

খুব বিরক্ত লাগতো। একদিকে অমিতাভ বচ্চন দশ বারোজনকে পিটিয়ে শুইয়ে দিচ্ছে, আরেকদিকে উত্তম কুমার নামের একজন নায়িকাকে মোটরসাইকেলের পেছনে বসিয়ে গান গাচ্ছে, "এই পথ যদি না শেষ হয়!" কোনটা ভাল?
ছোট বেলায় অভিনয়ের খুটিনাটি, সিনেমার কাহিনী, সংলাপ, ডায়লগ ডেলিভারি, প্রজেকশন, মডিউলেশন কিছুই বুঝতাম না। তখন আমার কাছে বিনোদন মানে কোন নায়ক কয়টা ভিলেনকে খালি হাতেই পিটাচ্ছে। আর নায়িকা? সিনেমায় তাদের ফাংশন হচ্ছে "অ্যাংরি ইয়ং ম্যান" নায়ককে নিজের দিকে আকৃষ্ট করার জন্য নায়কের পিছু পিছু গান গাইতে গাইতে দৌড়াবে। নায়িকা একাই না, তার সখীরাও তার সঙ্গীনি হবে।

নায়ক প্রথম দিকে কাউকেই পাত্তা দিবে না। কিছু ঘটনার পরে নায়কের মন নরম হবে, সেও মেয়েটিকে নিজের মন দিয়ে দয়া করবে।
ধীরে ধীরে বড় হতে লাগলাম এবং রঙ্গিন হিন্দী সিনেমায় বিরক্তি আসতে লাগলো। একসময়ে কিছু করার ছিল না বলেই আব্বুর সাথে বসে 'দেবদাস' দেখছিলাম। হিন্দী দেবদাস।

যেখানে নায়ক দিলীপ কুমার। নায়িকা সুচিত্রা সেন। যার একজন বড় ভক্ত আমার আব্বু। যার ভক্ত আমার আব্বুর জেনারেশনের সব পুরুষ। এবং সেই রাতেই আমিও তাদের দলে নাম লেখালাম।


অভিনয় কাকে বলে, কত প্রকার ও কী কী - এই সিনেমার দুই নায়ক নায়িকা আমাকে চোখে আঙ্গুল দিয়ে শেখালেন। প্রথম কোন সিনেমায় দেখলাম, নায়িকার কাজ কেবল নায়কের পিছু পিছু দৌড়ে গান গাওয়া নয়, তারও ব্যক্তিত্ব থাকতে পারে, তারও নিজস্ব স্বত্বা থাকতে পারে। সেই সাদা কালো যুগে, যেখানে চেহারা ঠিক মতন দেখাই যায়না, সে অবস্থাতেও ফেসিয়াল এক্সপ্রেশন দিয়ে দর্শককে হাসিয়ে, কাঁদিয়ে একাকার করে ছাড়ার ক্ষমতা রাখতেন যিনি, তিনি মহানায়িকা না হলে হবেন কে?
বিশটা বছর ধরে পর্দা কাঁপিয়ে দাপটের সাথে রাজত্ব করা কোন নায়কের পক্ষেও অনেক কঠিন ব্যপার। সুচিত্রা সেন একজন নায়িকা হয়েও সেটা করে দেখিয়েছেন। তারকাদের উত্থান পতন থাকেই, তিনিই কি একমাত্র নারী তারকা নন যার কোন পতন ঘটেনি? শুরু করেছিলেন জয় দিয়ে।

বিশ বছর পর বিদায়ও যখন নিলেন, তখনও তিনি ছবির প্রধান নায়িকা এবং তাঁর ছবির টিকিটের জন্য তখনও মানুষ লাইনে ভিড় করছে।
আমার বিয়ের শাড়ি কিনতে আব্বু আম্মু কলকাতায় গিয়েছিলেন। পার্ক স্ট্রিট থেকে কেনাকাটি শেষে কলকাতা ঘুরতে বেরোলেন। বালিগঞ্জের কাছাকাছি এসেই আব্বুর বুক কাঁপতে লাগলো। পাশের গলিতেই সুচিত্রা সেনের বাড়ি! গত তিরিশ বছর ধরে তিনি এই বাড়িতেই আছেন।

কোথাও বেরোননা। চিরদিন যার ছবি বুকে লালন করে রেখেছেন, তাঁর এতটা কাছাকাছি আব্বুর এই প্রথম আসা।
আব্বু আম্মুকে বললেন, "চল আমরা ঐ বাড়ির সামনে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকি। "
আম্মু খুবই বিরক্ত হলেন। হাতে সময় এমনিতেই কম, সেখানে শুধু শুধু একটি বাড়ির সামনের ফুটপাথে দাঁড়িয়ে থাকার মানে কী?
তীব্র গলায় বললেন, "ওখানে দাঁড়িয়ে কী করবো?"
আব্বু আমতা আমতা করতে লাগলেন।


পরে দেশে ফেরার পর বলেছিলেন, আব্বুর মনে ক্ষীন আশা ছিল, যদি তিনি একবারের জন্য বারান্দায় এসে দাঁড়াতেন! একটি পলকের দেখা হলেও আব্বুর জীবনটা ধন্য হতো!
“রাজা যায়, রাজা আসে” - কথাটা সত্য। বাংলা চলচ্চিত্র উত্তম সুচিত্রার বিদায়ের পরে থেমে থাকেনি। তবে একটা কথা এখনও সত্য, উত্তম কুমারের যেমন কোন বিকল্প আসেনি, সুচিত্রা সেনেরও ক্ষেত্রে ঠিক তাই।
এক নায়িকা নাকি তার কাছের লোকজনদের বলেছিলেন, "সুচিত্রা সেনের মধ্যে এমন কী আছে যা আমাদের মধ্যে নেই?"
ঠিক কথা। তাঁর থেকে বেশি সুন্দরী নায়িকার আগমন প্রচুর ঘটেছে।

কিন্তু তাঁর মতন মহারানী হবার মতন যোগ্য "মহা নায়িকা" কেউ আসেনি। একটা সত্য সবারই স্বীকার করে নেয়া উচিৎ, পিতল ঘষে মেজে যতই চকচকে করা হোক না কেন, আসল সোনার ধারে কাছে যাবার যোগ্যতা তার নেই।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।