আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

যাযাবরের চিঠি [১]

প্রিয় রায়হান,
আশা করি ভাল আছিস। অনেক দিন যাবত তোর কোন চিঠি না পেয়ে বুঝতে পেরেছি যে বারবার এত করে বলার পরেও তোদের গ্রামের বাড়ি না গিয়ে চলে এসেছি বলে রাগ করেছিস। তাই না? আমি ঠিক বুঝতে পেরেছি। কিন্তু, আমি কেন যাইনি সে কথা এতো দিনেও বলি বলি করে বলা হয়নি। তুই যখন রাগ করে আমাকে ভুল বুঝে চুপ করে বসে আছিস তা হলে আজ বলি, দেখ চেষ্টা করে আমাকে ক্ষমা করতে পারিস কি না।


তোদের গ্রামে এমন এক জন আছে যার হবার কথা ছিল আমার অনেক কিছু অথচ সে এখন আমার কেউ না। এ কথা আমার বাবা মা, আমি আর আমার বাবার এক বন্ধু ছাড়া আর কেউ জানে না, আরও এক জন জানতেন তবে তিনি এখন এই পৃথিবীতে নেই। কি ভাবে যেন সব ওলট পালট হয়ে বিধাতার যা ইচ্ছা তাই হয়ে গেল। আচ্ছা, শুনেছিস কোথাও, যে নাকি বৌ হবে তাকে জন্মের পর প্রথম কোলে নিয়েছে কেউ?
আমার জীবনে ঠিক এমনি এক ঘটনা ঘটতে গিয়েও নিয়তির নিতান্ত অনিচ্ছা ছিল বলে আর হয়ে উঠেনি। আমার ছোট বেলা বিদেশে কেটেছে সে তুই জানিস।

ওখানে একটা নাম করা হাসপাতালে আমার বাবার এক বন্ধু কালাম চাচার কন্যা সন্তান জন্ম নেয়। চাচী অত্যন্ত অসুস্থ ছিল বলে আমার মা তাকে দেখা শুনা করছিল। মেয়ে হবার সংবাদ পেয়ে কালাম চাচা বাবা এবং আমাকে নিয়ে হাসপাতালে গেল। হাসপাতালে দেখি চাচির বিছানার পাশে দোলনায় ফুটফুটে এক মোমের পুতুল ঘুমাচ্ছে। পাশে আমার মা বসে।

কিছুক্ষণ আগে নার্সরা দোলনায় দিয়ে গেছে এখনো কেউ কোলে নেয়নি। চাচির অবস্থা খুবই খারাপ। কে কেমন আছে কার কি অবস্থা এসব কথার মধ্যে সেই পুতুলের ঘুম ভেঙ্গে গেল, একটু কান্না করতে চাইল। আমি এগিয়ে দোলনার কাছে গেলাম আর চাচী আমাকে বলল নাও কোলে নাও। ওই বয়সে যতটা সাবধান হয়ে এমন নব জাতক কে কোলে নিতে হবে বুঝেছি ততটা সাবধানে আস্তে করে তুলে নিলাম।

কি করি না করি সে ভয়ে মা এসে কাছে দাঁড়ালেন। চাচী ডান দিকে মুখ ফিরিয়ে আমার কোলে তার মেয়েকে দেখে রোগ ক্লিষ্ট মুখে একটু হেসে বলল তুমিই প্রথম কোলে নিলে বাবা, এটা তোমাকেই দিব। তখন চাচির এ কথার মানে বুঝিনি। এমনিতেই চাচী আমাকে খুব আদর করতেন। না, মেয়ের জামাই করবে এই আশা নিয়ে নয় কারণ তখন তাদের কোন বাচ্চাই ছিল না।

বাসায় গেলেই ফ্রিজ খুলে যত রকমের খাবার আছে সব বের করে দিত। না খেলে সাঙ্ঘাতিক বকা বকি করত। আমি নাকি ছোট বেলায় খুব শান্ত সুবোধ আর একটু বোকা ধরনের ছিলাম।
চাচির কি যে একটা কঠিন অসুখ হয়েছিল নাম মনে নেই, এখনো মনে আছে শরতের স্নিগ্ধ জোছনার সাথে সিঁদুর মাখা মাখি হলে যেমন হয় তেমন ছিল চাচির গায়ের রঙ। পরে আস্তে আস্তে তার শরীরের নানা জায়গা নীল হয়ে যেতে দেখেছি।

মাংস পেশিতে পচন। সোনার পুতুলটাকে রেখে ওই রোগেই চাচী বছর খানিক পর মারা গেল।
স্বাভাবিক ভাবে পুতুলটার সব ভার এসে পরল আমার মায়ের উপর, নিজের কাছে এনে রাখলেন। এ ছাড়া আর কিছু করার ছিল না, বিদেশে কার কয় জন আত্মীয় থাকে? প্রথম মাস কয়েক চাচার অবস্থা প্রায় পাগলের মত, অফিস নেই খাওয়া নেই, কখন কোথায় যায় কি করে কিচ্ছু ঠিক ঠিকানা নেই। এ ভাবে প্রায় বছর খানিক পর অনেক বুঝিয়ে সুঝায়ে আমার মা বাবা পুতুল সহ চাচাকে দেশে পাঠিয়ে দিলেন লম্বা ছুটি নিয়ে।

এই মেয়ের ভার কে নিবে? দেশে যাবার পর সবাই ভেবে চিন্তে মেয়ের কথা ভেবে চাচির মার পেটের ছোট বোনের সাথে আবার চাচার বিয়ে দিলেন। কিন্তু মার পেটের বোন তার মেয়েকে নিজের পেটের মেয়ে বলে মেনে নিতে পারেনি। যা হবার তাই হোল। ও মেয়ের আশ্রয় হোল নানীর কাছে।
এর মধ্যে হিমালয় থেকে অনেক বরফ গলা পানি গঙ্গা যমুনা পদ্মা বয়ে সাগরে, মিশেছে, অনেক কলি ফুটে ঝরে গেছে।

পৃথিবীর মানচিত্রে একটা নতুন দেশের জন্ম হয়েছে আর আমরা সেই দেশে ফিরে এসেছি। কলেজে তোর সাথে প্রথম পরিচয়, মনে আছে সে দিনের কথা? ওই তখনকার কথা। সে যখন ক্লাস এইটে তখন নারায়ণগঞ্জে ওর নানার বাড়িতে আমি শেষ দেখেছি। ওর অবস্থা দেখে এসে মাকে বললাম সব কথা। বিশ্বাস করবি কিনা, গায়ের রংটা পেয়েছিল মায়ের মত সেই রঙ পুড়ে তামার মত হয়ে গেছে, আমি চিনতেই পারিনি।

এই মেয়েকে ময়লা কাপড় পরনে, বিষণ্ণ মলিন মুখে রান্না ঘরে হাড়ি পাতিল মাজতে দেখলে কার সহ্য হয় বলতে পারবি? আমার মা কিছুক্ষণ কাঁদলেন, মার সাথে আমিও কেঁদেছিলাম। কয়েক দিন পর গিয়ে মা দেখে আসলেন, এসে আবার কান্না। এতো দিনে চাচির সেই কথার মানে বুঝতে শিখেছি। মনে মনে কখন যে মোর স্বপন চারিণী হয়ে গিয়েছিল বুঝিনি। তাই বুঝি মার কান্নার সাথে আমার কান্নাও মিশে গিয়েছিল।

[চলবে]।

সোর্স: http://prothom-aloblog.com

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।