আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

রাজশাহীতে এখনো সংরক্ষিত আছে অত্যাচারী দেওরাজের নরবলী দেয়ার যন্ত্র , সেই যুপকাষ্ঠ (ছবিব্লগ)

Set sail, ye hearts~ into the sea of hope..

বাংলাদেশের অন্য যেকোনো জেলার ইতিহাসের চেয়ে রাজশাহী শহরের পত্তনের ইতিহাস আমাকে বেশি আকর্ষন করে। সেটা হতে পারে ছোটবেলা থেকে এই গল্পগুলো শুনে শুনে বড় হয়েছি তাই। কিন্তু গল্পের সেই মহাকাল গড় রাজ্য, দেওরাজের শাসন-শোষন, কালো জাদুর চর্চা, নরবলী..মানে শোষনের চরম পর্যায়ে চলে যাওয়া একটা জনপদ বলতে যা বোঝায়, তার সমস্ত উপাদানই ছিলো সেই রাজ্যে। সেখান থেকে ক্রমশ উত্তোরন, যুদ্ধ, নতুন রাজ্যের পত্তন..পুরোটাই যেনো টানটান একটা থ্রিলার উপন্যাস, পাতায় পাতায় ক্লাইম্যাক্সে ঠাসা।

তখনকার সময়ে ধান আর মাছ ছিলো অর্থনীতির মূল ভিত্তি, তাই সব শাসকদের মেইন ফোকাস থাকতো জেলে আর কৃষকদেরকে কিভাবে হাতে রাখা যায়।

তার জন্যে বিভিন্ন শাসক বিভিন্ন পদ্ধতি অবলম্বন করতো। দেওরাজের পদ্ধতিটা ছিলো এরকম, সে প্রতি বছর পূজার মৌসুমে একজন মানুষকে দেবতার উদ্দেশ্যে বলী দিতো, আর কাকে বলী দেয়া হবে সেটা ঠিক করা হতো প্রজাদের মধ্যে লটারি করে।

ধর্মের নামে কতকিছুই তো জায়েজ করা হয় এযুগেও। তখন সেটা হতো আরো ব্যপকভাবে। তাই এভাবে ভালোই চলছিলো সবকিছু।

প্রজারাও মেনে নিয়েছিলো, বছরে একটা মানুষই তো মরবে। প্রতিবছর এই দিনটা আসার আগে দুরু দুরু বুকে সবাই জড়ো হতো মন্দিরে। তারপর লটারীর ফল ঘোষনার সাথে সাথে হাঁপ ছেড়ে বাচতো সবাই। কে জানে হয়তো নাম ঘোষনার সাথে সাথেই মনে মনে পৈশাচিক আনন্দ অনুভব করতো অনেকে। যাক আপদ বিদায় হলো, আরো এক বছর সবাই মিলে নিরাপদে থাকা যাবে।

শুধু কান্নার রোল উঠতো একটা পরিবারে...



এর মধ্যেই একটা ঘটনা ঘটলো। সেসময় এর তাৎপর্য হয়তো কেউ সেভাবে বুঝে উঠতে পারেনি, কিন্তু এখন আমরা বুঝি এই সামান্য ঘটনা কতটা সুদূরপ্রসারী পরিবর্তন এনেছিলো এই জনপদে। এক বছর পূজার আগে বলীর লটারীতে উঠলো জেলে পাড়ার একটা ছেলের নাম। তাকে বলী দেয়া হলো সে বছর। এরপরের বছর লটারী করে দেখা গেলো এবারও উঠেছে সেই একই ঘরের মেজো ছেলের নাম।

সেই খবরে সেই পরিবারের প্রতিক্রিয়া কি ছিলো বা তারা প্রতিবাদ করেছিলো কিনা জানা তা আমাদের জানা নেই, তবে এটা জানা আছে যে সে বছরেও কোনো বিঘ্ন ছাড়াই নরবলী সুসম্পন্ন হয়েছিলো। এভাবেই চলে আসলো এরপরের বছর লটারির সময়। আমাদের সম্ভাব্যতার অংক কি বলে? সেই পরিবারের কারো আবার বলীর সম্ভাব্যতা কি খুব বেশী? না। কিন্তু পরের বছর লটারির সময় দেখা গেলো এবার নাম উঠেছে সেই বাড়ীর তিন ছেলের মধ্যে সবচেয়ে ছোট এবং শেষ সন্তানের নাম।

পরপর দুই ছেলেকে বলীর যুপকাষ্ঠে তুলে দেয়ার পর শেষ সন্তানের নাম লটারিতে উঠতে দেখে পিতার মনের ভেতর জ্বলে ওঠে বিক্ষোভের ছাই চাপা আগুন।

বলী দেয়ার দিন যতই সামনে আসতে থাকে, সে ছটফট করতে থাকে যদি কোনো ভাবে এই ছেলেটিকে পিশাচ রাজার হাত থেকে বাঁচানো যায়। কিন্তু একজন প্রবল প্রতাপশালী শাসকের বিরুদ্ধে সামান্য এক দরিদ্র জেলে কিই বা করতে পারে?

সে জানতো ততদিনে দিল্লীতে মোঘল শাসনের পত্তন হয়েছে, আরবের কন্টকাকীর্ণ শুষ্ক জমি পেরিয়ে মুসলিম শাসকরা ক্রমে এগিয়ে আসছে ভারতের উর্বর মাটির দিকে। হিন্দু রাজারা তা নিয়ে বিলক্ষণ দুঃচিন্তায় ছিলো। একমাত্র মুসলিম বাহিনীকে যদি কোনোভাবে এই দেওরাজের ভূমিতে আনা যায়, বলী অনুষ্ঠানের আগেই, একমাত্র তাহলেই হয়তো বাঁচানো যাবে তার শেষ সন্তানকে। এই আশার ক্ষীণ আলো জ্বালিয়ে রাখতেই অতি গোপনে সে যোগাযোগ স্থাপন করতে পেরেছিলো এক মুসলিম সাধকের সাথে।

তার কানে গিয়েছিলো , এই সাধক অত্যন্ত দয়ালু মানুষ। তার কাছে যদি সে এই অত্যাচারের কাহিনীটা খুলে বলতে পারে, সে নিশ্চই কোনো মুসলিম রাজার দরবারে তা পৌছে দিবে।

এই ভেবেই যোগাযোগ করে সে কিভাবে কিভাবে পৌছে গেলো সে সাধকের কাছে। ঠিক হলো সন্ধ্যায় পদ্মার তীরে আসবেন তিনি, নিজে কথা বলবেন সেই জেলের সাথে। আর ঠিক পরের দিন সকালেই হবে সেই বলীর অনুষ্ঠান।



সেদিন বিকাল গড়িয়ে সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসতেই এক জেলেকে দেখা গেলো উদ্ভ্রান্ত চেহারায় পদ্মার তীরে দাঁড়িয়ে থাকতে।

কখন সেই সাধক আসবেন, উদ্ধার করে নিয়ে যাবেন তাদেরকে। ক্ষণে ক্ষণে চকচক করে উঠে জেলে পিতার চোখ, আবার পরক্ষণেই চেহারা মিইয়ে যায় দুঃচিন্তায়।

কিন্তু অপেক্ষা করতে করতে অনেক রাত তো হলো, কোথায় সেই সাধক?

অনেক রাত পর্যন্ত অপেক্ষা করার পর একটা সময় জেলে বুঝতে পারলো আর এখানে দাঁড়িয়ে থাকা বৃথা। কেউ আসবে না তাদেরকে বাঁচাতে।

যা করার নিজেকেই করতে হবে। হয় পুরো পরিবার নিয়ে পালিয়ে যেতে হবে, ধরা পড়লে সপরিবারে মরতে হবে, আর নাহলে নিজেরাই নিজেদেরকে শেষ করে দিতে হবে। অন্তত আর কোনো ছেলেকে বলীর যন্ত্রে তুলে দেয়ার চেয়ে মৃত্যুই শ্রেয়।

হতাশ, নিরুপায়, বিব্রত সেই জেলে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ঘুরে দাড়ালো। আর একটা মুহুর্ত অপেক্ষা করে পা বাড়ালো বাড়ীর পথে...

ঠিক এমন সময় সে পেছন থেকে একটা ডাক শুনতে পেলো।

“এইইই যে এইই, দাঁড়াও...” হঠাৎ ডাক শুনে চমকে উঠে ঝট করে পেছন ফিরে তাকালো জেলেটি।

আজকের মতো কাহিনীটা এই পর্যন্তই থাকুক। কালের আবর্তনে প্রবল প্রতাপশালী সেই দেওরাজের পতন হয়েছে, মহাকাল গড়ের বিধ্বস্ত রাজ্যের উপর পত্তন হয়েছে রাজশাহী শহরের। তবে ইতিহাস অনেক কিছুই মনে রাখেনি, আমরা বিস্মৃত হয়েছি সেই পরিবর্তনের ঝান্ডা তুলে ধরা সেই জেলের নামধাম পরিচয়। কিন্তু কালের সাক্ষী হিসেবে থেকে গেছে নরবলী দেয়ার সেই যুপকাষ্ঠটি।

এর অনেক কলকব্জা হারিয়ে গেছে অবশ্য, তবে মূল ফ্রেমটা বর্তমানে সংরক্ষণ করা হয়েছে সেই মুসলিম সাধক, শাহ মখদুম (রহ) এর মাজারে।





মাজারের সাথে সংশ্লিষ্টদের মুখে যা শুনলাম, তাদের ভাষায়, যখন সব যন্ত্রপাতী সহকারে একটা মানুষকে এখানে বাঁধা হতো তার একটা পেশী নাড়ানোর ক্ষমতাও থাকতো না।

(শেষকথা: এই যুপকাষ্টেই বলী দেয়া হয়েছিলো ইসলামের ডাক নিয়ে প্রথম রাজশাহীতে আসা আরেক সাধক তুরকান শাহ রহ. কে। আপাতত সেদিকে যাচ্ছি না, সেটাও আবার আরেক লম্বা কাহিনী। )

--
আরও পড়ুনঃ
মুসলিম বিশ্বে ব্লাসফেমি: ধর্মের মুখোমুখি প্রগতি ও বাকস্বাধীনতা?


অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.