আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

দেশের প্রথম ব্যক্তিগত কৃষি পাঠাগার... শাহ কৃষি তথ্য পাঠাগার



কৃষি বিষয়ক সব তথ্য যদি একসঙ্গে পাওয়া যেত তবে কত ভালো হতো ব্যাপারটা, তাই না! নিশ্চিন্তে চাষ করা যেত যে কোনো ফসল। গোলা ভরে উঠত ধানে বা গমে, গোয়াল ভরা থাকত দুধেল গাভীতে, পুকুরে থাকত রুপালি মাছের খেলা, বাড়ির আঙিনা ছবি এঁকে দিত হরেক রকম শাকসবজি, উঠান কিংবা বাড়ির সামনে পুকুর ঘেঁষে চরে বেড়াত হাঁস-মুরগি বা পোল্ট্রির দল। কী মজা হতো, তাই না! কোথা থেকে পাবেন এত সব তথ্য! চিন্তা করবেন না, কৃষি বিষয়ক চলমান ও অত্যাবশ্যক প্রায় সব তথ্য আছে ‘শাহ কৃষি তথ্য পাঠাগার’-এ। দেশের প্রথম ব্যক্তিগত এই কৃষি লাইব্রেরিতে পেতে পারেন আপনার দরকারি কৃষি তথ্য। তাতেও যদি কারো প্রয়োজন না মেটে তাহলে এই কৃষি লাইব্রেরির প্রতিষ্ঠাতা একজন একনিষ্ঠ কৃষি সেবক জাহাঙ্গীর আলম শাহের কাঁধের ঝোলা ব্যাগের ডায়েরি থেকে।

তাতে সহজ ভাষায় তোলা আছে শতাধিক ফসলের চাষাবাদ পদ্ধতি, সেচ, সার ও রোগবালাই ব্যবস্থাপনা, আধুনিক কৃষি প্রযুক্তি সংক্রান্ত তথ্য এবং প্রতিদিন তাতে যোগ হচ্ছে নতুন ও আধুনিক কার্যকর তথ্য। ধীরে ধীরে কৃষকদের উন্নয়নের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছে তার কৃষি লাইব্রেরি। নওগাঁ জেলার মান্দা উপজেলার কালিগ্রামের বাসিন্দা জাহাঙ্গীর আলম শাহ। চাকরিসূত্রে তিনি থাকেন রাজশাহী। রাজশাহী কলেজিয়েট স্কুলের সহকারী শিক্ষক তিনি।

কৃষির প্রতি বেশ ঝোঁক তার শৈশব থেকেই। ছেলেবেলা থেকেই এখান ওখান থেকে বিভিন্ন ফসলের ভালো জাত সংগ্রহ করে তার আঙিনা ও মাঠে লাগাতেন। ভালো জাতের ফলের চারা সংগ্রহ ও কলম করে রাখতেন বাড়িতে। সেগুলো যদি ভালো ফলন দিত তবে তিনি সেই জাতের বীজ বাড়িয়ে আশপাশের কৃষকদের মাঝে বিতরণ করতেন। সুযোগ পেলেই তিনি কৃষি বিষয়ক বই জোগাড় করে মন দিয়ে পড়তেন।

যতটুকু সম্ভব কৃষকদের কৃষি বিষয়ক তথ্য ও পরামর্শ দিয়ে সহযোগিতা করার চেষ্টা করতেন। এটাই তার ভালো লাগা, ভালোবাসা। এভাবেই তিনি শুরু করেন কৃষিসেবার কাজ। কৃষিসেবক জাহাঙ্গীর আলম শাহর সঙ্গে আলাপ হলে তিনি জানান, রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক মাঈন উদ্দিনের কাছ থেকে তিনি বই জোগাড়ের উৎসাহ পান। ২০০৪ সাল থেকে তিনি বিভিন্ন কৃষি বিষয়ক প্রতিষ্ঠান, সেমিনার, সিম্পোজিয়াম থেকে বই, লিফলেট, পোস্টার সংগ্রহ করতে শুরু করেন।

ক্রমে ক্রমে তার কৃষি ও মৎস্য এবং পশুসম্পদসহ বিভিন্ন বিষয়ে অন্যের বইয়ের একটা মজুদ তৈরি হয়। তথ্যনির্ভর এসব বই একসঙ্গে কোথাও পাওয়া যায় না। এজন্য লাইব্রেরি করার কথা ভাবেন। লক্ষ্য, কৃষকদের কৃষি বিষয়ক তথ্য জানানো ও বিজ্ঞানসম্মত চাষবাসে সহযোগিতা করা। নওগাঁ শহর থেকে ৪০ কিলোমিটার ও মান্দা সদর থেকে ১০ কিলোমিটার দক্ষিণে নিভৃত পল্লী কালিগ্রামে ২০০৮ সালের ১৮ এপ্রিল নিজ বাড়ির একটি মাটির ঘরে জাহাঙ্গীর শাহের ব্যক্তিগত উদ্যোগে গড়া কৃষি লাইব্রেরির যাত্রা শুরু হয়।

‘শাহ কৃষি তথ্য পাঠাগার’ নামে এই কৃষি লাইব্রেরির আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্বোধন করেন শিল্প মন্ত্রণালয়ের তৎকালীন অতিরিক্ত সচিব এ বি এম খোরশেদ আলম। এ সময় উপস্থিত ছিলেন এয়ার কমোডর (অব.) গোলাম তৌহিদ। পাঠাগারের পরিদর্শন বইয়ে খোরশেদ আলম লেখেন, একজন শিক্ষক হিসেবে সমাজের দায়িত্ব পালনের এ বিরল দৃষ্টান্ত সমসাময়িক একজন আদর্শ শিক্ষকের ভূমিকায় জাহাঙ্গীর আলমকে প্রতিষ্ঠিত করবে বলে তার বিশ্বাস। একচালা মাটির ঘরের একটি কক্ষকে বানানো হয়েছে কৃষি লাইব্রেরির পড়ার ঘর। পাশেই রয়েছে খোলা মাটির ঘরের বারান্দা।

হ্যাঁ, এটাই শাহ কৃষি তথ্য পাঠাগারের সেমিনার কক্ষ, প্রশিক্ষণ ভেন্যু; আবার কখনো কখনো তা পড়ার জায়গা। এখানে জাহাঙ্গীর শাহ কৃষি বিষয়ক ১৭টি সেমিনারের আয়োজন করেন যা থেকে ওই এলাকার কৃষকরা উপকৃত হয়েছেন বারবার। পাঠাগারটি এখন কৃষকদের ঘরেও জ্ঞানের আলো জ্বালাচ্ছে। লাইব্রেরিতে এখন প্রায় দেড় হাজার বই, সাময়িকী, কৃষি ম্যাগাজিন, ৫০০ কৃষি বিষয়ক লিফলেট, বুকলেট রয়েছে। কৃষকদের বিভিন্ন বিষয়ে সচেতন করে তুলতে লাইব্রেরির বারান্দায় টানানো আছে বেশবিছু পোস্টার ও তালিকা।

এক পাশ খোলা বারান্দার দেয়ালজুড়ে রয়েছে কীভাবে লক্ষণ দেখে ভালো দুধ দেয়া গাভী চেনা যায়, ভেজাল সার চেনার উপায়, কৃষিতে নারীর অবদান, কৃষিতে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব, সবজিপঞ্জি, হাঁস-মুরগি ও গরুÑছাগল পালন প্রভৃতি সম্পর্কিত নানা পোস্টার। শুধু তাই নয়, জনসচেতনতা বৃদ্ধিতে এইডস প্রতিরোধে করণীয়, হার্ট অ্যাটাক মোকাবেলার উপায় ছাড়াও সাধারণ চিকিৎসা বিষয়ক পোস্টার। জাহাঙ্গীর আলমের চাচাতো ভাই লিপটন শাহ এ লাইব্রেরির দেখভাল করেন। প্রতিদিন ২৪ ঘণ্টা বলতে গেলে এটি খোলা থাকে। লাইব্রেরিতে ভর্তি হতে হয় না।

মাসিক চাঁদাও দিতে হয় না। বই বাড়িতে নিয়ে পড়ার নিয়ম নেই। লাইব্রেরির ভেতর চেয়ার, চৌকি ও মোড়ায় বাসে দিনভর পড়া যায়। যারা পড়তে জানেন না, তারা পরিচিত কাউকে দিয়ে পড়িয়ে তা শোনেন। জাহাঙ্গীর শাহ এখানে বয়স্ক ও শিশু শিক্ষার ব্যবস্থা করেছেন।

কিছু কিছু বয়স্ক মানুষ এখনো তাদের ইচ্ছামাফিক লাইব্রেরিতে আসেন, বই পড়েন, আনন্দ করেন। এছাড়া ওই এলাকার ৫০ জন বিভিন্ন শ্রেণীর শিক্ষার্থীকে নিয়মিত কলম বিতরণ করেন তিনি। কলমের কালি শেষ হলে তা জমা দিয়ে নতুন কলম তারা নিতে পারে। এর পাশাপাশি সারা বছর বিভিন্ন উৎসব, বিশেষ দিবস উপলক্ষে এখানে চলে বয়স ও শ্রেণীভেদে হাতের লেখা প্রতিযোগিতা, বিভিন্ন খেলাধুলা। জাতীয় কৃষি দিবসে কৃষকদের উৎসাহিত করতে ভালো কৃষক, ভালো হালচাষী, ভালো শ্রমিক, ভালো বীজতলা প্রস্তুতকারকসহ মোট আটটি শ্রেণীতে ১১টি পুরস্কার দেয়া হয় লাইব্রেরির পক্ষ থেকে।

কৃষকদের স্বাস্থ্য সমস্যার কথা বিবেচনা করে তিনি কৃষি ও কৃষকের হেলথ ক্যাম্পেরও আয়োজন করেছিলেন কিছু দিন আগে। কৃষি বিষয়ে আরো উচ্চতর পরামর্শ নেয়ার জন্য কৃষিবিদদের টেলিফোন নাম্বার, হাসপাতাল, ফায়ার সার্ভিস, অ্যাম্বুলেন্স ও বিভিন্ন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের সঙ্গে যোগাযোগের টেলিফোন নাম্বারও রেখেছেন এ লাইব্রেরিতে। তিনি তার বেতনের প্রায় পুরোটাই ব্যয় করেন কৃষি সেবার পেছনে। কোথাও কোনো নতুন কৃষি প্রযুক্তির সন্ধান পেলে তিনি সেখানে ছুটে যান তথ্য সংগ্রহের কাজে। শিখে নেন নতুন কলাকৌশল যাতে পরে অন্য কৃষকদের শেখানো যায়।

জাহাঙ্গীর শাহ কৃষি সেবা দিয়ে দেশটাকে পরিবর্তনের ছোঁয়া এনে দিতে চান। তিনি বলেন, কৃষি বিষয়ক তথ্য বিভিন্ন কৃষি প্রতিষ্ঠানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। এতে করে কৃষকরা তাদের প্রয়োজনীয় তথ্য একটি মাত্র প্রতিষ্ঠান বা উৎস থেকে পাচ্ছেন না যা তাদের কৃষি ব্যবস্থার উন্নতির এক রকম পিছুটান। শাহ কৃষি তথ্য লাইব্রেরিতে কৃষির সব শাখার এবং ফসল ও প্রযুক্তির তথ্য রাখার চেষ্টা করা হয়েছে যা কৃষক ও কৃষি ব্যবস্থার উন্নতি সাধনে ভূমিকা রাখবে বলে তিনি মনে করেন। কারো কোনো আর্থিক সহায়তা ছাড়াই তিনি তার কৃষি তথ্য পাঠাগার গড়ে তুলেছেন।

এখনো কোথাও বেড়াতে গেলে বা কোথাও কোনো কৃষি বিষয়ক ভালো বই পেলে তিনি তা সংগ্রহ করেন কিংবা কিনে কিনে বাড়াতে থাকেন তার লাইব্রেরির বইয়ের সারি। কোনো সংস্থা বা কোনো ব্যক্তির কাছ থেকে লাইব্রেরির জন্য তিনি কোনো আর্থিক সাহায্য চান না। তিনি বলেন, টাকা নয়, চাই কৃষি বিষয়ক বই। যদি কেউ বা কোনো প্রতিষ্ঠান আমার এ ছোট্ট লাইব্রেরির জন্য সরাসরি মূল্যবান এবং প্রয়োজনীয় বই ও কৃষি শিক্ষার উপকরণ কিনে দেন তবে তিনি সবচেয়ে বেশি খুশি হবেন। বাংলাদেশের প্রতিটি থানায় যদি একটি করে ব্যক্তিগত বা সমন্বিত প্রচেষ্টার কৃষি লাইব্রেরি গড়ে তোলা যায় তাহলে এ দেশকে সোনার বাংলা হিসেবে গড়ে তুলতে তেমন বেগ পেতে হবে না।


অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.