আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

আমরি বাংলা ভাষাঃ আবেগ ও বাস্তবতা



বাঙালি বড়ই আবেগপ্রবণ জাতি, ভাষা নিয়ে তাই আবেগ থাকবে এটাই স্বাভাবিক, আর আমাদের আবেগের সব চেয়ে বড় জায়গাটি-ই হচ্ছে এই বাংলা ভাষা। এই ভাষাতেই আমার অস্তিত্ব, এই ভাষাতেই আমার পরিচয়। তাই বলে এদেশের সবাই যে বাংলাকে শ্রদ্ধা কিংবা অন্তরের অন্তঃস্থল থেকে অনুভব করে তা কিন্তু নয়! তাই আজ শুধু আবেগের কথাই লিখবনা কিছু বাস্তবতার কথাও থাকবে!

প্রথমেই সবচেয়ে বেশি চোখে পরে এমন একটা দৃশ্য বলছিঃ

আমাদের চারপাশে দেখবেন সবার মুখে দেশপ্রেম উথলে উঠে, সময় অসময়ে দেখবেন কথায় কথায় ভারতের বিরুদ্ধে কথা বলে, পাকিস্তানের বিরুদ্ধে বলে। এটুকু হলে ঠিক ছিল, দেশ প্রেম বুঝা যেতো কিন্তু যখন দেখা যায় যে ভারতের/পাকিস্তানের বিরুদ্ধে কথা বলার ১০ সেকেন্ড পরেই শুনছে কোন হিন্দি কিংবা উর্দু গান তখন একে কি বলবেন? ভণ্ডামি নিশ্চয়ই! আমাদের এই বাংলাদেশ হয়েছে এই ভাষার উপর ভিত্তি করে আর এই ভিত্তিকে উপেক্ষা করে ভালবাসা, দেশপ্রেম সম্ভব? আমাদের এই দেশের এযাবৎ কালের সেরা জিনিস হচ্ছে সঙ্গীত, সঠিক ভাবে বললে বাউল এবং রক সঙ্গীত। বাউলরা সব সময় বাংলায় সঙ্গীত করে।

আমাদের রক শিল্পিরাও বাংলায় সঙ্গীত করে, চাইলে ইংরেজিতে করতে পারত, সারাবিশ্বে নাম কামাতে পারত, কিন্তু তারা তা করেনি, কারনটা ভালবাসার কিংবা বিবেকের জন্য অবশ্যই, তার চেয়েও বড় কারন বোধয় বাংলা ভাষার তেজ! এ ভাষায় কি নেই যা অন্য ভাষায় আছে? এ ভাষা এক ছাই চাপা আগুন।
আবেগের জায়গা থেকে কিছু বলার জন্য হুমায়ুন আজাদ এর ‘কত নদি সরোবর’ থেকে কয়েকটি লাইন নিলাম-
‘কত ভাষা এই পৃথিবীতে। ইংরেজি, ফরাসি, জার্মানি, জাপানি, রুশ, তামিল, তেলেগু, মালায়, আরবি, ফারসি, হিন্দি,হিব্রু ও আরো কত ভাষা। ইচ্ছে করলে আর সুযোগ পেলে আমরা শিখতে ও বলতে পারি যেকোনো ভাষা। কিন্তু পৃথিবীর প্রতিটি মানুষের রয়েছে একটি আপন ভাষাঃ মাতৃভাষা।

যে ভাষা তার মায়ের, যে ভাষা তার বাপের। যে ভাষা তার সমাজের অন্যান্যর, যে ভাষা তার নিজের। নিজ ভাষা বলে-শুনে যে সুখ, তা পাওয়া যায়না অন্য কোন ভাষায়। প্রতিটি মানুষের পরিচয় তার ভাষায়... কতদিন আমি দুরদেশে, তিন বছর ধরে, বাসে চেপে পায়ে হেতে তুষার ঠেলে বন্ধুর বাসায় টোকা দিয়েছি শুধু একটু বাংলা বলব বলে। শুধু একটু বাংলা শুনব বলে।

এমন হয় সব মানুষের-ই। পৃথিবীতে কতো ভাষা, তবু শুধু একটি ভাষাই তার কানের ভেতর দিয়ে মর্ম পশে। পৃথিবীতে কতো মা, তবু শুধু একজনের জন্যই চোখ জলে ভরে ওঠে। আনচান করে প্রাণ... পৃথিবীতে আরও বহু ভাষা আছে। তাদের কোনটির সৌন্দর্যে অন্ধ হয়ে যায় চোখ।

কোনটির ঐশ্বর্যের কাছে নুয়ে আসে মাথা...তবুও আমার কাছে বাংলার মত আর কোন ভাষা নেই... আমি বাংলা ভাষার রুপে আর শোভায় আর সৌন্দর্যে মুগ্ধ। আমার মায়ের মুখের মত সে শান্ত। তার অশ্রুর মত সে কোমলকাতর... যখন বাংলা ভাষা দীর্ঘশ্বাস ফেলে তখন আমার চণ্ডীদাসের কথা মনে পড়ে। তার উল্লাসে আমার মনে পড়ে মধুসূদনের মুখ। তার থরোথরো ভালবাসার নাম আমার কাছে রবীন্দ্রনাথ।

তার বিজন অশ্রুবিন্দুর নাম জীবনানন্দ। তার বিদ্রোহের নাম নজরুল। বাংলা আমার ভাষা। এ-ভাষা ছাড়া আমি নেই। ’

দ্বিতীয় যে বিষয়টি সব সময় পরিলক্ষিত হয়ঃ
বাংলা ভাষা স্নেহ পায়নি সমাজপ্রভুদের।

এ ভাষা অবহেলিত হয়েছে উচ্চবিত্তদের কাছে, আগেও এবং এখনো। বরং আগের চেয়ে এখন আরও বেশী আকারে, কারন নব্য ধনী শ্রেণীর উত্থান। তাদের ভাবখানা এমন যে আমজনতার ভাষা বাংলা, তাদের সাথে শ্রেণী পার্থক্য দেখানোর জন্য অন্যকোনো ভাষায় কথা বলতে হবে। ঠিক যেমন বাংলার নবাব হয়েও সিরাজ-উদ-দউলা উর্দু তে কথা বলতো, আর আমাদের বর্তমান সময়ে আধুনিকতার ও শিক্ষিতের ধুঁয়া তুলে চলছে ইংরেজি! ২ টা ইংরেজি শব্দ পারলে টা দেখানোর কি এক অসুস্থ প্রয়াস! এর জন্য দায়ী কে? আমি বলব আমাদের মিডিয়া! পৃথিবীতে অনেক উন্নত জাতি আছে যারা ইংরেজি ছাড়া দিব্বি চলছে, নিজেদের মধ্যে। কোন জার্মান, সুইডিশ কিংবা কোন জাপানি নিজেদের সাথে কথা বলার সময় কখনো কোন ইংলিশ শব্দ উচ্চারন করেনা।

তাই বলে ভাবা ঠিক হবেনা যা তারা ভাল ইংলিশ পারেনা, আমাদের চেয়ে ঢের ভাল ইংরেজি জানে, আমি এর অনেক চাক্ষুষ প্রমান দেখেছি। যারা নিজ দেশে নিজেদের লোকজনের সাথে ভাব/উচ্চশ্রেণী জাহির করার জন্য অন্যকোনো ভাষা বলে তাদের নিয়ে আমি আর কি বলব, ৫০০ বছর আগে কবি আব্দুল হাকিম তাদের জন্ম পরিচয় নিয়ে প্রশ্ন তুলেগেছেন! বাংলাতে থেকে, বাংলাতে নিঃশ্বাস নিয়ে যারা বাংলাকে অবজ্ঞা করে তাদের নিয়ে তিনি লিখে গেছেনঃ

‘যে সব বঙ্গেতে জন্মে হিংসে বঙ্গবাণী ।
সে সব কাহার জন্ম নির্ণয় ন জানি । । ’

যাদেরকে কবি ৫০০ বছর আগে বলেছিলেন বেজন্মা, তারা এখনো আছে এই বাংলায়, এ সংখ্যা বেড়েই চলেছে!!

আরও একটি বিষয়ঃ

অশিক্ষিত লোকেরা ইংরেজি জানেনা তাই বাংলায় কথা বলে, একদিক দিয়ে তো তাও তারা বাংলার সেবা করছে! কিন্তু বেশীরভাগ শিক্ষিত লোক কথা বলার সময় ২০-৩০% ইংরেজি ছাড়বেই! এ বিষয়ে যদি প্রশ্ন করেন তবে উত্তর পাবেন যে ‘সব শব্দ বাংলায় বলা যায় না!’ তার মানে বাংলা স্বয়ংসম্পূর্ণ ভাষা নয়! যাদের এই ধরনের ধারনা আছে তাদের জন্য একটা উদাহরন আছে- সত্যেন্দ্র নাথ বসু বাংলার সবচেয়ে বড় বিজ্ঞানী, ‘ বোস-আইনস্টাইন তত্ত্ব’ এখনো পৃথিবীর সবচেয়ে বড় গবেষণার বিষয়।

তো, তিনি একদিন (আজ থেকে ৬০-৬১ বছর আগে) কোলকাতায় এক বিজ্ঞানসভায় ‘পদার্থ বিজ্ঞানের ভবিষ্যৎ এবং কোয়ান্টাম মেকানিক্স’ নিয়ে ১ ঘণ্টার একটা বক্তৃতা দিয়েছিলেন এবং সে বক্তৃতায় একবারও একটিও ইংরেজি শব্দ উচ্চারণ করেননি। তার মানে যা ৬০ বছর আগে সম্ভব ছিল আজ তাকেই আমরা অসম্ভব বানিয়ে ফেলেছি মাত্রাতিক্ত ইংরেজি অনুশীলনে! একটু সচেতন হলেই ইংরেজি শব্দ এড়িয়ে খাঁটি বাংলায় কথা বলা যায়।

যে বিষয়টিকে এড়িয়ে যাওয়া যাচ্ছে নাঃ

আমরা অনেকেই আকাশ সংস্কৃতির এই যুগে বাংলাদেশে ভারতীও তথা হিন্দি ভাষার আগ্রাসনে ভারতকে দোষ দেই, একটু ঠাণ্ডা মাথায় ভেবে দেখুন তো এটা কী ভারতীয়দের দোষ নাকি আমাদের? ওরা কি আমাদের জোর করে চাপিয়ে দিয়ে হিন্দি শুনাচ্ছে? নাকি আমরাই শুনছি? আর, টেলিভিশনের সব চ্যানেল কি হিন্দি? আমার জানা মতে ৫০% এর বেশী হবেনা। তাই বলা যেতে পারে বিকল্প আছে। আমরা নিজেরা টিভি খুলে হিন্দি সিরিয়াল, সিনেমা, নাচ-গান দেখব আর দোষ দিব ভারতীয়দের?! সঠিক কথাটি হচ্ছে, কে কি দেখবে, কি শুনবে এটা তার বাক্তিত্তের- আধুনিকতার পরিচয়।

আর, এখানেই আমাদের সমস্যা! হিন্দি সিরিয়াল-সিনেমা দেখে নিজেকে আধুনিক ভাবা!! ইন্টারনেটের কথাই ধরুন- ইউটিউব থেকে শুরু করে পর্ণসাইট সবই আছে, আপনি কোন সাইটে যাবেন এটা একান্তই আপনার উপর, আপনার বাক্তিত্ত ও আধুনিকতার উপর নিরভর করে। আপনি চাইলে সামুতে গিয়ে একটা ভাল লেখা লিখতে পারেন আবার অই সময়টা বাজে কোন সাইটে কাঁটিয়ে দিতে পারেন!

বশেষে বলবো, বাংলাদেশ-ই পৃথিবীর একমাত্র দেশ যার রাষ্ট্রভাষা বাংলা, তাই বাংলা ভাষাকে রক্ষা করা আমাদেরই দায়িত্ব (ভারতের পশ্চিমবঙ্গের ভাষা বাংলা কিন্তু তার উপর আছে হিন্দির প্রভাব এবং ওরা অনেক সময় হিন্দিতেই কথা বলে। আর, ১৯৫০ এর পর বাংলা সাহিত্যে ওদের চেয়ে আমাদের অবদান অনেক গুন বেশী যা বাংলা সাহিত্যের রাজধানী কলকাতা থেকে সরিয়ে ঢাকাতে নিয়ে এসেছে বহু আগেই!)।
‘’আমরা এক মহান ভাষার ধারক। আমাদের শয়নে, স্বপ্নে, বাস্তবতায় থাকুক বাংলা।

সর্বক্ষেত্রে থাকুক বাংলা, শুধু বিদেশীদের সাথে যোগাযোগের মাধ্যমের জন্য ইংরেজি, এছাড়া অন্যকোনো ভাষা নয় এই বাংলাতে। জয় হোক বাংলার, সারা পৃথিবীব্যাপী ছড়িয়ে যাক বাংলা। ‘’

মৃত্যুঞ্জয়ী ভাষা শহীদদের জানাই বিনম্র শ্রদ্ধা। ।



অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।