আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

সারপ্রাইজ

। । ১। ।
"কী কর, নানা? কী কর তুমি একা একা? ঘুম নাই?"
বাসার সামনে চৌকোনো খোপ খোপ গ্রিল দেয়া বারান্দার এক্কেবারে কোনাটায় ছোট্ট একটা কাঠের চেয়ার, কালো ভার্নিশ করা।

পাশে একটা ছোট্ট গোল টেবিল। গ্রিল কেটে দুপুরের মায়া মায়া রোদ খোপ খোপ হয়ে বারান্দায় পড়ছে, অমনি পড়ছে টেবিলটাতেও। টেবিলে ছড়ানো ছিটানো রঙ, রঙ তুলি, সাইন পেন। নানান রঙের। আঁকার খাতা নিয়ে গভীর মনোযোগে কী আঁকছে তিয়ানা- অথবা লিখছে- হাতে রঙ লেগে আছে।

কিছুক্ষণ গালে হাত দিয়ে ভেবে নিয়েছিল বোধ হয়- সবুজ ছাপ পরেছে সে খেয়াল নেই।
নানার ডাক শুনে ফিরে তাকালো একবার, আবার মুখ ফিরিয়ে নিল। কত কাজ, শেষ করতে হবে না!
"দেখি তো নানা, কী কর! দাও তো দেখি!"
নানা এগিয়ে আসেন নাতনীর দিকে। হাত বাড়ান টেবিলে!
"না! না! না!" রীতিমত আঁতকে ওঠে তিয়ানা, "দেখবা না! এইটা সারপ্রাইজ!"
নানা চোখ বড় বড় করেন শুনে। "তাই নাকি?"- হেসে জিজ্ঞেস করেন।

"তা কার জন্য? আমার জন্য নাকি?"- হাত সরিয়ে এনে চুলগুলো এলোমেলো করে দেন একটু, গালের রংটা মুছে দেয়ার চেষ্টা করেন আলতো করে।
"বলা যাবে না! সারপ্রাইজ না!?" তিয়ানা চটপট জানায়। হাতের কাগজটা নিয়ে ওঠেও যায়, এখানে আর বসা যাবে না, সবাই খালি বিরক্ত করে! আর নানা বেড়াতে এলে এই চেয়ারে বসেই জামা-জুতো ছাড়েন, ও জানে। অন্যদিন হলে ও নানার পাঞ্জাবীর পকেটটা দেখে নিত একবার, বিস্কুট না চকলেট এলো, বুঝে নেয়ার ব্যাপার আছে। আজকে সেটাও করল না- সময় কোথায়!


। ২। ।
'সারপ্রাইজ' শব্দটা তিয়ানা কিছুদিন আগে শিখেছে।
আব্বু গিয়েছিল কলকাতা, আপিসের কাজে।

যাবার আগে জিজ্ঞেস করল- "বাবান! কী আনব বল তোমার জন্য?" কলকাতায় আনন্দ পাবলিশার্স আছে ও আগে থেকেই জানে, মাসে মাসে টিনটিন আর অ্যাসটেরিক্স আর শঙ্কু আর ফেলুদার যে রঙ্গিন কমিক্সগুলো বাসায় আসে তার মলাটে ঠিকানা লেখা থাকে। ও ওগুলোই বলেছিল আনতে।
তা আব্বু ফিরে এলো, কমিক্সসমেত। নতুন রঙ্গীন কমিক্স সব। আর বলল- 'মামনি, আরেকটা জিনিস আছে তো তোমার জন্য? নেবে না?"
তিয়ানা অবাক হল।

আবার কী? কমিক্স তো পেয়েইছে! আব্বু এইবার আম্মুর দিকে তাকালো, আম্মু একটু হাসল আর গিয়ে রুমের কোনায় স্টিলের আলমিরা খুলে দাঁড়ালো- আর ডাকল চোখে চোখে- "এসো! নিজেই দেখে যাও!"
খালি পায়ে বিছানা থেকে নামতে যাচ্ছিল, আম্মুর ভ্রু কুঁচকে যেতে দেখে স্যান্ডেলটা পড়ে নিয়ে গেল আর উঁকি দিল ভেতরে- আর চোখগুলো বড় বড় হয়ে গেল ওর- একটা লাল রঙের স্কুল ব্যাগ,ওপরে টিনটিন আর কুট্টুসের ছবি, কুট্টুসের মুখে একটা বড়সড় হাড়! ও কবে থেকে চাইছে টিনটিন ব্যাগ, আব্বু বলেছে কিনে দেবে, দেয়নি। দৌড়ে এসে আব্বুকে জড়িয়ে ধরে ও, খুশিতে, "আগে তো বল নি?"- ঠোঁটজোড়া হাসিতে জিজ্ঞেস করে।
"সারপ্রাইজ!" আব্বু বলল তখন- "আগে জানলে এত ভাল লাগত? এত আনন্দ হত?" ব্যাগটা খুলে দেখাতে দেখাতে জিজ্ঞেস করল- "এখন বেশি ভাল লাগছে না?"
"হ্যাঁ!"- ও বলল ছোট্ট করে। কমিক্সগুলো ব্যাগে নিয়ে এরপর সবাইকে দেখাবে না শুধু ব্যাগটাই দেখাবে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে সেটাই তখন ভেবে পাচ্ছে না তিয়ানা।
তবে, সেইদিন থেকেই ও জানে, সারপ্রাইজের চে ভাল কিছু হয় না!


। ৩। ।
"কীকরকীক্করকীক্কর?!"
ইনানের গলা শুনতেই উবু হয়ে বসা থেকে এক পলকে দাঁড়িয়ে যায় তিয়ানা। "না না না না না না"- কী করবে ভেবে পায় না, তাড়াহুড়ো করে রং-এর টিউবগুলো সরিয়ে নেয়ার চেষ্টা করে, তুলিটা হাত থেকে পড়ে যেতে ঝটপট তুলে নেয় আবার মেঝে থেকে- দুহাত উঁচু করে ধরে ইনানের হাতের নাগালের বাইরে- ও ততক্ষণে কাছে চলে এসেছে- ফ্রক ধরে টানছে- নেয়ার চেষ্টা করছে-
"দাওদ্দাওদ্দাওদ্দাও!"
কথা শিখেছে মাত্র ইনান।

থপথপ করে হাঁটে আর কথা বলতে থাকে কেবল। এক কথা বার বার বলে। বলতেই থাকে।
"না না না না এটা না বাবু এটা না! তুমি আম্মু যাও!" তিয়ানা ওর মনোযোগ হাতের রঙ তুলি থেকে সরিয়ে দেয়ার চেষ্টাটা করে- "তুমি না ভাল! তুমি না লক্ষ্মী!"- আম্মুর বলা কথাগুলি চটপট বলে ফেলে।
বারান্দা থেকে এসে ও বসেছে ভেতরের টিভি রুমের মেঝেতে।

আম্মু ঘুমাচ্ছে, ইনানও ঘুমাচ্ছিল, ঘুম ভেঙ্গে চলে এসেছে! আম্মুও ওঠে গেল নাকি! আয় হায়!
একেবারে বুক ধ্বক করে ওঠে ওর! আম্মু জেনে ফেললে কী করে হবে!
তিয়ানা দরজার দিকে চোখ রেখেই তাড়াতাড়ি রঙ আর তুলি নিয়ে টিভির ট্রলির নীচে লুকানোর চেষ্টা করে। ওখানে রেখে ঘুরতেই বোঝে কী বিশাল ভুলটা হয়ে গেছে এর মধ্যে-
"আমাত আমাত আমাত"- করছে ইনান- মেঝেতে বসে- হাতে একটা কাগজ-মুঠি করা- মুখে দেয়ার চেষ্টা করছে-
"আম-মু-উ-উ-উ!"- আর সইতে পারে না তিয়ানা, ওর সাধের কাজের এই দশা দেখে- ডুকরে কেঁদে ওঠে একদম-
আম্মু তাড়াতাড়ি এসে ইনানকে কোলে নেন। "কী হয়েছে?"- মেয়ের দিকে এগিয়ে আসতে আসতে জিজ্ঞেস করেন- কান্নাকাটিকে সাংঘাতিক ভয় তাঁর- একজনের চোখে পানি দেখলে অন্যজনের কান্নাকাটি শুরু হয়- এদের সামলানো তখন দুরূহ ব্যাপার-
তিয়ানার তখন আর নড়াচড়ার অবস্থা নেই। চোখ দিয়ে অঝোরে পানি পড়ছে, মাঝে মাঝে কেঁপে উঠছে, আঁকাআঁকি করছিল বোঝাই যাচ্ছে- হাতের কালি গালে লেগে আছে, এখন আবার চোখ মোছার ফাঁকে চোখের উপরেও পৌঁছেছে- "আমার- " এই বলতেই আবার ঠোঁট ভেঙ্গে আসে। ওর চোখ ইনানের হাতের কাগজে।


এইবারে আন্দাজ হয় তাঁর, ছেলের হাত ছাড়িয়ে নেন কাগজটা- "আমাত আমাত আমাত" করে তীব্র প্রতিবাদ জানায় ইনান, আরো একবার- ছিঁড়ে নেয় একটা কোনা- মুখে পুরে দিয়ে একগাল হাসি দেয়-
"না না না না ওটা খেয়ো না-" কান্না ফেলে হা হা করে আসে তিয়ানা, ভাইয়ের জন্য তার অসীম টান- "ফেলে দাও ফেলে দাও!"- "আমাত আমাত আমাত" আবারো দাবী পরিস্কার করে ইনান।
"এই এই এই কী হয়েছে এখানে কী হয়েছে?"- ঘরে এসেই জিজ্ঞেস করেন নানা- দুই ভাই বোনের দিকে তাকান একবার, এরপর ওদের মায়ের দিকে-
আম্মুর হাতে ছেঁড়া কাগজটা, খোলা-
দুমরানো কাগজটা এগিয়ে দেন তিনি- নানান রঙ এ কতগুলো শব্দ লেখা, আলাদা আলাদা করে,
"শু ভ জ ন্ম দি ন, আ ম্মু!!!"
"এই জন্যেই তো বলি বাপ-মেয়েতে দুইদিন ধরে কী এত গুজগুজ ফুসফুস চলছে"- আম্মু নানাকে বলেন, "বিকেলে ফিরবে বলে ছুটির দিনে বেরিয়েছে আর মেয়ে এই নিয়ে ব্যস্ত!"
নানা মুখে হাসি ঝুলিয়ে নাতনীর দিকে চোখ ফেরান-
তিয়ানার মুখে এগাল ওগাল হাসি- হাতের চেটোয় ভেজা গাল আরেকবার মুছে নেয় ও- গালের সবুজ রঙ আরো একটু ছড়ায়- আম্মুর দিকে তাকাতেই শব্দ পেয়ে যায় খুঁজে-
"সারপ্রাইজ!"
[ফুটনোট ১।
এখন থেকে প্রায় এক যুগ বা তার চাইতে বেশি সময় চলে গেছে হয়ত। তখন সন্ধ্যার পর 'মাইক্রোসফট এক্সেল'-এর বদলে 'ডেনিস দ্য মেনিস', 'টম এন্ড জেরি', 'আঙ্কল স্ক্রুজ', 'মিকি মাউজ' দেখাটাই রুটিন ছিল। টিভির সামনে চেয়ার দুলিয়ে দুলিয়ে দেখার অভ্যাসে বাঁধা পড়ল হঠাৎ- কার্টুন দেখার বদলে একজন নতুন খেলা বের করলেন- চেয়ারে বসে আমাকে পা সোজা করে বসে বসে কার্টুন দেখতে হবে।

এই সময়টায় তিনি কখনো একা, কখনো সাঙ্গপাঙ্গদ সমেত পা বেয়ে বেয়ে কোলে ঊঠবেন এবং ওগুলোকে 'স্লিপার' হিসাবে ব্যবহার করে পিছলে নামবেন। উঠবেন এবং পিছলে পড়বেন। ক্লান্তি না আসা প্পর্যন্ত এমন চলতেই থাকবে আর এ সময় মোটেই চেয়ার ছাড়া চলবে না।
এ লেখাটা যখন লিখছি তখন তিনি এবং তার সাঙ্গপাঙ্গরা পরের দিনের বাংলা দ্বিতীয় পত্রের বৈতরনী পেরনোর উপায় খুঁজে স্বপন দেখছেন হয়ত! তিয়ানা, ঋদ্ধ, ইউশা- তিনজন এইবার এস এস সি দিচ্ছে।
ত্রয়ীর প্রথমজন, তিয়ানার আজ জন্মদিন।

বাকি দুইজনের জন্মদিন গেছে যথাক্রমে ডিসেম্বর আর জানুয়ারিতে!
এ লেখাটা এই 'থ্রি মাস্কেটিয়ার্স'-এর জন্য।
ফুটনোট ২।
গল্পের 'গল্প'টা- যদি বলি সত্য, তাহলে মিথ্যা হবে। আবার যদি বলি মিথ্যা, তাহলেও মিথ্যা হবে। কাজেই একে কেবল গল্পই বলি না হয়! ]


সোর্স: http://www.sachalayatan.com     দেখা হয়েছে বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।