আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

বিদায় ঘটনাবহুল ২০১২

কুয়াশার চাদর মোড়া নগরে আজ সন্ধ্যায় যে সূর্যটা অস্ত যাবে তার মাধ্যমে আজ সোমবার দেশের মানুষ বিদায় জানাবে পুরনো বছরকে। আগামীকাল মঙ্গলবার নতুন বছরের সূর্যটা দশ দিগন্ত আলোকিত করবে। আশায় বুক বাঁধবে মানুষ। নতুন দিনে, নতুন বার্তার প্রত্যাশা নিয়ে আজ বছরের শেষ দিন কেটে যাবে। আর সাধারণ মানুষের কাছে এটি অন্য সব দিনের মতোই একটি দিন।

বিদায়ী বছরে দেশে সবচেয়ে কষ্টে ছিলেন কৃষকেরা। ফসলের সঠিক দাম পাননি তারা। সময়মতো তারা বিদ্যুৎ-সারও পাননি। তবুও কঠিন এই বহমান সময়ে নিজেদের টিকে থাকার লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন তারা। ধান ও মওসুমি ফসলের ওপর যেসব পরিবার নির্ভরশীল তাদের অবস্থা কতটা কঠিন তা কেবল উত্তরবঙ্গের কৃষক পরিবারের দিকে চোখ বুলালেই দেখা যাবে।

তবুও সরকার বলছে, মানুষ ভালো আছে। কতটা ভালো? এ নিয়ে নানাজনের নানা মত থাকতে পারে। গতকাল বিকেলে যে রিকশায় চড়ে অফিসে যাচ্ছিলাম তার কথাÑ ‘ভাইজান জীবন আর চলে না। ’ জীবন চলতে পারে না। কারণ চলমান সঙ্ঘাত দেশের পরিবেশকে করেছে বৈরী।

জিনিসপত্রের দাম লাগামছাড়া। এর ভেতর দিয়ে চলতে হচ্ছে আমাদের। চলতে হবেই। সরকার আপাতত কোনো সুখবর দিতে পারছে না। তাদের নজর রাজনৈতিক পুষ্টি জোগানের দিকে।

খাদ্য অপুষ্টিতে জাতি যে রুগ্ণ হয়ে যাচ্ছে সে দিকে কোনো নজর তাদের নেই। বিদায়ী বছরে বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক ইলিয়াস আলী গুম হয়েছেন। তিনি রাজনৈতিক নেতা বলে তার কথা আমাদের মনে আছে। কিন্তু গুমের তালিকা অনেক লম্বা। সাধারণ অনেক মানুষ গুম হয়েছেন।

তাদের কারো লাশ পাওয়া গেছে নদীনালায়। মানবজীবনের এমন করুণ পরিণতির কোনো ব্যাখ্যা দিতে পারেনি সরকার। বিরোধী দল দলন ইচ্ছেমতো করেছে সরকার। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সরকারদলীয় কর্মীর ভূমিকায় মাঠে ছিল বছরজুড়ে। হরতালের সময় এক যুবকের গলায় পা রেখে পুলিশ বুঝিয়ে দিয়েছে আমজনতা কোনো মানুষের কাতারেই পড়ে না।

বছরজুড়েই সরকারের আলোচনা ছিল মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার আর বিরোধী মতের সমালোচনায় মুখর। কেবল রাজনৈতিক নয়, অরাজনৈতিক ক্ষেত্রেও দরকার নেই এমন প্রসঙ্গ নিয়ে ব্যাপক সমালোচনার জন্ম দিয়েছে মহাজোট সরকার। নোবেল বিজয়ী প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে ঘিরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আব্দুল মুহিতের বক্তব্য নিয়ে তোলপাড় হয়েছে। সরকারের তরফে ড. ইউনূসের আয়ের ট্যাক্সসহ নানাবিধ বিষয়ে খতিয়ে দেখা হচ্ছে। গ্রামীণ ব্যাংক সহযোগী প্রতিষ্ঠানের আয়কর দেয়া হয়েছে কি না, কেমন অনিয়ম করেছে, ড. ইউনূস কতটা মেরেছেনÑ এসব ছিল সরকারের প্রধান কনসার্ন।

কিন্তু শেষতক কিছুই ধরতে পারল না। গ্রামীণ ব্যাংকে ড. ইউনূসের আধিপত্য কমাতে সরকার আগস্ট মাসে বদলে ফেলে গ্রামীণ ব্যাংক অধ্যাদেশ। পরিচালনা পর্ষদ চেয়ারম্যানকে ক্ষমতা দেয়া হয় ব্যবস্থাপনা পরিচালক খুঁজে বের করার। সে ক্ষমতা বলে তিনি ব্যবস্থাপনা পরিচালক অনুসন্ধান কমিটিও করেছেন। খবরের কাগজে বিজ্ঞপ্তিও প্রকাশ করেছেন।

কিন্তু কমিটি থেকে সরে দাঁড়িয়ে পর্ষদ সদস্য তাহসিনা পুরো কমিটিকেই প্রশ্নের মুখে ফেলেন। এ নিয়ে বছরজুড়েই ড. ইউনূস ও গ্রামীণ ব্যাংক ছিল আলোচনার শীর্ষে। শেয়ারবাজার ছিল গত বছরের সবচেয়ে বেদনাদায়ক অধ্যায়। লাখ লাখ বিনিয়োগকারীর অশ্রুও সরকারের দৃষ্টিগোচর হয়নি। এ কেলেঙ্কারিতে জড়িত ছিলেন বড় বড় রাঘববোয়াল।

এক রকম ধামাচাপাই দেয়া হয়েছে এই কেলেঙ্কারি তদন্তের রিপোর্ট। এমনকি এই বিনিয়োগখেকোদের নাম পর্যন্ত প্রকাশ করা হয়নি। বিনিয়োগ হারিয়ে আত্মহত্যার নজিরও রেখে গেল ২০১২। রামু ও উখিয়ায় বৌদ্ধবিহারে হামলা হয়েছে বিদায়ী বছরে। হাজার বছরের ইতিহাসে এটি একটি ব্যতিক্রম ঘটনা।

এ ঘটনা দেশে ও দেশের বাইরে রাষ্ট্রের ভাবমর্যাদা ক্ষুণœ করেছে মারাত্মকভাবে। কিন্তু সরকার চেষ্টা করেছে এখান থেকে কিভাবে ফায়দা তোলা যায়। তাই স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতামূলক তদন্তের বাইরে একপেশে রিপোর্ট প্রকাশ করে নতুন বিতর্ক জন্ম দিয়েছে। বিরোধী মত দমনের কৌশল হিসেবে সরকার এটাকে ব্যবহার করে। সে জন্য ঘটনার তিন মাস পরেও এ নিয়ে কোনো বিচারিক কাজ শুরু করা যায়নি।

বছরজুড়ে শিক্ষাঙ্গনে ছিল অস্থিরতা। বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনায় রাজনৈতিক বিবেচনা প্রাধান্য পাওয়ায় বুয়েটজুড়ে ছিল ক্ষোভ-বিক্ষোভ। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রামসহ দেশের প্রায় সব বিশ্ববিদ্যালয় ছিল অস্থির। ছাত্রলীগের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড ছিল লাগামহীন। তাদের নিয়ন্ত্রণে সরকার বরাবরের মতোই ছিল ব্যর্থ।

পার্বত্য চট্টগ্রামে অস্থিরতা ছিল বছরের মাঝামাঝিতে। রাঙ্গামাটি জেলায় পাহাড়ি ও বাঙালিদের মধ্যে সঙ্ঘাত হয়েছে। তুচ্ছ ঘটনা নিয়ে সমস্যায় দুই পক্ষের মধ্যে বিরোধ দেখা দেয়ায় পাহাড়ে নিরাপত্তা হুমকির মুখে পড়ে। পার্বত্য চট্টগ্রামের ভূমি সমস্যার সমাধানে করা কমিশনের চেয়ারম্যানের মেয়াদ শেষ হওয়ার পরেও সেখানে নতুন করে কাউকে নিয়োগ দেয়া হয়নি। তবে বাঙালিদের বিরোধিতা উপেক্ষা করে সরকারের কুড়িটির বেশি বিভাগের দায়িত্ব স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠান, আঞ্চলিক পরিষদ ও জেলা প্রশাসনের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে।

বছরজুড়ে পাহাড়ে জনসংহতি ও ইউপিডিএফের মধ্যে ছিল সঙ্ঘাত। মারা গেছে অন্তত ১০ জন। আন্দোলন-সংগ্রামে মুখর ছিল গোটা দেশ। বিরোধী দল রাজপথে অবস্থানসহ বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করে। বছরের শেষ দিকে এসে দ্বিতীয়বারের মতো বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরকে গ্রেফতার করা হয়।

এর আগে মির্জা ফখরুলসহ ৩৩ জন নেতাকে গ্রেফতার করা হয়েছিল। পরে অবশ্য তারা জামিনে মুক্ত হন। বছরের সবচেয়ে বড় আলোচিত ঘটনা ছিল স্কাইপ কেলেঙ্কারি। মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারে গঠিত আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনালের বিচারক নিজামুল হকের সাথে প্রবাসী আইনজীবী আহমেদ জিয়াউদ্দিনের সংলাপ ফাঁস হয়ে যায়। আমার দেশ পত্রিকা এটি প্রকাশ করলে সরকার ক্ষিপ্ত হয়।

নিজামুল হক পদত্যাগে বাধ্য হন। সরকার আমার দেশ-এর ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক মাহমুদুর রহমানের বিরুদ্ধে সাইবার অপরাধ আইন ও রাষ্ট্রদ্রোহ আইনে মামলা করে। বর্তমানে তিনি পত্রিকা অফিসে বন্দী জীবন যাপন করছেন। হলমার্ক কেলেঙ্কারি পুরো দেশের অর্থনীতিতে নেতিবাচিক প্রভাব ফেললেও অর্থমন্ত্রী এ ঘটনায় বেহাত হওয়া অর্থকে এমন বড় কোনো অঙ্কের টাকা নয় বলে উল্লেখ করে ব্যাপক সমালোচনার মুখে পড়েন। সরকারের একজন উপদেষ্টা এ কেলেঙ্কারির সাথে জড়িত থাকলেও তার বিষয়ে কঠোর কোনো পদক্ষেপ চোখে পড়েনি।

একইভাবে ঘটেছে ডেসটিনি কেলেঙ্কারি। সাধারণ মানুষের শত শত কোটি টাকা লুটে নেয় প্রতিষ্ঠানটি। পদ্মা সেতু কেলেঙ্কারির নায়ক আবুল হোসেনকে প্রধানমন্ত্রী দেশপ্রেমিক বলে বর্ণনা করেন। লন্ডনে তিনি এমন কথা বলার পর এ নিয়ে তুমুল সমালোচনার মুখে পড়েন। সেই দেশপ্রেমিক সৈয়দ আবুল হোসেনকে বাদ দিয়ে দুর্নীতি দমন কমিশন দুদক মামলা করে সাতজনের বিরুদ্ধে।

তাদের দু’জন গ্রেফতার হয়েছেন। তবে বিশ্বব্যাংক ফেরেনি পদ্মার অর্থায়নে। সামনে ফিরবে কি না তা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে। বিশ্বব্যাংক বর্তমান সরকারের পদ্মা সেতু প্রকল্প স্বচ্ছ নয় বলে সরাসরি অর্থায়নের প্রস্তাব নাকচ করলে সরকার নিজের টাকায় পদ্মা সেতু দুইখান বানাবে বলে ঘোষণা করে বিভিন্ন দানের টাকা নেয়ার জন্য অ্যাকাউন্টও খোলে। এতে অবশ্য সাড়া পাওয়া না যাওয়ায় সরকার বাধ্য হয়ে ফের বিশ্বব্যাংকের কাছে ধর্ণা দেয়।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিশ্বব্যাংকের অর্থায়ন বাতিলের জন্য ড. ইউনূসকে অভিযুক্ত করেন। তবে ড. ইউনূস এটি উড়িয়ে বলেন, এটি কোনো বিশ্বাসযোগ্য অভিযোগ হতে পারে না। রেলমন্ত্রী সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত অভিযুক্ত হন উৎকোচ গ্রহণের দায়ে। মন্ত্রিত্ব ছেড়ে আবার দফতরবিহীন মন্ত্রী হিসেবে যোগ দেন তিনি। বছরজুড়ে কালো বিড়ালের অর্থ কেলেঙ্কারি ছিল আলোচনায়।

বর্বরতার সবচেয়ে বড় উদাহরণ রেখেছেন ছাত্রলীগের জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। তারা বিশ্বজিৎকে কুপিয়ে হত্যা করে নিজেদের শক্তিমত্তা প্রমাণের চেষ্টা করেন। বিশ্বজিৎকে জামায়াত-শিবিরকর্মী সন্দেহে কুপিয়ে আহত করার পর চিকিৎসা নিতে বাধা দেয়ার অভিযোগ ওঠে। বড় নির্মম হত্যাকাণ্ডের বিচারে সরকারের টালবাহানা চলে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও প্রধানমন্ত্রীর প্রেস সচিব দু’জনই বলেছেনÑ ছাত্রলীগকর্মীরা আসলে বিশ্বজিৎকে মারেনি।

মেরেছে শিবিরকর্মীরা। পরে অবশ্য গণমাধ্যমে খবর প্রকাশের পর ছাত্রলীগের কয়েকজনকে গ্রেফতার করা হয়। ইসলামি রাজনীতির বিরুদ্ধে অবমাননাকর উক্তি করে জুতার কবলে পড়েন মন্ত্রী শাজাহান খান। একই মন্ত্রী একটি বেসরকারি টিভি টকশোতে গিয়ে বিরোধী দলের এক নেতাকে মারতে তেড়ে যান। তা নিয়েও ছিল সমালোচনা।

প্রযুক্তিবান্ধব বলে দাবিদার এ সরকার বলেছিল ১০ হাজার টাকায় দোয়েল ল্যাপটপ পৌঁছে দেয়া হবে জনগণের হাতে। কিন্তু সেটি বাস্তবায়ন করতে পারেনি। বড় ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে তৃতীয় প্রজন্মের মোবাইল ফোন সেবা চালুর ক্ষেত্রেও। বছরের শেষ নাগাদ এর জন্য কোনো নীতিমালা পর্যন্ত চূড়ান্ত করতে পারেনি। বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক ভালো করতে শেখ হাসিনা এবং বেগম খালেদা জিয়া ভারতের শরণাপন্ন হয়েছেন।

বিএনপির নীতিতে বড় ধরনের পরিবর্তন এসেছে বলে মনে করেন অনেকে। খালেদা জিয়া ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ক নিয়ে একটি নিবন্ধ লেখেন এবং সপ্তাহজুড়ে ভারত সফর করেন। ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।