আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

বিদ্যুৎ বিভাগকে তোপের মুখে ফেলেছে সামিট

প্রভাব খাটিয়ে সবচেয়ে বড় বড় বিদ্যুৎকেন্দ্রের কাজ বাগিয়ে নিয়েও শেষ করতে পারছে না সামিট গ্রুপ। বছর তিনেক ঘুরিয়ে অবশেষে ৩০০-৪৫০ মেগাওয়াট ক্ষমতার বিবিয়ানা-১ বিদ্যুৎকেন্দ্রটি নির্মাণে অপারগতা প্রকাশ করেছে প্রতিষ্ঠানটি। নির্মাণ করতে পারেনি একই ক্ষমতার বিবিয়ানা-২ কেন্দ্রটিও। সময়মতো কেন্দ্র নির্মাণে অপারগতা প্রকাশ করায় নিয়ম অনুযায়ী প্রতিষ্ঠানটির কাছ থেকে জরিমানাও আদায় করতে পারছে না বিদ্যুৎ বিভাগ। এতে দেশের মানুষ বঞ্চিত হচ্ছে কম দামে বিদ্যুৎ পাওয়া থেকে।

আর রাজস্ব থেকে বঞ্চিত হচ্ছে সরকার। ফলে তোপের মুখে পড়েছে বিদ্যুৎ বিভাগ। অথচ সরকারের লক্ষ্য ২০১৬ সালের মধ্যে ১৫ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুতের ৫৮ শতাংশ বেসরকারি খাতে উৎপাদন করা।

বড় ভিত্তি বিদ্যুৎকেন্দ্রের অভাব ও ব্যয়বহুল ভাড়াভিত্তিক কেন্দ্র দিয়ে ঘাটতি পূরণ করায় গত কয়েক বছরে হু হু করে বেড়েছে বিদ্যুতের দাম। এতে শিল্পপ্রতিষ্ঠান থেকে শুরু করে হতদরিদ্রদের ওপর নেমে এসেছে লাগামহীন বিদ্যুৎ বিলের বোঝা।

সামিটের বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো উৎপাদনে এলে এখান থেকে দুই টাকা ৬৬ পয়সা ইউনিট দরে বিদ্যুৎ পাওয়া যেত। আশা করা হয়েছিল সামিটের বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো উৎপাদনে এলে এ বোঝা অনেকটাই কমে আসবে। এর আগে সক্ষমতা বিচার না করেই তাদের হাতে তুলে দেওয়া হয় বেসরকারি খাতে দেশের সবচেয়ে বেশি বিদ্যুৎ (প্রায় ১৮৩০ মেগাওয়াট) উৎপাদনের দায়িত্ব। সরকারের উপরমহলকে ম্যানেজ করে ২০১১ সালে বড় বড় তিনটি বিদ্যুৎকেন্দ্রের কাজ বাগিয়ে নেয় গ্রুপটি একাই। তবে তিন বছর পর এখনো কোনো কেন্দ্রই উৎপাদনে আনতে পারেনি প্রতিষ্ঠানটি।

বেশ কয়েকবার সময় বাড়িয়ে আগামী মার্চে শুধু মেঘনাঘাট ৩০০-৪৫০ মেগাওয়াট কেন্দ্রটি উৎপাদনে আসার ব্যাপারে বিদ্যুৎ বিভাগকে জানিয়েছে সামিট। সূত্র জানায়, মূলত সাবেক জ্বালানি উপদেষ্টা ড. তৌফিক-ই-ইলাহীর আগ্রহেই সক্ষমতা না থাকলেও সামিটের হাতে একসঙ্গে এক হাজার ৩৫০ মেগাওয়াটের তিনটি বিদ্যুৎকেন্দ্রের কাজ তুলে দেওয়া হয়।

জানা গেছে, বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে ২০১১ সালের ১২ মে মেঘনাঘাট ৩০০-৪৫০ মেগাওয়াট কম্বাইন্ড সাইকেল পাওয়ার প্লান্ট এবং ওই বছরের ১৫ মে বিবিয়ানা ৩০০-৪৫০ মেগাওয়াট কম্বাইন্ড সাইকেল পাওয়ার প্লান্ট-১ ও একই ক্ষমতার ইউনিট-২ নির্মাণের লক্ষ্যে সামিট পাওয়ার লিমিটেডের সঙ্গে চুক্তি করে বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি)। এ ছাড়া আগে-পরে দেওয়া হয় রেন্টালসহ বেশ কিছু ছোট কেন্দ্রের কাজ। কিন্তু অর্থ জোগাড় করতে না পারায় দেড় বছর পার হলেও বড় কেন্দ্র তিনটির একটিরও কাজে হাত দিতে পারেনি সামিট গ্রুপ।

বিদ্যুৎ বিভাগের একাধিক কর্মকর্তা বলেন, মূলত বড় বিদ্যুৎকেন্দ্র উৎপাদনে এলেই রেন্টাল, কুইক-রেন্টালের ব্যবসা বন্ধ হয়ে যাবে। এই ভয়ও কাজ করছে সামিটের মধ্যে। এদিকে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, সাতটি রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্রের চুক্তির মেয়াদ ২০১৮ সাল পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছে।

সূত্র জানায়, বিদ্যুৎ বিভাগ থেকে সামিটকে বারবার তাগাদা দেওয়া হলে তারা পদ্মা সেতু নিয়ে বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে সরকারের শীতল সম্পর্ককে অর্থ জোগাড়ের পথে বাধা হিসেবে দায়ী করে। একই সঙ্গে জমি বুঝিয়ে দেওয়া হচ্ছে না বলেও অভিযোগ উত্থাপন করে তারা।

তবে বিদ্যুৎ বিভাগ থেকে বছর দেড়েক আগে সামিটকে জমি বুঝিয়ে দেওয়া হলেও বিবিয়ানা-১ কেন্দ্রটি তাদের পক্ষে করা সম্ভব নয় বলে শেষ কথা জানিয়ে দিয়েছে তারা। বাধ্য হয়ে এ কেন্দ্রটি সরকারি অর্থায়নে করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে বিদ্যুৎ বিভাগ। গত সপ্তাহে কেন্দ্রটি নির্মাণে দরপত্র আহ্বান করা হয়েছে। অন্যদিকে বিবিয়ানা-২ কেন্দ্রটির কাজে তারা হাত দিয়েছে প্রায় দুই বছর পর। কেন্দ্রটি উৎপাদনে আসতে আরও অন্তত দেড় বছর সময় লেগে যাবে বলে জানিয়েছে পিডিবি।

অথচ গ্যাসভিত্তিক এই তিনটি ইনডিপেনডেন্ট পাওয়ার প্রডিউসারের (আইপিপি) মধ্যে বিবিয়ানা ইউনিট-১ ও ইউনিট-২ গত বছরের আগস্ট মাসেই উৎপাদনে আসার কথা ছিল।

এদিকে চুক্তি অনুযায়ী বিবিয়ানা-১ বিদ্যুৎকেন্দ্রের নির্মাণকাজ শুরু করতে না পারায় সামিটের জামানতের ৩০ লাখ ডলার বাজেয়াপ্ত করে পুনরায় দরপত্র আহ্বান করার কথা। কিন্তু বিদ্যুৎ বিভাগ এখনো সামিটের কাছ থেকে নিরাপত্তা জামানতের ৩০ লাখ ডলার আদায় করতে পারেনি। জানা গেছে, এবি ব্যাংকের কারওয়ান বাজার শাখা থেকে সামিট পাওয়ারের ওই ব্যাংক ড্রাফটি ক্যাশ করার জন্য বিদ্যুৎ বিভাগের পক্ষ থেকে চিঠি দেওয়া হয় গত বছরের ৪ সেপ্টেম্বর। জামানতের টাকা না দিতে সামিটও বিভিন্ন পরিকল্পনা সাজায়।

বিদ্যুৎ বিভাগেরই কিছু অসাধু কর্মকর্তার পরামর্শ ও সহযোগিতায় হাইকোর্টে রিট করে সামিট পাওয়ার। রিটের পরিপ্রেক্ষিতে সামিটের জামানত বাজেয়াপ্ত করার ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেন আদালত। সামিটের দায়ের করা ওই রিটের শুনানির তারিখ ছিল গত বছরের ২৪ ডিসেম্বর। কিন্তু শীতকালীন ছুটির কারণে তা পিছিয়ে যায়। এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (পিডিবি) চেয়ারম্যান আব্দুহু রুহুল্লাহ বলেন, বিবিয়ানা-১ বিদ্যুৎকেন্দ্রটি এখন পিডিবি নিজস্ব অর্থায়নে নির্মাণ করবে।

সামিটের সঙ্গে চুক্তি বাতিল করা হয়েছে। আর চুক্তি ভঙ্গ করায় সামিটকে জরিমানা দিতে হবে। তবে তারা রিট করায় জামানতের বিষয়টি ঝুলে গেছে। এ ব্যাপারে আদালতের রায়ের অপেক্ষায় আছে পিডিবি। এ ব্যাপারে পাওয়ার সেলের সাবেক মহাপরিচালক প্রকৌশলী বিডি রহমতউল্লাহ জানান, সম্পূর্ণ বেআইনিভাবে সামিটকে এমন সুযোগ দেওয়া হয়েছে।

আসলে সরকার কোনোভাবেই সামিটের জামানত বাজেয়াপ্ত করতে চায় না। বিদ্যুৎ বিভাগের একাধিক কর্মকর্তা বলেন, বিদ্যুৎ বিভাগকে তোপের মুখে ফেলেছে সামিট। তাদের কারণে মিডিয়ায় বিদ্যুৎ বিভাগের বিরুদ্ধে প্রচুর লেখালেখি হচ্ছে। কিন্তু সরকারে তাদের দাপটের কারণে কেউই সাবেক মন্ত্রী ফারুক খানের ভাইয়ের এই প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে সরাসরি পদক্ষেপে যেতে চাইছে না। তারা বলেন, সম্পূর্ণ বেআইনিভাবে সামিটকে বাড়তি সুযোগ দেওয়া হচ্ছে।

এটি বিদ্যুৎ খাতে একটি ন্যক্কারজনক উদাহরণ হয়ে থাকবে। ভবিষ্যতে অন্য কোনো কোম্পানি আইন ভঙ্গ করলে তাদের বিরুদ্ধে সরকারের নৈতিকভাবে কিছুই করার থাকবে না।

কথা রাখেনি সামিট : গত নভেম্বরে জাতীয় গ্রিডে ২২০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ দিতে চেয়েও তা দিতে পারেনি কোম্পানিটি। রাজনৈতিক অস্থিরতাকে দায়ী করে নতুন ডেটলাইন দিয়েছে ২৫ ফেব্রুয়ারি। কিন্তু কোম্পানিটির ওয়েবসাইটে এখনো দেখা যাচ্ছে নভেম্বর, ২০১৩ থেকে পরীক্ষামূলকভাবে মেঘনাঘাট কেন্দ্র থেকে ২২০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ জাতীয় গ্রিডে যুক্ত হবে।

আর কোম্পানিটির নতুন ডেটলাইন সম্পর্কে দাফতরিকভাবে অবগত নয় বাংলাদেশ পাওয়ার ডেভেলপমেন্ট বোর্ড (পিডিবি)। সংস্থাটি বলছে নভেম্বর থেকে সামিট পাওয়ারের তত্ত্বাবধানে নির্মাণাধীন মেঘনাঘাট কেন্দ্র থেকে ২২০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ জাতীয় গ্রিডে দেওয়ার কথা ছিল। কিন্তু এখনো বিদ্যুৎকেন্দ্রের নির্মাণই সম্পন্ন করতে পারেনি সামিট পাওয়ার কর্তৃপক্ষ। অন্যদিকে বেসরকারি খাতে সিরাজগঞ্জ ৩০০-৪৫০ মেগাওয়াট ক্ষমতার বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের দরপত্রে সামিট অংশ নেয়। তবে এ প্রকল্পের দরপত্র মূল্যায়ন কমিটি সামিটের প্রস্তাবকে গ্রহণযোগ্য বিবেচনা করেনি।

এখন নতুন আরেকটি কেন্দ্রের কাজ পেতে সরকারের উচ্চ মহলে জোর তদবির চালাচ্ছে সামিট কর্তৃপক্ষ। মেঘনাঘাট বিদ্যুৎকেন্দ্রের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা এ এন এম তারীকুর রশীদ বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে গত নভেম্বর-ডিসেম্বরে তাদের বিদেশি বিশেষজ্ঞরা ঢাকা ছেড়ে গিয়েছিলেন। ফলে সে সময় কেন্দ্রের কাজ এগোয়নি। এখন তারা আবার ফিরে এসে কাজে যোগ দিয়েছেন। চলতি মাসের ২৫ তারিখ থেকে পরীক্ষামূলকভাবে ২২০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ সরবরাহ করতে পারবেন বলে তিনি আশা প্রকাশ করেন।

তিনি দাবি করে বলেন, ৩৩৫ মেগাওয়াট উৎপাদন ক্ষমতাসম্পন্ন এই কেন্দ্রের কাজ এখন পর্যন্ত ৮০ শতাংশ এগিয়েছে। তবে পিডিবির একটি সূত্র জানায়, কেন্দ্রটির কাজ এখনো প্রায় ৪০ ভাগই বাকি রয়েছে। কবে নাগাদ এ কেন্দ্র থেকে তারা জাতীয় গ্রিডে বিদ্যুৎ দিতে পারবে, তা নির্দিষ্ট করে বলা যাচ্ছে না। ৩০৫ মেগাওয়াট উৎপাদন ক্ষমতাসম্পন্ন এটি একটি ডুয়েল ফুয়েল বিদ্যুৎকেন্দ্র। গ্যাস দিয়ে উৎপাদন করলে এতে প্রতি ইউনিটের উৎপাদন খরচ পড়বে আড়াই টাকা।

আর তেল দিয়ে চালালে উৎপাদন খরচ পড়বে ১৪ থেকে ১৬ টাকা। এখান থেকে ১৭ টাকা ইউনিট দরে বিদ্যুৎ কিনবে বিউবো। আর তা গ্রাহকদের কাছে বিক্রি করা হবে সাড়ে চার টাকা দরে। পিডিবির তথ্যমতে, সামিট পাওয়ারের অধীনে যেসব কেন্দ্র রয়েছে সেগুলোর উৎপাদন ক্ষমতা ১৮৩০ মেগাওয়াট। সেখান থেকে পিডিবি বিদ্যুৎ পায় মাত্র সাড়ে ৭০০ মেগাওয়াট।

এদিকে সামিট পাওয়ারের তথ্যমতে, ১১১৫ মেগাওয়াট উৎপাদন ক্ষমতাসম্পন্ন কয়েকটি কেন্দ্র থেকে সাড়ে ৭০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ সরবরাহ করা হচ্ছে। আর মেঘনাঘাট কেন্দ্রটির নির্মাণ সম্পন্ন হলে আগামী জুন থেকে আরও ৩৩০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ জাতীয় গ্রিডে সরবরাহ করবে সামিট। এভাবেই মাসের পর মাস কথা দিয়ে আসছে সামিট পাওয়ার। কিন্তু প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী বিদ্যুৎ সরবরাহ করতে পারছে না। সরকার কোম্পানিটির বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নিচ্ছে না বলে জানা গেছে।

সাবেক বাণিজ্যমন্ত্রী ফারুক খানের ভাই সামিট পাওয়ারের কর্ণধার আজিজ খান এ প্রসঙ্গে বলেন, 'সরকারের সঙ্গে আমাদের যে প্রতিশ্রুতি রয়েছে, আমরা তা পালনের চেষ্টা করছি। আর আমাদের সঙ্গে সরকারের প্রতিশ্রুতি হচ্ছে সঠিক সময়ে পর্যাপ্ত গ্যাস সরবরাহ করা। '

 

 

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.