আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

বাংলা ভাষায় মুসলমানদের অবদান ヅ

আমি খুব সাধারন .......

সৃষ্টি জগতের সমস্ত সৃষ্টির নিজ নিজ ভাষা আছে, কিন্তু সে সব ভাষায় নেই কোন পরিবর্তন বিবর্তন। কিন্তু আল্লাহ প্রদত্ত মানুষের ভাষায় রয়েছে বৈচিত্র্য ও পরিবর্তন বিবর্তনের গতি। মানুষের ভাষা আল্ল­াহ তায়ালা পবিত্র কুদরতের নিদর্শন। পবিত্র কুরআনে এরশাদ হচ্ছে, ‘‘তার নিদর্শনাবলীর অন্যতম নিদর্শন হল আকাশমন্ডলী ও পৃথিবীর সৃষ্টি এবং তোমাদের ভাষা ও বর্ণ বৈচিত্র্য; নিশ্চয়ই এতে জ্ঞানীদের জন্য রয়েছে নিদর্শন। ’’

পৃথিবীতে রয়েছে কয়েক হাজার ভাষা।

সময়ের স্রোতে প্রতিটি ভাষা কম বেশি তার রূপ বদলায়। আমাদের মাতৃভাষা বাংলাও বিভিন্ন সময় তার রূপ পাল্টিয়েছে। প্রতিটি ভাষার রূপের কারিগর ঐ ভাষাভাষী মানুষ। আমাদের মাতৃভাষা বাংলার যে সুন্দর রূপ বর্তমানে আমরা দেখতে পাই তার পেছনে রয়েছে বাঙালীর বহু শতাব্দীর সাধনা।

ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহর মতে বাংলা ভাষার উৎপত্তিকাল খ্রীস্টিয় সপ্তম শতাব্দী।

অন্যূন হাজার বছরের পুরানো বাংলা ভাষা উৎপত্তির পর থেকে নানা পর্যায়ে পরিবর্তনের মাধ্যমে আধুনিক পর্যায়ে উপনীত হয়েছে। বাংলাদেশের অধিবাসীরা প্রথম থেকেই বাংলা ভাষায় কথা বলত না। বর্তমান বাংলা ভাষা প্রচলনের আগে গৌড় ও পুন্ড্রের লোকেরা অসুর ভাষাভাষী ছিল। এই অসুর ভাষাই ছিল আমাদের দেশের ভাষা। বাংলাদেশে আর্যদের আসার আগে এদেশবাসীরা যে ভাষা ব্যবহার করতেন, তার কোন নিদর্শন আজ পর্যন্ত পাওয়া যায়নি।



ঐতিহাসিকরা মনে করেন, বাংলা ভাষার প্রাথমিক স্তর পঞ্চম থেকে দশম শতাব্দীর মাঝামাঝি সময় উদ্ভূত হয়েছিল। সেনরাজগণ বিদেশী ছিলেন বলে বাংলা সম্বন্ধে বিশেষ কৌতূহলী ছিলেন না। তাদের সভায় সংস্কৃতজ্ঞ ব্রাহ্মণ-পন্ডিতদের প্রাধান্য ছিল বেশি। বাংলাদেশে বাংলা ভাষা ও বাংলা সাহিত্যের উদ্ভব ও প্রসার লাভ ঘটেছে বৌদ্ধ আমলে; বিশেষ করে স্বাধীন পাল রাজাদের পৃষ্ঠপোষকতায়। পাল এবং সেন বংশীয় রাজাদের আমলে বাঙালি জনগণ ও তাদের ভাষাও অন্যতম মুখ্য বিশিষ্টতা প্রাপ্ত হয়।

নতুন ভাষা বাঙলার রূপ গ্রহণের সাথে সাথে বাঙালির মানসিক সংস্কৃতি এই ভাষার মাধ্যমে আত্মপ্রকাশের কাজে লেগে গেল-আনুমানিক দশম শতক হতে প্রাচীন বাঙলায় রচিত বৌদ্ধ চর্য্যাপদকে অবলম্বন করে বাংলা ভাষার সাহিত্যিক ইতিহাস শুরু হয়।

বাংলা সাহিত্যের প্রথম মুসলমান কবি হিসেবে শাহ মুহম্মদ সগীর বিশেষ গৌরবের অধিকারী। তিনি গৌড়ের সুলতান গিয়াসউদ্দিন আজম শাহের রাজত্বকালে [ ১৩৯৩-১৪০৯ খ্রিঃ] ইউসুফ জোলেখা কাব্য রচনা করেন। এর পরে যাদের নাম করতে হয় তারা হলেন দৌলত উজির বাহরাম খান, মুহম্মদ কবির, সাবিরিদ খান ও দোনাগাজী চৌধুরীর।

মধ্যযুগে [১২০০-১৮০০ খ্রিস্টাব্দ] আরকান রাজ সভায় বাংলা সাহিত্যের চর্চা হয় এবং সেখানকার মুসলমান কবিগণ ধর্ম সংস্কার মুক্ত মানবীয় প্রণয়কাহিনী অবলম্বনে কাব্য রচনা করে এক নতুনতর বৈশিষ্ট্য দেখান।

আরকানের বৌদ্ধ রাজাদের আনুকূল্যে বাংলা সাহিত্যের চর্চা করে যে সমস্ত মুসলিম কবি খ্যাতি অর্জন করেছেন, তাঁদের মধ্যে দৌলত কাজীর নাম সর্বাগ্রে স্মরণীয়। তাঁর রচিত কাব্যগ্রন্থের মধ্যে ‘সতী ময়না ও লোর চন্দ্রানী' নামে একটি মাত্র কাব্যের সন্ধান পাওয়া যায়।

আরকান রাজসভার বাংলা সাহিত্যের আর একজন নামকরা কবি মহাকবি আলাওল। কবি আলাওলের সাহিত্য সম্পদের প্রাচুর্য সহজেই চোখে পড়ার মত। ফারসী সাহিত্য ভান্ডার থেকে তিনি ‘সেকান্দার নামা', ‘সয়ফুল মুলক বদিউজ্জামাল', ‘হপ্ত পয়কর' প্রভৃতি কাব্য ও ধর্ম বিষয়ক ‘তোহফা' গ্রন্থটি অনুবাদ করেন।

মহাকবি আলাওলের অমর কাব্য ‘পদ্মাতবি কাব্য। এছাড়াও সতের শতকের বিখ্যাত মুসলমান কবি হলেন, আবদুল হাকিম, নওয়াজিস খান, সৈয়দ মুহম্মদ আকবর প্রমুখ।

বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের যে রূপ নিয়ে আমরা গর্ব করি তা প্রকৃত প্রস্তাবে শুরু হয়েছিল বাংলাদেশে মুসলিম শাসনামল থেকে। গুপ্তদের শাসনামলে সংস্কৃত ভাষা ও সাহিত্যের যে চর্চা শুরু হয়, পাল ও সেন আমলে সে ধারা অব্যাহত থাকে। তবে বাংলা দেশের স্বাধীন শাসক পালদের আমলে দেশীয় ভাষা হিসাবে প্রথম বাংলার চর্চা শুরু হয়।

বাংলা দেশে বাংলা ভাষা ও বাংলা সাহিত্যের উদ্ভব ও প্রসার ঘটেছে বৌদ্ধ আমলে; বিশেষ করে স্বাধীন পাল রাজাদের পৃষ্ঠপোষকতায়। হিন্দু সেন রাজাদের আমলে বাংলা ভাষা ও সাহিত্য পৃষ্ঠপোষকতা থেকে বঞ্চিত হয়। সেন আমলে বাংলা ভাষার চর্চা না হলেও এ ভাষার নিজস্ব সত্তা একেবারে লোপ পায়নি। স্বাভাবিকভাবে মুসলমানদের আগমনের পর মুক্ত পরিবেশে সাধারণের মুখের ভাষা বাংলার ব্যাপক চর্চার সুযোগ ঘটে।

বাংলা ভাষা মুসলমান প্রভাবের পূর্বে অতীব অনাদর ও উপেক্ষায় আত্মপ্রকাশ করেছিল।

ইতরের ভাষা বলে বাংলা ভাষা পন্ডিত সমাজে অপাংক্তেয় ও উপেক্ষার পাত্র ছিল। মুসলমান বিজয় বাংলা ভাষার জন্য শুভ দিন বয়ে আনল। বাংলা ভাষা-সাহিত্য তথা বাঙালীর জন্য ১২০৫ খ্রিষ্টাব্দ এক মহা ঐতিহাসিক ক্ষণ। তুর্কি মুসলিম সেনাপতি মুহম্মদ বখতিয়ার খিলজি বাংলা দেশে মুসলিম রাজত্ব কায়েমের ফলে বাংলাভাষা ও সাহিত্যের নবজন্ম ঘটে। মুসলমান শাসক হুসেন শাহ, গৌড়ের সামসুদ্দিন ইউসুফ শাহ এবং অপরাপর মুসলমান সম্রাটেরা বাংলা দেশে বাংলা ভাষাকে সুপ্রতিষ্ঠিত করে আমাদের সাহিত্যে এক নতুন যুগ সৃষ্টি করেছিলেন।

এ সব ইতিহাস সামনে রেখে শ্রীদিনেশ চন্দ্র সেন মন্তব্য করেন, ‘‘মুসলমান সম্রাটগণ বর্তমান বঙ্গ-সাহিত্যের এইরূপ জন্মদাতা বলিলেও অত্যুক্তি হয় না। ... বঙ্গ সাহিত্য মুসলমানদেরই সৃষ্ট, বঙ্গভাষা বাঙ্গালী মুসলমানের মাতৃভাষা। ’’

বাংলা সাহিত্যে মুসলমান শাসকগণের উদার পৃষ্ঠপোষকতায় যে নবজীবনের সূচনা হয়েছিল সে সম্পর্কে ড. মুহম্মদ এনামুল হক মন্তব্য করেছেন, ‘বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের বিকাশে বাংলার মুসলমানদের যতখানি হাত রহিয়াছে হিন্দুদের ততখানি নহে। এদেশের হিন্দুগণ বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের জন্মদাতা বটে; কিন্তু তাহার আশৈশব লালন পালন ও রক্ষাকর্তা বাংলার মুসলমান । স্বীকার করি, মুসলমান না হইলে বাংলা ভাষা ও সাহিত্য মনোরম বনফুলের ন্যায় পল্লীর কৃষককণ্ঠেই ফুটিয়া উঠিত ও বিলীন হইত, কিন্তু তাহা জগতকে মুগ্ধ করিবার জন্য উপবনের মুখ দেখিতে পাইত না বা ভদ্র সমাজে সমাদৃত হইত না।

'

মধ্যযুগে মুসলিম সুলতান ও আমাত্যগণের অকৃপণ পৃষ্ঠপোষকতায় হিন্দু মুসলিম উভয় কবিদের মিলিত প্রচেষ্টায় সুসমৃদ্ধ সাহিত্য গড়ে ওঠে। মধ্যযুগে আরবী- ফারসি- তুর্কি- উর্দু শব্দের সংমিশ্রণে বাংলা যেমন সমৃদ্ধ হয়ে ওঠে, বাঙালী মুসলিম হিন্দু নির্বিশেষে সে ভাষায় কাব্যচর্চা করে বাংলা সাহিত্য ভান্ডারকে পূর্ণ করে তোলেন।

মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যে ধর্মীয় বিষয় বস্তু ব্যাপক ভাবে স্থান লাভ করেছিল। মর্সিয়া কাব্যের উপাদান বিবেচনা করলে এগুলোকেও ধর্মীয় সাহিত্য হিসেবে বিবেচনা করা যায়। মোগল আমলে বাংলায় মর্সিয়া সাহিত্য রচনা করেছিলেন তাদের মধ্যে উল্লেখ যোগ্য হলেনঃ দৌলত উজির বাহরাম খান, মুহম্মদ খান, হায়াৎ মামুদ, জাফর, হামিদ প্রমুখ।

দৌলত উজির বাহরাম খান ‘জঙ্গনামা' কাব্য রচনা করেছিলেন। মুহম্মদ খান ‘মক্তুল হোসেন' কাব্য রচনা করে যথেষ্ট খ্যাতি লাভ করেছিলেন । ইসলামী বিষয় অবলম্বনে বাংলা সাহিত্য সৃষ্টির যে সব নিদর্শন মধ্য যুগে লক্ষ করা যায় তার মধ্যে সুফী সাহিত্য বিশিষ্ট স্থানের অধিকারী। বাংলা সুফী সাহিত্যের ধারায় সর্বাধিক উল্লেখ যোগ্য কবি সৈয়দ সুলতান।

১৭৫৭ সালে পলাশীর যুদ্ধে বাংলার স্বাধীন সূর্য অস্তমিত হবার পর বাংলা সাহিত্যে আবার পালা বদল হল।

পরিবর্তন ঘটল মুসলিম শাসনের। সনাতন শিক্ষা ব্যবস্থা ভেঙ্গে গড়ে উঠতে লাগল ইংরাজ সৃষ্ট নতুন ইঙ্গ- হিন্দু মার্কা শিক্ষা ব্যবস্থা। ফারসীর বদলে নতুন রাষ্ট্র ভাষা হল ইংরাজি। ইংরাজি ভাষা- সাহিত্যের প্রভাবে ইংরাজি পড়া বাঙালীর হাতে আধুনিক বাংলা সাহিত্যের গোড়া পত্তন হল।

ফোর্ড উইলিয়মের সংস্কৃতজ্ঞ পন্ডিতেরা বাংলাভাষায় পন্ডিতী রীতির জন্মদান করেন এবং বিদ্যাসাগর (১৮২০-১৮৯১) তার প্রাণ প্রতিষ্ঠা করেন।

তাদের আমলে বাংলা ভাষা এক রকম বাঙালিত্ব বর্জন করে খাঁটি আর্য ভাষায় (সংস্কৃত) রূপান্তরিত হয়েছে। উল্লেখ করা যেতে পারে, আধুনিক বাংলার জনক নামে পরিচিত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের ভাষা এত খাঁটি ছিল যে, তার ‘বেতাল পঞ্চবিংশতি' ও ‘সীতার বনবাস' গ্রন্থদ্বয়ের শব্দ সম্ভারের শতকরা ৯০ থেকে ৯৯ ভাগ পর্যন্ত সংস্কৃত হয়ে উঠেছিল। ফোর্ড উইলিয়ম কলেজকে কেন্দ্র করে যে বাংলা গদ্যের ভিত্তি প্রতিষ্ঠিত হয় বাঙালী হিন্দু সমাজ ছিল তার প্রধান রূপকার। বাঙালী মুসলমানদের তরফ থেকে এই প্রয়াসের বিরুদ্ধে যে প্রতিবাদ জ্ঞাপন করা হয়েছিল, দুর্ভাগ্য ক্রমে তা বিশেষ আমলে আনা হয়নি।

ফোর্ট উইলিয়মের পন্ডিতেরা নির্মীয়মান বাংলা থেকে ইচ্ছাকৃত ভাবে আরবী-ফার্সী শব্দ বর্জন করে ছিলেন।

তারা বাংলা ভাষার বিশুদ্ধতা রক্ষার জন্য এই শব্দ বর্জনের পরামর্শ দিয়েছিলেন। হিন্দু পন্ডিতগণ এ আদেশ অক্ষরে অক্ষরে পালন করে ছিলেন কিন্তু মুসলমান কবিরা আরবী-ফার্সী শব্দাবলীকে বাংলা ভাষার নিজস্ব সম্পদ মনে করে তা বর্জন করতে রাজী হননি।

ফোর্ট উইলিয়মের পন্ডিতগণ ও তার পরবর্তী হিন্দু সাহিত্যিকগণ যাই করুন না কেন, বাঙালী মুসলমান লেখকগণ কিন্তু এই অভিনব গদ্য-পদ্যের ধারাকে কোনদিনই মনে প্রাণে গ্রহণ করতে পারেনি। ফলে, তথাকথিত আধুনিক বাংলা সাহিত্যের ধারা থেকে তাঁরা বহু দিন ধরে দূরে অবস্থান করেছেন। উনবিংশ শতাব্দীর শেষ দিকে মীর মোশাররফ হোসেন [১৮৪৭- ১৯১২] মুসলমানদের সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় বিশয় বস্তু নিয়ে সাহিত্য সৃষ্টি করেছেন।

তার পরে কায়কোবাদ থেকে শুরু করে শেখ আবদুর রহীম, মুনশী রিয়াজুদ্দীন, মোজাম্মেল হক প্রমুখ সাহিত্যিকগণ ইসলামী সাহিত্যের ধারা সৃাষ্টি করলেন তাদের সাহিত্য কর্মে। এ সব মুসলিম সাহিত্যিক বিদ্যাসাগর, বঙ্কিম, ও মধুসূদনের অনুপ্রেরণায় পাশ্চাত্য প্রভাবান্বিত আধুনিক বাংলা গদ্য সাহিত্য সৃষ্টির পথ তৈরির প্রয়াস চালিয়েছেন। ।

প্রকৃত পক্ষে প্যারীচাঁদের ‘আলালের ঘরের দুলাল' রচনা কাল থেকে আধুনিক বাংলা গদ্য রীতির একটি শক্তিশালী ধারার উদ্ভব ঘটে। বঙ্কিমচন্দ্র (১৮৩৮-১৮৯৪) আলালের ঘরের দুলালের ভাষা- রীতির দ্বারা আকৃষ্ট হয়ে বাংলা গদ্য পুনঃনির্মাণের গরজ অনুভব করেছিলেন।

বঙ্কিমচন্দ্রের সমসাময়িককালে মধুসূদনের অবির্ভাব। বিশাল প্রতিভার অধিকারী মধুসূদন বাংলায় প্রথম সার্থক মহাকাব্য, সনেট, গীতিকাব্য, নাটক ও প্রহসন রচনা করেন।

মধুসূদনের পরে বাংলা সাহিত্যে যে যুগান্তকারী প্রতিভার আবির্ভাব ঘটে তিনি হলেন রবীন্দ্র নাথ ঠাকুর (১৮৬১-১৯৪১)। তিনি নানা বৈচিত্র্যে ও অভূতপূর্ব অবদানে বাংলা সাহিত্যকে এক নতুন দিগন্তে পৌঁছে দেন। রবীন্দ্রনাথের পরে বাংলা কাব্যের সর্বাধিক উল্লেখযোগ্য কবি হলেন কাজী নজরুল ইসলাম (১৮৯৯-১৯৭৬)।

রবীন্দ্রনাথের প্রভাব বলয় অতিক্রম করে তিনি বাংলা কাব্যে এক নতুন ধারার যুগান্তকারী বৈশিষ্ট্য নিয়ে আসেন। বাংলার যে একটি মুসলমানী রূপ আছে নজরুল ইসলাম তাঁর কাব্যে সেটা সার্থকভাবে তুলে ধরেছেন। নজরুল ইসলাম বাংলা কাব্যে যে তেজস্বিতা, প্রাণময় উদ্দীপনা ও নতুন বৈশিষ্ট্য নিয়ে এলেন, তাঁর সমকালে অনেক কবি তাতে অনুপ্রাণিত হয়ে বাংলা কাব্যকে নানা ভাবে সমৃদ্ধ করে তোলেন।

বাংলা গদ্যের সমৃদ্ধিতে মুসলিম সাহিত্যিকদের অবদান ঈর্ষণীয়। এদের মধ্যে যারা শীর্ষে ছিলেন তাঁরা হলেন নওশের আলী খান ইউসুফ জায়ী, আবদুল করীম সাহিত্যবিশারদ, মোহাম্মদ রওশন আলী চৌধুরী, সৈয়দ ইসমাইল হেসেন সিরাজী, বেগম রাকেয়া, কাজী ইমাদুলহক, লুৎফর রহমান এস. ওয়াজেদ আলী, শাহাদৎ হোসেন, ইবরাহিম খাঁ শেখ ফজলুল করিম, আবুল মনসুর আহমদ, কাজী আবদুল ওয়াদুদ, মোহাম্মাদ নজিবর রহমান, মোম্মদ বরকতুল্লাহ মোহাম্মাদ ওয়াজেদ আলী, শেখ হাবিবর রহমান, মোতাহের হোসেন চৌধুরী প্রমুখ।



এ ভাবে আমরা দেখতে পাই, মধ্যযুগের বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের উন্নতি ও শ্রীবৃদ্ধির মূলে রয়েছে মুসলমান আমীর-উমরাহ থেকে শুরু করে বিভিন্ন মুসলিম কবি সাহিত্যিক।

বাংলা ভাষার শ্রী বৃদ্ধির পরে আলোচনা করতে হয় বাংলা ভাষার মর্যাদা প্রতিষ্ঠায় মুসলমানদের অবদান নিয়ে। ভারতে বৃটিশ রাজের শেষের দিকে গৃহীত লাহোর প্রস্তাব থেকে শুরু করে ১৯৪৭ সনে উপমহাদেশের মুসলমানদের জন্য স্বাধীন রাষ্ট্র পাকিস্তানের অভ্যূদয়ের প্রেক্ষাপটে বাংলা ভাষার মর্যদা প্রতিষ্ঠার জন্য এক নতুন আবহ সৃষ্টি হয়। ১৯৪০ সালের ঐতিহাসিক লাহোর প্রস্তাব পাশের, তথা সাবেক পাকিস্তান আন্দোলনের সময় থেকে, ১৯৫২ সালের ঐতিহাসিক ভাষা আন্দেলনের সময় পর্যন্ত যদি ইতিহাস পর্যালোচনা করা যায়, তা হল বিভিন্ন মুসলিম ব্যক্তিদের ঐতিহাসিক ভূমিকার পরিচয় দীপ্ত হয়ে উঠবে।

মাতৃভাষা বাংলার সাথে উর্দুর একটি প্রতিযোগিতা গড়ে উঠেছিল দেশ বিভাগের বেশ আগ থেকেই।

এক শ্রেণীর বাঙালী মুসলমানের মনে উর্দু প্রীতির উদ্ভব ঘটেছিল বিভিন্ন কারণে। যেমন, ‘‘যখন বাঙ্গলা সাহিত্য চর্চায় বাঙ্গলার মুসলমানগণের একটা ঘৃণা জন্মিয়া গেল, তখন তাহারা কোথাকার উর্দু ভাষাকে মাতৃভাষা বলিয়া বরণ করিয়া লইতে বৃথা চেষ্টা করিতে লাগিলেন। ’’

দেশ বিভাগের অনেক আগে, ১৯৪২ সালেরও আগে, ‘পূর্ব পাকিতান কথাটি' একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্রের ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা ও প্রতীক হিসাবে চালু হয়ে গিয়েছিল এবং বুদ্ধিজীবীদের মনোরাজ্যেও ঠাঁই করে নিয়েছিল। বস্তুত এ কারণেই সাবেক পাকিস্তান প্রতিষ্ঠারও বহুকাল আগে ১৯৪২ সালেই কলকাতায় প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ‘পূর্ব পাকিস্তান রেনেসাঁ সোসাইটি এবং ঢাকায় ‘পূর্ব পাকিস্তান সাহিত্য সংসদ। ' দেশ বিভাগ ও (সাবেক) পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হবার পর ‘পূর্ব পাকিস্তান'- এর রাষ্ট্র ভাষা কি হবে, এ নিয়ে রেনেসাঁ আন্দোলনের নায়করা চিন্তা ভাবনা করেছিলেন দেশ বিভাগের বহু আগে, ১৯৪২-৪৩ সালেই।

পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার আগেই বাংলা ভাষাকে নতুন রাষ্ট্রের, রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা দানের দাবি উঠে ছিল। বস্তুত সেকালেই ‘দৈনিক আজাদ', ‘মাসিক মোহাম্মদী' , ‘সওগাত' প্রভৃতি পত্রিকায় প্রবন্ধ ও অন্যান্য রচনার মাধ্যমে মুসলিম বুদ্ধিজীবীরা পাকিস্তানের রাষ্ট্র ভাষা নিয়ে আন্দোলন শুরু করেন। ‘আজাদ'- এর প্রতিষ্ঠাতা মওলানা মোহাম্মাদ আকরাম খাঁ ছিলেন বাংলা ভাষার সুপন্ডিত শক্তিমান লেকক, মাতৃভাষার প্রতি গভীর অনুরাগী ও শ্রদ্ধাশীল। ‘বাংলা ভাষা বাঙালী মুসলমানের মাতৃভাষা কিনা' এই হটকারী ও বিভ্রান্তিমূলক প্রশ্নের উত্তরে ১৩২৫ সালেই মওলানা মোহাম্মদ আকরাম খাঁ বলেছিলেন, ‘দুনিয়ায় অনেক রকম অদ্ভুত প্রশ্ন আছে, বাঙালী মুসলমানের মাতৃ ভাষা কি? উর্দু না বাংলা? এই প্রশ্নটা তাহার মধ্যে সর্বাপেক্ষা অদ্ভূত। নারিকেল গাছে নারিকেল ফলিবে না বেল?... বঙ্গে মোছলেম ইতিহাসের সূচনা হইতে আজ পর্যন্ত বাংলা ভাষাই তাহাদের লেখ্য ও কথ্য মাতৃভাষা রূপে ব্যবহৃত হইয়া আসিয়াছে।

এবং ভবিষ্যতেও মাতৃভাষা রূপে ব্যবহৃত হইবে। '

উর্দুকে মাতৃভাষা রূপে গ্রহণ করার মানসিকতা কিছু মুসলমানের মধ্যে সৃষ্টি হয়েছিল এক বিশেষ প্রেক্ষাপটে। ইতিহাসের প্রেক্ষাপট বিশে­­ষণ করলে দেখা যায় হিন্দু নেতারা বার বার মুসলমানদের ভাষা উর্দুকে দূরে ঠেলে দিয়ে হিন্দিকে সুপ্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা চালিয়েছে। ‘As early as 1867, Hindu leaders in Benares began a movement to replace Urdu- the chief language of the Muslims- by Hindi.’ ১৯১৮ সালে বিশ্ব ভারতীতে স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ভারতবর্ষে বাংলার পরিবর্তে হিন্দীকে রাষ্ট্র ভাষা করার প্রস্তাব করেছিলেন। ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ হিন্দির পরিবর্তে বাংলার পক্ষে যুক্তি-তর্ক উপস্থাপনা পেশ করেন এবং বলেন, ‘‘শুধু ভারত কেন, সমগ্র এশিয়া মহাদেশেই বাংলা ভাষার স্থান হবে সর্বোচ্চ।

ভাব সম্পদ ও সাহিত্যের গুণে বংলাভাষা এশিয়ার ভাষা গোষ্ঠীর মধ্যে অদ্বিতীয়। ’’ হিন্দুরা সেদিন এটি মেনে নিতে পারেনি। উর্দু-হিন্দি-বাংলা বিতর্কে কংগ্রেসের সব নেতাই হিন্দির পক্ষে রায় দেন। শুধু রায়ই নয়, সমগ্র ভারতকে এক রাষ্ট্রে পরিণত এবং এক জাতীয়তায় আবদ্ধ করার জন্য কংগ্রেসের সব নেতাই এক বাক্যে হিন্দির পক্ষে রায় দেন। এ ঘটনার প্রায় ৩০ বছর পরে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার প্রক্কালে ১৯৪৭ সালের জুলাই মাসে আলীগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যানেন্সলর ড. জিয়াউদ্দীন আহমদ স্বাধীন ভারতে হিন্দিকে রাষ্ট্র ভাষা করার মোকাবিলায় পাকিস্তানে উর্দু কে রাষ্ট্র ভাষা করার প্রস্তাব দিয়েছিলেন।

ইতিহাসের এই গতি ধারায় মুহম্মদ আলী জিন্নাহ পাকিস্তান সৃষ্টির পরে ১৯৪৮ সালের ২১ মার্চ ঢাকায় গোটা পাকিস্তানের রাষ্ট্র ভাষা হিসাবে উর্দু উপযুক্ত হবে বলে বিবেচনা করে ঘোষণা প্রদান করেন যে উর্দু হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্র ভাষা। জিন্নাহর এই ঘোষণাকে পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ মাতৃভাষা বাংলা ও সংস্কৃতির ওপর হামলা বিবেচনা করে সংগ্রামে অবতীর্ণ হয়। এই ভাষা সংগ্রামে যারা নেতৃত্ব দিয়েছিলেন তারা সবাই ছিলেন মুসলমান। ভাষা আন্দেলনের ইতিহাসে একজনও অমুসলমান ছাত্র- যুবকের নাম খোঁজ করে পাওয়া যায় না। ১৯৪৮ সালের রাজপথে শুরু হওয়া ভাষা আন্দোলন- যা' ১৯৫২ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারিতে কতগুলো মুসলমান শহীদের রক্তের বিনিময়ে অর্জন করে অমর মহিমা।

ঢাকার রাজপথ কিছু মুসলিম তরুণ তাদের বুকের তাজা রক্ত ঢেলে বাংলা ভাষার মর্যাদা প্রতিষ্ঠার নতুন ইতিহাস সৃষ্টি করল।

বাংলা ভাষার মর্যাদা প্রতিষ্ঠার জন্য '৫২-এর ভাষা আন্দোলন রাজনৈতিক নৈতিক আন্দোলনের রূপ ধারণ করে। '৪৮ পূর্ব আন্দোলন ছিল বুদ্ধি বৃত্তিক আন্দোলন। স্বাধীনতা পূর্বকালে ১৮৯৯ সালে বাংলা দেশের মুসলিম পুনর্জাগরণের অগ্রদূত সৈয়দ নওয়াব আলীর নেতৃত্বে ‘বঙ্গীয় সাহিত্য বিষয়ক মুসলিম সমিতি' গড়ে ওঠে এবং ১৯১১ সালে ‘বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য সমিতি' যে উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে যাত্রা শুরু করেছিল সেই একই উদ্দেশ্যে স্বাধীনতা উত্তর কালে জন্মলাভ করে ‘তমদ্দুন মজলিস'। এই তমদ্দুন মজলিশ ই সর্ব প্রথম ভাষা আন্দোলনকে সাংগঠনিক রূপ দান করে।

এ ভাবেই তুর্কী আগমনের পর থেকে শুরু করে বাংলা ভাষার উন্নতি ও মর্যাদা প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে মুসলমানগণ সক্রিয় অংশ গ্রহণ করে '৫২ সালে শাহাদতের মধ্য দিয়ে বিশ্বের দরবারে মাতৃভাষাকে মর্যাদার আসনে স্থান দিতে সক্ষম হয়।

*সূত্র :

১। বাংলা ভাষায় মুসলমানদের অবদান -শেখ তোফাজ্জল হোসেন |

২। ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ রচনাবলী ।

৩।

জীবনে যা দেখলাম - ভাষা সৈনিক অধ্যাপক গোলাম আযম।

৪। বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের মর্যাদা প্রতিষ্ঠায় মুসলিম অবদান -মনসুর আহমদ

৫। দৈনিক প্রথম আলো,দৈনিক ইনকিলাব,দৈনিক নয়াদিগন্ত,দৈনিক সংগ্রাম, প্রাগুপ্ত ঢাকা ডাইজেষ্ট ,অন্য দিগন্ত ও বিভিন্ন ম্যাগাজিন।


অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.