আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

অনন্য সদাচারী শিক্ষাব্রতী অধ্যাপক রংগলাল সেন

প্রগিশীল, মুক্তমনা, সমঅধিকার এবং মানবতাবাদে বিশ্বাসী



প্রথিতযশা শিক্ষাবিদ, বিশিষ্ট সমাজ বিজ্ঞানী ও গবেষক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সমাজ বিজ্ঞান বিভাগের সাবেক চেয়ারম্যান এবং জগন্নাথ হলের প্রাক্তন প্রাধ্যক্ষ- জাতীয় অধ্যাপক ড. রংগলাল সেন বিগত ১০ ফেব্রুয়ারি ২০১৪, সোমবার বেলা সাড়ে ৩টায় চট্টগ্রামের একটি হাসপাতালে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। জটিল কিডনী রোগসহ দীর্ঘদিন যাবত তিনি বার্ধক্যজনিত বিভিন্ন রোগে ভুগছিলেন। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৮১ বছর৷ তিনি স্ত্রী, এক পুত্র, দুই কন্যা, নাতি-নাতনি এবং অংসখ্য প্রিয় ছাত্রা-ছাত্রী ও গুণগ্রাহী রেখে গেছেন।

অনন্য সদাচারী শিক্ষাব্রতী রংগলাল সেন মহোদয়ের কর্মময় বর্ণাঢ্য জীবন-বৃত্তান্ত সকলের জ্ঞাতার্থে এখানে বিবৃত করা হল। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক এই মনীষীকে জাতীয় অধ্যাপক পদে অলংকৃত করার পর ২০১১ সালের ১৬ সেপ্টেম্বর জগন্নাথ হল অ্যালামনাই অ্যাসোসিয়েশন কর্তৃক তাঁকে সাড়ম্বর সংবর্ধনা প্রদান করে।

উক্ত সংবর্ধনা উপলক্ষে প্রকাশিত স্মরণিকায় মুদ্রিত তাঁর জীবন-বৃত্তান্তের প্রয়োজনীয় সম্পদনা এবং তাতে কিয়দ সংযোজন করে এখানে পুঃনপ্রকাশ করা হল।

অধ্যাপক তিনিই যিনি বিশেষ জ্ঞান বা বিদ্যার অধিকারী, বা বলতে পারি যিনি বিজ্ঞান, সংস্কৃতি, সমাজ সম্পর্কে বিশেষ জ্ঞান ধারণ করেন। অধ্যাপক রংগলাল সেন শুধু বিশেষ জ্ঞানেই সমৃদ্ধ ছিলেন না, জীবনভর তিনি তা অকাতরে বিতরণ করে গেছেন, জ্বালিয়ে রেখেছেন নিরন্তর আলো। তিনি শিক্ষকতা শুরু করেছিলেন প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক হিসেবে আজ থেকে প্রায় ছয় দশক আগে। পরবর্তীতে পূর্ণজীবনে হয়েছিলেন তিনি জাতীয় অধ্যাপক- গোটা জাতির পরম পূজনীয় ও সম্মানিত শিক্ষক।

এই অবিরাম পথ চলায় তিনি শ্রেণীকক্ষের কাতারে সামনে বসা শিক্ষার্থীদের পাঠ্যবিষয় সম্পর্কে অবহিত করেছেন, একই সঙ্গে প্রেরণা যুগিয়েছেন চার দেয়ালের বাইরেই শুধু নয়, বিশ্ব-জগতের দিকে তাকাতেও। যে-আকাশ সবাইকে উদার হতে শিক্ষা দেয়, যে-বায়ু কর্মী হওয়ার মন্ত্র জোগায়, যে-পাহাড় মৌন থেকেই মহান-মহীয়ান হয়ে ওঠার ভিত রচনা করে দেয়- রংগলাল সেনের মধ্যে সমন্বয় ঘটেছে এর সব কিছুরই। শুধু বঙ্গের ভাণ্ডার থেকে নয়, বিশ্ব জুড়ে জ্ঞানের যে আধার তার সেরাটুকু তিনি আস্তে আস্তে নিজের করে নিয়েছেন, তারপর বিলিয়ে দিয়েছেন সবার মাঝে। আনুষ্ঠানিক অবসরেও থেমে থাকেনি তাঁর জ্ঞানের রথ। সভা-সমাবেশের নিবিড় উচ্চারণে, গ্রন্থ-নিবন্ধের সুচিন্তিত ভাষ্যে, নির্লোভ সাদাসিধা জীবনাচরণে যথার্থ যথার্থ শিক্ষক হিসেবেই নিরলস কর্মসাধনা চলেছে তাঁর।

তাই ২০১১ সালের ১৪ জুন জাতীয় অধ্যাপকের সম্মান প্রাপ্তি তাঁর উষ্ণীষে নতুন কোনও স্বর্ণপালক যুক্ত করেনি, বরং তিনি যে সুমহান উচ্চ মর্যাদায় বরণীয় হয়েছিলেন তাকেই কেবল স্বীকৃতি দেয়া হয়েছিল। তবে নিঃসন্দেহে সেই স্বীকৃতি গৌরবের।

১৯৩৩ সালের ২৪ সেপ্টেম্বর তৎকালীন শ্রীহট্ট, বর্তমান মৌলভীবাজার জেলার সদর থানার ত্রৈলোক্যবিজয় গ্রামে শিক্ষিত মধ্যবিত্ত পরিবারে অধ্যাপক রংগলাল সেনের জন্ম। বাবা রমনচন্দ্র সেন, মা গিরিবালা সেন। তাঁদের দশ সন্তানের চার জনের শৈশবেই টাইফয়েড রোগে মৃত্যু হয়।

বড় ভাই রোহিণীকান্ত সেনও ছিলেন পেশায় শিক্ষক। বাড়ির কাছের মনুমুখ উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতা শিক্ষক ছিলেন তিনি। অনুজ ডা. বঙ্কিমচন্দ্র সেন চিকিত্সক এবং একইসঙ্গে সমাজের অবহেলিত নারী-পুরুষের পক্ষে অসম সাহসী কণ্ঠস্বর। ছাতকছড়ার প্রতিবাদী নারী নূরজাহানের আত্মহননের পেছনে যে অশুভ শক্তি প্ররোচনা দিয়েছিল, তিনি তাদের বিরুদ্ধে লড়েছেন অকূতোভয়ে, আইনী প্রক্রিয়ায় নিশ্চিত করেছেন শাস্তি। সর্বকনিষ্ঠ অ্যাডভোকেট পিযূষ কান্তি সেন আইনজীবী হিসেবে স্বীয় কর্মক্ষেত্রে সুপরিচিত এবং সুপ্রতিষ্ঠিত।

উল্লেখ্য, উপরোল্লিখিত আইনি প্রক্রিয়া পুরোটা তাঁর নেতৃত্বে সম্পন্ন হয়।

জাতীয় অধ্যাপক রংগলাল সেনের বাবা রমনচন্দ্র সেন ১৯২০ সালে মৌলভীবাজার সরকারি উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এন্ট্রেন্স পাস করেন। মহাত্মা গান্ধীর অসহযোগ ও খিলাফত আন্দোলনের সময় মোক্তার হিসেবে তার কর্মজীবন শুরু। এ পেশায় রোজগার ভাল হলেও মন বসছিল না। তাই ফিরে যান মাটির টানে।

নিজ গ্রামের কাছে আজমনি মাধ্যমিক ইংরেজি বিদ্যালয় এবং আখাইলকুরা মাদ্রাসায় খণ্ডকালীন শিক্ষক হিসেবে বাংলা ও অংক পড়াতেন। এভাবে পিতার কাছ থেকেই রোহিণীকান্ত এবং রংগলাল পেয়েছিলেন শিক্ষাব্রতী হওয়ার অনুকরণীয় প্রেরণা।

১৯৪০ সালে তৎকালীন মৌলভীবাজার মহকুমার সদর থানার বাসুদেবশ্রী মধ্যবঙ্গ বিদ্যালয়ে (বর্তমানে প্রাথমিক বিদ্যালয়) রংগলাল সেন প্রথম শ্রেণীতে ভরতি হন। ১৯৪৬ সালে এই বিদ্যালয় থেকে তিনি ‘মিডল স্কুল লিভিং সার্টিফিকেট পরীক্ষা’য় প্রথম বিভাগে পাস করেন, সঙ্গে সে সময়ের দুর্লভ অর্জন- বৃত্তি। মৌলভীবাজার সরকারি উচ্চ বিদ্যালয় থেকে ১৯৫০ সালে কৃতিত্বের সাথে ম্যাট্রিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন।

উচ্চশিক্ষার ছিল তাঁর অদম্য বাসনা। কিন্তু বাধা ছিল পরিবারের অসচ্ছলতা, যা তিনি অনায়াসে জয় করেন। পড়াশোনার খরচ চালাতে বেছে নেন শিক্ষকতার পেশা এবং একইসঙ্গে মনোযোগ নিবদ্ধ থাকে তাঁর উচ্চ মাধ্যমিক শ্রেণীর পাঠ্যসূচিতে। এরপর তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগে ভর্তি হয়ে ১৯৬২ সালে স্নাতক এবং ১৯৬৩ সালে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন। উভয় পরীক্ষায় প্রথম স্থান ছিল তাঁর দখলে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগে সর্বপ্রথম তিনিই প্রথম শ্রেণীতে স্নাতকোত্তর ডিগ্রিধারী৷ তিনি ইংল্যান্ডের সাসেক্স বিশ্ববিদ্যালয়ে আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন সমাজবিজ্ঞানী অধ্যাপক টি. বি. বটোমোর-এর অধীনে ১৯৭৪ সালে এম এ এবং ১৯৭৭ সালে পিএইচ.ডি ডিগ্রি অর্জন করেন।

রংগলাল সেনের কর্মজীবন বৈচিত্র্যে ভরপুর। ১৯৫৩ সালে তিনি বাসুদেবশ্রী বাধ্যতামূলক প্রাথমিক বিদ্যালয়ে সহকারী শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন৷ এরপর প্রেমনগর বাধ্যতামূলক প্রাথমিক বিদ্যালয় ও ভাঙ্গারহাট প্রাথমিক বিদ্যালয়ে সহকারী শিক্ষক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৫৫-৫৬ শিক্ষাবর্ষে সিলেট প্রাইমারি ট্রেনিং ইনস্টিটিউট (পি.টি.আই. পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করেন এবং পূর্ব পাকিস্তানের চৌদ্দশ’ প্রশিক্ষণার্থীর মধ্যে প্রথম শ্রেণীতে তৃতীয় স্থান অধিকার করেন। এরপর বড়লেখা থানায় কাঁঠালতলী বাধ্যতামূলক প্রাথমিক বিদ্যালয় এবং মৌলভীবাজার সদর থানার শ্যামরায়ের বাজার মডেল প্রাথমিক বিদ্যালয়ে প্রধান শিক্ষক হিসেবে কৃতিত্বের সাথে দায়িত্ব পালন করেন।

এভাবে ১৯৫৩ সালের ১ নভেম্বর থেকে ১৯৫৯ সালের ১৩ জুলাই পর্যন্ত প্রায় ছয় বছর পাঁচটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষকতার মাধ্যমে তিনি কোমলমতি শিশুদের জন্য নিজেকে উত্সর্গীকৃত রেখেছিলেন। ১৯৫৭ সালে রংগলাল সেন বড়লেখার কাঁঠালতলী বাধ্যতামূলক প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে মৌলভীবাজার শহরের কাছে শ্যামরায়ের বাজার মডেল প্রাথমিক বিদ্যালয়ে প্রধান শিক্ষক হিসাবে বদলি হয়ে আসেন। এসময় তিনি রামকৃষ্ণ মিশন ছাত্রাবাসে অবস্থান করেন এবং প্রাইভেট পরীক্ষার্থী হিসেবে মৌলভীবাজার মহাবিদ্যালয় কেন্দ্র থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে আই,এ, পরীক্ষায় অংশগ্রহণ নিয়ে কৃতিত্বের সাথে উত্তীর্ণ হন। স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করার পর ১৯৬৪ সালে বাংলাদেশে প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে সমাজবিজ্ঞানের লেকচারার হিসেবে তাঁর নতুন পর্যায়ের শিক্ষতা জীবনের সূচনা। এরই ধারাবাহিকতায় ১৯৬৫ সালের ৪ মার্চ লেকচারার হিসেবে যোগদান করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগে।

টানা আট বছর ছাত্রদরদী শিক্ষক হিসেবে দায়িত্ব পালনের পর ১৯৭৩ সালে বৃত্তি নিয়ে ইংল্যান্ডের সাসেক্স বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন হন এবং সেখান থেকে ১৯৭৪ সালে এম,এ, এবং ১৯৭৭ সালে পিএইচ.ডি ডিগ্রি অর্জন করেন। দেশে ফিরে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগেই যোগদান করেন এবং ১৯৮৬ সালে অধ্যাপক হিসেবে পদোন্নতি লাভ করেন। প্রায় ৩৭ বছর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজ বিজ্ঞান বিভাগে শিক্ষকতা শেষে ২০০২ সালের ২২ জানুয়ারি তিনি অবসরে চলে যান। প্রায় পাঁচ বছর বিরতির পর ২০০৬ সালের ৭ ডিসেম্বর পুনরায় ফিরে আসেন নিজের জীবনের শ্রেষ্ঠ সময় কাটানো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজ বিজ্ঞান বিভাগে খণ্ডকালীন শিক্ষক হিসেবে।

রংগলাল সেন ১৯৬৬ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি বিয়ে করেন।

স্ত্রী কমলা সেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় রসায়ন বিভাগ থেকে ১৯৬৫ সালে এম.এসসি. ডিগ্রি অর্জন করেন। তিনি ১৯৭২ সলে ঢাকা টিচার্স ট্রেনিং মহাবিদ্যালয় থেকে প্রথম শ্রেণীতে বি.এড. পাস করেন। ১৯৭৬ সালে রংগলাল সেন যখন ইংল্যান্ডের সাসেক্স বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণারত, তখন তিনি পোস্ট-গ্রাজুয়েট ইন এডুকেশন সার্টিফিকেট কোর্স সমাপ্ত করেন। শ্রীমতী কমলা সেন কর্মজীবনের শুরুতে ঢাকার নারী মন্দির (বর্তমানে শেরে বাংলা মহাবিদ্যালয়) এবং মির্জাপুর ভারতেশ্বরী হোমসে বিজ্ঞানের শক্ষিকা ছিলেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকার উদয়ন বিদ্যালয়ে পাঠদান করেও পেয়েছেন কৃতী শিক্ষিকার সম্মান।



অধ্যাপক ড. রংগলাল সেন ও শ্রীমতী কমলা সেনের দুই মেয়ে ও এক ছেলে। বড় মেয়ে সূচনা সেন (পাপড়ি) পেশায় ডাক্তার, বর্তমানে চট্টগ্রামের একটি মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ে কর্মরত। ছোট মেয়ে রচনা সেন (পাপিয়া) বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তড়িৎ কৌশল বিভাগে স্নাতক ডিগ্রিলাভ করেন। পরে যুক্তরাষ্ট্রের আরিজোনা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর হয়ে তিনি বর্তমানে একটি কম্পিউটার কোম্পানিতে কর্মরত রয়েছেন। ছেলে সত্যকাম সেন (পরাগ) বিসিএস প্রশাসন ক্যাডারের সদস্য হিসেবে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ে কর্মরত।

সত্যকাম সেনের স্ত্রী দিপালী বকশী উদ্ভিদবিদ্যা বিষয়ে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রিধারী। তিনি ঢাকার একটি স্কুলে শিক্ষকতা পেশায় নিয়োজিত।

অধ্যাপক রংগলাল সেন শিক্ষকতার বাইরেও প্রশাসনিক ও সাংগঠনিক ক্ষেত্রে দক্ষতা ও যোগ্যতার স্বাক্ষর রেখেছেন। বলা যায়, যেখানে যখন যে দায়িত্ব পেয়েছেন সেখানেই তিনি সফল হয়েছেন। ১৯৭১ সালে আমাদের গৌরবময় মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয়ভাবে সামিল হওয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণে মুহূর্ত মাত্র দেরি করেননি তিনি।

তাঁকে শিলং-এ প্রথম স্থাপিত বাংলাদেশ সরকারের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় অফিসে তথ্য কর্মকর্তার দায়িত্ব অর্পন করা হয়। শিক্ষকতার সময়ে ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে যেমন জনপ্রিয় ছিলেন, ভিন্ন রাষ্ট্রে আশ্রয়গ্রহণকারী ও মুক্তিযোদ্ধাদের কাছেও তিনি দ্রুতই হয়ে ওঠেন একজন একনিষ্ঠ সম্মানিত কর্মকর্তা। স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে ১৯৭৯-১৯৮২ সাল পর্যন্ত তিন বছর ঢাকা বশ্ববিদ্যালয়ের জগন্নাথ হলের প্রাধ্যক্ষ হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন অধ্যাপক রংগলাল সেন। এ দায়িত্ব পালনকালে তিনি সর্বক্ষণ শিক্ষার্থীদের পাশে থাকার চেষ্টা করেছেন, অর্জন করেছেন সকলের আস্থা। হল ও বিশ্ববিদ্যালয়কেন্দ্রিক নানা কর্মকাণ্ড ও অনুষ্ঠানে তিনি নেতৃত্ব দিয়েছেন।

সর্বোপরি, জগন্নাথ হলের উন্নয়ন এবং স্বার্থ সংরক্ষণে নিরলস সচেষ্ট থেকেছেন। সার্বিকভাবে হলের সুষ্ঠু পরিবেশ বজায় রাখায় তাঁর আন্তরিক উদ্যোগ আজঅবধি সংশিষ্ট সকলে শ্রদ্ধাভরে স্মরণ রেখেছেন। তিনি প্রাধ্যক্ষ থাকাকালীন ১৯৮১ সালে জগন্নাথ হলের হীরক জয়ন্তী উপলক্ষে প্রকাশিত ‘বাসন্তিকা’ নামের স্মরণিকা গ্রন্থটি এখনও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হলকেন্দ্রিক প্রকাশনার ইতিহাসে শ্রেষ্ঠত্বের দাবিদার। স্থিতধী শিক্ষক এবং হল প্রশাসক হিসেবে কেবলমাত্র তাঁর পক্ষেই এতো উঁচুমানের একটি দালিকিক গ্রন্থ প্রকাশ করা সম্ভব হয়েছিল। শুধুমাত্র সম্পাদনা ও প্রকাশনাই নয়, ‘বাসন্তিকা’ স্মরণিকায় মুদ্রিত জগন্নাথ হলের ইতিহাস নিয়ে যে-প্রবন্ধ তিনি রচনা করেন, তাতে সামগ্রিকভাবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার প্রেক্ষাপটও তুলে ধরা হয়।

জগন্নাথ হলের প্রাধ্যক্ষের পদ ছাড়াও তিনি ১৯৮৪-৮৭ সাল পর্যন্ত তিন বছর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় এবং চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেট ও সিন্ডেকেটের সদস্য হিসেবে কাজ করেছেন। বাংলাদেশ সমাজবিজ্ঞান সমিতির প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি নির্বাচিত হয়ে তিনি ১৯৮৬ সাল থেকে দু’বছর দায়িত্ব পালন করেন। এছাড়া, তিনি বাংলা একাডেমী, এশিয়াটিক সোসাইটি অব বাংলাদেশ এবং বাংলাদেশ ইতিহাস পরিষদের জীবন সদস্য। ড. রংগলাল সেন শুধু বাংলাদেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় ও বিদ্বত্সভার সাথেই যুক্ত ছিলেন না, তিনি বেশ কয়েকটি সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও উন্নয়নমূলক সংগঠনের সাথেও সম্পৃক্ত ছিলেন।

এসকল সংগঠনের মধ্যে রয়েছে বঙ্গবন্ধু পরিষদ, ফণিভূষণ মজুমদার স্মৃতি সংসদ, বাংলাদেশ কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় জালালাবাদ ছাত্র কল্যাণ ফাউন্ডেশন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় জালালাবাদ ছাত্রকল্যাণ ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা কোষাধ্যক্ষ হিসাবে তিনি ১৯৮১ থেকে ১৯৮৬ সাল পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করেন। বাংলাদেশে প্রথম প্রতিষ্ঠিত শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের কোর্স ও কারিক্যুলাম প্রণয়নের সাথে অধ্যাপক রংগলাল সেন যুক্ত ছিলেন। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর এই বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিষয়ের পাঠ্যসূচি পরিমার্জনের দায়িত্বও তাঁকে দেয়া হয় এবং সেখানেও রেখেছেন তিনি নিষ্ঠা ও দক্ষতার স্বাক্ষর।

ড. রংগলাল সেন বাংলা ও ইংরেজী ভাষায় একাধি গ্রন্থ রচনা, অনুবাদ এবং সম্পাদনা করেছেন।

তাঁর রচিত, অনূদিত এবং সম্পাদিত গ্রন্থের সংখ্যা ২৫টি। এছাড়া, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক জার্নাল ও গ্রন্থে এবং দেশীয় পত্র-পত্রিকায় তাঁর শতাধিক ইংরেজী ও বাংলা প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে। তিনিই প্রথম ‘মানুষের সমাজ’ এবং ‘সমাজবিজ্ঞান’ নামে ১৯৭২ এবং ১৯৭৩ সালে আমেরিকান দু’জন সমাজবিজ্ঞানীর দু’টি পাঠ্যবইয়ের বঙ্গানুবাদ করেন। বাংলাভাষায় সমাজবিজ্ঞান শিক্ষা ও চর্চার ক্ষেত্রে এই দু’টি বই গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখে। এ ক্ষেত্রে রংগলাল সেন পথিকৃতের ভূমিকা পালন করেন।

তিনি বিশ্বখ্যাত পদার্থবিজ্ঞানী আলবার্ট আইনস্টাইনের একটি প্রবন্ধ, এবং আইনস্টাইন ও মনোবজ্ঞানী সিগমুন্ড ফ্রয়েডের দু’টি দুষ্প্রাপ্য চিঠি অনুবাদ করেন। বাংলায় আইনস্টাইন ও ফ্রয়েড চর্চার ক্ষেত্রে এই অনুবাদ বিশেষ অবদান রাখে। তিনি স্কটিশ ঐতিহাসিক এডাম ফার্গুসন রচিত 'An Essay on the History of Civil Society' (১৭৬৭) নামক দুষ্প্রাপ্য গ্রন্থ অবলম্বনে একটি দীর্ঘ বংলা প্রবন্ধ লেখেন, যা ২০০১ সালের মে থেকে ২০০২ সালের জুন মাস পর্যন্ত সংবাদ পত্রিকায় ধারাবাহিকভাবে ৮ সংখ্যায় প্রকাশিত হয়।

ড. রংগলাল সেন বাংলাদেশে সিভিল সোসাইটি-সম্পর্কিত ধারণার প্রণালীবদ্ধ আলোচনার ক্ষেত্রে পথপ্রদর্শকের ভূমিকা পালন করেছেন। এ বিষয়ে তাঁর ‘An Evaluation of the Western Concept of Civil Society from Plato to the Present: An Appraisal’ শিরোনামে একটি দীর্ঘ প্রবন্ধ The Dhaka University Studies (Journal of the Faculty of Arts, Vol. 58, No. 1 June. 2001)-এ প্রকাশিত হয়।

সিভিল সোসাইটি সম্পর্কিত তাঁর আলোচনার গভীরতা পণ্ডিত সমাজে সমাদৃত হয়। তিনি ‘Political Elites in Bangladesh’ নামের গ্রন্থের জন্য আন্তর্জাতিক অঙ্গনে খ্যাতি অর্জন করেন। এটি তাঁর পিএইচ.ডি অভিসন্দর্ভের ওপর ভিত্তি করে রচিত হলেও মৌলিক চিন্তা ও অন্তর্ভেদী বিশ্লেষণের জন্য অনন্যতার দাবিদার। এছাড়া, ভারতের দুইজন বিখ্যাত সমাজবিজ্ঞানী পার্থনাথ মুখার্জি ও চন্দন সেনগুপ্ত সম্পাদিত ‘Indigenecity and Universality in Social Science : A South Asian Response’ (SAGE Publications India Private Ltd, First Published in 2004) গ্রন্থে তাঁর প্রবন্ধ 'Glimpses of Social Structure in Ancient India: Kautilyas Relevance for Sociology in South Asia' তাঁকে এশিয়ার মধ্যে একজন শ্রেষ্ঠ সমাজবিজ্ঞানীর মর্যাদায় আসীন করে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সমাজবিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালনকালে ১৯৮৪ সালে অধ্যাপক রংগলাল সেনের উদ্যোগে উক্ত বিভাগের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা প্রয়াত প্রফেসর এ, কে, নাজমুল করিমের দ্বিতীয় মৃত্যু বার্ষিকী উপলক্ষে ‘এ.কে. নাজমুল করিম স্মারক গ্রন্থ’ প্রকাশিত হয়।

এতে ‘বাংলাদেশে সমাজবিজ্ঞানের বিকাশ’ শিরোণামে তাঁর একটি মূল্যবান প্রবন্ধ স্থান পায়। প্রফেসর এ, কে, নাজমুল করিমের ‘Changing Society in India, Pakistan and Bangladesh’ গ্রন্থের মূলানুগ অনুবাদ করার কৃতিত্বও রংগলাল সেনের, যা ‘পরিবর্তনশীল সমাজ : ভারত, পাকিস্তান ও বাংলাদেশ’ (২০০৭) নামে গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়। তাঁর অন্যবদ্য গ্রন্থ ‘বাংলাদেশের সামাজিক স্তর বিন্যাস’ (বাংলা একাডেমী, ১৯৮৫) বাংলাদেশের সামাজিক কাঠামো এবং এর পরিবর্তনশীলতাকে বুঝাতে সহায়তা করে। ক্ষুদ্র পরিসরে এত ব্যাপক বিষয়ের আলোচনা রংগলাল সেনের মতো একজন প্রকৃত সমাজবিজ্ঞানীর পক্ষেই কেবল সম্ভবপর। তাঁর ‘প্রারম্ভিক সমাজবিজ্ঞান’ (২০০৩) গ্রন্থটি ছাত্রপাঠ্য হিসেবে রচিত হওে যাঁরা সমাজবিজ্ঞানের প্রাথমিক পাঠ নিতে ইচ্ছুক, তাদের সবার জন্যও এটি অপরিহার্য।

তাঁর ‘সিভিল সোসাইট’ (২০০৬) গ্রন্থটিও বাংলাদেশের সিভিল সোসাইটির ধারণা ও আচরণ বুঝতে সহায়ক। এই তিনটি গ্রন্থের মাধ্যমে অধ্যাপক রংগলাল সেন বাংলাদেশের একজন অগ্রগণ্য সমাজবিজ্ঞানীর দায়িত্ব পালন করেছেন। ২০০৯ সালে ঢাকা থেকে তাঁর-ই সম্পাদনায় ‘বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ : ঢাকা ও কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অবদান’ প্রবন্ধ-গ্রন্থটি প্রকাশিত হয়। ঢাকার চারশ’ বছর পুর্তি উপলক্ষে ২০১০ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে এশিয়াটিক সোসাইটি অব বাংলাদেশের উদ্যোগে আয়োজিত আন্তর্জাতিক সেমিনারে তিনি চার পর্বে ‘Society and Social Structure in Capital Dhaka : Mughal and British Period এবং ‘Pakistan and Bangladesh Period’ শীর্ষক দু’টি মূল্যবান প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন, যা পরবর্তীতে এশিয়াটিক সোসাইটির জার্নালে বাংলা ও ইংরেজিতে প্রকাশিত হয়। ২০১১ সালে দিল্লি থেকে প্রকাশিত আন্তর্জাতিক মানের ‘Minorities and the State : Changing Social and Political Landscape of Bengal’ গ্রন্থে ড. রংগলাল সেনের ‘Role of Civil Society in Combating Violance against Religious Minorities during the post-2001 General Elections of Bangladesh’ শীর্ষক তথ্যবহুল প্রবন্ধটি স্থান পায়, যা ২০০৮ সালে কলকাতায় একটি সেমিনারেও তিনি উপস্থাপন করেন।

আর ২০১১ সালের মে মাসে ‘Middle Class Elites, Civil Society and other Essays’ শীর্ষক তাঁর রচিত সর্বশেষ গ্রন্থ দুই খণ্ডে প্রকাশিত হয়।

জাতীয় অধ্যাপক ড. রংগলাল সেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের Social Science Review (১৯৮৫) এবং বাণিজ্য অনুষদের The Dhaka University Studies, Part-C (১৯৮৪)-এর সম্পাদনা পরিষদের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। এছাড়া, তিনি নয়াদিল্লীর কাউন্সিল ফর সোশ্যাল ডেভলাপমেন্ট কর্তৃক প্রকাশিত Social Change নামক গবেষণা পত্রিকার উপদেষ্টামণ্ডলীর সদস্য ছিলেন। তিনি দেশ-বিদেশে অনুষ্ঠিত উল্লেখযোগ্য সংখ্যক সেমিনার, সিম্পোজিয়াম এবং ওয়ার্কশপে অংশগ্রহণ করেন। দিনি দিল্লিতে অনুষ্ঠিত State of Sociology in South Asia শীর্ষক সার্ক দেশসমূহের এক ওয়ার্কশপ (২৩-২৪ ফেব্রুয়ারি ২০০৫)-এ বাংলাদেশ দলের প্রতিনিধি ছিলেন।

নাজমুল করিম স্টাডি সেন্টার ও সমাজবিজ্ঞান সমিতি প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রেও তাঁর অবদান শ্রদ্ধার সাথে স্মরণীয়।

শিক্ষকতা এবং গবেষণা কর্মের পাশাপাশি প্রগতিবাদ ও সমাজবাদ আদর্শের ধারক অধ্যাপক রংগলাল সেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির প্রতিনিধি হিসেবে হিসেবে বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক এবং স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনে সক্রিয় অংশগ্রহণ করেছেন।

উপমহাদেশে সমাজবিজ্ঞান চর্চার প্রাতিষ্ঠানিক অঙ্গনে জাতীয় অধ্যাপক ড. রংগলাল সেন আবশ্যকীয়ভাবে উচ্চারিত নাম। সমাজবিজ্ঞান গবেষণা ও শিক্ষাদানের অঙ্গন পেরিয়ে জাতীয় অগ্রগতির ক্ষেত্রে তাঁর চিন্তা ও মতবাদ কার্যকর হলে তা দেশের জন্য মঙ্গল ও হিতকর হবে, সন্দেহ নেই। বৈষয়িক লোভ তাঁকে কখনো মহৎ জীবনাদর্শ থেকে বিচ্যুত করতে পারেনি।

আমাদের দেশের সেরা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের মর্যাদায় অধিষ্ঠিত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ আরও অনেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, আমাদের সমাজ ও সর্বোপরি, রাষ্ট্র তাঁর এই ত্যাগ ও তিতিক্ষাকে ইতিবাচক মূল্যায়ন করেছে। তাইতো তিনি সততা ও নিষ্ঠার কাছে নতজানু না হয়ে যে সম্মান ও স্বীকৃতি পেয়ে জাতীয় অধ্যাপক পদে ব্রতী হয়েছিলেন, তা অনেক অনেক বৈষয়িক প্রাপ্তির চেয়ে ঢের বেশি মূল্যবান কেবল তা-ই নয়, অমূল্য। তিনি স্বীয় আদর্শ ও বিশ্বাসে অটল থেকেছেন এবং অন্যদের তাতে সমিল করায় নিরন্তর চেষ্টা করেছেন। এমন ব্যক্তিত্বের সান্নিধ্যে আসতে পারা, সে যে কারো জন্য পুণ্য কর্মফল।

অধ্যাপক রংগলাল সেন জগন্নাথ হল অ্যালামনাই অ্যাসোসিয়েশনের যাত্রালগ্ন (৯ অক্টোবর ২০০০) থেকেই এর কর্মকাণ্ডে নিজেকে যুক্ত রেখেছেন।

২০০৯ সালের ১৮ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত সংগঠনের সম্মেলনে তিনি নির্বাচন কমিশনের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন পূর্বক সুষ্ঠুভাবে নির্বাচন কার্যক্রম পরিচালনা করেন। নির্বাচনের ফলাফল ঘোষণার পূর্বে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমবয়সী জগন্নাথ হলের সাবেক ছাত্রদের ঐতিহ্যমণ্ডিত কর্মকাণ্ড সম্পর্কে তিনি যে দিকনির্দেশনাপূর্ণ বক্তব্য রাখেন তা সার্বিকভাবে উক্ত অ্যালামনাই অ্যাসোসিয়েশনের সকলের চলার পথে পাথেয় হয়ে রয়েছে।

শিক্ষা, গবেষণা এবং সমাজসেবায় রংগলাল সেন মহোদয়ের অনন্যসাধারণ অবদান রাখার স্বীকৃতিস্বরূপ ২০১১ সালের ১৪ জুন গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার তাঁকে জাতীয় অধ্যাপক পদে ভূষিত করে। এ উপলক্ষে ঐ বছর ১৬ সেপ্টেম্বর জগন্নাথ হল অ্যালামনাই অ্যাসোসিয়েশন এই মনীষীকে অভিনন্দিত করা এবং তাঁর প্রতি শ্রদ্ধার্ঘ্য নিবেদনার্থে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় নবান নওয়াব আলী চৌধুরী সিনেট ভবনের অডিটরিয়ামে সাড়ম্বর এক সংবর্ধনা অনু্ষ্ঠানের আয়োজন করে। এটিই ছিল এই মহান শিক্ষকের জীবনের শেষ কোনও অনুষ্ঠানে যোগদান।

তিনি তখন তাঁর জ্যেষ্ঠ সন্তান ডা: সূচনা সেন পাপড়ির চট্টগ্রামের বাসভবনে অবস্থান করছিলেন। তখন থেকেই তিনি বেশ অসুস্থ ছিলেন বিধায় চিকিৎসা এবং সার্বক্ষণিক দেখভাল করার জন্য ডা: সূচনা বাবাকে নিজের কাছে নিয়ে গিয়েছিলেন। ঢাকায় সংবর্ধনা দেবার কথা তাঁকে ফোনে জানলে তিনি আবেগ আপ্লুত হয়ে পড়েন। তাঁর সুবিধা মত একটি তারিখ নির্ধারণের অনুরোধ জানালে তিনি আয়োজকদেরকে বলেন- ‘আমি অসুস্থ, কিন্তু তাই বলেতো তোমাদের আবদার আমি কোনওভাবেই ফেলতে পারব না। আমি অবশ্যই ঢাকায় আসব।

তোমরা ১৬ সেপ্টেম্বর অনুষ্ঠানের আয়োজন কর’।

ড. রংগলাল সেন কেবলমাত্র পাঠকক্ষের শিক্ষক বা ছাত্রাবাসের অভিভাবকই ছিলেন না, পিতৃতুল্যও বটে। শাসন, স্নেহ, আদর, উপদেশ, শিক্ষাসম্পর্কিত কর্মকাণ্ডে নেতৃত্বদান ইত্যাদি সব মিলিয়ে তিনি যেভাবে সবাইকে ঋণী করে গেছেন তা চির অপরিশোধনীয়। তাই তাঁর অনুমতি পেয়ে সংবর্ধনা অনুষ্ঠান আয়োজনে অনেকটা ধুমধাম পড়ে যায়। সংবর্ধনা উপলক্ষে একটি ছোট্ট স্মরণিকা প্রকাশ করা হয়।

এতে মূলত তাঁর জীবনালেখ্য এবং তাঁর প্রতি শ্রদ্ধার্ঘ্য ও অভিনন্দন নিবেদন বার্তা মুদ্রিত হয়। তাঁর সন্তানতুল্য ছাত্ররা মনের মাধুরি মিশিয়ে গভীর শ্রদ্ধা, প্রণতি, পুষ্পার্ঘ্য, উত্তরীয়, মসি, মানপত্র ও তাঁর প্রতিকৃতিখচিত উৎকৃষ্ট মানের কুলচিহ্ণ (Crest) ইত্যাদি অর্পণপূর্বক শিক্ষাগুরুর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশের পরম সুযোগ গ্রহণ করেন, তারা ধন্য হন। অসুস্থ শরীর নিয়েও সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে অধ্যাপক রঙ্গলাল সেন এক ঘণ্টারও বেশি সময় ধরে তাঁর জীবনের শেষ জয়গান শুনিয়ে সবাইকে মন্ত্রমুদ্ধ করে তুলেন। ৭৮ বছর বয়সেও তিনি শিক্ষা, সমাজ, ইতিহাস, দেশ, রাষ্ট্রনীতি, মানুষে-মানুষে সম্প্রীতি বা ভেদাভেদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও জগন্নাথ হলসহ সমসাময়িক অন্যান্য প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তিবর্গের ইতিহিাস ও ঐতিহ্য ইত্যাদি বিষয়ে যে তথ্যসমৃদ্ধ ও জ্ঞানগর্ভ বক্তৃতা প্রদান করেন তা অবিস্মরণীয় এবং উক্ত অনুষ্ঠানে উপস্থিত সকলের চলার পথে পাথেয় হয়ে রয়েছে।

সংবর্ধনাশেষে অসুস্থ বাবাকে বেশি দিন ঢাকায় রাখতে চাননি ডা: সূচনা, আবার তাঁকে নিজের কাছে নিয়ে যান।

যথাসাধ্য চিকিৎসা এবং সেবাযত্ন করে অনেকটা সুস্থও করে তোলেন। কিন্তু ২০১৩ সালের শেষের দিকে ড. রংগলাল সেনের কিডনীতে মারাত্মক সমস্যা দেখা দেয়। তাঁকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। একটানা আড়াই মাস হাসপাতালে থাকাকালীন সময় সময় শারীরিক কিছুটা উন্নতি, আবার অবনতি, এভাবে সুস্থতা ও অসুস্থার দোলাচল চলে। শেষ দিকে তিনি মেয়েকে প্রায়ই প্রশ্ন করতেন- ‘মা, আমি কি মরে যাব? পরাগ ও পাপিয়ার সাথে আমার আর দেখা হবে না?’ ডা: সূচনা একদিকে তার বাবাকে সান্তনা দেবার চেষ্টা করেন, অন্যদিকে বিদেশে অবস্থানরত ভাই ও বোনকে দেশে ডেকে পাঠান।

সময় স্বল্পতার কারণে পাপিয়া দেশে আসতে পারেননি। তবে সরকারের বৃত্তি নিয়ে বিদেশে শিক্ষারত পরাগ দেশে ফিরে ১০ ফেব্রুয়ারি দুপুর নাগাদ চট্টগ্রামে পৌঁছে যান। পুত্রকে দেখে পিতা সস্নেহে বলে ওঠেন- ‘এসেছিস বাবা! তোর মাকে দেখে রাখিস’। স্পষ্টভাষী ও সদাবাগ্মী রংগলাল সেনের জীবনের এটাই শেষ জবান। ঐ দিনই বেলা সাড়ে তিনটায় স্তব্ধ হয়ে যায় তাঁর হৃদস্পন্দন।



জাতীয় অধ্যাপক ড. রংগলাল সেন পরিণত বয়সে ইহলোক ত্যাগ করেছেন বটে, কিন্তু তাঁর মতো সৎ, আদর্শ ও নীতিবান, কর্মঠ, বিদ্যোৎসাহী, চৌকষ শিক্ষক, ঐকান্তিক গবেষক, নির্লোভী ও অনুকরণীয় ব্যক্তিত্বের জীবনকাল প্রলম্বিত হলে দেশ, জাতি ও জনগণই উপকৃত হত। তাই তাঁর মহাপ্রয়াণে যে ক্ষতি সাধিত হল তা কোনও দিনও পূরণ হবার নয়।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।