আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

কৃষি জমি রক্ষার তাগিদ ও কয়লার ভবিষ্যৎ

খুব জানতে ইচ্ছে করে...তুমি কি সেই আগের মতনই আছো নাকি অনেকখানি বদলে গেছো...


শনিবার, ১৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৪

কৃষিজমি রক্ষার তাগিদ ও কয়লার ভবিষ্যৎ
ভোরের কাগজ : শনিবার, ১৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৪

কয়লা উৎপাদনে কৃষিজমি রক্ষার ওপর জোর দিয়ে প্রয়োজনে ‘নতুন প্রযুক্তি’ আসা পর্যন্ত অপেক্ষা করতে জ্বালানি মন্ত্রণালয়কে নির্দেশনা দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। পাশাপাশি গ্যাসের উৎপাদন বৃদ্ধি, নবায়নযোগ্য জ্বালানি ব্যবহার বৃদ্ধিসহ বিদ্যুৎ খাতে সরকারের ভিশন বাস্তবায়নে সংশ্লিষ্ট সকলকে দিকনির্দেশনা দিয়েছেন। কৃষি অর্থনীতির এ দেশে কৃষিজমি রক্ষা অনস্বীকার্য। মোট জনগোষ্ঠীর প্রায় অর্ধেকের বেশি মানুষ কৃষিজীবী। তাদের উৎপাদিত খাদ্যশস্য দেশের চাহিদা মিটিয়ে থাকে।

তাই কৃষিজমির রক্ষার সঠিক চর্চা হলে দেশে খাদ্য ঘাটতি কমবে এবং সেই সঙ্গে বিদেশ থেকে খাদ্য আমদানির মাত্রাও কমবে। প্রধানমন্ত্রী বলেছেন আগে কৃষিজমি রক্ষা করতে হবে তারপর আমরা ভেবে দেখবো আমরা কি করতে চাই? কয়লা উৎপাদন ভবিষ্যতের ওপর ছেড়ে দিতে চাই।

পেট্রোবাংলার হিসাব মতে, দেশের পাঁচটি খনিতে কয়লার মোট মজুদ রয়েছে ৩১০ কোটি মেট্রিক টন। ভূগর্ভস্থ পদ্ধতিতে রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনায় বড়পুকুরিয়া খনি থেকে প্রতিদিন সাড়ে চার হাজার মেট্রিক টনের মতো কয়লা উত্তোলন করা হচ্ছে। ফুলবাড়ী নিয়ে রয়েছে সবচেয়ে বড় বিতর্ক।

এশিয়া এনার্জি নামক একটি বৈদেশিক কোম্পানির সঙ্গে স্থানীয় জনগণের আন্দোলনের ফলে ফুলবাড়ী প্রকল্প ভেস্তে যেতে শুরু করে। এশিয়া এনার্জি ফিল্ড কার্যক্রম গুটিয়ে ঢাকা কেন্দ্রিক হয়ে পড়ে। সেই থেকে শুরু হয়েছে কয়লানীতি প্রক্রিয়াকরণের কাজ। মূলত এশিয়া এনার্জির বিতর্কের কারণে কয়লানীতি পিছিয়ে পড়েছে! দেশের সুশীল সমাজের বিরাট এক অংশ ক্রমাগত এশিয়া এনার্জির বিপক্ষে অবস্থান নেয়ায় সরকার চাইলেও কোনো সিদ্ধান্তে আসতে পারছে না। বেশ কয়েকটি রিভিউ কমিটিও করা হয়েছে কিন্তু কাজের কাজ কিছু হয়নি।

সবচেয়ে বিতর্ক কয়লা কোন পদ্ধতিতে তোলা হবে? কেউ বলছে ভূগর্ভস্থ পদ্ধতি পরিবেশ সহায়ক আবার কেউ বলছে উন্মুক্ত পদ্ধতি বাণিজ্য সহায়ক। এ বিতর্কে দেশের বিশেষজ্ঞরা একমত হতে পারছে না। তার ওপর বাম রাজনীতিকরা উন্মুক্ত পদ্ধতির বিরোধিতা করছেন বিতর্কের শুরু থেকেই। কেননা এশিয়া এনার্জির প্রকল্প প্রস্তাবনায় উন্মুক্ত পদ্ধতির কথা বলা হয়েছিল।

গত আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকারের সবচেয়ে বড় সাফল্য ছিল বিদ্যুৎ খাত।

শত সমালোচনা সত্ত্বেও সরকার বিদ্যুতের আশাতীত উৎপাদন বাড়াতে পেরেছে। ফলে সরকার ২০৩০ সাল পর্যন্ত বিদ্যুতে মহাপরিকল্পনা ঘোষণা করে। এই সময়ের মধ্যে ৩০ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের টার্গেট রয়েছে। যার অর্ধেকই আসবে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো থেকে। বিশ্বের মোট উৎপাদিত বিদ্যুতের শতকরা ১৬ ভাগ আসে কয়লা থেকে।

আমেরিকাতে প্রায় ৩০০টি কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র রয়েছে। ভারতের জ্বালানির শতকরা ৫৫ ভাগ আসে কয়লা থেকে। পৃথিবীতে সবচেয়ে বেশি কয়লা ব্যবহার করে চীন, ভারত ও যুক্তরাষ্ট্র। তাই এ দেশ তিনটি পরিবেশ রক্ষায় কিউটো প্রটোকলে স্বাক্ষর করেনি। এ সরকার ইতোমধ্যেই বেশ ক’টি কয়লাভিত্তিক বড় ধরনের বিদ্যুৎ প্রকল্প গ্রহণ করেছে।

রামপাল কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্রটি সুন্দরবনের অতি নিকটে হওয়ায় এ প্রকল্প নিয়ে বেশ বিতর্কও রয়েছে। যদিও সরকার সুপার ক্রিটিক্যাল প্রযুক্তির ব্যবহারের মধ্য দিয়ে পরিবেশ দূষণ কমিয়ে আনার প্রত্যয় ঘোষণা করেছে। এ প্রকল্পটি বাংলাদেশ-ভারতের যৌথ বিনিয়োগে নির্মিত হচ্ছে। ভারত থেকে কয়লা পরিবহনে রামপাল অত্যন্ত সুবিধাজনক অবস্থানে রয়েছে। সুন্দরবনের আকরাম পয়েন্টকে কয়লা ওঠানামার কাজে ব্যবহার করা হবে।

যা সুন্দরবনের জীববৈচিত্র্যের ওপর প্রভাব ফেলবে।

কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণে ও বিদ্যুৎ উৎপাদনে আমদানি করা কয়লার ব্যবহার নিয়ে প্রশ্ন তোলা হচ্ছে। বাংলাদেশে উন্নত মানের বিটুমিনাস কয়লার প্রাকৃতিক রিজার্ভ থাকতে ভারত বা অন্য দেশ থেকে কয়লা আমদানি করে বিদ্যুৎ উৎপাদন এটা অনেকেই মেনে নিতে পারছে না। গত আমলে আওয়ামী লীগ কয়লা ওঠানোর পক্ষে ছিল। এ জন্য বিশেষজ্ঞ কমিটি গঠন, কমিটির প্রতিবেদন রিভিউ বা পুনর্মূল্যায়ন করাসহ বেশ কিছু পদক্ষেপও নিয়েছিল।

কিন্তু এবার ক্ষমতায় এসে সরকার ভোল পাল্টেছে। স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী বলছেন কৃষিজমি রক্ষার কথা তার মানে এ সরকার কয়লা ওঠানোর ব্যাপারে খুব একটা আন্তরিক নয়। এ কথা সত্য যে দিন দিন কৃষিজমি হারাচ্ছি আমরা। বিভিন্ন উপায়ে কৃষিজমি গ্রাস হচ্ছে। কৃষিজমির বিনষ্টের পেছনে হাউজিং কোম্পানিগুলো সবচেয়ে বেশি দায়ী।

ঢাকা ও এর আশপাশে লাখ লাখ একর কৃষিজমি হাউজিং ব্যবসায়ীরা কিনে নিচ্ছে। এ নিয়ে কিন্তু পলিটিক্যালি কিছু বলা হচ্ছে না এর কারণ এসব ব্যবসায়ী সরাসরি রাজনীতির সঙ্গে জড়িত। এরাই সরকারি দল বিরোধী দল ডমিনেন্ট করে। সরকার আজকে হাউজিং প্রকল্পের জমি কিনা বন্ধ করে দিলে লাখ লাখ একর কৃষিজমি রক্ষা পাবে কিন্তু এটা করবে না। যাই হোক রাজনীতিকরাই যদি কয়লা ওঠানোর প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করেন তাহলে এ সমস্যার সমাধান খুব সহজে হবে না সেটা বুঝাই যাচ্ছে।



পৃথিবীর ইতিহাসটাই এমন প্রাকৃতিক সম্পদ তেল গ্যাস কয়লা এগুলো হয় কৃষিজমির ওপর না হয় বসতি এলাকায় পাওয়া যাচ্ছে। জার্মানিতে একটা শহরকে ভেঙে মাটির নিচ থেকে কয়লা তোলা হচ্ছে। সেখানে ওরা হিসেবটা করেছে শহরের স্ট্রাকচার ও মানুষের মোট সম্পদের সঙ্গে কয়লা রিজার্ভের মোট মূল্যের পার্থক্য। যখন দেখা গেলো কয়লার মূল্য কয়েকগুণ বেশি তখন সরকার শহর ভেঙে দেয়ার সিদ্ধান্ত দ্রুতই নিয়ে নিলো। সেখানে বিদ্রোহ হয়েছে, লোকজন অনশন করেছে কোর্টে মামলা হয়েছে কিন্তু সরকার সব বাধাবিপত্তি পেরিয়ে কয়লা তুলে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিদের দ্বিগুণ তিনগুণ বেশি মূল্য পরিশোধ করেছে।

পরে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিরাই কোলফিল্ডে গিয়ে তাদের সমর্থন জানিয়েছে।

বাংলাদেশ ঘনবসতিপূর্ণ একটা দেশ। বিস্তীর্ণ অঞ্চলজুড়েই এ দেশের গ্রামীণ জনজীবন। উত্তরের জেলাগুলো নওগাঁ, দিনাজপুর, রংপুর এলাকাতেই কয়লার প্রাকৃতিক মজুদ রয়েছে। আবার এ অঞ্চলগুলো দরিদ্র গ্রামীণ এলাকা।

মঙ্গাপীড়িত। অথচ কয়লার মতো বহু মূল্যাবান সম্পদ তাদের পায়ের নিচে। তারা কিন্তু সে সম্পদ তাদের জীবনে কাজে লাগাতে পারছে না। কয়লার মজুদের ওপর ১০/১২ ইঞ্চি পুরু মাটির স্তরের ওপর কৃষি অর্থনীতির প্রবাহে টেনেটুনে চলছে তাদের জীবন। এখন সরকারের হিসাব করতে হবে কয়লার শক্তির মূল্য যদি গ্রামীণ কৃষি অর্থনীতির চেয়ে বেশি হয় তাহলে মাটির নিচ থেকে কয়লা তুলতে অসুবিধা নেই।

যাদের জমিতে কয়লার রিজার্ভ আছে তারা সে কয়লা কতোটা অংশ পাবে তা সরকারকে নির্ধারণ করে দিতে হবে। এবং সরকারকে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হতে হবে কয়লা দিয়ে ঐ এলাকার দারিদ্র্যমুক্ত করার। এমন না হয় যেন ঘরের নিচে কয়লা পাওয়া যাওয়ায় মানুষকে গৃহহীন হতে হয়। মানুষ যেন মাটির ঘর থেকে পাকা ঘরে উঠতে পারে সেদিকে দৃষ্টি সরকারকেই দিতে হবে। কয়লা আমাদেরকে ওঠাতেই হবে।

সরকারি ব্যবস্থাপনায়ই হোক আর বেসরকারিভাবেই হোক কয়লা তোলার বিকল্প নেই। কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র যেমন আমাদের দরকার সাশ্রয়ী বিদ্যুৎ ব্যবস্থার প্রবর্তনের জন্য তেমনি দেশীয় কয়লার ব্যবহার করাও আমাদের দরকার। কারণ যদি আগামী বিশ-ত্রিশ বছর পর কয়লা তুলতে গিয়ে যদি আন্তর্জাতিক বিপত্তির মুখে পড়তে হয় তাহলে এ সম্পদ আমাদের জন্য সুফল বয়ে আনতে পারবে না। এখনই কিন্তু পৃথিবীজুড়ে কয়লার ব্যবহার কমিয়ে আনার জন্য কয়লা ব্যবহারকারী দেশগুলোর সঙ্গে বিভিন্ন ফোরামে দর কষাকষি চলছে। জলবায়ু পরিবর্তন রোধে কয়লার ব্যবহার কমিয়ে আনার প্রতি গুরুত্ব আরোপ করা হচ্ছে।

এ দাবি যে আগামী কয়েক বছরের মধ্যে জনদাবিতে পরিণত হবে সন্দেহ নেই। তাই কয়লা তোলার ক্ষেত্রে সরকারকে অতি দ্রুত সিদ্ধান্ত নেয়ার দরকার। বড়পুকুরিয়ার মতো আরো একটি বা দুটি কোলফিল্ড সরকারি বা বেসরকারি উদ্যোগে শুরু করা যেতে পারে। সরকারি ব্যবস্থাপনায় করলে কয়লানীতির প্রয়োজন পড়বে না। প্রচলিত খনি ও খনিজ বিধিমালার আলোকেই কয়লা তোলা যাবে যেমনটা বড়পুকুরিয়া থেকে তোলা হচ্ছে।

তাই সরকারকে আধুনিক ও যুগোপযোগী সিদ্ধান্ত নেয়ার আহ্বান জানাচ্ছি। তাছাড়া বাংলাদেশকে মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত করার স্বপ্ন বাস্তবায়নেও মাটির নিচের কয়লা অনেক বেশি সাহস জোগাতে পারে। তাই ফসলি জমি রক্ষার দোহাই দিয়ে কয়লা উত্তোলন না করার সিদ্ধান্ত কখনই যুগোপযোগী সিদ্ধান্ত হতে পারে না। সরকার পেট্রোবাংলার মতো ‘কোল বাংলা’ গঠন করেও কয়লা সম্পদের দেখভালের ব্যবস্থা নিতে পারে।

হাসান কামরুল : জ্বালানি ও পরিবেশ বিষয়ক লেখক।



অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.